১৬০৮ বার পঠিত
টেকনিক্যালি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের যে রায় টা দিয়েছে, সেইটা ভারতের পারস্পেক্টিভে ঠিক আছে। কারণ, এই রায় যদি ডমিনেন্ট ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে যেত তাহলে এই মূহুর্তে হয়তো ভারতে অনেকগুলো দাঙ্গা হতো তাতে কয়েকহাজার মুসলমানের প্রাণ যেত।
এইটা আমি জাস্টিফাই করতেছি না, জাস্ট বলতেছি, পৃথিবীর সবদেশে এইভাবেই সিস্টেম কাজ করে। পৃথিবীর কোন কোর্ট ওই রাষ্ট্রের ডমিনেন্ট ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে যেতে পারে কীনা আমার জানা নাই। আপনি বলতে পারেন, ইকুয়ালিটির কী হবে, জাস্টিসের কী হবে।
ইকুয়ালিটি এবং জাস্টিস উভয়েই একটা মিথ। এইটা অবশ্যই দাবি করে যেতে হবে। কিন্ত এইটাও বুঝতে হবে জাস্টিস এবং ইকুয়ালিটি প্রতিটি রাষ্ট্রের ডমিনেন্ট ন্যারেটিভের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে নির্ধারিত হয়।
পাশ্চাত্যের কথা আপনি বলবেন, ইউরোপের কথা বলবেন। দেখবেন ফ্রান্সের মত দেশে মুসলমানদের টার্গেট করে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাকি অনেক দেশে যেখানে ইসলাম বিরোধী ডিসকোর্সে সমাজে মেইনস্ট্রিম হয়েছে, সেইসব দেশেও রাষ্ট্র নিজে থেকে তার ইকুয়ালিটি এবং জাস্টিসের সোকল্ড ফ্রেমওয়ার্ক ভেঙ্গে নিপীড়ক আইন করছে।
যারা ইকুয়ালিটি এবং জাস্টিসকে খুবই শুদ্ধভাবে দেখেন, যারা মনে করেন সংবিধান-বিচার-আইন এইগুলো দিয়ে জাস্টিস এবং ইকুয়ালিটি বণ্টন করা যায়, তারা দুনিয়াটাকে এপলিটিকালি দেখেন। কারণ, রাষ্ট্রের ডোমিনেন্ট ডিসকোর্সের মধ্যে সংবিধান এবং গঠনতন্ত্র অথবা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়,এবং কোর্ট সেই আইন মেনেই চলে। এবং ডোমিনেন্ট ন্যারেটিভের অনুভুতিকে মেনে নিয়ে, বিচার নিশ্চিত করা হয়।
পাশ্চাত্যের ডোমিনেন্ট ন্যারেটিভ এমনভাবে সাজানো, তাতে তারা নিজের দেশে ইকুয়ালিটি এবং জাস্টিস রাখে। কিন্ত তাদের সামরিক বাহিনী জ্বালানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যে, মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে যখন লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমান মারে, কোন কোর্ট সেই গণহত্যাকারী জর্জ বুশের বিচার করে না।
কিন্ত আমাদের দেশের সেক্যুলাররা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যেন ন্যায়বিচার পান, এইজন্য কান্তে কান্তে মরতেছে। কারন, ফ্রিডম অফ স্পিচ, হুইসেল ব্লোয়ার এইগুলো পাশ্চাত্যের ডোমিনেন্ট ন্যারেটিভের প্রশ্ন। ১ মিলিয়ন মানুষ হত্যার জন্যে, বুশের বিচার বা লিবিয়াকে ধ্বংস করার জন্যে ওবামার বিচার ওদের ন্যারেটিভে নাই, তাই সেইটা নিয়ে কোন কোর্ট কিছু করে না।
এই আলাপে আমি ভারত রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠাকে জাস্টিফাই করছিনা।
বরং বলতেছি যে, কোন রাষ্ট্রে ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ যদি এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তাকে কাউন্টার করার মত আর কোন ডিসকোর্স রাষ্ট্রে নাই তখই একটা রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।
আপনি সেই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বলতে পারবেন, যে রাষ্ট্রে কোন একটা সিঙ্গেল আইডোলজি ডোমিনেন্ট ন্যারেটিভ হিসেবে রাষ্ট্রের সকল স্পেয়ার দখল করে নেয় না। যেখানে চার-পাঁচটা প্যারালাল কম্পেটিং আইডলজি আছে, যার প্রত্যেকটাই শক্তিশালী। সেই রাষ্ট্রটাই বাস্তবিক অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে।
ভারত একসময় গণতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু মোদির হাত ধরে গত কয়েকবছরে ভারতের হিন্দুইজমের একটা সিঙ্গেল আইডোলজি সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
একইসাথে বাংলাদেশও একসময় কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু এখন বিগত কয়েকবছরে একটা ডমিনেন্ট আইডোলজিকে সামনে এনে এটাকে প্রশাসন ক্ষমতা কাঠামো, মিলিটারি, পুলিশ, পলিটিক্স, মিডিয়া; সবজায়গায় একমাত্র গ্রহণযোগ্য আইডলজি হিসেবে ইনফিল্ট্রেট করানো হয়েছে। এবং বাকি সব আইডিলজি ধ্বংস করা হয়েছে।
এবং এর প্রভাব যে কী ভয়ঙ্কর সেটা সমাজে পলিটিক্স, অর্থনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, বিচারব্যবস্থাসহ সবকিছুতেই আমরা দেখতে পাই।
এখানে অনেকে ডমিনেন্ট ন্যারেটিভের আধিপত্যের সাথে মাইনরিটির ওপরে মেজরিটির আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টা গুলিয়ে ফেলেন।
মেজরিটি সবসময়ে মাইনরিটিকে অত্যাচার করে- এই সংখ্যাভিত্তিক আলোচনা থেকে যারা ক্ষমতাকে দেখেন তারা আসলে আধুনিক রাষ্ট্রের ন্যারেটিভ কীভাবে নির্মাণ হয় এবং ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ কীভাবে ক্ষমতা উৎপাদন করে সেইটা সম্পর্কে অসচেতন।
ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ সবসময়ে মেজরেটেরিয়ান হয় না। ভারতের ডমিনেন্ট আইডোলজি মোদির হাতে বর্তমানে হিন্দুইজম। এইটা মেজরিটেরিয়ান ন্যারেটিভ।
কিন্তু বাংলাদেশের ডমিনেন্ট আইডোলজি সেক্যুলারিজম এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এইটা মেজরেটেরিয়ান না। এইটা সমাজের খুব ক্ষুদ্র অংশের আইডলজি। কিন্ত, তাদের বয়ানই বাংলাদেশের রাষ্ট্রে ক্ষমতা, কোর্ট এবং কোনটা ঠিক এবং ভুল সেই প্রশ্নটি নিয়ন্ত্রণ করে।
ঠিক এই কারণেই কিন্তু আমরা বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের হাতে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টাকে, ভারতের হিন্দুদের হাতে মুসলমানদের নির্যাতনের সাথে একটু আলাদাভাবে দেখি। কারণ, এখানে সেক্যুলার এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইসলামিজম থেকে ক্ষমতার পারটিসিপ্সনের জায়গায় অনেক বেশী শক্তিশালী ন্যারেটিভ। শুধু এখন নাহ, বিগত ৪ দশকেই এইটা শক্তিশালী ছিল।
তো এই ডমিনেন্ট ন্যারেটিভের সেক্যুলাররাই বাংলাদেশে তারা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলা তালেবান হবে ভয় দেখিয়ে, তাদের ক্ষমতা ধরে রাখে এবং এর বিনিময়ে তারা যে রাষ্ট্র তৈরি করে, সেইটা আফগানিস্তান থেকে উন্নত কিছু নয়।
মুল পয়েন্ট যেইটা বলছিলাম, ভারতে বাবরি মসজিদের রায় তাদের ডোমিনেন্ট ন্যারেটিভকে খুশি করছে। এইটা কাম্য না হইলেও, এইটা না হলে একটা সংঘাত হত, তাতে মুসলমানেরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত।
এইটা আমি জাস্টিফাই করছি না, জাস্ট বলছি পৃথিবীর সবদেশে এইভাবেই সিস্টেম কাজ করে। লড়াইটা কোর্টে নয়, লড়াইটা বয়ানে।
এই বয়ানে যদি আপনি দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে কোর্টের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে কোন লাভ নাই। কারণ, কোর্ট ন্যায়বিচার দেয় না, বয়ান ন্যায়বিচার দেয়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন