আমার বাবা দেখতে উত্তম কুমারের চেয়ে সুদর্শন ছিলেন। আব্বা ডাক বিভাগের মাঝারি গোছের সরকারি চাকরি করতেন। আমরা ভাইবোন কেউ-ই অতি সুদর্শন আব্বুর মত হইনি। খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে আছে আমার। রিউমেটিক ফেবারে পড়েছিলাম। আমাকে প্রতি সন্ধ্যায় একটি ইঞ্জেকশন দেয়া হোত। খুব কস্ট হোত সেটি নিতে। আব্বু আমাকে কোলের ওপর বসিয়ে রেখে বলতো, এইতো আমার সাহসি ছেলে। এটুকু ইঞ্জেকশনের সুচ পিপড়ার কামড়ের চেয়ে কম ব্যাথ্যা লাগবে। আমি আব্বুর দিতে তাকিয়ে হাত পেতে দিতাম। খুব কস্ট হোত, কিন্তু মুখে হাসি ধরে রাখতাম।
সরকারি বড় বাসা পেতো আব্বু। বাসা থেকে স্কুল একদম কাছে ছিলো। পোস্ট অফিসের কোয়ার্টারের প্রাচীরের সামনেই ছিলো স্কুলের প্রাচীর। স্কুলে যেতে চাইতাম না। আমার একটা বড় ডানোর কৌটা ছিলো। ওটাতে আব্বু চকলেট ভরে রাখতো। শুধু স্কুলে গেলেই সেই কৌটাটা আমাকে দেয়া হোত।
আমি আব্বুর মত আদৌ রুপবান নই। কিন্তু বাচ্চাকালে সম্ভবত সব শিশুদের সুন্দর দেখায়। আমাকে দেখলেই আপুরা নাক, মুখ টিপে দিতো। আলী আহসান কাকু নামে একজন পুলিশ ছিলেন। তিনিতো প্রায় আমাকে চুমু খেতেন। একদিন আব্বু দেখে ফেলে কড়া ধমক দিলেন। এরপর থেকে পুলিশ কাকু আমার থেকে দুরে থাকতেন। আজ বুঝি, এই চুমু নিছক কোন স্নেহ নয়, অবদমিত বহুদিনের কাম।
যে দিন আব্বুর হার্ট অ্যাটাক হলো, সেই রাতেই তিনি আমাকে আম ও দুধ দিয়ে ভাত মেখে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। বারবার বলছিলেন, বড় হচ্ছিস আর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিচ্ছিস। আব্বু মারা যাবার পর আমি আর কখনোই আম দুধ ভাত খাইনি। এমন কী দুধ ভাত খাইনি। সে কারণে আস্তে আস্তে আমার লেকটোজেন ইনটলারেন্স বেড়েছে। আর এখন যদি দুধ খাই তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আব্বু মারা যাবার মধ্য দিয়ে আমার প্রিয় খাবারেরও মৃত্যু ঘটেছে।
মুজিববাদী থেকে বামপন্থা
আব্বু ছিলেন ঘোর আওয়ামী লীগ চিন্তার অনুসারী। মার্চে তিনি ঢাকায় ছিলেন কোন একটি ট্রেনিংয়ের জন্য। ট্রেনিং থেকে বাঁশ নিয়ে তিনি ৭ মার্চের ভাষন শুনতে গিয়েছিলেন। যখন শেখ মুজিবের ভাষনের মাঝে ভিডিওতে লাখ মানুষ বাঁশ উচিয়ে গর্জন করে তখন মনে হয় ওই ভিড়ের মধ্যে আমার আব্বাজানও আছেন।
স্বাধীনতার সময় যশোরে আব্বার পোস্টিং ছিলো। একদিন এসে আব্বাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেলেন। মা তখন অন্তসত্বা। বাসায় একা কেঁদে কেটে অস্থির। কারণ যাকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে আর ফিরছে না। আব্বাকে মিলিটারিরা ছেড়ে দিলো বিকেলের দিকে। আব্বা বাসায় ফিরে মা, বড় ভাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন গ্রামের বাড়ির দিকে। বড় ভাইয়ের তখন কতইবা বয়স। তবে আসার আগে পোস্ট অফিসে রাখা সরকারি সব অর্থ তিনি সাথে করে আনলেন। তখন সাধারণ মানুষের সব লেনদেন হোত পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। আজকের দিনের মত ব্যাংকিং প্রথা ছড়িয়ে পড়েনি।
সে কত টাকা হবে? বহু টাকা। ব্যাগভর্তী টাকা। যশোর থেকে হেটে দুদিন পরে নড়াইলের লোহাগড়ার তালবাড়িয়া গ্রামে মানে আমার মামাবাড়ি পৌছালেন। চারিদিকে তখন নকশালপন্থিরা। আমার নানা ধলামিয়া শেখের বাবা পাচকড়ি শেখ ছিলো ব্রিটিশদের নায়েব। এলাকার সব থেকে প্রভাবশালী ও বিত্তবান মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই জোতদার ছিলেন। নকশালরা নানাজানের কাছে এসেছেন। আজ যিনি নড়াইলের লোহাগড়া আসনের সংসদ সদস্য সেই শেখ হাফিজুর রহমান নানার কাছে যুদ্ধের জন্য বন্দুক চেয়েছিলেন। কিন্তু অভিজাত নানা বন্দুক দেননি। নকশাল হাফিজ ভাই নানাকে সাজোড়ে থাপ্পড় মেরে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে আমার নানা বাড়ির চৌদ্দ পুরুষ নকশাল ও কমিউনিস্টদের ঘেন্না করে।
বাবা এতোগুলো টাকা মাটির তলায় রেখেছিলেন। পরে দেশ স্বাধীন হলে সেই টাকা তিনি আবার সরকারি কোষাগারে ফেরত দেন। মায়ের কাছে এসব গল্প শোনা। কিন্তু বাবার বহু সহকর্মী তাদের কাছে রাখা সরকারি অর্থ আর ফেরত দেননি। মেরে দিয়েছেন। বলেছেন, টাকা লুট হয়ে গেছে। যশোরেও ট্রেজারি লুট হয়েছিলো। কথিত লুটের নামে মেরে দেয়া সেই টাকা দিয়ে তারা বাড়ি গাড়ি করেছেন, সেই গল্প মায়ের কাছে শুনেছি।
সেই মুজিব ভক্ত বাবা বড় ছেলের বিপ্লবের নেশায় নিজেকে পরিবর্তন করে বামপন্থি বনে গেলেন। অথচ বাবার কাছের মানুষরা নকশাল ছিলেন সেও ওই পথে যেতে পারতো যাইনি। নাকি শেষ বয়সে এসে আব্বাজান আসলে ছেলের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন সেটা আর জানা যায়নি।
স্বাধীনতার আগেই এলাকা থেকে নকশালদের ভাগিয়ে দিয়েছিলো মুজিব বাহিনী। এলাকার এরিয়া কমান্ডার ছিলেন আমার খালু। আমার নানার সাত মেয়ে। চতুর্থ মেয়ের স্বামী দাউদ মৃধার কাছে পরাস্ত হলেন নকশালরা। ভিষন যুদ্ধ। খালুর হাতে নকশালদের ছোড়া গুলি লেগেছিলো। ওই অবস্থায় খালু এসে ওঠেন মামা বাড়িতে। মায়ের বিছানার নিচে খালুকে শুয়ে দিয়ে তার উপর মা বিছানা করে শুয়েছিলেন। অন্তসত্বা মাকে দেখে নকশালরা ফিরে যায়। বেচে যান খালুজান। এরপরেই এলাকা দখল করে নেয় মুজিব বাহিনী। তবে সেই মুক্তিযোদ্ধা খালু গত বছর মারা গেলে অবশ্য কোন মুজিববাদীকে সেখানে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রীয় সম্মানতো দুরে থাক।
স্বাধীনতার কিছুদিন পরে আমার মেজ ভাইয়ের জন্ম। এ অবস্থায় ডাকাত পড়েছে বাড়িতে। মা, আমার দাদি বাগানে আশ্রয় নিয়েছেন। ডাকাতদের একজন মায়ের চেনা। তিনি আমার খালুর আপন ভাই। খালুর সাথে তিনিও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মায়ের অনেক গহনা ছিলো। ডাকাতরা সে গহন নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনা বাবাকে বহুবার বলেছেন মা। গহনার জন্য কেদেছেন। বাবা বলেছেন, গহনা দিয়ে কি হয়? মানুষের চেয়ে কি গহনা বড়?
হ্যা বাবা, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই পৃথিবীতে। গহনাতো সেখানে সামান্য একটা মেটাল।
নব্বই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় আমাদের এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা ছিলো বামপন্থিদের। উপজেলা নির্বাচনে বামপন্থিদের প্রার্থী হাফিজ ভাই এখন যিনি এমপি তিনি দাড়ালেন হাঁস মার্কা নিয়ে। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী খসরুজ্জামান দাঁড়ালেন জাহাজ মার্কা নিয়ে। বামপন্থিরা হারিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে। এই নির্বাচনে আব্বা খুব খেটেছেন। তখন তিনি সরকারি চাকরিতে নেই। স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। বড় বড় সমাবেশ হয়, আমি আব্বাজানের হাত ধরে ময়দানে দাড়িয়ে থাকি। চারপাশ থেকে হাজার হাজার লাল পতাকা আসে নিয়ে মানুষ আসে, ময়দান ভরে যায়। মানুষের স্লোগানে কম্পিত হয় আকাশ। আব্বার হাত ধরে দাড়িয়ে থাকতে আমার যে কি ভালো লাগে? মনে হয় এই হাত যেনো শত সহস্র বছরের বন্ধন।
সুবজ ঘাসের নিচে তাকে রেখে এলাম
আমি একটি ধ্রুপদি মফম্বল শহরে বড় হয়েছি। পুরানো রাজবাড়িটি ছিলো বিশাল। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আব্বা এই বাড়িতে আমাদের নিয়ে ওঠেছিলেন। গ্রামে ফিরে যাননি। সম্ভবত আমাদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে। গ্রাম থেকে শহরের দুরত্ব বেশ ছিলো। তাছাড়া সড়কও ছিলো না বলতে গেলে। আমাদের বাড়িটি আক্ষরিক অর্থেই একটি রাজবাড়ি। দোতলা ভবন। লাগোয়া বিশাল পুকুর। আর তার পরেই নদী। বাড়ির সামনে ছোট একটা মাঠ। এমন ভ‚বনে আমি বেড়ে ওঠেছি।
জোসনায় যখন চরাচর প্লাবিত হোত তখন বাড়িটিকে আমার পালতোলা একটা জাহাজ মনে হোত। যেনো বাড়িটি এখনি ছোটা শুরু করবে। যার মাথায় উড়ে যাওয়া গ্রীক দেবি মূর্তীর ভাস্কর্য্য অনেকটা আরবী মাইথোলজির পরিরের অবয়বে।
আব্বা মারা গেলেন ২২ আগস্ট ১৯৯২ সালে। হার্ট অ্যাটাক হবার দিনরাতে ২০ আগস্ট আমি আব্বার সাথেই ঘুমিয়ে ছিলাম। তখনো একা একা ঘুমানোর অভ্যাস হয়নি। ঘুম ভাঙলো মায়ের চিৎকারে। আমাকে ডেকে বললেন, তোর আব্বা অসুস্থ, ডাক্তার ডেকে আন।
বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে তখন আমি একা। বড় দুই ভাই ঢাকা থাকেন। কিন্তু ডাক্তার ডাকতে গেলে একটি মস্ত বাগান পাড়ি দিতে হবে। ওই বাগানে ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে একটা কাজের মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। আমার স্কুলে যাওয়ার পথ ছিলো ওই বাগানটি। যথারিতিতে সেইদিনও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে দেখি একটা মেয়ে ঝুলে আছে গাছের ওপর, আর তা পা বাতাসে নড়ছে। মুখের জিহবা বের হয়ে আছে। এরকম জিহবা আমি শুধু পাশের কালি মন্দিরে ‘মা কালি’কেই দেখেছি। আমি সব সময় কালি মন্দির এড়িয়ে যেতাম। ওদিকে তাকাতাম না। রাতে নাকি কালি ঘুরে ফিরে বেড়ায়। মানুষ পেলেই রক্ত খায়, এসব শুনতাম। রাতে কখনো প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিলে মাকে ডাকতাম। সেই আমি, ভিতু আমি কিভাবে সাহসী হয়ে ওঠলাম জানি না। লাশ ঝুলে থাকা সেই ভয়ের বাগানের মধ্য দিয়ে সেরাতে ডাক্তার ডেকে এনেছিলাম। এ ঘটনার আরো বহুপরে আমি শশ্মানে গিয়ে বসে বসে নক্ষত্র গুনেছি। আর ভয় করেনি। বাবা মরে গিয়ে আমাকে ভয়শূণ্য করে দিয়ে গেছে।
আব্বার হার্ট অ্যাটাকের দুদিনের মাথায় মারা গেলেন। আব্বাকে মাটি দেয়া হলো গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে আমাদের যেখানে ঘর ছিলো তার ঠিক পেছনে। আব্বা মারা যাবার পর আমি একটুও কাঁদিনি। একটুও না। কিন্তু বড় হবার পর বুঝেছি, আমি আসলে বুকের মধ্যে কান্নার একটা নদী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
বাবা, তুমি যখন চলে গেলে তখন আমার বয়স কতইবা। আমি তখন ১১ বছরের শিশু। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম দেখতাম বন্ধুদের বাবারা চিঠি পাঠায়। সেখানে মাসের খরচের টাকার কথা থাকে, গ্রামের বাড়ির খোজ খবর থাকে। মায়ের শরীরের কথা থাকে, শুধু বাবার শরীর কেমন আছে সেগুলো থাকে না। বাবারাই এমনই। আমার তখন ভিষন কস্ট হোত। মনে হোত, তুমি যদি বেঁচে থাকতে তাহলে আমাকে চিঠি লিখতে। তোমার হাতের লেখা এতো সুন্দর।
বাবা খুব কস্ট পেলে এই পৃথিবীতে কাউকে বলতে পারি না, আমার ভিষন কস্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নিশ্বাস আটকে আমি মারা যাবো। তবুও মরছি না। আমার তখন ভিষ কাদতে ইচ্ছে করে। কবে কোথায় যেনো পড়েছিলাম, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।
মৃত্যুর গন্ধ কেন টের পাই?
