[ পূর্ব্বভারত কী পারবে তার মৌলবাদবিরোধী স্বাতন্ত্র্য, সৃজনশীল ভাষা ও সংস্কৃতির পরম্পরা ধরে রাখতে? তিন চার সহস্রাব্দ ধরে নানা জয়-পরাজয়সহ বিবিধ বিবর্ত্তন ও রূপান্তর সত্ত্বেও মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সে অস্বীকার করে এসেছে। বৈদিক ভারত যখন মৌলবাদে আক্রান্ত হয় আর্য্যবর্ত্তের তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য মানতে না পেরে প্রতিবাদী ও বিরোধী একদল বেদপন্থী বেদিয়া বা বেদে হয়ে যাযাবর বা জিপসী [ইজিপ্সিয়ান] জীবনচর্য্যা অবলম্বন করে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হন। পক্ষান্তরে পূর্ব্বভারত বৈদিক নিদান নির্ব্বিচারে মেনে না নিয়ে, আত্মসমর্পণ না করে মৌলবাদী ভাবধারার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে সে তার স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারে বটে কিন্তু বৈদিক সভ্যতা তাকে ‘ম্লেচ্ছ’ বলে ঘোষণা করে দেয়। এই বিরোধিতা করতে গিয়ে বাঙালী তথা পূর্ব্বভারত বিভিন্ন সময়ে তান্ত্রিক শৈব, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, মুসলমান, বামপন্থী মার্ক্সবাদী ইত্যাদি নানা রূপে বিবর্ত্তিত হয়েছে, কিন্তু কখনো মৌলবাদকে আশ্রয় করে নি।
কিন্তু আজ কি দেখছি – প্রায় সমগ্র উত্তর-পূর্ব্ব ভারত, বিহার মৌলবাদের কবলিত। (বাংলাদেশও মৌলবাদের কবলিত তবে সেখানে মৌলবাদবিরোধী শক্তিও সক্রিয়)। উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গ বাকী ছিল, কিন্তু সেখানেও মৌলবাদের শিকড় বিকশিত হচ্ছে। এই মৌলবাদের উত্থানের বিপদ সম্পর্কে “বঙ্গযান” ভাষার মধ্যে, শব্দের মধ্য্ শব্দার্থের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মৌলবাদী ধ্যানধারণা বিমুক্ত ক্রিয়াভিত্তিক- বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের ব্যাপক প্রচার প্রসারে যত্নবান হতে চেয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ৩০শে জুলাই, ২০১৭ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রীমতি সেমন্তী ঘোষ-এর উত্তর-সম্পাদকীয় ‘ঠিকই তো, সঙ্ঘের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে হজম করা অসম্ভব : নিষিদ্ধ করলেন না?’ রচনাটি পড়ে আমাদের স্মরণে এল, এ বিষয়ে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির উদ্গাতা রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান-এর যৌথ রচনা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল …’ নিবন্ধটির কথা। এটি ২০০৮ সালে ‘রোয়াক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে ২০১১ সালে তাঁদের দুই খণ্ডের‘ বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ প্রকাশিত হওয়ার পরেই তাঁদের ‘সুন্দর হে সুন্দর’ নামক গ্রন্থে নিবন্ধটি সঙ্কলিত হয়। শ্রীমতি সেমন্তী ঘোষ-এর রচনার সমর্থনে নিবন্ধটি এখানে পুনঃপ্রকাশিত হল। ]
বাংলার মাটি বাংলার জল…
“প্রেমে জল হয়ে যাও গলে
কঠিনে মেশে না সে, মেশে রে সে তরল হলে। ‘’
[ রজনীকান্তের গান ]– রবি চক্রবর্ত্তী এবং কলিম খান
এক
চাঁপা বা কনকচাঁপা গাছে বেশী বেশী ফুল ফোটে মেয়েরা যদি সে-গাছে ফুঁ দেয় বা তার চারদিকে নাচানাচি করে। তিল গাছের ওসব লাগে না, মেয়েদের কটাক্ষপাতেই তার গা সিরসিরিয়ে ওঠে, উপচে পড়ে তার ফুল, ফল। আর, বকুল গাছের চাই মেয়েদের ধিক্কার, থুতু। তখন সে ঘুরে দাঁড়ায়, দেখিয়ে দেয় কত ফুল সে ফোটাতে ও ঝরাতে পারে। তবে অশোক গাছটা ভারি বেহায়া, তার ন্যাওটা বায়নাক্কা – ‘দেহিপদপল্লব-মুদারম্’; মেয়েদের লাথি না খেলে তার মন ওঠে না, নারী-পাদস্পর্শেই সে ফুলে ফুলে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। সহকার গাছের আবদার আরও বেশী, তার চাই মেয়েদের আলিঙ্গন। পাকেচক্রে তা যদি সে পেয়ে যায়, তাহলে ‘যায় যদি যাক প্রাণ’ ব’লে সে এত মুকুল, এত ফল ফলিয়ে বসে যে, ফলের ভারে তার ডালপালা ভেঙে পড়ে।
এসব সংবাদ রয়েছে আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদির ‘দোহদ’ বিষয়ক অংশে, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থেও কিছু কিছু পাবেন, রয়েছে আমাদের মেয়েদের আচার-আচরণেও। বকুল ফুল কুড়ানোর সময় কোনো কিশোরী গাছে থুতু ফেললে অবাক হবেন না, শুধোলে সে বলতেই পারে, ‘ফেলতে হয়, ঠাকুমা বলেছে’। কারণ আমাদের বাংলাভাষার পঞ্চভুবনের১ বয়োবৃদ্ধ-গণের অনেকেই এসব কথা জানেন এবং মানেনও। অর্থাৎ গাছের চেতনা বিষয়ে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল, আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ও সামাজিক আচার-আচরণে তার বেশ কিছু স্মৃতি এখনও বর্ত্তমান রয়েছে, আমরা একালের অ্যাকাডেমী- শিক্ষিত (= অ্যা-শিক্ষিত) ‘সর্বজ্ঞ’রা সেগুলিকে যতই অবহেলা করি।
এরকমই হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিকে লোকে যথাযথ মর্য্যাদা দেয় না, ‘বাপের পয়সায় কেনা কাশ্মীরী শাল দিয়ে নিজের রোজগারে কেনা জুতো মোছে’। কিন্তু অনাথের তেমন বড়লোকী সাজে না, তাকে নিজেই খেটেখুঁটে অর্জ্জন করতে হয়। অতীতের এ’ধরনের স্মৃতি পশ্চিমের খুবই কম, তাই তাঁরা দিনরাত শ্রম করেন সেসব কথা জানার জন্য। খেটে রোজগারের মূল্যই আলাদা।
১৯৬৬ সালে Backster Effect [ গাছের ধারেকাছে অন্য জীবকে হত্যা করলে গাছের দুঃখ হয় ] আবিষ্কারের পর থেকে আজ পর্য্যন্ত প্রচুর গবেষণা করেছেন তাঁরা। অজস্র বই বেরিয়েছে, অজস্র তথ্যে-তত্ত্বে ভরে উঠেছে তাঁদের ‘গাছের মন’ বিষয়ক জ্ঞানের ভাণ্ডার। দু-চারটি উদাহরণ দিই। ধ্রুপদী সঙ্গীত অবিরাম শোনালে গমের ফলন ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা গাছের চারদিকে খেলাধূলা, নাচানাচি করলে গাছেরা খুশিতে ডগমগ হয়। যে-লোক একবার গাছের ডাল কেটেছে, পরে কখনো সে ঐ গাছের কাছে এস দাঁড়ালে গাছ তাকে চিনতে পারে, ভয় পায়, আর সে-ভয় এখন মাপাও যায়। আপনারা স্বামী-স্ত্রী যে গাছের তলায় ‘কপোত-কপোতী যথা’ নিত্য বসে এককালে প্রেমালাপ করতেন, বহুবছর বিদেশবাসের পর ফিরে এসে সেই গাছের তলায় বসলে, গাছ কিন্তু আপনাদের চিনে ফেলবে এবং খুশী হবে। আর, যদি রোজ তার গোড়ায় জল ঢেলে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই; আপনি তার কাছে এলেই কলকলিয়ে উঠবে তার ব্যাকুলতা এবং সে ব্যাকুলতাও এখন মাপা যায়।
…মোটকথা, বিজ্ঞানসম্মত যে সিদ্ধান্তে এখন পর্য্যন্ত তাঁরা পৌঁছতে পেরেছেন তার সংক্ষিপ্তসার হল – শোক-দুঃখ-ভয়-ত্রাস-নিরাশ-প্রণয় কেবল মানুষের নয়, গাছেদেরও হয়, যথেষ্টই হয়। তার গভীরতা বুঝতে হলে এ ব্যাপারে পশ্চিমী উদ্ভিদবিজ্ঞানিদের সাম্প্রতিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশলগুলি জানা চাই, কিংবা কমপক্ষে বোবা-শিশুর ও পোষা-পাখীর খুশী ও অভিমানের সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার। নইলে বোঝা যাবে না।
অথচ, গাছেদের মনোলোক বিষয়ে কোনো স্মৃতি পশ্চিমের ছিল না বললেই চলে। অ্যারিষ্টটল তো বলেই গিয়েছিলেন, গাছেদের প্রাণ থাকলেও বোধ নেই। আজ সেই ইয়োরোপের উত্তরসূরিরা বহু শ্রমে সত্য আবিষ্কার করছেন। আর আমরা? উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা তার মর্ম্ম বুঝতে চাইনি, বুঝতে যাইনি। নিজেদের আধুনিকতা নিজেরা অর্জ্জন করিনি, অন্যের অর্জ্জিত আধুনিকতার নকল করে আধুনিক হতে গেছি, ‘থ্রোয়িং দ্য বেবি উইথ দ্য বাথওয়াটার’-এর নীতি মেনে কুসংস্কারের নামে পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত জ্ঞানের স্মৃতিকেও ফেলে দিয়েছি। ফলত, নিজেদের নিঃস্ব অনুভব করে পশ্চিমী গবেষকদের গবেষণালব্ধ ফল নকল করে আনতে এখন সেখানে দৌড়চ্ছি!
অথচ, এই দুরবস্থা স্বাধীনতার প্রাক্কাল পর্য্যন্ত আমাদের ছিল না। তখনও আমরা নিজেরাই জ্ঞান ‘অর্জ্জন’ করার চেষ্টা চালাতাম, জ্ঞান-‘ভিক্ষা’ করে বেড়াতাম না, বিশ্বাস করতাম আমাদের নিজস্ব পৈতৃক সম্পদ আছে, আমরা অনাথ নই। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা জানতাম – এই বিশ্বপ্রকৃতি ইচ্ছাময়ী, গাছেদেরও প্রাণ আছে। তাই জগদীশচন্দ্র বসু যখন তাকে ব্যক্তরূপে (explicitly) আবিষ্কার করে নবরূপে অর্জ্জন করলেন, আমরা অবাক হইনি। কারণ সেটা তো আমরা জানতামই। কিন্তু তারপর আর যা-কিছু জানতাম, তা নিয়ে আর গবেষণা করিনি। মনে করেছি, আমাদের যা কিছু স্মৃতি, আচার-আচরণ, সবই কুসংস্কার এবং সেগুলিকে ফেলে দিয়েছি। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারটাও আমাদের চোখ খুলল না যে, আমাদের উত্তরাধিকারলব্ধ প্রাচীন বিশ্বাসগুলি রয়েছে অব্যক্তভাবে (tacitly), সেগুলিকে এবার ব্যক্তভাবে (explicitly) আবিষ্কার করে বুঝে নেওয়া দরকার। তা না করে, সব ফেলে দিয়েছি; এখন ইয়োরোপ আমেরিকার কাছে হাত পাতা ছাড়া আর আমাদের উপায় কী?
কিন্তু সেখানেও সমস্যা। যে মার্কিন গুরুদের কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়েছি, সেই গুরুরাই দেখি, অনেক সময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মূর্খ-অশিক্ষিত রেড-ইণ্ডিয়ান বুড়ো-বুড়িদের সন্ধানে। কারণ সেই ‘মূর্খেরা’ নাকি বহু গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের আধার! এই রেড-ইণ্ডিয়ানদের কিন্তু কোনো গ্রন্থ নেই, এমনকি তাঁদের সমাজের স্মৃতিতেও সব কথা অত স্পষ্টভাবে নেই; আমাদের যেরকম ছিল। তবুও মার্কিন-গুরুরা এখন তাঁদেরই শরণাপন্ন! আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মার্কিন পণ্ডিতদের হঠাৎ এমন উদ্ভট বোধোদয় হল কীভাবে?
হয়েছে অনেক দুঃখে, অনেক দেখে এবং ঠেকে। সেই সমগ্র ঘটনাক্রমের ইতিহাস বলার পরিসর এখানে নেই; বরং আপনি যাতে বিষয়টি চট করে ধরে নিতে পারেন, সেভাবে বলে নিয়ে আজকের মূল কথায় চলে যাব।
সবাই জানেন, সুনামিতে আন্দামান সন্নিহিত অঞ্চলের কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; কিন্তু অনেকেই জানেন না, যে, একজনও আদিবাসী মারা যায়নি। কারণ কুকুর বেড়াল প্রভৃতি জীবজন্তুর মতো আদিবাসিরাও আগেভাগে টের পেয়ে গিয়েছিল যে, সুনামি আসছে; এবং দৌড়ে উঁচু জায়গায় উঠে গিয়েছিল। অথচ ক্ষমতার দম্ভে দাম্ভিক সভ্য মানুষেরা, তথাকথিত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গর্ব্বে মাটিতে যাদের পা পড়ে না, তারা আগেভাগে বুঝতেই পারেনি, জান-মাল বাঁচানো তো দূরের কথা। কেন?
কারণ, মা-প্রকৃতি তাঁর জীবদের যে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক-জ্ঞান সরবরাহ করে থাকেন, যার সাহায্যে প্রকৃতির এইরূপ প্রলয়কাণ্ড সম্পর্কে তাঁর সৃষ্ট জীবেরা আগেভাগে জেনে যেতে পারে ও আত্মরক্ষা করতে পারে, মানুষের সভ্যজগৎ ও তাদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থা সেই জ্ঞানকে সভ্যমানুষের মস্তিষ্ক থেকে নিশ্চিহ্ন ক’রে সভ্যমানুষকে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানধারা ও জ্ঞানসমুদ্র থেকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অথচ, মানবের সচেতনতা ও জ্ঞানের সেটিই তো প্রধান ও মূল ধারা। সেই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞান না হলে এখন যে আর প্রাণ বাঁচে না! সে-জ্ঞান মিলবে কোথায়? এই প্যাঁচে পড়েছেন মার্কিন পণ্ডিতেরা।
ইংরেজ তথা ইউরোপের কাছ থেকে আধুনিক সভ্যতার পতাকাটা হাতে নেবার পর, ফোর্ডবাবুর নেতৃত্বে এঁরাই ঘোষণা করেছিলেন – টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম্ম, টাকাহি পরমন্তপ: এবং ‘ইতিহাস মানেই জঞ্জাল!’ কালের ও কপালের ফেরে দেখা যাচ্ছে, সেই জঞ্জালের ভিতরেই থেকে গেছে মানবসভ্যতার প্রাণপাখী! এখন তাকেই চাই! সভ্যতা বাঁচলে তবে তো গাড়ী বিক্রি, টাকা কামাই, পুঁজিবৃদ্ধি, সব। সভ্যতাই যদি না বাঁচে? মার্কিন গুরুরা তাই আতান্তরে পড়েছেন এবং যাদের মাটি ও বাহ্যসম্পদ তাঁরা আগেই হস্তগত করেছেন, সেই রেড-ইণ্ডিয়ান ‘মুরুব্বি-মানুষ’দের জ্ঞানবুদ্ধি হস্তগত করার জন্যে এখন হন্যে হয়ে তাদের পেছনেই ঘুরছেন! সবই কপালের ফের। কথায় বলে ‘যাকে কর হীন, সেই রাখে একদিন!’
আর আমরা? আমাদের সেই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণ থাকলেও, এমনকি আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা সেগুলিকে গ্রন্থাদিতে লিখে রেখে গেলেও, এবং আমাদের জীবনে, সমাজে, আচার-আচরণে সেগুলি কমবেশী প্রচলিত থাকলেও, আমরা সেগুলিকে গুরুত্ব দিইনি; সেগুলির মানে বোঝার চেষ্টাই করিনি। পশ্চিমী গবেষকেরা যেমন যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে গমের ক্ষেতে অবিরাম ক্লাসিক সুর বাজিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, সেভাবে আমরা আমাদের স্মৃতি ও স্মৃতির ধ্বংসাবশেষগুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিনি।
“বাহ্যফললাভকে চরম বলে সারা পৃথিবী য়দি মেনে নেয়, ভারত যেন না মানে” – বিধাতার কাছে এই প্রার্থনা করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মতে,
“দেশের উদ্বোধনের কথা আমরা আজকাল সর্ব্বদাই বলিয়া থাকি। মনে করিয়া থাকি সেই উদ্বোধন কেবল রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলন- সভায়। অর্থাৎ, কেবল অভাবের ক্রন্দনে, দরিদ্রের প্রার্থনায়। এই আমাদের মজ্জাগত ভিক্ষুক-স্বভাবে আমরা ভুলিয়া গিয়াছি, যেখানে দেশের আসল সম্পদ নিহিত সেইখানেই দেশের আপন গৌরব প্রসুপ্ত আছে। সেই সম্পদ যতই উদ্ঘাটিত হইবে আমাদের গৌরবের ততই উদ্বোধন হইবে।”
রবীন্দ্রনাথের এসব কথা আমরা শুনিনি। বিশ্বের দেহবাদিদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরাও আজ ‘বাহ্যসম্পদ’কেই চরম বলে ভাবতে লেগেছি, ‘টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম্ম’ গাইতে লেগেছি। [ আজ সেই গানের সবচেয়ে বড় গায়ক মোদী ও তাঁর গুজরাট – বঙ্গযান ]| স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আরও বেশি করে আমরা স্বকীয় ‘জ্ঞান-অর্জন’ -এর পথ ত্যাগ করে জ্ঞানভিক্ষার পথ গ্রহণ করেছিলাম; এখন সেই জ্ঞানভিক্ষার সাথে পুঁজিভিক্ষা ও দাসত্বভিক্ষায় [ সাইবার কুলি, বিপিও, পরিষেবা ইত্যাদি দাসত্বভিক্ষারই ছদ্মনাম ] আত্মনিয়োগ করেছি; নিজেদের প্রকৃত সম্পদের খোঁজ করিনি। অর্থাৎ, যতই আমরা রবীন্দ্রভক্তি দেখাই, আমরা কার্য্যত রবীন্দ্রবিরোধী। যা করলে আমাদের যথার্থেই মঙ্গল হত, তাঁর আত্মাও শান্তি পেত, তা আমরা করিনি; তাঁর আরব্ধ কাজে হাত লাগাইনি। এখনও যদি তা না করি, আমাদের সমস্ত পৈতৃক সম্পদ হারিয়ে যাবে। জ্ঞানভিক্ষা, পুঁজিভিক্ষা, দাসত্বভিক্ষা, দয়াভিক্ষা করেই যেতে হবে আমাদের, এই ভিক্ষাবৃত্তির অন্ত হবে না কোনোদিনও।
দুই
কথাটা উঠেছিল বাংলাভাষী মানুষের মনের মাটির বিশেষত্ব নিয়ে, বাঙালীর জাতীয় চেতনার স্বভাবচরিত্র নিয়ে। সেখান থেকে মানুষের চেতনা, পশুপাখিদের চেতনা, উদ্ভিদের চেতনা, জড়ের চেতনা পেরিয়ে কথাটা এগোতে লাগল। প্রশ্ন উঠল, এ বিশ্বব্যবস্থায় চেতনা কীভাবে সক্রিয় রয়েছে? এই পরমাপ্রকৃতি যে ইচ্ছাময়ী, অত্যন্ত সচেতন, সে বিষয়ে আমাদের স্মৃতি রয়েছে আজও। কিন্তু তা নিয়ে আমরা তেমন কোনো গবেষণাদি করিনি। পশ্চিমের বিজ্ঞানিরা সম্প্রতি এই বিশ্বব্যবস্থার ভিতরে ‘এম্পেরর্স্ মাইন্ড্’কে খোঁজাখুঁজি করতে লেগেছে।
কিন্তু চেতনার দুনিয়া যে কঠিন, তরল, বায়বীয়, এই তিন ভাগে বিভক্ত, তেমন কোনো ধারণার সাক্ষাৎ তাঁরা এখনও পাননি। আমরা কিন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে জানি কথাটি ঠিক। চেতনাকে আমাদের প্রাচীন পুরুষেরা যে-করেই হোক তিন ভাবে বুঝেছিলেন এবং দেখেছিলেন স্রোতধারা-রূপে। আমাদের ভাষায় ‘চেতনাপ্রবাহ’, ‘ভাবধারা’, ‘চিন্তাধারা’ ‘জ্ঞানতৃষ্ণা’ – প্রভৃতি অজস্র শব্দের উত্তরাধিকারই তাঁদের সেই অর্জ্জনের প্রমাণ। আপনি বলতে পারেন, ‘তরলমতি’, ‘হাল্কা-কথাবার্ত্তা’, এসবও তো রয়েছে।
ঠিকই, কিন্তু ওগুলি আমাদের প্রাচীন উত্তরাধিকার নয়। মধ্যযুগের বাংলায় শব্দদুটি নাই। এগুলি ইংরেজী শিক্ষিত-প্রভাবিত বাংলাভাষীর সৃষ্টি। এতে জ্ঞানের কঠিন রূপটি বাকি দুটি রূপের নিন্দা করছে। জ্ঞানের তিনটি রূপই প্রকৃতির সৃষ্টি। উপরোক্ত গাছের মনোলোক বায়বীয় জ্ঞানের এলাকাতেই কার্য্যকরী থাকে। মানুষের স্বাভাবিক বাস কিন্তু জ্ঞানের তিন এলাকাতেই। তার মনের পা থাকে তরলে, ডান হাত থাকে শক্তের দুনিয়ায় এবং বাঁ হাত থাকে বায়বীয় দুনিয়ায় এবং চোখ থাকে প্রেমাকাশের দিকে। শিবের অবস্থানও এই রূপ। কিন্তু দক্ষের বা স্পেশালাইজেশনের পা থাকে শক্তের দুনিয়ায়। তাকে সঠিক বলে মেনে নিলে, মানুষের অবস্থান ‘একটেরে’ বা ‘একঝোঁকা’ হয়ে যায়।
মানুষের সমাজ এই একঝোঁকা অবস্থান গ্রহণ করায় বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে তার বাড়বাড়ন্ত হয় এবং কালে কালে পশ্চিমের হাত ধরে তা ‘সম্পূর্ণ-একঝোঁকা’ (= দেহবাদী) হয়ে মানবসভ্যতার শাসনশীর্ষে উঠে পড়ে। বর্ত্তমানে আমেরিকার নেতৃত্বে তা সারা পৃথিবীতেই রাজত্ব করছে। স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানকে এই শক্ত-জ্ঞানের কারবারিরা নিন্দা করে থাকে। ‘কংক্রিট-আলোচনা’, ‘কংক্রিট-কথাবার্ত্তা’, ‘কংক্রিট-সিদ্ধান্ত’ না হলে তাদের মন ওঠে না।
তাই বলে এমন মনে করার দরকার নেই, যে, জ্ঞানের তিনটি রূপকে বাঙালিরা ছাড়া দুনিয়ার আর কেউই জানতেন না সব জাতির পূর্বসূরিরাই কমবেশী সেটা জানতেন, ইংরেজদের পূর্ব্বপুরুষেরাও জানতেন। তাঁদের ভাষায় সরাসরি hard-knowledge, liquid- knowledge বা gaseous-knowledge জাতীয় কোনো শব্দ না থাকলেও, ধারণাটি তাঁদেরও ছিল এবং তাঁদের কবি-সাহিত্যিকদের বয়ানে তার বহু প্রমাণ মেলে, যদিও তাঁদের তাত্ত্বিকদের বয়ানে বা ধারণায় তা কখনো আমরা পাইনি। ইংরেজের ‘gas’ কথাটি থেকেই তো অ্যাকাডেমী-শিক্ষিত বাঙালী ‘মিথ্যা কথা’কে ‘গ্যাস-দেওয়া’ শব্দে অনুবাদ করে নিয়েছে। তার ওপর concrete-discussion ইত্যাদি তো রয়েছেই। তবে, জ্ঞানের তরল রূপটিকে একবার চিনে নিতে পারলে, এসব কথা খুব সহজেই বোধগম্য হয়ে যায়। তাছাড়া, আপনিও সেই তরল রূপটিকে ভালই চেনেন, কেবল সেকথাটা এতদিন কেউ আপনাকে মনে করিয়ে দেয়নি।
আপনি মাকে নিয়ে রিক্শায় উঠেছেন মাসীর বাড়ি যাবেন বলে। উঠেই দেখলেন, রিকশাওলার সঙ্গে মা গল্প জুড়ে দিয়েছেন – হ্যাঁ বাবা, তোমার বাড়ী কোন পাড়ায়? ছেলেমেয়ে কয়টি … ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং রিকশা থেকে নামা পর্য্যন্ত, আপনি দেখলেন, দুই পরিবারের অনেক সুখদুঃখের কথাই লেনদেন হয়ে গেছে। অথচ ক’দিন আগে আপনি যখন একা এ-পথে এসেছিলেন, তখন রিকশাওলার সঙ্গে আপনার মাত্র দুটি বাক্য বিনিময় হয়েছিল, ‘… খানে যাবে?’ তার ‘হ্যাঁ’ শুনে আপনি জানতে চেয়েছিলেন ‘ভাড়া কত?’ উত্তর শুনে উঠে পড়েছিলেন এবং নামার সময় কোনো কথা না বলে ভাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। আজ সেরকম হল না, দুটো পরিবারের কোথায় যেন একটা পারস্পরিক মেশামেশি হয়ে গেল; যেন-বা দুটো পুকুরের মাঝের বাঁধটায় ফুটো হয়ে গেল।
