০
৬৯১ বার পঠিত
ক্ষুদিরামের লক্ষ্য ছিলো বিচারককে বোমা মেরে হত্যা করা। বোমা ছোড়া হয়েছিলও। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট সে বোমায় মারা পড়েছিলেন দুই ইংরেজ মহিলা। ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিলো সেই হত্যার দায়ে। সবাই ক্ষুদিরামকে মহিমান্বিত করেন, কিন্তু ওই দুই মহিলার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন না। মহিলা এবং শিশু, বিরোধ আর বিদ্বেষের বাইরে। এমন কী মধ্যযুগের যুদ্ধেও তা মানা হতো। নারী ও শিশু হত্যাকে কাপুরুষোচিত আখ্যা দেয়া হতো, এখনো হয়। ইতিহাসে অনেক বর্বর ও অযোগ্য শাসককে দেখা গেছে, নারী ও শিশুকে মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে। শাসক হোক আর শোষিতই হোক নারী ও শিশুকে হত্যা সকল নীতির বাইরে। সুতরাং বিপ্লবের সুফলের পাশাপাশি তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকেও টেনে আনা উচিত। ইতিহাসের আলোচনা নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন।
বয়সে উনিশ হয়ে উঠেনি এমন একজনকে দিয়ে বিচারককে হত্যার মতন পরিকল্পনা যে গোষ্ঠী আটতে পারে, তাদের নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। অপ্রাপ্ত বয়স এবং চিন্তার একজন তরুণকে দিয়ে এমন একটা কাজ করানোর পরিকল্পনাও সুস্থতার মধ্যে পড়ে কিনা, তাও ভেবে দেখা দরকার। আইএস এর মত এখনকার মনোবিকারগ্রস্ত জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো সেই কাজই করছে।
এই লিখা লিখতাম না। কিন্তু ভারতীয় এক নারীবাদী’র লিখা দেখেই লিখতে ইচ্ছা হলো। দুজন নারী মারা গেলেন তাদের নিয়ে সেই মহিলার কোন দুঃখ নেই। তাদের মৃত্যুতে তার সমবেদনা নেই, অথচ তিনি নারীবাদী। একজনকে মহান করতে গেলে অন্যজনকে ছোট বা উপেক্ষা করতে হবে এমন শিক্ষা কখনো কল্যাণকর হতে পারে না। অনেক ইংরেজ প্রশাসকের প্রশংসা ভারতের অনেকেই করেছেন। রবি বাবুও বাদ যাননি। এখনো কেউ কেউ করেন। তখন তো তাদের বিপ্লবের চেতনায় টান পড়ে না। কিন্তু বোমায় নিহত দুই নারীর বেলায় তাদের যত অনাগ্রহ। বলিহারি এনাদের।
দক্ষিণ এশিয়ায় আবহমানকাল ধরেই এক ধরণের অদ্ভুত নীতিবাদের চর্চা চলছে। অবশ্য চাণক্যের মতন কাল্ট প্রধানের ফ্যান ফলোয়াররা এর থেকে বেশি আর কী নীতিবাগিশ হতে পারে। ষড়যন্ত্রের স্বার্থক রূপকার ছিলেন চাণক্য। মলয়কেতুকে পরাস্ত করার কাহিনি যার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। তারপরেও চাণক্যকে মহিমান্বিত করে ভারতীয় মিথ। নচিকেতা তার গানে যেমনটা বলেছেন, ‘রাম যদি হেরে যেতো রাবণ দেবতা হতো’। তেমনি চাণক্য জিতে গিয়ে দেব-সমান মর্যাদা পেয়েছেন।
আমার এ লেখায় মাথামোটারা ইংরেজদের পক্ষপাতিত্বের গন্ধ পাবেন। বলবেন, ইংরেজদের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হয়েছিলো বলেই বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করেছে। মাথামোটাদের এই হয়। আরে, ইংরেজদের কাছ থেকে আমাদের যদি স্বাধীনতা লাভ করতে হতো, তাহলে আমরা ১৯৪৭-তেই স্বাধীনতা পেতাম, ’৭১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। আমাদের সে স্বাধীনতা পাওয়া হয়নি তৎকালীন ভারতীয় নেতাদের কারণে। সে সময় স্বাধীনতা পেলে আমাদের মানচিত্রের সীমানা বিস্তৃত হতো আরো অনেকদূর। যে কাজটা নেপাল এবার করে দেখিয়েছে নতুন মানচিত্র এঁকে। আমাদের প্রথম স্বাধীনতা বেহাত হয়েছে ভারতের কারণে। সেই স্বাধীনতাই আমরা যুদ্ধ করে অধিকার করেছি পাকিস্তানের কাছ থেকে। তারপরেও আমরা আমাদের পূর্ণ মানচিত্র পাইনি।
যা হোক, পূর্ণ মানচিত্রের কথাটা বলি, যা আঁকা হয়েছিলো প্রথম ১৯০৩ সালে। যা স্বীকৃত হয় ১৯০৫ সালে। তখন ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গকে ৬টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। ঢাকা বিভাগের অধীন জেলা সমূহ ছিলো- ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও সুন্দরবন। চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন জেলা ছিলো- চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, কুমিল্লা ও নোয়াখালী। রাজশাহীর অধীন ছিলো- রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, মালদহ ও জলপাইগুড়ি। সুরমা উপত্যকা ও পার্বত্য বিভাগে ছিলো- সিলেট, কাছাড়, লুসাই পার্বত্য জেলা, নাগা পার্বত্য জেলা, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পার্বত্য জেলা ও গারো পার্বত্য জেলা। আসাম উপত্যকা’র অধীন ছিলো- গোয়ালপাড়া, কামরূপ, দাররাং, নওগাও, শিবসাগর ও লখিমপুর জেলা। আরেক বিভাগের অধীনে ছিলো- পার্বত্য ত্রিপুরা ও মনিপুর। বোঝেন অবস্থাটা। চিন্তা করুন মানচিত্রের আকারটা। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু এমন মানচিত্রের চিত্রটা বাস্তব হয়ে উঠেনি। আরেকটু উল্লেখ করে নিই। ১৭৬৫ সাল থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা পূর্ববঙ্গের সাথে যুক্ত ছিলো। সাম্রাজ্যবাদের আঁকা নকশায় বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের প্রাবল্যে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে যায়। আমরা হারাই অঙ্গীভূত ভূখন্ড।
ইতিহাসের পাঠ নিরপেক্ষই হওয়া উচিত। তাই কথা উঠিয়েছিলাম ক্ষুদিরামের বোমায় নিহত দুই নারী বিষয়ে। ‘ইজম’ না বুঝে ‘ফেমিনিজম’ কায়েমের কিম্ভুত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। সত্যকে এড়িয়ে যাবার বিপক্ষে। জানি প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে এই লেখা। প্রচলিত এবং প্রকৃত, এই দুটি স্রোতের ধারা জানান দিতেই এমন প্রচেষ্টা। যা অব্যাহত থাকবে এবং তা বিরুদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন