বাংলাভাষার বিপদ কোথায়?
-রবি চক্রবর্ত্তী এবং কলিম খান
“…দয়ার উপর নির্ভর করার দীনতা যে মানুষের মনুষ্যত্ব নাশের শ্রেষ্ঠ উপায়, সেকথা অনেকেই খেয়াল রাখেন না এবং মানুষকে দয়া করতে লেগে যান। গুহ্যকরাজও ডান হাতে সর্ব্বস্ব হরণ করে বাঁ হাতে ‘এনজিও’র নামে বদান্যতা করে মনুষ্যত্বের সর্ব্বনাশ করে থাকে; এও সেই রকম। বিশ্বের মানুষের মাতৃভাষা হরণ করে ‘মাতৃভাষা দিবস’-এর বদান্যতা স্বভাবতই তার স্নেহপুষ্ট হয়ে যায়। এ হল নিজের মাকে জীবন থেকে, পরিবার-পরিজন থেকে সরিয়ে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসুন, আর বছরে একদিন ‘মাদার্স-ডে’ বলে তাঁর জন্য মায়াকান্না কাঁদুন! এই হল আধুনিকতার তামাশা। সেভাবেই বছরের ৩৬৪ দিন টানা ‘অর্থকরী-ভাষা’মদে মত্ত থাকুন, বাকি শুধু একটি মাত্র দিন, ২১শে ফেব্রুয়ারি, চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাপী আপন আপন মাতৃভাষার জন্য সভায় সেমিনারে হাপুস নয়নে কাঁদুন। তাহলেই যেন মাতৃভাষা সগৌরবে বেঁচে থাকবে। অর্থাৎ, তাগাটা বাঁধা হয়েছে সমাজদেহের পায়ে, যদিও ছোবল পড়েছে তার মাথায়।…”
ভাষাসংবাদ ও বাংলাভাষা
ভাষাবিদ পণ্ডিতগণের হিসেবে বিশ্বজুড়ে এখন প্রতি দশ বছরে গড়ে ৪০০টি ভাষার মৃত্যু ঘটছে। তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন, আজকের বিশ্বের ৬৯১২টি ভাষার মধ্যে মাত্র ১০০টি ভাষায় বিশ্বের ৯৫ শতাংশ (= ৬৬৫ কোটি) মানুষ কথাবার্ত্তা বলে থাকেন; বাকি ৬৮১২টি ভাষায় বাকী ৫ শতাংশ (= ৩৫ কোটি) মানুষ তাঁদের কথাবার্ত্তা চালান। ভাষাবিদগণের মতে, এগুলির একটিও বাঁচবে না। কেননা, ভাষাগুলির মধ্যে নাকি মাৎস্যন্যায় চলছে, সবল ভাষা দুর্ব্বল ভাষাকে একটু একটু করে গিলে নিচ্ছে, ফলে দুর্ব্বল ভাষাটি ক্রমশ বক্তাশূন্য হয়ে মরে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২১০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মানবজাতির ৯০ শতাংশ (= ৬২১০টি) ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর, ভাষার এই মৃত্যুমিছিলে যে ভাষাই সামিল হতে বাধ্য হচ্ছে, সেই ভাষার বক্তা-জাতিটি আপন ভাষা খুইয়ে নিজেদের জাতীয় জ্ঞানসম্পদ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি হারিয়ে মানসিক ভিখারী হয়ে যাচ্ছেন।
এরকম হচ্ছে কেন? কেন মানুষের ভাষারা হঠাৎ হিংস্র হয়ে পরস্পরকে নিকেশ করতে লেগেছে? এতকাল তো উলটো পরিস্থিতি ছিল বলেই জানতাম। আদিতে ছিল একটি (মতান্তরে কয়েকটি মাত্র) ভাষা; সেই ভাষাই এতকাল ক্রমশ বাঁশঝাড়ের মতো বংশবৃদ্ধি করে ৬৯১২টি ভাষার বিশাল বাঁশবনে পরিণত হয়েছিল। আজ আবার কী এমন হল যে, সেই বাঁশবনে এমন মড়ক লেগে গেল?
সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের বাংলাভাষারই বা কী অবস্থা, সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। যতদূর জানি, আমাদের সাধের বাংলাভাষাও খুব ভাল নেই। সাম্প্রতিক খবরাখবর বলছে, তারও বক্তাসংখ্যা হু হু করে কমে যাচ্ছে। আমরা দেখছি, আমাদের উপমহাদেশেও ইংলিশ মিডিয়াম-এর দারুণ দাপট চলছে। সম্পন্ন থেকে ছাপোষা অবধি সব বাংলাভাষী মানুষ তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ছুটছেন সেইরকম লেখাপড়া শেখানোর জন্য, যাতে তাঁদের সন্তানসন্ততি ইংরেজীতে বলিয়ে-কইয়ে হয়। আর, তাদের ইংরেজী শেখানোর নাম করে, দুনিয়ার বহু দেশের মতো এখানেও, হাজার হাজার ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল খুলে দিয়ে শুরু করা হয়েছে এক প্রকার কাজ-চালানো ইংরেজী শেখানোর হল্লা — সব ভাষা বাদ দাও, শুধু ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করো। বাড়ীতে বাবা-মাকেও ইংরেজী ভাষাতেই কথাবার্ত্তা বলতে হবে। নইলে তাদের বাচ্চারা ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করবে। চাকরি পেতে হলে, রুজি-রোজগার করতে হলে, কাজ-চালানো ইংরেজী রপ্ত করা চাই। অন্যথায় না খেয়ে মরতে হবে। তাই পেটের দায়ে প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালী ছাত্রছাত্রী ও তাদের বাবা-মায়েরা এই প্রাইমারী থেকে সেই প্রাইমারী, এই হাইস্কুল থেকে সেই হাইস্কুল, এই কলেজ থেকে সেই কলেজে হন্যে হয়ে ছুটছেন। …
গুষ্টিসুদ্ধ ইংরেজীর পিছনে ছোটার এই প্রবণতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, চারদিকে তাকালেই সাক্ষাৎ মালুম হয়। রাজধানী শহর কলিকাতায় সর্ব্বত্র লোকে ইংরেজী-মেশানো বাংলায় কথাবার্ত্তা বলছে — ‘ট্রেনটা রাইট টাইমে রান করছে তো’; ‘আমরা টিচারদের নিয়ে প্রাউড ফিল করি’; ‘হাওড়া ষ্টেশনের সাবওয়ের ৬ নম্বর গেট পেরিয়ে বাঁ দিকে ১২ নম্বর চ্যানেল, এখান থেকে ১২সি বাই টু, ১২সি বাই ওয়ান, এস ১২-সহ একাধিক বাস ছাড়ে’…। শহরে তো কথাই নেই, গ্রামের বাজারেও প্রায় সব দোকানের নামফলক (সাইনবোর্ড) এখন ইংরেজী ভাষায় লেখা। জিনিসপত্রের নামও বলা হচ্ছে ইংরেজীতে — টুথব্রাশ, পাউচ, বিষ্কুট, সিগারেট, প্যাণ্ট, শার্ট, প্রেসক্রিপসন, চার্ট, ডায়ে্রী … ইত্যাদি অজস্র।
বাংলায় এখন যে সব চলচ্চিত্র তৈরি হয়, তাদের অধিকাংশের শিরোনাম ইংরেজীতে কিংবা ইংরেজী মেশানো বাংলায়। বেতার ও দূরদর্শনের (টিভির) কথকেরা তাঁদের বাংলা বাক্যে ৬০/৭০ শতাংশ ইংরেজী শব্দ মিশিয়ে অনায়াসে দূষিত বাংলা বলে চলেছেন। পত্রপত্রিকায় ভাষাও দো-আঁশলা হয়ে গেছে। এমনকি গণ্ডগ্রামের চাষীকেও ইউরিয়া, এমোনিয়া, ফসফেট…এসব শব্দ শিখে নিতে হচ্ছে, নইলে তার চাষের কাজ আটকে যায়। ইংরেজীতে লেখা টেপ (মাপফিতা) পড়তে না পারলে রাজমিস্ত্রীর বা ইলেকট্রিক-মিস্ত্রীর যোগাড়ের কাজও জোটে না। বাংলায় আবেদনপত্র লিখলে মহাকরণ তা ফেলে দেয়; যদিও সেখানেই রবীন্দ্রসঙ্গীত সহযোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। সরকারি প্রশাসনে, থানা-পুলিশে, হাসপাতালে, আদালতে, ডাকঘরে, ব্যাঙ্কে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে, বিদ্যুৎ দপ্তরে, পূর্ত্ত কিংবা রাজস্ব দপ্তরে…কোথাও নিজের মাতৃভাষা বাংলায় আবেদনপত্র লিখে কাজ হয় না। …অতএব প্রাণপণ ছোটো, ইংরেজীর একটা ভেলা বা পানসি ধরো; অনায়াসে এই সংসারের ভবনদী পার হওয়া যাবে। মোটকথা, ঝাড়ে-বংশে গোটা বাংলাভাষী জাতটাই ভাষিক-উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে; নিজের ভাষা ও স্বকীয়তা ত্যাগ করে ইংরেজীর ভেলায় ভর করে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। দেশে যেন এক মহাসুনামী আছড়ে পড়েছে। এই সুনামির ঝাপটা গ্রামবাংলায় যত, জেলা শহরগুলিতে তার চেয়ে বেশী, কলকাতায় সবচেয়ে বেশী; যেন ‘ঊনপঞ্চাশের ঝড়’ বইছে। …
প্রশ্ন হল, কেন বাংলাভাষী-জাতিটি তাঁদের অতি উচ্চমানের ভাষা বা ‘মনোভাব লেনদেনের হাতিয়ার’ থাকা সত্ত্বেও তা ফেলে দিয়ে অন্যের থেকে নিম্নমানের হাতিয়ার ধার করে তাই দিয়ে কাজ চালানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন বা নিতে বাধ্য হচ্ছেন? শুধুই কি পেটের দায়ে বা টাকার লোভে?
সমাজদেহকেও তার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ই চালায়
সাধ করে কেউ নিজের মাতৃভাষা ত্যাগ করে অন্য ভাষা গ্রহণ করে না; অনেক দুঃখে তাকে সেটা করতে হয়। কাজের দুনিয়ায় গিয়ে নিজের প্রিয় মাতৃভাষায় যদি কাজকর্ম্ম চালানো না যায়, হেনস্থা হতে হয়, তাহলে মানুষ কী করতে পারে? ভাষা আন্দোলন করে তার মাতৃভাষাকে কর্ম্মসংসারে প্রতিষ্ঠা করে তারপর সে যাবে নিজের কর্ম্মজীবনের কাজ উদ্ধার করতে — এমন সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে না। কারণ, ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার পর কুয়া খুঁড়তে শুরু করা যায় না।
কিন্তু কর্ম্মসংসারে তার মাতৃভাষায় কাজ করা বা করানো যাচ্ছে না কেন? যাচ্ছে না, কারণ, কর্ম্মসংসারে বিজাতীয় ভাষার রাজত্ব চলছে। এমন হলে, জাতিকে বিজাতীয় ভাষা শিখতে বাধ্য হতে হয়।
কর্ম্মসংসারে বিজাতীয় ভাষার রাজত্ব চলছে কেন? অর্থাৎ, জ্ঞানজগতে, কর্ম্মজগতে ও প্রশাসনে স্বজাতীয় ভাষা বাদ দিয়ে বিজাতীয় ভাষার রাজত্ব চলছে কেন? চলছে, যাঁরা ঐ তিন জগতের পরিচালক তাঁরা বিজাতীয় ভাষায় তাঁদের কাজকর্ম্ম চালানো উচিত বলে মনে করছেন বলেই ঐ বিজাতীয় ভাষার রাজত্ব চলছে।
কর্ম্মজগতের পরিচালকদের সরাসরি দেখা যায় না; কিন্তু জ্ঞানজগতের ও প্রশাসনিক জগতের পরিচালকদের স্পষ্ট দেখা যায়। প্রশাসনের পরিচালক হলেন আমাদের নির্ব্বাচিত রাষ্ট্রপরিচালক নেতামন্ত্রিরা। একালে শিক্ষাজগতের পরিচালনা করেন সেই রাষ্ট্রপরিচালকের শিক্ষামন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং তাঁদের উপদেষ্টাগণ। এই মন্ত্রিগণ ও তাঁদের উপদেষ্টাগণ চাইছেন বলেই আমাদের শিক্ষাজগতে ও প্রশাসনে বিজাতীয় ভাষার রাজত্ব চলছে। অর্থাৎ, সমাজদেহের মস্তিষ্ক ও হৃদয় (বক্ষ) বিজাতীয় ভাষাকে স্বদেশের শিক্ষাজগতে ও প্রশাসনে ব্যবহার করার নির্দ্দেশ দিয়ে রেখেছেন বলেই জনসাধারণ নিজের ভাষা ত্যাগ করে বিজাতীয় ভাষা শিখে সেই ভাষায় কাজকর্ম্ম চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিন্তু সমাজদেহের মাথা ও বুক তো দেহেরই অংশ। জ্ঞানজীবী ও রাষ্ট্রনেতাগণ তো দেশেরই মানুষ, দেশের মানুষের প্রতিনিধি। তাঁরাই বা একটি বিজাতীয় ভাষাকে দেশের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করার নির্দ্দেশ দিয়ে রেখেছেন কেন? তাঁরা কি জানেন না, এর ফলে নিজেদের অতীত হারিয়ে সমগ্র জাতিটিই ভাষিক-উদ্বাস্তু হয়ে যাবে, আয়ার্ল্যাণ্ড১ যার সাক্ষাৎ উদাহরণ? নাকি, তাঁদের অন্য কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বা থাকে?
আড়াইশো বছর আগে পর্য্যন্ত ছিল না। তখন সমাজের জ্ঞানজীবী ও রাষ্ট্র-পরিচালকগণ (রাজা রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রনেতা মন্ত্রিগণ) স্বজাতীয় ভাষা ব্যবহার করতেন; দেশের সর্ব্বক্ষেত্রে স্বজাতীয় ভাষাই চলত। তাছাড়া, প্রতিটি দেশের কর্ম্মজগৎ কার্য্যত নিজ দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, সামান্য আমদানী রপ্তানী ছাড়া পারস্পরিক ভাষায় মেশামেশির বিশেষ অবকাশ ছিল না। তাই সেকালে জ্ঞানজীবী ও রাষ্ট্রপরিচালকদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে ঘরে বাইরে কোনো চাপ ছিল না। অবশ্য, পরাধীন দেশে, বিজাতীয় শক্তি এসে দেশ দখল করে শাসন চালানোয় দখলকারীর ভাষা প্রশাসনে খানিকটা স্থান করে নিত ঠিকই; কিন্তু দেশের জ্ঞানজগৎ ও কর্ম্মজগৎ যথাপূর্ব্বং সক্রিয় থাকত। সেকারণে দেশীয় মানুষের ভাষায় সাধারণভাবে বিশেষ একটা রদবদল ঘটত না।
কিন্তু ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর এই রীতি বদলাতে শুরু করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি একেবারেই বদলে যায়। বর্ত্তমানে সেই বদল এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিশ্বের তথাকথিত ‘স্বাধীন’ দেশের সরকারও জনসাধারণের ‘ভাষিক-উদ্বাস্তু’ হওয়া আটকাতে পারছে না।
বাংলাদেশের কথাই ধরুন। (পশ্চিমবঙ্গের কথায় আমরা পরে আসব)। নিজের ভাষার মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করেই দেশটি স্বাধীন হয়েছে। দেশের প্রশাসনে তাঁরা বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা করেছেন। উপরন্তু বলতে গেলে সমগ্র দেশ বাংলাভাষায় কথা বলে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শত শত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রাতারাতি গজিয়েছে, গজাচ্ছে। বঙ্গভাষীর ইঙ্গীকরণ হচ্ছে দ্রুত গতিতে। তাতে নিশ্চয় অধঃপতিত জ্ঞানজীবিদের আশকারা আছে। আছে বলেই, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে দু-চারটে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফেরা এবং ইংরেজীতে কথা বলতে পারা জ্ঞানজীবীর এত কদর! ঢাকার বাংলাভাষীরা বুঝে গেছেন, বঙ্গ হওয়ার চেয়ে ইঙ্গ হলে বাড়তি কদর, অর্থলাভ বেশী। লোকে, বিশেষত তরুণতরুণীরা, হু হু করে ইঙ্গীকৃত হয়ে যাচ্ছে এবং অত্যন্ত নিম্নমানের ইংরেজী বা ইংরেজী মেশানো বাংলাভাষায় কথাবার্ত্তা বলছে। দেখেশুনে সেখানকার বেতার ও দূরদর্শনের কথকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে আইন তৈরি করতে হয়েছে, তারা যাতে ইংরেজী-মেশানো বাংলায় কথা না বলে, বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় কথা বলে।
তার মানে, যতই স্বাধীন সার্ব্বভৌম হোক না কেন, একালে একটি দেশে কোন ভাষা বেশী করে ‘অর্থকরী’ হয়ে উঠবে, তার উপর সে দেশের রাষ্ট্রের হাত নেই, থাকে না; হাত থাকে সেই দেশের কর্ম্মজগতের (উৎপাদন-কর্ম্মযজ্ঞের) নিয়ামকের এবং তার সাগরেদ অধঃপতিত জ্ঞানজীবীদের। সেই নিয়ামক সত্তাটি কর্ম্মর্জগতে যে-ভাষা ব্যবহার করেন, কার্য্যত সে ভাষাই বেশী অর্থকরী হয়ে ওঠে। আর, যে-ভাষা বেশী অর্থকরী হবে, জীবিকার্জ্জনের ও টাকা কামানোর অধিক সুবিধা দেবে, লোকে সেদিকে ঝুঁকবেই। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, তাদের সরকার প্রশাসনকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাংলাদেশের কর্ম্মজগৎকে (কর্ম্মজগতের শীর্ষে অধিষ্ঠিত নিয়ামক শক্তিকে এবং তার সাগরেদ শিক্ষাজগৎকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সেই কর্ম্মজগৎই বাংলাভাষা ত্যাগ করে ইংরেজী ভাষা গ্রহণ করতে বাংলাদেশী জনসাধারণকে প্ররোচিত করে চলেছে; আর বাংলাদেশের শিক্ষাজগৎ পরিপূরকের কাজটি করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার তা রোধ করতে পারছেন না।
একই কথা ইংরেজী ভাষাভাষী জাতি বাদে বিশ্বের বাকি সমস্ত জাতির ভাষার ক্ষেত্রেও কমবেশী খাটে। রাজনৈতিকভাবে দুর্ব্বল ও কমবক্তাসম্পন্ন ভাষাগুলি তো বটেই, এমনকি ইংরেজী বাদে আর যে পাঁচটি ভাষাকে – চীনা, রুশ, ফরাসী, স্প্যানিশ, ও আরবীকে – স্বয়ং রাষ্ট্রসঙ্ঘ ঘোষিতভাবে ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভাষা’ রূপে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে, সে ভাষাগুলি সম্পর্কেও আজ একই কথা বলা যায়। ফরাসী ভাষা, যে কিনা নিজের ঐতিহ্য ও গৌরব সম্পর্কে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ছিল, তাকেও এখন ইংরেজী-দূষণ থেকে বাঁচতে আইন করার কথা ভাবতে হয়েছে। এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন-আমেরিকার সর্ব্বত্রই চলছে ইংরেজী ভাষার মহাসুনামী। এমনকি চীন জাপানের মানুষেরাও এখন ঝড়ের বেগে ইংরেজজী শিখে ভাষিক উদ্বাস্তু হতে শুরু করেছেন। ব্যাপারটি ঘটছে একপ্রকার উৎকট মাৎস্যন্যায় অনুসরণ করে। যথা, বাংলার আদিবাসীরা নিজের ভাষা ছেড়ে শিখছেন বাংলা, বাংলাভাষী শিখছেন হিন্দি, হিন্দিভাষী শিখছেন ইংরেজী; তবে এর পাশাপাশি সকলেরই চেষ্টা আছে ইংরেজজ শিখে নেওয়ার এবং অনেকেই সরাসরি ইংরেজী শিখে নিচ্ছেন। ভারতের সব প্রদেশের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া সবেগে চলছে। …
তার মানে, বর্ত্তমান কালে বিশ্বের কোনো দেশই সম্পূর্ণ স্বাধীন বা সার্বভৌম নয়। সদরে দেশটির নামধাম ঠাটবাট লোকলষ্কর সবই আগের মতো ‘স্বাধীন’ ‘সার্বভৌম’ আছে বটে, কিন্তু খিড়কী দিয়ে ঢুকে পড়েছে কর্ম্মজগতের নিয়ামক এবং অন্দরমহল দখল করে তার সুবিধামতো কর্ম্মযজ্ঞ ও সহযোগী শিক্ষাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার কাপড় সেলাই করছে বাংলাদেশের কর্ম্মজগৎ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি-যজ্ঞে ঘি ঢালছে সল্টলেক-হায়দ্রাবাদ-বাঙ্গালোরে কর্ম্মরত ভারতের উত্তরপ্রজন্ম। …বলতে গেলে বিশ্বজুড়ে ‘অগ্রণী’ নাগরিকেরা কর্ম্মজগতের নিয়ামকের জন্য কিছু না কিছু বানিয়ে বা করে দিন গুজরান করছে। অর্থাৎ কিনা, একালে বিশ্বের সকল দেশের কর্ম্ম জগৎ একীভূত এক মহাকর্ম্মজগতের অধীন ও অঙ্গীভূত হয়ে তার অংশরূপে দেশে দেশে সক্রিয় আছে; এবং তার সাগরেদগিরি করছে বিশ্বজোড়া এক তাঁবেদার শিক্ষাজগৎ। মহাকর্ম্মজগতের সেই নিয়ামকই বিশ্বের সকল দেশের কর্ম্মজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন; কোনো রাষ্ট্র বা সরকার তা করে না, করতে পারে না আর। সেই নিয়ামক যেহেতু ‘কাজ-চালানো-ইংরেজী’ ভাষায় তাঁর কর্ম্মকাণ্ড চালান, বিশ্বের সকল দেশের মানুষকে সে-ভাষাই আপন করে নিতে হচ্ছে, নিতে হবে; আজ নয়তো কাল।
তার মানে, শেষ বিচারে দেশের ভাষার বিষয়ে দেশনেতাদের বেশী কিছু করার নেই। কেননা, দেশের কর্ম্মজগৎ ও তার তাঁবেদার শিক্ষাজগৎ উপরোক্ত মহাকর্ম্মজগতের অধীন হয়ে বসে আছে; সরকার পূর্ব্বতন ঠাটবাট বজায় রেখে চলেছে মাত্র। যদিও তার প্রকৃতিশক্তি বা কর্ম্মজগৎ তার কথায় চলে না আর – ‘আমার বঁধুয়া আনবাড়ী যায় আমারই আঙিনা দিয়া’!
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যে মাতৃভাষা ত্যাগ করে বিজাতীয় ভাষা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে, সেটি আদৌ স্থানিক সমস্যা নয়। বিশ্বজোড়া এক প্রক্রিয়া প্রতিটি দেশের কর্ম্মজগৎকে বাধ্য করছে ইংরেজীতে কাজকর্ম্ম চালাতে; প্রত্যেক দেশের জনসাধারণ তাই বাধ্য হয়েই ইংরেজী ভাষা গ্রহণ করছেন। রাষ্ট্র চাইলেও এর বিপরীতে কোনো কার্য্যকরী ভূমিকা নিতে পারছে না।
তার মানে, বাংলাভাষার যে বিপদ, ইংরেজী বাদে বিশ্বের সকল ভাষারই সেই একই বিপদ। বাংলার মতো সব ভাষার মানুষদের মহাকর্ম্মজগতের নিয়ামকের ভাষায় বা ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে হবে, আজ নয়তো কাল।
কিন্তু এ তো পরাধীনতা! দেশের প্রকৃতিশক্তি বা কর্ম্মজগৎ এবং তার পরিপূরক শিক্ষাজগৎ দেশ-পরিচালকদের ইচ্ছানুসারে চলে না, চলে বাইরের কারও নির্দ্দেশে! বিশ্বের সব দেশ কি তাহলে দৃশ্যত স্বাধীন, অথচ ভিতরে ভিতরে গোপনে কার্য্যত পরাধীন হয়ে গেছে? কে তাদের এমন বোকা বানিয়ে অধীন করে ফেলল যে, অধীন দেশবাসী মানুষ জানতেই পারল না, সে কখন পরাধীন হয়ে গেছে? আর, তাছাড়া সেরকম হতে পারলই বা কেমন করে?
কুকুরকে বেশি লাই দিলে মাথায় ওঠে …
এইখানে এসে আমরা এমন এক জটিল সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হই, যে সমস্যার সুরাহা তো বহু দূরের কথা, সমস্যাটিকেই আজ পর্য্যন্ত ভাল করে চিহ্নিত করেননি বা করতে পারেননি কোনো সমাজবিজ্ঞানী। এইখানে এসে কেইনসবাদ, মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ…সব বাদই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। সার্থক কেউ যদি আদৌ হয়ে থাকেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। কেননা, এখানে একটি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসে সঙীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে – বলো, মানবসভ্যতাকে কে নিয়ন্ত্রণ করে? প্রশাসন? জ্ঞানজগৎ? কর্ম্মজগৎ? কে? কে সভ্যতার প্রকৃত পরিচালক, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী?
এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় কেবল ভারতবর্ষীয় পুরাণাদি গ্রন্থে, মহাভারতে। সেখানে দেখা যায়, ধর্ম্ম যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করছেন, সমাজের কেন্দ্রবিন্দু কোথায়? কোথা থেকে সমগ্র সমাজ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়? যুধিষ্ঠির উত্তর দিচ্ছেন, কর্ম্মজগৎই (উৎপাদন-কর্ম্মযজ্ঞই) সমাজের কেন্দ্রবিন্দু; তা থেকেই সমগ্র সমাজ, সমগ্র মানবসভ্যতা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। (ধর্ম্ম কহিলেন, ‘ভুবনের নাভি কোথায়?’, যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘যজ্ঞই ভুবনের নাভি।’) তার মানে, সমাজের উৎপাদন-কর্ম্মকাণ্ড যেমন হবে, যার পরিচালনায় বা নিয়ন্ত্রণে হবে, তদনুসারেই জ্ঞানজগৎ ও প্রশাসন চলবে। এর অন্যথা হওয়ার উপায় নেই; রাষ্ট্র-পরিচালক যেই হোন। অর্থাৎ কিনা, কর্ম্মজগতের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রণকারীই প্রকৃতপক্ষে সমাজের, জাতির, দেশের, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা নির্ব্বাহ করে থাকেন। প্রাচীন ভারতে কর্ম্মযজ্ঞের নিয়ন্তা ছিলেন জ্ঞানযোগী, তাঁর নির্দ্দেশানুসারে কর্ম্মযোগী বাকী সকলকে নিয়ে কর্ম্মজগৎ পরিচালনা করতেন। এখন যে সত্তা সেই নিয়ন্তার আসন দখল করেছে তাকে সুনির্দ্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর নাম দিয়েছেন যন্ত্ররাজ বিভূতি।২ একালের অ্যাকাডেমিশিয়ানরা তাকে বৃহৎশিল্প বা ইণ্ডাষ্ট্রি বলে থাকে।
সভ্যযুগের সূচনালগ্নে আবিষ্কারক-উদ্ভাবক (শিব) ও বিশেষজ্ঞের (দক্ষের) বিরোধে এটিই ছিল বিতর্কের মূল বিষয়। কৃত্রিম, গুহ্য, শর্টকাট, কল বা যন্ত্র যেন তার ব্যবহারকারীর মাথায় চড়ে না বসে।৩ লাঙল, নৌকার হাল, কুমোরের চাক, তাঁত…এ’সবই যন্ত্র বটে; কিন্তু এই যন্ত্রগুলি মানুষের অধীনস্থ থাকে; মানুষের স্বভাবকে বিকশিত হতেও সাহায্য করে। যে কারণে ‘গান গেয়ে ধান কাটে চাষা’, ‘গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে’…ইত্যাদি। কুটীর শিল্পে যন্ত্রের সর্ব্বোচ্চ প্রায়োগিক রূপ যে পঞ্চগুণী (পাণ্ডবীয়) সংস্থাগত পাইকারী উৎপাদন ব্যবস্থা (গিল্ড ইত্যাদি), তাও মানুষকে অতিক্রম করেনি। বৌদ্ধ-ভারতবর্ষে যন্ত্রযুগের (কলের যুগের বা কলিযুগের) সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ভারতবর্ষ শেষমেষ মানুষের উপর কলকে (যন্ত্রকে) রাজত্ব করতে দিতে রাজী হয়নি বলে অধীনতাকামী যন্ত্রকে চলে যেতে হয় মহাপ্রস্থানে, পাশ্চাত্যে। প্রায় হাজার বছর পরে ইউরোপে প্রবল ঢক্কানিনাদে প্রতিষ্ঠিত শিল্পবিপ্লব ‘আধুনিকতা’ ও ‘গণতন্ত্র’-এর নামে মানুষের উপর রাজত্ব করার সেই রাস্তাটাই খুলে দিল যন্ত্রের সামনে; প্রকৃত কলিযুগের (কলের যুগের) বা যন্ত্রযুগের সূচনা হয়ে গেল; বৃহৎশিল্প বা যন্ত্ররাজ মানুষের সামাজিক ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়ে গেল। …
সেই যন্ত্ররাজ বিভূতির বা গুহ্যকরাজের ফুলে-ফেঁপে যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি৪ হয়ে উঠবার জন্য অতঃপর পুরো আধুনিক যুগটি (১৭৬৯-১৯৬৯, দুশো বছর) খরচ হয়ে যায়। পুরাণের ভাষায় এই ‘আধুনিক যুগ’টিকে তাই বলতে হয় ‘কলির সন্ধ্যা’। তার পর থেকে শুরু হয়েছে ঘোর-কলি। আজ আমরা ঘোর-কলিযুগে বাস করছি। এ যুগের বিশেষত্ব কী?
এ যুগে মানুষ বা তার সমাজ কীভাবে চলবে, কোন দিকে যাবে না যাবে, সেটি কার্য্যত মানুষ ঠিক করে না; করে যন্ত্রসম্রাট, যন্ত্রের অধিকারী পুঁজি। এখন আর মানুষ যন্ত্রকে বা টাকাকে চালায় না, টাকা ও তার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র মানুষকে চালায়, যন্ত্রপতিদেরও চালায়। এই টাকার বা পুঁজির প্রাচীন নাম ছিল কুবের (কুবের পুঁজি), আধুনিক নাম ‘কর্পোরেট পুঁজি’। পুরাণমতে ‘অন্তর্দ্ধান’ই (অন্তরে থাকিয়া ধারণ করাই) তার একমাত্র শক্তি, তাই সে বিদেহী কুবের। জুয়াচুরি৫ তার স্বভাব। সবকিছুকে খণ্ডবিখণ্ড করা, সমাজ পরিবার প্রভৃতি ‘ঝাঁক’ অস্তিত্ব ভেঙে দিয়ে মানুষকে একা করে দেওয়া, তার জুয়াচুরির উপায়। সব কাজই সে লুকিয়ে করে বা অন্যকে দিয়ে করায়। নিজে কখনোই সামনে আসে না।৬
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই কুবেরের মূলনীতি হল ‘অর্থসংগ্রহ’। কোনো প্রয়োজনে নয়, অর্থসংগ্রহের জন্য অর্থসংগ্রহ; ‘ক্রমবৃদ্ধি’ই তার একমাত্র ধর্ম্ম । বরফের পাহাড় যেমন বরফ পড়ে পড়ে ক্রমশ উঁচু হতে থাকে, এও অনেকটা তেমনি। অর্থসংগ্রহ করে সে কেবল ফুলে-ফেঁপে উঠতে চায়। ধনীকে সে নিত্য প্ররোচিত করতে থাকে, ‘আরো টাকা আনো, দেখো, আমি কেমন ফুলে উঠি, কোটি থেকে কোটি কোটি হয়ে যেতে পারি; তুমিও কেমন কোটিপতি থেকে কোটি-কোটিপতি হয়ে যেতে পারো!’ আর, মানুষ সহ বিশ্বের ধূলিকণা থেকে পাহাড় সমুদ্র পর্য্যন্ত সবকিছুকে সে তার সেই ফুলে-ওঠার সহায়ক হিসেবে কাজে লাগায়। তার ফুলে-ওঠার কাজে বা অর্থসংগ্রহের কাজে সহায়ক হবে, সবকিছুকে সেভাবেই বদলে নিতে থাকে সে। সকল বৃহৎশিল্প বা যন্ত্ররাজকে সে নিয়ন্ত্রণ করে, যন্ত্ররাজেরা মানবসমাজের সকল কর্ম্মযজ্ঞসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে, কর্ম্মযজ্ঞসমূহ সমগ্র কর্ম্মজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই কর্ম্মজগৎ শিক্ষাজগৎ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে তার তাঁবেদারে পরিণত করে। এভাবে, মানবসভ্যতার মাথায় উঠে বসে গেছে তারই সৃষ্ট যন্ত্র, যন্ত্রপতি, যন্ত্রপাতিকে কেনার টাকা। …
কিন্তু প্রশ্ন হল, মানুষের সমাজে এই মহা-অনর্থ সম্ভব হল কী করে?
‘শিরে কৈল সর্পাঘাত কোথায় বাঁধবি তাগা’?
কীভাবে এই মহা-অনর্থ সম্ভব হল, সেটি বুঝতে গেলে নিশ্চয় দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন।৭ এখানে সংক্ষেপে এইমাত্র বলে রাখা চাই যে, শিল্পবিপ্লবের নামে বৃহৎশিল্প (যন্ত্ররাজ, ইণ্ডাষ্ট্রি ) জাতির শাসক-পরিচালকদের কাছে দাবী করেছিল, তার তিনটি অনিবার্য্য প্রয়োজন রাষ্ট্র যেন পূর্ণ করে – ক) যন্ত্রের গ্রাসের জন্য খাদ্য (কাঁচামাল ইত্যাদি) সরবরাহে বাধা দেওয়া যাবে না; খ) যন্ত্রজাত উৎপন্ন-ধারাকেও অবাধে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে দিতে হবে; এবং গ) যন্ত্রের প্রয়োজন অনুসারে সমাজসদস্যগণকে শ্রমিক রূপে গ্রহণ ও বর্জ্জন করতে দিতে হবে। কার্য্যত এ হল জড়জগৎ ও জীবজগৎকে লণ্ডভণ্ড করে লুণ্ঠন করার অধিকার দাবী; সমাজদেহের প্রতিটি কোষের সঙ্গে সমাজ-পরিচালক মস্তিষ্ক (জ্ঞানযোগী) ও হৃদয়ের (কর্ম্মযোগীর) সম্পর্ক ছেদ করার দাবি। অর্থাৎ, জড়জগৎ জীবজগৎ ও মনুষ্যজগৎকে যন্ত্ররাজ বৃহৎশিল্প তার দরকার মতো খাবলে খাবলে খাবে, মানুষের সমাজ-পরিচালকেরা কিছু বলতে পারবেন না – এই সামাজিক অধিকার ভোগ করার দাবী।
কিন্তু এ তো প্রকৃতির সামগ্রিক বিন্যাসকে ধ্বংস করার দাবী! ‘ঝাঁকজীব-মানুষ’-এর ঝাঁকত্বকে (সমাজকে) ধ্বংস করার অধিকার দাবী! স্বভাবতই বৃহৎশিল্পের এই দাবীর ঘোর বিরোধিতা করতে লাগলেন জ্ঞানযোগী ও কর্ম্মযোগী সম্প্রদায়, অর্থাৎ জ্ঞানব্রতী, জ্ঞানজীবী, ব্রহ্মজ্ঞানী, ধর্ম্মগুরু প্রমুখ (সমাজদেহের মাথা, জ্ঞানবলী) ও কর্ম্মোদ্যোগী-ক্ষত্রিয়, কর্ম্মযজ্ঞ-পরিচালক-গণনায়ক নেতানেত্রিগণ (সমাজদেহের হৃদয় ও হাত, বাহুবলী)। পূর্ব্বকালে রাজা (বাহুবলী) জনসাধারণের দায় বহন করতেন, না করলে জ্ঞানী (জ্ঞানবলী) তাঁকে ‘রাজধর্ম্ম পালনের অযোগ্য’ বা ‘পাপী’ ইত্যাদি বলে দোষারোপ করতেন; এমনকি কোনো কারণে সেই দায় বহন করতে না পারলে জ্ঞানীরাই রাজাকে দায় বহন করার উপায় বলে দিয়ে পথ দেখাতেন। তখন সমাজদেহের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের একপ্রকার মেলবন্ধন ছিল। গুহ্যকরাজ সবার আগে ছোবল মারল সমাজদেহের সেই মাথায় – ইউরোপের জ্ঞানযোগী সম্প্রদায় দ্বি-ধাগ্রস্ত হয়ে জ্ঞানব্রতী ও জ্ঞানজীবীতে বা বড়ো-জ্ঞানী ও ছোট-জ্ঞানীতে পরিণত হয়ে গেল। তারপর শুরু হল বড়ো-জ্ঞানীদের বিতাড়ন ও বিলুপ্তি এবং ছোট-জ্ঞানীদের অধঃপতন। সেই অধঃপতন সমগ্র মানবজাতিকেই ক্রমে অধঃপতিত করে দিল।
কীরকম সেই অধঃপতন?কোনো মানুষ যদি চুরি-চামারী চোট্টামী ক’রে এবং সামাজিক শাস্তি এড়িয়ে ধনী হয়ে যায়, সে যেমন বাহ্যিকভাবে উন্নতি করে, কিন্তু মানসিকভাবে এবং সমাজের চোখে পতিত হয়ে যায়, ঠিক সেইরকম। কেননা, সেরকম বাহ্যিক উন্নতি করার জন্য চোখের চামড়া (চর্ম্ম) থাকা চলে না, লাজলজ্জাহীন হতে হয়, চামার বা চশমখোর হতে হয়, অন্যের বাহ্যসম্পদে চোট মারতে বা খাবলে খানিকটা তুলে নিতে হয় এবং সেসব করার জন্য নিজের মনটাকে মারতে হয়, মনুষ্যত্বকে অত্যন্ত খর্ব্ব করতে হয় বা ফেলে দিতে হয়; তবেই ঐরকম বাহ্যিক উন্নতি করা যায়। মনুষ্যত্ব ফেলে দিয়ে মানুষের এমন উন্নতিকে বলা হয় অধঃপতন। যে মানুষ এইভাবে মনুষ্যত্ব ফেলে দিয়ে ধনী হয়, তাকে সেকারণে ধনী-ছোটলোক, জুয়াচোর বা জোচ্চোর, চোট্টা, চামার বা চশমখোর ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। একইভাবে, ইউরোপীয় সমাজের শিল্পবিপ্লবোত্তর উন্নতিকেও অধঃপতন বলা উচিত; কেননা, শিল্পবিপ্লব করতে গেলে সবার আগে সমাজশাসন থেকে মনুষ্যত্বকে ঝেঁটিয়ে ফেলে দিতে হয়, জোচ্চুরী চোট্টামী চামারী চশমখোরীকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হয়; অন্যথায় শিল্পবিপ্লব সমাধা হতে পারে না। …
তা সে যাই হোক, অতঃপর সেই অধঃপতিত জ্ঞানীদের দিয়ে আঘাত হানা হল কর্ম্মযোগীদের উপর। গুহ্যকরাজ কুবেরের প্ররোচনায় অধঃপতিত জ্ঞানীদের একটি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবোধ কর্মযোগীদের একটি দল রাষ্ট্রকে জনগণের দায়বহন থেকে মুক্ত করে ‘গণতন্ত্র’-এর বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে বসলেন; যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিনা যন্ত্ররাজের বা শিল্পবিপ্লবের তিনটি দাবীই মেনে নেবে। ফলে, সেই গণতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠা করা গেল, দেখা গেল, একদিকে তার ভিতরে গুহ্যকরাজ অনড় অটল নিগূঢ় সিংহাসন বানিয়ে তাতে ঘাপটি মেরে বহাল তবিয়তে বসে রয়েছে; অপরদিকে জনগণ খেতে পেল কি অভুক্ত থাকল কার্য্যত তা দেখার দায় থাকল না কারো। একদিকে যন্ত্রপতির গোবর্দ্ধন (পণ্যবৃদ্ধি) রাজ্যবর্দ্ধন (সাম্রাজ্যবাদিতা) শুরু হয়ে গেল এবং অন্যদিকে ইচ্ছাখুশি শ্রমিক গ্রহণ ও বর্জ্জন (ছাঁটাই) চলতে লাগল। পাছে সেই ছাঁটাই শ্রমিকের জীবিকার জন্য চুরি রাহাজানি খুনখারাবিতে যন্ত্রপতির বাসযোগ্য সমাজ অবাসযোগ্য হয়ে যায়, শুরু হল ইউরোপ থেকে অষ্ট্রেলিয়া আমেরিকা প্রভৃতি দেশে দ্বীপান্তর, দেশান্তর। জ্ঞানীপ্রবর টমাস কার্লাইল (১৭৯৫-১৮৮১) বললেন, ‘এর চেয়ে তো দাসতন্ত্র ভাল ছিল’!
তার মানে, ইউরোপে তথাকথিত শিল্পবিপ্লব বা যন্ত্ররাজ বিভূতি মানবসমাজের মাথায় চড়ে বসার সময় প্রথম যেটি করল, এককথায় তা ভয়াবহ। সমাজদেহের পেটের সেবায় নিয়োজিত হয়ে গেল সমাজদেহের মস্তিষ্ক ও হৃদয়, জ্ঞানযোগী ও কর্ম্মযোগী, শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। বৃহৎশিল্পের বা যন্ত্ররাজের পরিপূরক করে ফেলা হল জ্ঞানজগৎ ও সমাজ-পরিচালনার জগৎকে। আর তা করার জন্য জ্ঞানজগৎকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়ে একদিকে তাঁবেদার ছোট-জ্ঞানীদের নেতৃত্বে পরিচালিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মডেলটিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল এযাবৎ চলে আসা স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (নেচারাল) জ্ঞানজগতে; এবং অপরদিকে ছিদ্রযুক্ত-গণতন্ত্র বা ফুটো-গণতন্ত্রের (কানা-গণতন্ত্রের)৮ মডেলটিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল সমাজের প্রশাসনিক জগতে। এইভাবে বৃহৎশিল্পের (ইণ্ডাষ্ট্রির) শাসনে সমগ্র কর্ম্ম জগৎকে, বৃহৎশিল্পের তাঁবেদার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার শাসনে সমগ্র জ্ঞানজগৎকে, এবং বৃহৎশিল্পের সেবাদাস ‘ফোঁপরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’-এর শাসনে সমগ্র সামাজিক প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় করে নিয়ে শিল্পবিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। মানবজাতির অস্তিত্বের লীলাভূমি স্বরূপ যে ত্রিলোক – কর্ম্ম জগৎ, জ্ঞানজগৎ, ও সমাজশাসনের জগৎ – সেই ত্রিলোকে যথাক্রমে বৃহৎশিল্প, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, ও ফোঁপরা-গণতান্ত্রিক-রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, এই তিন বিষাক্ত ত্রিফলা ঢুকিয়ে দিয়ে ঐ ত্রিলোক দখল করে ফেলা হল।
তার পর থেকে বিগত দুশো বছর ধরে বৃহৎশিল্প বা যন্ত্ররাজ বিভূতি উপরোক্ত ‘ত্রিফলা ঢুকিয়ে দখলকরণ’ প্রক্রিয়াকে অনিবার্য ও সর্ব্বব্যাপ্ত করার কাজ সমানে চালিয়ে গেছে। এখন তাকে ছাপিয়ে তারই গোপন প্রভু গুহ্যকরাজ ফুলে-ফেঁপে যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি রূপে বিশ্বসম্রাট হয়ে বসেছে। তার সিংহাসন আজ নিষ্কণ্টক বলে সে মনে করে। কর্ম্মজগতে শিক্ষাজগতে এবং ‘গণতন্ত্র’ পরিচালিত প্রশাসনেও তার অবাধ রাজত্ব। গুহ্যক-সম্রাটের জোচ্চুরি স্বভাবটি শিক্ষাজগতে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছে। বড়-ইংরেজ, বড়-জার্ম্মান, বড়-ফরাসী, বড়-মার্কিন, বড়-বাঙালী … প্রভৃতি বড়-জ্ঞানীদের বিষয়ে নীরব থেকে শিক্ষাজগৎ থেকে তাদের মুছে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনে এই জোচ্চুরি দিন দিন রীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, করছে। …গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নিম্ন স্তরে সেই জোচ্চুরি ও নির্লজ্জতা ক্রমে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভরে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য্য কী!
মোটকথা, অতি উচ্চশিক্ষিতদের একটি অংশ বিশেষজ্ঞ হয়ে বুদ্ধির ঢেঁকিতে পরিণত হয়ে মহাবিভূতির সেবাদাস হয়ে গেছেন। তাঁদের প্ররোচনায় গোটা শিক্ষাজগৎটাই জ্ঞানব্রত ছেড়ে দিয়ে অর্থের পিছনে ছুটছে। জোচ্চোরের ঐ মাথামুটে সাগরেদরাই প্রচার করে রেখেছেন, ‘স্কুল কলেজে লেখাপড়া না শিখলে জীবন বৃথা’, অতএব, লেখাপড়া শিখে চাকরি৯ করো; অর্থাৎ, বিদ্যাকারখানাগুলি খুলে দিয়ে একালের অধঃপতিত মাথামুটে জ্ঞানজীবিরা উত্তরপ্রজন্মকে টাকা রোজগারের যন্ত্র বানিয়ে ফেলেন, অন্যের ক্রীতদাস হওয়ার বিদ্যা শেখান, তারপর ক্রীতদাসের জীবন যাপন করার উপদেশ দেন এবং ঐরূপ জীবনকে গৌরবজনক বলে ঘোষণা করে থাকেন। এক একটি গোটা গোটা জাতিকেই ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলছেন তাঁরা। তাঁদের প্ররোচনায় আজ দেশে দেশে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সমগ্র শিক্ষাজগৎ ও প্রশাসন মহাবিভূতির সেবায় নিয়োজিত। সেই সেবার মূলকথা হল – গুহ্যকরাজের ফুলে-ওঠার জন্য বা অর্থসংগ্রহের জন্য যা কিছু করা দরকার, তাই করতে হবে। মানুষ, জ্ঞানী, গুণী, দেশনেতা, ডাক্তার, উকিল, কবি, গায়ক, নায়ক…ব্যবস্থা, সংস্থা, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপতিত্ব, প্রধানমন্ত্রিত্ব…কোনো কিছুর কোনো মহিমা নেই, থাকলেও নেই, সে মহিমা রক্ষা করার দরকারও নেই; সবকিছু কাজ-চালানো গোছের হলেই হবে।
মানুষের মনুষ্যত্ব, জ্ঞানীর জ্ঞান, গুণীর গুণ, নেতার নেতৃত্ব, ডাক্তারের ডাক্তারি…সব সব টাকা দিয়ে কিনে নাও, বেচে দাও, না দিলে তাকে তা বেচে দিতে বাধ্য করো। কারণ, আমি গুহ্যকরাজ যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি কুবের ঘোষণা করছি, আমার রাজত্বে টাকায় কেনাবেচা করা যাবে না এমন কিছুই নেই, শিক্ষা স্বাস্থ্য সেবা ললিতকলা মায়া মমতা…মায় নিসর্গ-প্রকৃতির জল হাওয়া মাটি এমন কিছুই থাকবে না, রাখা হবে না, যাকে কেনাবেচা করা যাবে না। অতএব সবজি-মাণ্ডির মতো শিক্ষা-মাণ্ডি, স্বাস্থ্য-মাণ্ডি, সেবা-মাণ্ডি…খুলে ফেলো। বিশ্বসংসারকে বিক্রয়যোগ্য ও কাজ-চালানো গোছের করে নিয়ে শুধু অর্থসংগ্রহ করার দিকে ছুটতে হবে। তাই, করণীয় একটাই – সমগ্র কর্ম্মজগৎকে, জ্ঞানজগৎকে, ও প্রশাসন-জগৎকে সম্পূর্ণ কাজ-চালানো জগতে পরিণত করে দিয়ে শুধুমাত্র অর্থসংগ্রহে ধ্যান দাও। …
অতএব ভাষার ক্ষেত্রেও একই নিদান। এখন বিশ্বজুড়ে শুধুমাত্র অর্থকরী কাজ-চালানো ভাষা চাই, তা সে ভাষা দেশী হোক আর বিদেশীই হোক। কোনো রাষ্ট্র বা প্রশাসন চাইলেও এই অর্থকরী কাজ-চালানো ভাষার দিকে জনসাধারণের দৌড় রুখতে পারে না, বৃহৎশিল্পের তাঁবেদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রুখতেও চায় না। বলতে গেলে, বৃহৎশিল্প১০ ও তার দুই সাগরেদ শিক্ষাব্যবস্থা ও ফুটো-গণতন্ত্র – এই ত্রিলোক দখলকারী (রাবণ-রাক্ষসের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা) কুবেরের তাড়া খেয়ে লোকে নিজ নিজ মাতৃভাষা ত্যাগ করে ঝাঁকে ঝাঁকে অর্থকরী ভাষা অর্জ্জনের জন্য ছুটছে। যে ভাষা শিখলে তার কিছু টাকা হবে, খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে, সেরকম অর্থকরী ভাষা তার চাই। ভাষায় মড়ক তো লাগবেই!
তবে কিনা, সমাজে বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন উপাধ্যায় বা ওঝাদের তো অভাব নেই; তারা সাপের ছোবল শুনলেই তাগা বাঁধার তোড়জোড় করেন। ছোবলটা মেরেছে কোথায় সে খোঁজ নেওয়ার অবকাশ নেই তাঁদের। তাঁরা খেয়ালও করলেন না যে ছোবলটা পড়েছে সমাজের জ্ঞানব্রতীদের সর্বোচ্চ স্তরে, সমাজদেহের একেবারে মাথায়, হাতে পায়ে নয়। সেই ওঝারা ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিকে ‘বিশ্বমাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ১৯৯৯ সালে গেলেন ইউনেস্কোর দপ্তরে একটি প্রস্তাব পেশ করতে। প্রস্তাবটি সত্বর গৃহীতও হয়ে যায়। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি সেভাবেই প্রথম পালিত হয়। আশা করা হয়, এর ফলে বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষাগুলিকে নিশ্চয় বাঁচিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটি গুহ্যকরাজের পরিকল্পিত ‘গণতন্ত্র’, ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ ও ‘আধুনিকতা’র তামাশায় দাঁড়িয়ে যায়।
এমনিতে দয়ার উপর নির্ভর করার দীনতা যে মানুষের মনুষ্যত্ব নাশের শ্রেষ্ঠ উপায়, সেকথা অনেকেই খেয়াল রাখেন না এবং মানুষকে দয়া করতে লেগে যান। গুহ্যকরাজও ডান হাতে সর্ব্বস্ব হরণ করে বাঁ হাতে ‘এনজিও’র নামে বদান্যতা করে মনুষ্যত্বের সর্ব্বনাশ করে থাকে; এও সেই রকম। বিশ্বের মানুষের মাতৃভাষা হরণ করে ‘মাতৃভাষা দিবস’-এর বদান্যতা স্বভাবতই তার স্নেহপুষ্ট হয়ে যায়। এ হল নিজের মাকে জীবন থেকে, পরিবার-পরিজন থেকে সরিয়ে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসুন, আর বছরে একদিন ‘মাদার্স-ডে’ বলে তাঁর জন্য মায়াকান্না কাঁদুন! এই হল আধুনিকতার তামাশা। সেভাবেই বছরের ৩৬৪ দিন টানা ‘অর্থকরী-ভাষা’মদে মত্ত থাকুন, বাকি শুধু একটি মাত্র দিন, ২১শে ফেব্রুয়ারি, চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাপী আপন আপন মাতৃভাষার জন্য সভায় সেমিনারে হাপুস নয়নে কাঁদুন। তাহলেই যেন মাতৃভাষা সগৌরবে বেঁচে থাকবে। অর্থাৎ, তাগাটা বাঁধা হয়েছে সমাজদেহের পায়ে, যদিও ছোবল পড়েছে তার মাথায়।
পশ্চিমবঙ্গের ভাষাসাধনা : ‘মোদের গরব মোদের আশা’র হাল-হকিকৎ
সবাই জানেন, ভারতবর্ষে যতগুলি জাতি আছে, তাদের মধ্যে বাংলাভাষী বাঙালী জাতিটি একটু বিশেষ স্বভাবের। সব ব্যাপারেই সে এগিয়ে থাকে, সেরাতে অগ্রণী, নোংরাতেও। সেরা যদি তার রবীন্দ্রনাথ, তবে সেই রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দিতে না-দেওয়া নোংরা লোকটিও বাঙালী। স্বাধীনতা আন্দোলনকারী কংগ্রেস দলের ভিতরে সেই লোকটিই ক্ষমতা দখল করে বসেছিল। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজীর দুই পীঠস্থান ইংল্যাণ্ডে ও বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রধান সিংহাসন নিয়ে গুহ্যকরাজ যখন বিশ্বসম্রাট রূপে অধিষ্ঠিত, তখন বড়-ইংরেজ ও বড়-মার্কিন নিশ্চিহ্ন, শুধুমাত্র ছোট-ইংরেজ ও ছোট-মার্কিন-এর রাজত্ব চলছে।
সেই দুর্দ্দিনে আমরা স্বাধীন হলাম, আর, আমাদের মুখটা দেশ-এর দিক থেকে ইংল্যাণ্ড ও মার্কিন দেশের দিকে ধাঁ করে ঘুরে গেল। এতকাল আমরা দৈহিকভাবে পরাধীন ছিলাম, কিন্তু মানসিকভাবে স্বাধীন ছিলাম। রামমোহন থেকে বিভূতিভূষণ পর্য্যন্ত সব বড় বড় বাঙালীর উত্থান সম্ভব হয়েছিল পরাধীন ভারতেই। তখন নিজেদের বহুকালক্রমাগত ঐতিহ্য ও মাতৃভাষার উপর ছিল আমাদের নির্ভর। তাই বাইরে থেকে জ্ঞান আহরণ করতেও আমাদের কোনো অসুবিধা হত না। উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ অখণ্ড ও খণ্ড উভয়ভাবে জগৎ ও জীবনকে দেখবার যোগ্যতা ছিল আমাদের। তখন নিজের ভাষার প্রতি কী পরিমাণ নির্ভরতা ও শ্রদ্ধাভক্তি ছিল তার একটি অতি ক্ষুদ্র উদাহরণ হল, আত্মীয় ইংরেজীতে চিঠি দিয়েছিলেন বলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তা না পড়েই ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ব্যাপারটি উলটে গেল। আমরা দৈহিকভাবে স্বাধীন ও মানসিকভাবে পরাধীন হয়ে গেলাম। এতকাল ইংরেজের রাজত্বকালে আমাদের ইংরেজী না জানলেও সংসারযাত্রা চলে যেত। এবার ইঙ্গ-মার্কিনের এমন এক ভারতীয় তাঁবেদার আমাদের শাসক হয়ে গেল যে, তার রাজত্বকালে আমাদের ইংরেজী জানতে শিখতে বাধ্য হতে হল; না জানলে অর্থ ও সম্মান হানির ব্যবস্থা করা হল। ইংরেজ শাসকের ঔদাসীন্য এবং প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন বাধাকে উপেক্ষা করে আমাদের বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বাংলার একটা বিশেষ মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে; এবার সেখানে অধঃপতিত তাঁবেদার কাজ-চালানো ইংরেজীর মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং বাংলার শিক্ষক-অধ্যাপকেরা ফেকলু হয়ে গেলেন।
প্রশাসনে যে যত ইংরেজীতে বকবক করতে পারে তার তত কদর হল। স্বাধীনতা লাভের আগেই যাঁরা পদার্থবিজ্ঞান বীজগণিত মহাকরণ ময়না-তদন্ত…প্রভৃতি অভিনব বাংলা শব্দের সৃষ্টি করতে পারতেন, সেই বাংলা-জ্ঞানীদের নানাভাবে অপমান করে তাড়ানো হতে লাগল; এমনকি বড়-ইংরেজের কাছ থেকে যথাযথ ইংরেজী যাঁরা শিখেছিলেন, তাঁদেরকেও অনাদর করা হতে লাগল। উত্তরপ্রজন্মের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত বক্তব্যকেই সবার অলক্ষ্যে চোরের মতো ফেলে দেওয়া হল; সেগুলির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস নেই তাঁবেদার নপুংসকদের। লুকোচুরি করে প্রতিষ্ঠা করা হল কাজ-চালানো বাংলা ও ইংরেজীর।
সর্ব্বোপরি, এমন একপ্রকার মহামূর্খদের শাসনকাল প্রতিষ্ঠিত হল, যারা বিশ্বাস করে – জগতে আলোর ব্যবস্থা শুধুমাত্র বিজলীবাতির আলো দিয়েই করা হয়ে থাকে; সূর্য্য চন্দ্র নক্ষত্র দিয়ে পরমাপ্রকৃতি যে একটা সামগ্রিক আলোর ব্যবস্থা করে রেখেছেন তা তাঁরা বেবাক ভুলে যায়। অর্থাৎ, যে মহামূর্খেরা বিশ্বাস করে যে একমাত্র অ্যাকাডেমিক-শিক্ষাই মানুষকে জ্ঞানালোকে আলোকিত করে, জগৎসংসারে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানালোকের১১ মহান ব্যবস্থাটাই নাই, দৈহিক স্বাধীনতা লাভের পর বাঙালী জাতির উত্তরপ্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ামকের আসনে চড়ে বসল সেই মহামূর্খেরা। বাংলার যে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানার্জন ও তার উত্তরাধিকার, তা সব অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেল। হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যে জ্ঞান অর্জ্জন করে সঞ্চয় করে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, তা সব ফেলে দেওয়া হতে লাগল। আমরা মানসিক উদ্বাস্তু হতে লাগলাম। …
এরপর মঞ্চে হাজির হলেন বামপন্থীরা। মহামূর্খদের রাজত্বকে এঁরা পরিপ্রসারিত করে নিয়ে গেলেন চূড়ান্তে। ‘যত উচ্চশিক্ষিত হবে, যত শহুরে হবে, তত খর্ব্ব-মনুষ্যত্ববান বা মনুষ্যত্বহীন হবে, তত গণতান্ত্রিক-রাষ্ট্রপন্থী হবে, তত সমাজের (মানুষের ঝাঁকত্বের) বিরোধী বা গ্রাম-বিরোধী হবে’- কুবেরের এই নীতিকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে তারা। তার ওপর ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ ঘোষণা করে একদিকে এঁরা বড়-ইংরেজের মান্য ইংরেজীকে একেবারে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার ব্যবস্থা করলেন; অপরদিকে যাঁরা উপরোক্ত অভিনব বাংলা শব্দের সৃষ্টিতে অপারগ, সেই নিকৃষ্ট ও শ্রদ্ধাহীন বাংলার অধ্যাপকদের বসিয়ে দিলেন বাংলা শিক্ষার বিভিন্ন বিভাগগুলির পরিচালনার দায়িত্বে; এবং নিজ নিজ সন্তানকে পাঠিয়ে দিলেন বিদেশে বা দেশী ইংরেজী-মিডিয়াম স্কুলে। ফলটা হল খুবই ভয়ানক।
২০০০ সালে পৌঁছে দেখা গেল, অখণ্ডভাবে জগৎ ও জীবনকে দেখবার যোগ্যতা শিক্ষিত বাঙালী হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি একটি মৌলিক রচনা লেখার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা, কী বাংলায়, কী ইংরেজীতে। সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারে না তারা, ভাঙা ভাঙা ইংরেজী-মেশানো বাক্যে অসংলগ্ন কথা বলে থাকে। মহামূর্খদের শিক্ষাব্যবস্থার ফল ভোগ করছে আমাদের বর্ত্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। চুল নাক কান চোখ রক্ত পেশী হাড় … প্রভৃতি মানবশরীরের প্রত্যঙ্গগুলির পৃথক স্পেশালিষ্ট ডাক্তাররা যেমন বুঝতেই পারে না যে, মানবশরীর একটা অখণ্ড ব্যাপার, আজকের বাংলাভাষী শিক্ষিত শ্রেণীটিও আর বুঝতেই পারে না যে মানবশরীর, মানবমন, সমাজশরীর, সমাজমন, জগৎশরীর … সবই এক একটি অখণ্ড ব্যাপার। তাকে খণ্ডভাবে দেখা হাসপাতালে মানুষের কাটা-পা পড়ে থাকতে দেখার মতোই ভয়ানক, কিশোর রবীন্দ্রনাথ যা দেখে আঁৎকে উঠেছিলেন। একালের শিক্ষিত বাঙালীকে এইরূপ জগৎ ও জীবনকে অত্যন্ত খণ্ডভাবে দেখতে অভ্যস্ত করে তুলল শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালক মহামূর্খেরা। তাদের দৌরাত্ম্যে অভিনব বাংলা শব্দ সৃষ্টিক্ষম বাংলা-জ্ঞানীরা বাংলার শিক্ষাজগৎ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন; মান্য ইংরেজী-জানা মানুষেরাও সরে দাঁড়ালেন। ফলত, বাঙালীর উত্তরপ্রজন্ম না শিখল বাংলা, না শিখল ইংরেজী; ইংরেজী ভাষার মনোলোকের উদ্বাস্তু ছাউনিতে ঠাঁই হল তাদের। বাংলার অ্যাকাডেমী-শিক্ষিত বাঙালীর কার্য্যকরী মানে হয়ে গেল ইংরেজী র মানসভূমিতে মানসিক উদ্বাস্তুদের দঙ্গল। …
নীরদ চৌধুরী বা সত্যজিৎ রায় প্রমুখ মানুষেরা যে উভয় ভাষা শিখেছিলেন, তার তাত্ত্বিক অর্থ আমরা আগের নিবন্ধে দিয়েছি। সংক্ষেপে তা হল, মনের ভিতরে বাংলার বারোটি কর্ম্মশালারর পাশাপাশি ইংরেজীর কর্ম্মশালাগুলিও খুলে ফেলা; অনেকটা দেশে-থাকা ঘরবাড়ীর পাশাপাশি ইংলণ্ডেও ঘরবাড়ী করে ফেলা এবং দু-জায়গাতেই যাতায়াত করা। কিন্তু এখনকার কাজ-চালানো ইংরেজী শিক্ষায় সেরকম হয় না। তাতে নিজের দেশের ঘরবাড়ী ছেড়ে দিয়ে ইংলণ্ডে যাওয়া হয় মানসিক উদ্বাস্তু হয়ে এবং নিবাস করা হয় উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি প্লাষ্টিকের সাময়িক ঘরে। কেননা, কাজ-চালানো ইংরেজী শিখতে গিয়ে কেবল নিজের মাতৃভাষাকে ত্যাগই করা হয় না, ইংরেজী ভাষাকেও আপন করে নেওয়া যায় না। তাতে একদিকে নিজের মনোভূমিতে চলমান বারোটি শব্দসৃজন কর্ম্মশালাকে ত্যাগ করা হয়, অথচ তার পরিবর্ত্তে নতুন কোনো কর্ম্মশালা ঠিকঠাক গড়ে ওঠে না; কাজ চালানো হয় উঞ্ছবৃত্তি করে। তার মানে, ইংরেজী ভাষার জন্য এই যে দৌড়, তা কেবল আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে, নিজেদের সমস্ত অতীত থেকে – নিজেদের জবান জাতি জল জঙ্গল জমিজমা জীবজন্তু সহ সমস্ত বাহ্যিক ও মানসিক পরিবেশ থেকে – আমাদেরকে বঞ্চিত করে নিঃস্বই করছে না, নতুন সম্পদ অর্জ্জনের পথও বন্ধ করে দিচ্ছে এবং আমাদেরকে মানসিক উঞ্ছবৃত্তিজীবী বা মানসিক ওঁছায় পরিণত করেছে, করছে।
এখন এসেছে তৃণমূলের শাসন। কিন্তু বাংলাভাষা ত্যাগ করে ইংরেজীর দিকে দৌড়ানোর গতি বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে (মহামূর্খের আত্মপরিচয়-গোপনকারী কোনো নির্বোধ চেলা স্কুল থেকে বাংলাভাষা তুলে দেওয়ার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোট নেওয়া শুরু করে দিয়েছে!)। ভাষা-ব্যবহার বিষয়ে বর্ত্তমান প্রশাসনের আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, নেতানেত্রী ও তাঁদের উপদেষ্টা শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা বুঝেই উঠতে পারছেন না, তাঁরা কী করবেন। অথচ, তাঁদের কাছে বাংলাভাষী জনসাধারণের প্রত্যাশা প্রচুর। ১৯৭০-৮০ সালে বামপন্থীদের কাছেও বাঙালীদের সেইরকম প্রত্যাশা ছিল। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’-এর ধোঁকা দিয়ে সেই প্রত্যাশার বিপরীতের চূড়ান্ত করেছে তারা। এখন তৃণমূলের আমলে মহামূর্খ শিক্ষা-পরিচালকেরা নতুন রূপ ধারণ করেছে।
শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্লায় পড়ে পিছনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ঠোঁট নাড়াচ্ছে তারা; কিন্তু ‘উত্তরপ্রজন্মের লালনপালন’১২ বা শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে আগের মতোই লুকোচুরি করে সরিয়ে রাখছে তারা। বর্ত্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আনা রবীন্দ্রনাথের অভিযোগগুলিকে তারা লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখার নানা আয়োজন করে চলেছে এখনও। কেননা, রবীন্দ্রনাথের কোনো বক্তব্যেরই বিপরীত বক্তব্য রাখবার জ্ঞানবুদ্ধি ও সৎসাহস নেই কাপুরুষগুলোর। তাদের পূর্বসূরীদের মতো তারাও এখন রবীন্দ্রপূজা করে রবীন্দ্রনাশ-যজ্ঞের ঋত্বিকের দায়িত্ব পালন করতে লেগেছে। উত্তরপ্রজন্মকে বড় করে তোলার তাদের পরিকল্পনা গুহ্যকরাজ কুবেরের ইচ্ছার সঙ্গে হুবহু খাপ খেয়ে যায়। গোটা বাঙালী জাতিটাকে এক ছাঁচে ঢেলে যন্ত্রপাতিদের ক্রীতদাস হওয়ার উপযুক্ত বানানোকে তারা আদর্শ বলে মনে করেছে। উত্তরপ্রজন্মকে লালনপালন করার অন্য কোনোরকম পরিকল্পনার কথা তারা ভাবতেই পারে না। ভাববে কী করে! অধঃপতিত জ্ঞানজীবীদের উত্তরসূরী এই মহামূর্খেরা নিজেরাই চাকরের জীবন যাপন করে। অন্যের জন্য তারা বড়জোর ‘ভালো-চাকর’-এর জীবনের কথাই ভাবতে পারে। বাঙালীর ছেলেমেয়েরা আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চ্চা করবে, স্বনির্ভর হবে, এমন কথা তাদের কল্পনাতেও আসে না।