মায়ের এই আচরণটা আসলে মানব-মনের তরল চিন্তাধারার স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ধর্ম্ম, সমোচ্চশীলতা যার স্বভাবে। [ পুরাণে তাই ‘জনসাধারণ’ বোঝাতে ‘জল’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে বারবার। তাছাড়া ‘সমোচ্চশীলতাধর্ম্মী’ বলেই তো সাগরকে ‘সমুদ্র’ বলে ]। বাহক-আরোহীর মাঝে সম্বন্ধের যে উচ্চনীচ ভাব, মায়ের তরফে বাহকের সমতলে গড়িয়ে গিয়ে সমান হয়ে যাওয়ার চেষ্টা সেই উচ্চনীচ ভাবের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করে সেই উচ্চনীচ ভাবকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। আমরা অ্যা-শিক্ষিতরা যাকে শাসকশ্রেণী-শাসিতশ্রেণী, অভিজাত-পতিত বা উচ্চশ্রেণী-নিম্নশ্রেণী ইত্যাদি বলে বাঁধ বাঁধি, সেই দুই শ্রেণীর মধ্যেকার বাঁধটায় ইঁদুর-গর্ত্তের মতো ফুটো করে দিচ্ছে মায়ের তরল ব্যবহার।
সাধারণত মেয়েদের স্বভাবের মধ্যে, তথাকথিত অশিক্ষিতদের মধ্যে, গ্রামের মানুষজনের মধ্যে এবং উদার ও বড়ো মানুষদের মধ্যে এই রকম মনোলোকের সাক্ষাৎ মেলে; যেখানে এইরূপ ‘তরল চিন্তাধারা’ সর্ব্বদা সক্রিয় থাকে। অ্যা-শিক্ষিত শহুরে শ্রেণীসংগ্রামবাদিরা সমাজে অন্তর্লীন এই সক্রিয়তাকে দেখতে পান না, এর অসীম শক্তির খবর পাওয়া তো দূরের কথা। এইরূপ চিন্তাধারা স্বভাবতই সমোচ্চশীলতাধর্ম্মী ব’লে, অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে নিজের উঁচু হওয়ার উপায় রাখে না সে। তাই, এরূপ চিন্তাধারা আধুনিক মানুষের তথাকথিত ‘উন্নতি’র পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যই শহুরে, আধুনিক ও অ্যা-শিক্ষিত মানুষের দুনিয়া এরকম চিন্তাধারার বিরোধী এবং তাঁরা এরূপ মনোলোকের অধিকারিদের ‘তরলমতি’ বলে নিন্দা করে থাকেন|
অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত বলে আমরা প্রত্যেকেই মনে মনে উচ্চনীচবাদী, কিন্তু আমাদের মায়েরা স্বভাববশতই সাম্যবাদী। [ অ্যা-শিক্ষিত হলেও মনটাকে কঠিন করে ফেলেননি, এরকম বহু মানুষ আছেন, বাঙালিদের মধ্যে তো প্রচুর পরিমাণেই আছেন, প্রকৃত কবি-লেখক-শিল্পীরা তো বটেই; অ্যাকাডেমিক বিদ্যাবুদ্ধি তাঁদের স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক চিন্তাশৃঙ্খলাকে নষ্ট করতে পারেনি ]। অর্থাৎ আমাদের মনোলোকের সঙ্গে আমাদের মায়েদের মনোলোকের গুরুতর পার্থক্য ঘটে গেছে। আমাদের মনোলোকে চিন্তাধারার স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক প্রবাহ নেই, কিন্তু আমাদের মায়েদের মনোলোকে তা রয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন অধিকাংশ বাঙালী যদি আমার আপনার মতো ভাবেন, বাংলার মন হবে আমার-আপনার মনোলোকের মতো; আর অধিকাংশ বাঙালী যদি আমাদের মায়েদের মতো ভাবেন, বাংলার মন হবে আমাদের মায়েদের মনোলোকের মতো, এবং বাস্তবে সেরকমই হয়েছে। সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী’র সাক্ষ্য অনুসারে, এরকম মনোলোকের সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছেন বাঙালী ও ফরাসী জাতির মধ্যে, কলকাতায় ও প্যারিসে। বাংলা ছবি ফরাসী দেশে জনপ্রিয় কেন, ফরাসী প্রেসিডেণ্ট কেন সত্যজিৎ রায়কে সর্বোচ্চ সম্মান দেন, কেন অমর্ত্ত্যর পরামর্শ প্রত্যাশা করেন – এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে দুই জাতির মনের মাটির সমধর্ম্মিতা।
বিপরীতে, রিক্শাওয়ালার সঙ্গে আপনার আচরণটা ছিল কঠিন মনোলোকের স্বভাবপ্রসূত। দিল্লিতে পথ হারালে আপনি সে মনোলোকের সাক্ষাৎ পাবেন। ‘মালুম নহি’ শুনে শুনে আপনি বিরক্ত হয়ে যাবেন এবং কলকাতার স্বভাবের কথা ভেবে গৌরব বোধ করবেন। ইংরেজ ও ফরাসী জাতির স্বভাবের মধ্যে যে এই কঠিন ও তরল মনোলোকের ফারাকটা রয়েছে, অনেকেই তা জানেন; তা নিয়ে অনেক মজার গল্পও রয়েছে।
তিন
এই তরল জ্ঞানই বাঙালীর সবচেয়ে বড় সহায়। আমরা যতদূর জেনেছি, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মানুষের মনের পায়ের তলায় থাকে তরল জ্ঞানরস, তার বাঁ হাত থাকে বায়বীয় জ্ঞানরসের ‘ভাবধারা’র দিকে এবং ডান হাত থাকে শক্ত-জ্ঞানরসের ‘চিন্তাধারা’র দিকে এবং চোখ থাকে প্রেমরসের আকাশের দিকে। বৈদিক সভ্যতা যখন কঠিন জ্ঞানরসের উপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন থেকেই বাঙালী তার বিরোধী; সে নিজের অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত রেখেছে মানুষের আদি অবস্থানে। মানুষের আদি অবস্থান থেকে, মানবমনের আদি মাটি পা সরিয়ে নিতে সে কখনো রাজি হয়নি। বৈদিক যুগের আগের সনাতন যুগ থেকেই তার পা রয়েছে শিবঠাকুরের পায়ের তলার ভিত্তিভূমির উপর, রয়েছে আজও। তাই, একালের চোখে বাংলার মানুষের মনের মাটির চরিত্রই বিশেষ স্বভাবের।
একটি জাতি যে-কাজটি সবচেয়ে বেশী পরিমাণে করে, নিশ্চয় সে কাজটি করতে সে জাতির মনের গভীরে কোথাও একটা বিশেষ সমর্থনের, ভাললাগার জায়গা রয়েছে। সহজ কথাটিই ভাবুন না, বাংলাভাষিরাই বিশ্বের সর্ব্বাধিক ‘ছোট পত্রিকা’র উৎপাদক কেন? কেন তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলার আধার? …
আরও দেখুন, যে-ব্রিটিশকে দেশে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালী অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তাকেই উৎখাাত করতে সেই বাঙালীই সবচেয়ে বেশী রক্ত ঝরিয়েছিল। বাংলার যে ব্রাহ্মণশ্রেণী বঙ্গের বেদবিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, রঢ় বা লড়াই দিয়েছিল, সেই শ্রেণীকে বেদবাদিরাই তো ‘বারণ’ করে ‘বারেন্দ্র’ ও ‘রাঢ়ী’ বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বাঙালী ‘ষ্ট্রিমলাইণ্ড’ হয়নি; মুজতবা আলী তো সেকথাই বলে গেছেন।
আমরা জেনেছিলাম, যাঁরা ‘রাষ্ট্র’-বিরোধী, তাঁরা শূকরভক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন; যাঁরা ‘পণ্যরপ্তানী’- বিরোধী তাঁরা গোমাংসভক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন (বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের ‘অবিকল্পসন্ধান’ গ্রন্থটি দেখুন )। সেই হিসেবে, বেদবাদিরা যখন ব্যক্তিমালিকানার বিরোধী হয়ে আমিষভক্ষণ নিন্দনীয় করে দিল, বাঙালীর পূর্ববপুরুষেরা তা মানলেন না, তাঁরা মৎস্যভূক হয়ে তার বিরোধিতা করতে দ্বিধা করেনি। কেবল তাই নয়, মাছভাত ক্রমে বাঙালীর প্রধান খাদ্য হয়ে গেল। অথচ দেখা গেল যে-মাছ অন্য মাছকে খায়, যথা বোয়াল …, তাকে সে খেতে রাজি হল না। অর্থাৎ যে-ব্যক্তিমালিকানা অন্য ব্যক্তিমালিকানাকে গ্রাস করে, বাঙালী তারও বিরোধী।
তার কাছে বেদবাদিদের কূর্ম্মব্যবস্থাও ( আদি গ্রামসমাজ ) গ্রহণযোগ্য হয়নি, কারণ তার বিচারে এই উচ্চনীচ-ভিত্তিক ব্যবস্থা সমাজের অগ্রগতির বা যাত্রার পক্ষে ক্ষতিকর। কচ্ছপ সেকারণেই বাঙালীর কাছে অমঙ্গলসূচক ‘অযাত্রা’, আজও। সারা ভারতে যখন পুঁজি নিষেধ হয়ে গেল, ছানা খাওয়া নিষেধ হয়ে গেল, বাঙালী তখন কেবলমাত্র লক্ষ্মীর আরাধনাই করেনি, ছানা খেয়েছে, ভরপূর খেয়েছে, ননীচোরার গান বানিয়েছে, রসগোল্লা বানিয়ে তাকে বাঙালী জাতির জাতিচিহ্নে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে। অথচ একদিনের জন্য সে কুবেরের সাধনা করেনি, তাকে জেনেছে ঘৃণার্হ বলেই।
এই জাতি বেদবিরোধী হয়ে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় তান্ত্রিক হয়েছে, বৌদ্ধ হয়েছে, বৈষ্ণব হয়েছে, মুসলমান হয়েছে, সুফী হয়েছে, ব্রিটিশকে আবাহন করে আধুনিকতাবাদী হয়েছে, ব্রিটিশকে তাড়াতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় স্বাধীনতাযোদ্ধা হয়েছে, তারপর সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় কমিউনিস্ট হয়েছে, এবং এখন আবার সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় … … … হতে চলেছে।
না, ঠিক কী হতে চলেছে, সে বিষয়ে এখনও আমরা স্পষ্ট জানি না। তবে তা যে তৃণমূল হওয়া নয়, নকশাল বা উগ্রপন্থী-সন্ত্রাসবাদী হওয়া নয়, এমনকী শুধুমাত্র আইটিওয়ালা হওয়াও নয়, সেকথা স্পষ্ট বোঝা যায়। তবুও কিছু বাঙালী যে তৃণমূল, উগ্রপন্থী, আইটিওয়ালা হচ্ছে, তা হওয়া যেন তাদের সাময়িক সিদ্ধান্ত। প্রকৃতপক্ষে বাঙালী ঠিক কী হতে চলেছে, আমরা এখনও তা সুস্পষ্ট জানি না। তা জানার জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
বস্তুতই বিদ্যাসাগরদের আগে আমাদের যে শ্রেষ্ঠ বাঙালী পূর্ব্বপুরুষ জন্মেছিলেন, সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন প্রেম ও জ্ঞানের ভাণ্ডার। তাঁর উত্তরাধিকার বর্ত্তেছিল লালন, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নজরুলে। সারা বিশ্ব তো বটেই, এমনকি ভারতের রাষ্ট্রপরিচালকেরাও আজ বিশ্বায়নের ঢেউয়ে তাল রাখতে না পেরে বাহ্যসম্পদকে মানুষের চরম লক্ষ্য বলে মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু যে-মাটি শ্রীচৈতন্য ও তাঁর উপরোক্ত উত্তরাধিকারিদের জন্ম দিয়েছিল, সে মাটি কি এই অ-মানবিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে? সে যে সেই সনাতন যুগ থেকে প্রেম ও জ্ঞানের যথার্থ ভিত্তিভূমির উপর নির্ভর করে আজও এগিয়ে চলেছে। তবে কি এখান থেকেই শুরু হবে বিশ্বায়নের পাল্টা ঢেউ? যে ঢেউ দেহবাদী-ধনবাদিদের অধীন করার বোকামী না-করে তাদের পুনর্বাসন দিয়ে, যথাযথ মর্য্যাদা দিয়ে, জ্ঞান ও প্রেমের পতাকাকে সবচেয়ে উঁচুতে তুলে ধরবে? কারণ, আদিতে দেহের অমর্য্যাদাই দেহবাদিদের জন্ম দিয়েছিল। উভয়বাদী বাংলার মাটি কিন্তু দেহ ও আত্মার সমমর্য্যাদায়, পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহারের আদি সনাতন ভিত্তিভূমির উপর পা রেখে আজও সোজা হয়ে রয়েছে, একঝোঁকা হয়ে পড়েনি। … হয়তো এই বাংলার পাল্টা ঢেউয়েই ঘটবে বিশ্বায়নের মোক্ষলাভ।
টীকা ও টুকিটাকি –
১. পঞ্চভুবন বলতে পশ্চিমবাংলা (১ম), বাংলাদেশ (২য়), ত্রিপুরা সহ আটটি পূর্ব্বভারতীয় রাজ্যের বাংলাভাষিগণ (৩য়), ভারতের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষিরা (৪র্থ) এবং বাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাভাষিগণ (৫ম) – এর কথাই বলা হচ্ছে।