শুধু কি তাই! স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মহামূর্খদের রাজত্ব শুরু হয়; মনুষ্যত্ব ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র দেহের সেবা শুরু হয়, বাহ্যলাভই মানুষের মোক্ষ বলে ভিতরে ভিতরে ঘোষিত হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব খর্ব্ব করে পরের চাকর হওয়া, চাকরী করা আদর্শ হয়ে ওঠে; গোপনে, কোনো রকম সুনির্দ্দিষ্ট প্রকাশ্য ঘোষণা না করে। রবীন্দ্রনাথ লিখিতভাবে এই চাকর-জীবনের বিরুদ্ধে গুরুতর আপত্তি জানিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মহামূর্খ কাপুরুষেরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছুই না বলে তাঁর সব কথা গোপনে ফেলে দিয়ে চাকর গড়ার বিদ্যাকারখানা সমূহ গড়ে তোলে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি বানিয়ে প্রতিটি বাঙালীর সন্তানকে চাকর বানানোর ব্যবস্থা করা হয়। গোটা সমাজ লেখাপড়া শিখে চাকর হওয়ার জন্য ছুটতে থাকে। কিন্তু সবাই যদি চাকর হবে, চাকর রাখবে কে? । যন্ত্ররাজ তো সুবিধামতো নেবে আর ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তাহলে? মহামূর্খেরা বগল বাজিয়ে নৃত্য করতে থাকে আর বলতে শেখায় – হয় চাকরি দাও, নয় বেকার ভাতা দাও, নইলে গদি ছাড়ো। নেতারা কূলকিনারা খুঁজে পায় না। কারণ, তাঁদের অধিকাংশই তো ঐ মহামূর্খ-গুরুদের শিক্ষাব্যবস্থায় পালিত। গুরুমারা বিদ্যা অর্জ্জন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
আরও আছে। মহামূর্খদের কীর্ত্তির শেষ নেই। আমরা যখন কোনো শিক্ষিত বাঙালীর কাছে বাংলাভাষা নিয়ে কথা বলতে যাই, প্রায়শই তাঁরা বলেন, ‘ও সব তো ভাষাতত্ত্বের ব্যাপার, ভাষাতাত্ত্বিকরা বলতে পারবেন। আমি ভাষার বিষয়ে কী জানি।’ কেননা, তিনি রসায়নের কিংবা অঙ্কের বা ভূগোলের অধ্যাপক কিংবা ভাষাতত্ত্ব বাদে অন্য কোনো বিষয়ে ব্যাচিলর বা মাষ্টার ডিগ্রী করেছেন। আসলে মহামূর্খদের পরিচালিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের জ্ঞানের দুনিয়াটাকে কেবল হাজার ভাগে ভাগই করে রাখেনি, এক একজন মানুষকে এক একটি বিষয়ে ‘শিক্ষিত’ বানিয়ে ৯৯৯টি বিষয়ে মূর্খ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তার মানে, একালে উচ্চশিক্ষিত কথাটির মানেই হল, যিনি ৯৯৯টি বিষয়ে মূর্খ। তবে সেখানেই মহামূর্খদের দুষ্কর্মটি থেমে থাকলেও কথা ছিল; তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্ত শিক্ষিত বাঙালীর মনের ঠ্যাংটাই ভেঙে ছেড়ে দেয়। অ্যাকাডেমী শিক্ষা দ্বারা খর্ব্ব-মনুষ্যত্ববান এই মানসিক খঞ্জরা আর বিশ্বাসই করতে পারে না যে, তাদের পক্ষে অন্যান্য বিষয়েও জানা সম্ভব।
ফলে, একালের শিক্ষিত বাঙালী নিজেই ঘোষণা করে যে, সে কেবল একটি বিষয়ে জানে এবং বাকি ৯৯৯টি বিষয়ে মূর্খ এবং একথা বলতে তার লজ্জাও করে না, দুঃখও হয় না। অথচ আকাট-মূর্খ (আনকাট ডায়মণ্ড) হলে এই সহজ কথাটি সে সহজেই বুঝে নিতে পারত যে, তার সব জ্ঞানই কমবেশী লাগে – বাজারে গেলে অর্থনীতি লাগে, পাড়ায় ঝামেলা হলে রাজনীতি লাগে, ছেলের অসুখ করলে চিকিৎসাবিদ্যা লাগে…সবই লাগে এবং সে সবের জন্য ছুটোছুটি করে তাকে সব প্রয়োজনীয় জ্ঞানই কমবেশি অর্জন করতে হয়, করতে হয়েছে; নইলে তার জীবনযাত্রাই আটকে যেত। …মহামূর্খদের শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু নিদান দিয়ে রেখেছে, ভূগোল পড়লে বিজ্ঞান পড়তে পারবেন না, ইতিহাস পড়লে অঙ্ক পড়তে পারবেন না …ইত্যাদি ইত্যাদি।
আগের কালে দুরকম শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, কি পাশ্চাত্যে, কি প্রাচ্যে – মানুষ তৈরির শিক্ষা ও কর্ম্মী তৈরির শিক্ষা।১২ মহামূর্খেরা মানুষ তৈরির শিক্ষাকে লাটে তুলে দিয়েছে; এবং কর্ম্মী তৈরির শিক্ষাকে হাজার ভাগে ভাগ করে সমগ্র সমাজে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছে। লোকে ভাবছে, তাদের ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার প্রযুক্তিবিদ আই-টি-পেশাদার বিজনেস-ম্যানেজার…ইত্যাদি হচ্ছে। আসলে, তারা মনুষ্যত্ব অর্জ্জনের শিক্ষা না শিখে কোনো না কোনো কর্ম্মশিক্ষা লাভ করছে, কর্ম্মী হচ্ছে, দক্ষ বা অতিদক্ষ শ্রমিক হচ্ছে, মানুষ হচ্ছে না। যদি একটু আধটু মানুষ হয়, সে হয় তার পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের আবহের কারণে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে লব্ধ শিক্ষার কারণে নয়। সবাই বুঝবেন, পরমাণুবিজ্ঞানী হোক আর কমপিউটার প্রযুক্তিবিদ হোক, আসলে তারা তো অতিদক্ষ মজুর বা মিস্ত্রি মাত্র। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাল বিক্রীর বিদ্যা শিক্ষা। ডাক নাম কমার্স; সাম্প্রতিক নাম বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন…ইত্যাদি।
ছেলেমেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই কমার্সকে অঙ্গীভূত করতে এমনকি ‘দোকানদারের জাত’ ইংরেজেরও লজ্জা করেছিল। তার সুযোগ্য ভাবশিষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুষ্কর্মটির প্রচলন প্রথম করে। তারপর, সরাসরি মিস্ত্রি বানানোর বিদ্যাকে ‘টেকনলজি’ নাম দিয়ে দিকে দিকে টেকনলজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়তে থাকে তারা। অন্যান্য দেশের পণ্ডিতম্মন্য দেশনেতারা জেনে বা না-জেনে তাদেরই পথ অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশে কমার্স ও টেকনলজিকে উত্তরপ্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে জওহরলাল নেহেরু দেশের সোনার ছেলেগুলোকে মিস্ত্রি বানানোর জন্য ‘আই আই টি’ খুলে বড়ই তৃপ্তি বোধ করেন। এই সব কাণ্ডের ফলে, পরমাণুবিজ্ঞানী থেকে দক্ষশ্রমিক পর্য্যন্ত যে বিশাল কর্ম্মীদের ঝাঁক গড়ে উঠেছে, তারা যে বাংলাভাষা ছেড়ে কাজ-চালানো ইংরেজীতেই অভ্যস্ত হবে, ইংরেজীতে কথা বললেই তাদের দাম বাড়বে, সেকথা সবাই জানে। অতএব বাঙালীর কর্ম্মজগতের বড় অংশই যে বাংলাভাষা পরিত্যাগ করবে, তাতে আর আশ্চর্য্য কী!
বিপদের কেন্দ্রবিন্দু : বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ
১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে আইরিশ জাতি যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন তাঁদের ৮০ শতাংশ অধিবাসী আইরিশ ভাষায় কথাবার্ত্তা ও কাজ-কারবার চালাতে পারতেন। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই সংখ্যাটি কমতে থাকে এবং ইংরেজী ভাষার রমরমা বাড়তে থাকে; ঠিক আমাদের পশ্চিমবাংলার মতো। স্বাধীন আইরিশ প্রশাসন নানা সুবিধা দেখিয়ে তাদের কাজে-কর্ম্মে ইংরেজী ভাষাকে যথাপূর্ব্বং ব্যবহার করতে থাকে এবং নানা অসুবিধা দেখিয়ে আইরিশ ভাষাকে প্রশাসনে ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। ইংরেজীতে না লিখলে কোনো আবেদনই যেমন তাদের প্রশাসনে গ্রাহ্য হয় না, ইংরেজী না জানলে চাকরী পাওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এর বিরুদ্ধে দু-চারটে আন্দোলনও হয়। শেষমেষ ফল হয় এই যে, বিদ্যালয়গুলিতেও আইরিশ ভাষাকে টপকে ইংরেজীর রমরমা বাড়তে থাকে। আইরিশ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে দ্রুত গতিতে ইংরেজী ভাষার দখলে চলে যেতে থাকে। ২০০২ সালে পৌঁছে দেখা যাচ্ছে বর্ত্তমান আইরিশ জাতির মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ – যে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে থাকেন শুধুমাত্র তাঁরাই – আইরিশ ভাষা বলতে পারেন; কাজেকর্ম্মে প্রশাসনে আইরিশ ভাষা ব্যবহারের তো কথাই নাই। মোটকথা, পরাধীন থাকাকালীন নয়, স্বাধীন হওয়ার পরই আইরিশ জাতির নেতানেত্রীদের সিদ্ধান্ত জাতিটিকে তার নিজের ভাষা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করে মানসিক ভিখারী করে দিয়েছে।
আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও স্বাধীনতার আগে বাংলাভাষা একটুও হারাইনি, বরং অর্জ্জন করেছি, নোবেল প্রাইজ পর্য্যন্ত পেয়েছি। আমরা বাংলাভাষা হারাতে শুরু করেছি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই কাজ শুরু করেছিল, বামপন্থী নেতৃত্ব তাকে নিয়ে যায় চূড়ান্তে; তাদের সাধারণ নেতা-কর্ম্মীরা নন। এখন এসেছে তৃণমূল। তাঁরা কী করবেন এখনো আমরা জানি না। একদিকে তাঁদের স্বভাবে বাংলাভাষা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি আদর-সোহাগ, অপরদিকে ইংরেজী ভাষার প্রতি একপ্রকার অজ্ঞতাজনিত মোহ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁরা মহাকরণে রবীন্দ্রজয়ন্তী করেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের পূজা করেন, কিন্তু মহাকরণের কাজকারবার সবই চলে আগের মতোই ইংরেজীতে। তাঁরা যে শিক্ষাব্যবস্থার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মডেলটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, সেটি যে আসলে যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি কুবেরের পরিকল্পিত ভাষা-সংস্কৃতি-সমাজ ধ্বংসকারী মডেল, এই সত্য এখনও তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি বলেই মনে হয়।
…ফলে, বাংলাভাষাকে ধ্বংস করার যুদ্ধে ১৯৪৭-এর পর থেকে কুবেরের তাঁবেদার কংগ্রেস যে পতাকা বহন করে নিয়ে চলেছিল, ৭০ দশকে বামপন্থীরা বিস্তর বাগজাল বিস্তার করে সেই পতাকাই আরও উচ্চে তুলে বহন করে ২০১০ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে এবং এখন সেই একই পতাকা তৃণমূলও বহন করে নিয়ে চলেছে, নিজেদের অজান্তেই। আমাদের ধারণা, ভাষার বিষয়ে প্রচণ্ডভাবে হেনস্থাপ্রাপ্ত গ্রামবাংলা কতখানি আশা-ভরসা নিয়ে তাঁদের দিকে চেয়ে আছে, তৃণমূল নেতৃত্ব তা উপলব্ধি করতে পারেন না; জানেন না, বাংলাভাষা বিষয়ে তাঁরা কী করছেন এবং তাঁদেরকে ঘিরে থাকা শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালক বিশেষজ্ঞরা তাঁদেরকে সেকথা বুঝতেও দিচ্ছেন না। ফলে, যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলছে। শহুরে শিক্ষিত বাঙালী ‘ট্রেনটা রাইট টাইমে রান করছে তো’ থেকে ‘আমরা ভেরি প্রাউড, বিকজ উই আর বং-কানেকটেড বেঙ্গলী’ বলার যোগ্যতা অর্জ্জন করছে! আর, এভাবেই যদি চলতে থাকে, আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, বর্ত্তমান আইরিশ জাতির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব আর মাত্র দশ-পনের বছরের।
এ তো গেল বাংলাভাষার বিপদের কেন্দ্রবিন্দুর বহিরঙ্গের কথা। এবার অন্তরঙ্গের কথায় আসা যাক। এই অন্তরঙ্গের কথাটি সামনে এনে ফেলার কৃতিত্ব আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, অবশ্যই তাঁর নিজের অজ্ঞাতসারে। এ যেন অজান্তে একেবারে খুনের অকুস্থলে হানা দেওয়া। তিনি তাঁর রেলমন্ত্রিত্বের বিদায়বেলায় বিভিন্ন রেল ষ্টেশনের নতুন নতুন নামকরণ করা শুরু করলেন। তাঁর বিরোধীরা হৈ হৈ করে উঠল। পত্রপত্রিকায় দূরদর্শনে বাংলাভাষার বড় বড় পণ্ডিতেরা নানারকম বয়ান দিতে লাগলেন। সবই অজ্ঞতায় ভরা। মানববিশ্বে নামকরণের ইতিহাসটাই তাঁরা জানেন না, জানেন না নামকরণ বিষয়ে আমাদের বাংলাভাষীদের কী সম্পদশালী উত্তরাধিকার রয়েছে। স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল, বাঙালী জাতির আজ বড়ই দুর্দ্দিন। তার সমাজদেহের মাথা, তার জ্ঞানচর্চ্চাকারী শ্রেণীটি কতখানি অধঃপতিত। মুখ্যমন্ত্রী কী করবেন? তিনি তো বাঙালী জাতির নেত্রী। বাঙালী জাতির যে যোগ্যতা আছে, তা সবই তাঁর আছে এই অর্থে যে, তিনি চাইলেই বাঙালীর শ্রেষ্ঠ নদীবিশেষজ্ঞ নদী বিষয়ে, বাঙালীর শ্রেষ্ঠ কৃষিবিশেষজ্ঞ কৃষি বিষয়ে…এভাবে বাঙালী জাতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞগণ তাঁদের নিজ নিজ বিষয়ের জ্ঞানবুদ্ধি তাঁকে সরবরাহ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই হিসেবে জাতির সর্ব্বজ্ঞানের অধিকারী জাতির নেতা। নামকরণের ব্যাপারে দেখা গেল, কেউই কোনো যথাযথ তত্ত্ব দিতে পারলেন না; তিনিও কারো কোনো কথা শুনলেন না। শুনবেনই বা কেন? এ বিষয়ে কোনো তত্ত্ব তো প্রতিষ্ঠিত বাঙালী পণ্ডিতদের নেই, বর্ত্তমান বিশ্বের পণ্ডিতদের হাতেও নেই। কেন নেই?
এই কেন-র উত্তর জানতে গেলে যেখানে আমরা পৌঁছে যাই, সেটি হল সেই অকুস্থল, শিল্পবিপ্লবভিত্তিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা পাশ্চাত্যের সত্য গোপনকারী গুহ্যকরাজ কুবের তার নিজের অগ্রগতির সুবিধার জন্য মানবসভ্যতার যে মর্ম্মস্থলে প্রথম প্রাণনাশী আঘাত হেনেছিল। সেই মর্ম্মস্থলটি হল – সত্তার ভিতরেই সত্তার ক্রিয়া বা ধর্ম্ম থাকে; শব্দের ভিতরেই শব্দের মানে বা কর্ম্মধর্ম্ম থাকে। নামশব্দের ভিতরে সেই কার্য্যাবলীর কথা বলা থাকে, নামধারী যে কার্য্যাবলী করে। শব্দের বা নামশব্দের অন্তরালের সেই ইতিহাসকে খুন করে মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কারণ, সেই ইতিহাস প্রকাশ হয়ে পড়লে গুহ্যক বাঁচে না। শব্দের পিছনের ইতিহাসকে সে ভয় পায়। শব্দের নির্দ্দেশকতা গুণটুকু রেখে বাকি সব ইতিহাস ফেলে দিলেই মানুষের ভাষার শব্দ গুহ্যকরাজ কুবেরের পক্ষে স্বস্তিদায়ক হয়।
অতএব সে ঘোষণা করে, নামের কোনো মানে থাকা উচিত নয়। ডাকবার জন্য তো নাম। তার আবার মানে কী? নামের মানের দরকার কী? কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে মানবসভ্যতার রীতি ছিল, প্রতিটি শহরের, নদীর, পাহাড়ের, দেশের, মানুষেরও নাম হবে তাদের কর্ম্মধর্ম্ম বা স্বভাব অনুসারে। যে যা করে, তাই জানিয়ে দেওয়া হবে তার নামের মাধ্যমে। এর ফলে নাম শুনেই মানুষ বুঝে যাবে, যার নাম ডাকা হচ্ছে, সে কী করে বা করতে পারে। কার্য্যত এ হল ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দবিধির প্রায়োগিক রূপ, যা মানবসভ্যতা তার প্রাচীন যুগ থেকে বিশ্বের সব দেশেই অনুসরণ করে আসছিল। কিন্তু শব্দার্থ বিষয়ে সক্রেটিস প্লেটোর ব্যর্থতা এবং ক্রমে শব্দার্থচর্চার দুনিয়ায় ‘খামখেয়ালি’ (আর্বিট্রারি) অর্থের ধারণার প্রতিষ্ঠা পাশ্চাত্যকে শেখাল, নামের পেছনে কোনো অর্থ থাকে না, নেই, থাকলেও নেই। শব্দার্থের এই ভুল তত্ত্ব গুহ্যকরাজের পক্ষে বড়ই স্বস্তিদায়ক ও প্রিয় হয়ে ওঠে। ফলত, পাশ্চাত্যের শিল্পবিপ্লবোত্তর সামাজিক শক্তি বা যন্ত্ররাজ বিভূতির উপর ভর করে সেই ভুল তত্ত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, এল বাংলাতেও। আমাদের শব্দার্থজ্ঞানীরা নিজেদের উত্তরাধিকার তুলে ধরতে ব্যর্থ হলেন। নামের পেছনের কথা অন্তরালে চলে গেল।
তাছাড়া, নামের পেছনের অর্থকে সক্রিয় করে দিলে তো মানুষের জ্ঞানচক্ষু খোলা থাকবে, সে তো সমস্ত কিছু দেখে ফেলবে! সেরকম জ্ঞানচক্ষু-খোলা মানুষ তো শিল্পবিপ্লবকারী ধনতন্ত্রের শত্রু, যন্ত্ররাজ বিভূতির শত্রু। ঐ জ্ঞানচক্ষু-ওয়ালাদের হাত থেকে বাঁচতে সদ্যোজাত ইউরোপীয় ধনতন্ত্রকে তো কম লুকোচুরি করতে হয়নি। আঠারশ সালের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ইংরেজী সাহিত্যিকদের লাগাতার বাণবর্ষণের১৩ সামনে শিল্পবিপ্লবোত্তর ধনতন্ত্রকে বিস্তর ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তাই অতীতকে সে অত্যন্ত ভয় পায়। সুতরাং, ওসব ঐতিহ্য-ইত্যাদি সরিয়ে রাখো। নাম একটা হলেই হল। তার কোনো মানে থাকার দরকার নেই। শুরু হল তাৎক্ষণিক ক্ষুদ্র-উদ্দেশ্যসাধক কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্থান কাল পাত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সেকারণে অর্থহীন নাম রাখার রেওয়াজ।
তবে এক লাফে তো একেবারে অর্থহীন নামে যাওয়া যায় না, ‘পাবলিকে’ মানবে না। পাশ্চাত্যে অর্থপূর্ণ নাম থেকে কীভাবে ক্রমশ অর্থহীন নামে পৌঁছানো হল, সে উদাহরণ এখন থাক; এখন বাংলার কথাই হোক। বাংলায় অর্থহীন নাম রাখার প্রক্রিয়া শুরু হল এইভাবে – টালিসাহেবের গঞ্জ, টালিগঞ্জ; রবিবাবুর বাড়ীর রাস্তা, রবীন্দ্র সরণী। বামপন্থীরা এসে তাকে আরও নিখুঁত করে ফেলল, পশ্চিমবাংলায় জন্ম নিল অজস্র লেনিননগর, কমরেড…সরণী ইত্যাদি; স্থানের স্বভাবের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্কই থাকল না। তারপর এসে গেল গুহ্যকরাজের মার্কিন নীতি অনুসারে ফোর্থ এভিনিউ, ফিফথ এভিনিউ-এর নকলে একেবারে অর্থহীন নামের তালিকা – ৭ নং সেকটার ফাইভ, ৯ নং ট্যাঙ্ক, ১০ নং ট্যাঙ্ক … ইত্যাদি। নির্দ্দেশকতার বাইরে নামশব্দের কোনো তাৎপর্য্যই থাকল না আর। স্বভাবতই মুখস্থ করে রাখা ছাড়া এ নামশব্দ শুনে বোঝার উপায় রইল না, কার কথা বলা হচ্ছে।
এভাবে বাংলাভাষার বিপদের অন্তরঙ্গ কথাটিকে মুখ্যমন্ত্রীর নব নব নামকরণ চেষ্টা একেবারে উলঙ্গ করে দিল। জানিয়ে দিল, বাংলার বর্ত্তমান বাংলাভাষা-জ্ঞানিগণ স্থানের নামকরণের রীতিনীতি বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ। শব্দের ধর্ম্ম ও স্থানের ধর্ম্ম মিলিয়েই বিশ্বের সমস্ত স্থানের নাম রাখা হত, একথা যাঁরা জানতেন, সেই অভিনব শব্দসৃজনকারী বাংলাজ্ঞানীরা কেউ বেঁচে নেই; থাকলেও থাকেন সমাজের উপরিতল থেকে দূরে, সকলের অগোচরে। আমরা তাঁদের চিনি না। তার মানে, বর্ত্তমান বাংলার সমাজদেহের মাথায় যে জ্ঞানিগণ বিরাজ করেন, তাঁরা মধ্যমেধা বা নিম্নমেধার মানুষ। তাঁরা আমাদের সমাজদেহের হৃদয়কে বা নেতানেত্রীকে পথ দেখাতে পারছেন না। সমাজদেহের মাথার এই ব্যর্থতা এক কথায় ভয়ানক। মাথা ঠিক থাকলে তবেই তো গাড্ডায় পড়ে যাওয়া মানুষ নিজেকে উদ্ধার করতে পারে। বাংলার সমাজদেহের মাথাটি ঠিকঠাক নেই। তাকে ঘষাঘষি নাড়াচাড়া করে তার সম্বিত ফেরাতে হবে। অন্যথায় সে ঘুরে দাঁড়াবে কী করে? বাংলাভাষার বিপদের অন্তরঙ্গ কথা এটিই।
উপসংহার
বাংলাভাষার সম্পদ কোথায়, সেকথা আমরা আগেই জেনেছি; এখন জানলাম তার বিপদ কোথায়। ফলত, দশ-বারো বছরের মধ্যেই হয়তো পশ্চিমবাংলার অবস্থা হবে আয়ার্ল্যাণ্ডের মতো। আমাদের মাতৃভাষা থাকবে, কিন্তু সে মাতৃভাষা ব্যবহার করবেন গণ্ডগ্রামের ১০ শতাংশ বৃদ্ধবৃদ্ধাগণ। এর কারণ যা বোঝা গেল, তা হল কুবেরশাসিত বিশ্বায়নে ত্রস্ত এই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে মহাপ্লাবন, গ্রেট-এক্সোডাস। লোকে তাদের সমস্ত অতীত ছেড়ে পালাচ্ছে, পালাচ্ছে ভাষা ছেড়েও। …
এর থেকে মুক্তির উপায় কী? এক্ষেত্রেও বাংলাভাষী জাতিটি কি তার অগ্রণী স্বভাবের দ্বারা প্ররোচিত হবে? এবার কি সে কাজ-চালানো ইংরেজী-বাংলা হঠাও, প্রকৃত ইংরেজি বাঁচাও, প্রকৃত বাংলা বাঁচাও – এমন কথা বলে উঠবে? এবার কি সে মা মাটি মানুষের পাশাপাশি মাতৃভাষার মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত লাগাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা পরবর্ত্তী নিবন্ধে।
টীকাটিপ্পনী
1. পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে। পাঠক চাইলে আন্তর্জ্জালে আইরিশ ভাষার খবরাখবর নিয়ে নিতে পারেন।
2. যন্ত্ররাজ বিভূতি : যন্ত্ররাজ = যন্ত্রসমূহের রাজা; যে যন্ত্র অন্য সকল যন্ত্রের উপর রাজত্ব করে; যে যন্ত্রে কাজ করার সময় গান গাওয়া যায় না; যে যন্ত্রে মানুষ পর্ব্বতের (পিরামিডের) নিয়মে দলবদ্ধ হইয়া কাজ করে; যে যন্ত্রকে কমপক্ষে একটি সামাজিক গোষ্ঠী চালায়; যে যন্ত্র সমাজের ঘাড়ে ভর করে। বিভূতি = বিপরীত ভূতকরণ সক্রিয় যাহাতে; (যন্ত্ররাজকে কাজে লাগাইয়া পণ্যাদি উৎপাদনপূর্ব্বক) বিপরীত বস্তু (…বাহ্যসম্পদ) সৃজন সক্রিয় করে যে; (যন্ত্ররাজকে কাজে লাগাইয়া) জগৎকে বাহ্যসম্পদে রূপান্তরিত করে যে। = বৃহৎশিল্পের পতি, ইণ্ডাষ্ট্রিপতি। বৃহৎশিল্পকে বোঝাতে অভিনব এই ‘যন্ত্ররাজ বিভূতি’ শব্দটি সৃষ্টি করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ‘মুক্তধারা’ নাটকে।
3. রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মানুষের সভ্যতা কৃত্রিমের সহায়তা লইতে বাধ্য, সেইজন্য এই কৃত্রিম যাহাতে অভ্যাসদোষে আমাদের কর্ত্তা হইয়া না উঠে, যাহাতে আমরা নিজের গড়া সামগ্রীর চেয়ে সর্ব্বদাই উপরে মাথা তুলিয়া থাকিতে পারি, এ দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা দরকার।’
4. যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি = যন্ত্ররাজসমূহের রাজা; গুহ্যকসমূহের সম্রাট কুবের; যন্ত্ররাজ বিভূতিকে কিনিয়া লয় বা কেনাবেচা করে যে; বৃহৎশিল্পের পতিকে নিয়ন্ত্রণ করে যে; যে কখনো প্রকাশ্যে আসে না; সমাজ তাহাকে দেখিয়া ও চিনিয়া ফেলিলেই যে মরিয়া যায় বা অন্তর্দ্ধান ঘটে।
5. অন্যের ছক্কা পড়লেও সেটিকে গোপনে বদলে বা সরিয়ে দিয়ে নিজের ছক্কা দেখিয়ে দান (দানে প্রাপ্য সম্পদাদি) আত্মসাৎ করাকে বলে ‘জুয়াচুরি’ করা।
6. কলকাতার ‘আমরি-কাণ্ডে’ যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেই মালিকেরা সবাই কি অন্তরালবাসী নয়?
7. এ বিষয়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি আমাদের ‘বঙ্গযান’ গ্রন্থে।
8. গণের তন্ত্র অবশ্যই ভাল। ঝাঁকজীব-মানুষের ঝাঁক পরিচালনার স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (নেচারাল) নিয়মকে ব্যক্ত (explicit) রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তার ভিতরে কুবের ঢুকে গিয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গণতন্ত্রকে ছিদ্রসম্পন্ন, ফোঁপরা, কানা, ফুটো গণতন্ত্রে পরিণত করে তাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আর তা করার উপায়স্বরূপ তাতে ঢোকানো হয়েছে দলতন্ত্র ও গোপন-ভোটব্যবস্থা। দল গণতন্ত্র চর্চ্চকারী মানুষকে খর্ব্ব ও নষ্ট করে দেয়। দল কোনো মনুষ্যত্ব-বিরোধী সিদ্ধান্ত নিলেও দলের সদস্যকে তা মানতে হয়, আর তৎক্ষণাৎ তার মনুষ্যত্ব খর্ব্ব হতে থাকে। কেউ (ভারতের কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট প্রভৃতি) কোনো পার্টি করে মানেই সে খর্ব্ব-মনুষ্যত্ববান মানুষ, ছোটলোক। আর, গোপন ভোটব্যবস্থা জনতার সঙ্গে নেতার নাড়ির সম্পর্কটিই ছিন্ন করে দেয়। ফলে, শাসকের সঙ্গে শাসিতের প্রেমবন্ধন নষ্ট হয়ে উভয়ের মাঝে যে ফাঁক তৈরি হয়, সেখানে ঢুকে পড়ে গুহ্যকরাজ কুবের। নির্ব্বাচিত নেতাকে দিয়ে গণতন্ত্রের নামে প্রকৃত শাসন চালায় ঐ কুবের। এ বিষয়ে আমাদের ‘…জ্যোতি থেকে মমতায়’, ‘অবিকল্পসন্ধান…’, ‘বঙ্গযান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
9. যতদূর জানি, ১৯৬০ সাল পর্য্যন্ত বঙ্গসমাজে, বিশেষত গ্রামে, চাকরী করাকে কমবেশী ঘৃণা করা হত; বলা হত, যে মানুষ পরের হুকুম তামিল করার কাজ করে, চাকরের কাজ করে, তার মনটা চাকরের মতো হয়ে যায়, তার মনুষ্যত্ব খানিকটা খর্ব্ব হয়ে যায়। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, আগের কালে কেউ কারও কাছে কাজ করত না। করত, অবশ্যই করত। কিন্তু তার মূল সম্বন্ধটিই ছিল ভিন্ন প্রকারের। তাতে মনুষ্যত্ব খর্ব্ব হওয়ার পথ রুদ্ধ ছিল। অতি প্রাচীন কাল থেকে স্বাধীনতাপূর্ব্ব কাল অবধি নিয়োগকর্ত্তা ও নিযুক্তের সম্বন্ধের যে ইতিহাসটি পাওয়া যায়, তাতে ‘বরণ করা’ বলে একটি প্রথা লাগাতার বলবৎ ছিল। দখিনা মজুরকে যেমন বরণ করে নিতে হত, এলাকার উত্তরপ্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষার জন্য নিয়োজিত অধ্যাপককেও বরণ করে নিতে হত। এবং কোনো কারণে ‘অবমানিত’ বোধ করলে তাঁরা তাঁদের কাজ ত্যাগ করে চলে যেতেন। ‘পুরাতন ভৃত্য’ ‘রূপো-কাকা’দের সঙ্গে আবেগ, শ্রদ্ধা ও স্নেহমমতার বা সমমর্য্যাদার সম্বন্ধ ছিল। ইংরেজের শাসনে এই বোধ খর্ব্ব হতে শুরু করে। তারা ‘হুকুমের চাকর’ নিয়োগ করা শুরু করেন, যদিও সেটা করতে তাঁদের প্রায় ১৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর আজ?
10. যেমন সাম্প্রতিক পশ্চিমবাংলায় যারা ‘কৃষি চাই, শিল্প চাই’ বলেন, তাঁরা আসলে ‘শিল্প’ কথাটির ভিতরে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ‘বৃহৎশিল্প চাই’ কথাটিকে লুকিয়ে রাখেন। একালের অ্যাকাডেমী-শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ও নেতারা সভায় বা দূরদর্শনে নিয়মিত আবির্ভূত হয়ে অবোধ শিশুর মতো নানাভাবে যন্ত্ররাজের ওকালতি করে থাকেন। একটি নমুনা তুলে দিই। ‘ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্পের মাধ্যমেই, যা শিল্পপতিকে আরও আরও ধনী করে, একমাত্র তার মাধ্যমেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হতে পারে, এটা কি পরীক্ষিত সত্য নয়? পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্ত্তী দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নতি … কি তাই-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না?’ তথাগত রায়। আনন্দবাজার পত্রিকা ২০.০৬.২০১৩।
11. প্রাচীন মুনি ঋষি আউলিয়া আম্বিয়া সেণ্ট সাধু থেকে আধুনিক রবীন্দ্রনাথ নজরুল পর্য্যন্ত আমাদের মনীষীরা সবাই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়েই আমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো তাঁদের কারও কারও অধিকারে কমবেশী থাকলেও, সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানের আলোর অর্জ্জনই ছিল তাঁদের প্রধান অবলম্বন। এই জ্ঞানের স্বরূপ কেমন, উদাহরণ দিয়ে বলতে হলে বলা যায় – বিগত সুনামিতে জীবজন্তু ও আদিবাসী মানুষেরা মরেনি। তারা তাদের স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানের দ্বারা আগেভাগেই টের পেয়ে গিয়েছিল যে সুনামী আসছে। ছুটে গিয়ে উঁচু জায়গায় উঠে আত্মরক্ষা করেছিল তারা। মরেছিল সভ্য দুনিয়ার শিক্ষিত মানুষেরা। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা আমাদের ‘সুন্দর হে সুন্দর’ গ্রন্থে করেছি।
12. আমাদের ‘অবিকল্পসন্ধান …’ গ্রন্থে সংকলিত ‘উত্তরপ্রজন্মের লালনপালন ও শিক্ষাদীক্ষা’ শীর্ষক একটি বড় নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, লালনপালন বা শিক্ষাদীক্ষা বলতে ঠিক কী বোঝায়, কীভাবে তা করতে হয়, করা উচিত।
13. শিল্পবিপ্লবের চেয়ে বড় ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এই ঘটনায় বিশ্বমানবের সমাজশরীরের মাথাটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে খারাপ হয়ে যায়। জড়জগৎকে জীবজগৎকে এবং নিজেকে সে খাবলাতে লাগে উন্মাদের মতো। তার দাপাদাপি গিয়ে ঠেকে দুইখানি বিশ্বযুদ্ধে। সেই উন্মাদকে ঠেকানোর আর কোনো শক্তি এখন নেই। নিজের অনন্ত ক্ষুধা শান্ত করতে পারলে যদি সে বেঁচে যায়, এই আশায় সে পৃথিবীটাকেই গ্রাস করতে লেগেছে। তাতে যে তারও মরণ অবশ্যম্ভাবী, সেকথা ভাবার অবস্থায় সে নেই।
মানবসভ্যতার মশাল যতদিন বৌদ্ধ ভারত, খ্রীষ্টান পাশ্চাত্য, ও মুসলমান মধ্যপ্রাচ্য বহন করছিল, ততদিন এ দুর্ঘটনা ঘটেনি; ঘটল সেই মশাল যখন হাতে তুলে নিল ‘আধুনিক ইউরোপ’। মানবজাতিকে সর্ব্বপ্রকারের বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলত যে জ্ঞানযোগী ও তার সহকারী কর্ম্মযোগী সম্প্রদায়, তাদের ‘মাথামুটে’ বানানোর প্রস্তাব দিল ইউরোপের নবোদ্ভূত যন্ত্ররাজ বিভূতি। একদল নিম্নমানের দেহবাদী জ্ঞানজীবী সেই প্রস্তাব মেনেও নিল এবং তাদের সহায়তায় যন্ত্ররাজ বিশ্বজগৎকে খাবলাতে লেগে পড়ল। ইউরোপের মহান জ্ঞানব্রতীরা হাহাকার করে উঠলেন। ডক্টর জনসন, অলিভার গোল্ডস্মিথ, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়র্থ, চার্লস ল্যাম্ব, কোলরিজ, শেলী, চার্লস ডিকেন্স, টমাস কার্লাইল, জন রাষ্কিন…প্রমুখ হৃদয়বান মানুষেরা ককিয়ে উঠলেন নানা স্বরে – হায়, এ কোন অশুভের গ্রাসে চলেছি, চলেছে আমার দেশ! বাহ্যসম্পদ অর্জ্জিত হচ্ছে, টাকা জমে জমে পাহাড় হচ্ছে, মানুষ ক্ষয়ে ক্ষয়ে গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে! যে বলিষ্ঠ কৃষকসমাজ আমাদের মাতৃভূমির গৌরব, তারা, তারা যদি এমন করে ধ্বংস হয়ে চলে যায়, আর তো ফিরবে না কোনো দিন! হায় হায়, দেখো দেখো! যার সবচেয়ে বেশী টাকা সেই আজ আমাদের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ! আজ প্রকৃতির মধ্যে কোনো সৌরভ নেই, এখন শুধু জোচ্চুরি চামারী করে টাকা কামাও, ওড়াও, এটাই দস্তুর, মান্য, পূজ্য! সরল জীবন উচ্চ চিন্তা উবে গেছে শূন্যে। হায় হায়, যন্ত্রের এই রাজত্বে কর্ম্মী মানুষগুলোর মনুষ্যত্ব চোখে পড়ছে না। একটা ভূমিকম্প এসে কেন এই কাপড়ের মিলগুলোকে গিলে ফেলছে না! …
“Ill fares the land, to hastening ills a prey,
Where wealth accumulates and men decay;
Princes and lords may flourish, or may fade;
A breath can make them as a breath has made;
But a bold peasantry, their countries pride,
When once destroyed, can never be supplied.”
“The wealthiest man among us is the best;
No grandeur now in Nature or in book
Delights us. Rapine, avarice, expense,
This is idolatry; and these we adore;
Plain living and high thinking are no more.”
“Man, I verily believe, is out of his element as long as he is operative. I am altogether for the life contemplative. Will no kindly earthquake come and swallow up those accursed cotton-mills?”
কিন্তু সেই সমস্ত হাহাকার ব্যর্থ হল। বড়-ইংরেজকে অবজ্ঞা করে, তার ব্যাপারে নীরব থেকে, গোপনে তাকে অবনমিত করে, তাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হতে লাগল; যন্ত্ররাজ বিভূতির কৃপায় রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল ‘মাথামুটে’ ছোট-ইংরেজের। মানুষ যেমন দেহবাদী, ধনসম্পদ-লোভী, ছোট মনের মানুষ হয়ে গেল, বিশ্বমানবও তেমনি ছোট হয়ে যেতে লাগল। আমাদের বাংলায় রবীন্দ্রনাথকেও অবজ্ঞা করে, তাঁর বক্তব্য বিষয়ে নীরব থেকে, গোপনে তাঁকে শিক্ষাজগৎ থেকে সরিয়ে দিয়ে একই কুকর্ম্ম করল সেই মাথামুটেরা।
—