‘মৃত্যুর গন্ধ আছে। এই গন্ধ অনেকে আগে থেকে বুঝতে পারেন।’ এটা আমার বড় খালাম্মা বলতেন। দৌদাণ্ডপ্রতাপশালী নানার বাবা পাঁচকড়ি শেখের একমাত্র সন্তান ধলামিয়া শেখের বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন এতিম এক যুবকের সাথে। রাজকন্যাসম সেই বড় খালাম্মা যখন পুকুরে গোসল করতেন যেতেন, সেই পুকুরের পানিতে বহুদিন গন্ধ লেগে থাকতো। কোনপুত্র সন্তান না হওয়ায় এতিম যুবক আরেক নারীর পানিগ্রহণ করলেন। সেই থেকে খালাম্মা রাজ্য হারিয়ে বেশুমার এক দীর্ঘ জীবনের পথে রওনা দিলেন। খালাম্মা কতদিন বেঁচে ছিলেন তা হিসেব কশে বের করা সম্ভব নয়, তবে আমার নানার সাত মেয়ে ও দুই ছেলের বয়স আন্দাজ করে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় ১০০ বছরের কম হবে না।
গত কয়েক বছর আগে বড় খালা গত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি বোধহয় সবাইকে বিরক্ত করে তুলেছিলেন। দীর্ঘ জীবনের কোন মানেই নেই-শেষদিকে এটাও বলতেন। একবার আমাকে ডেকে বললেন, ‘মানুষের সব কস্টের শুরু হলো, মানুষের চাওয়া। যার যত কম চাওয়া তার ততো কম কস্ট।’
আব্বা মারা যাবার সময় তীব্রভাবে বুঝেছিলাম মৃত্যুর গন্ধ শরীরের রোপক‚পগুলো কিভাবে অবশ করে দেয়। আব্বাকে যেদিন কবরে রেখে দেওয়া হলো, আমি কোথা থেকে যেনো একটা কাচের বোতলের গোলাপজল কিনে এনেছিলাম। কবরের মাটির ওপর ছড়িয়ে দিয়েছিলাম গোপনে রাখা সেই গোলাপজল। আহা! আব্বা যদি দেখতো!
বয়স বাড়লে মানুষ মনে হয় কেবলই পেছনে যেতে চায়। আমার ফেলে আসা ভাঙ্গা রাজপ্রাসাদ। সেই ছাদে ধ্যানস্থ্য ঋষির মত আকাশের নক্ষত্রগোনা। তারপর কোথা থেকে আমার নিহত কমরেডদের কেউ একজন বলে উঠে, এরকম রাত্রিগুলোতে জীবাননান্দ দাসকে পানীয় বানিয়ে মাতাল হতে ইচ্ছে করে।
আমার নিহত কমরেডদের জীবনানন্দ দাসকে পানীয় বানানো হয় না। রাইফেলের শীতল নলগুলো তাদের বুকের ওপর নেমে আসে। হয়তো এমন করে তাদের প্রিয়তমরাও একদিন প্রগ্রাড়ভ ভালোবাসা নিয়ে নেমে এসেছিলো। তবে সেইসব প্রেমিকাদের দরদ তারা মনে না রেখেই সীমারের মত চলে যায় যুদ্ধের ময়দানে। যেখানে বিরাট বিরাট আরবগুলোর মুখে লেগে আছে রক্তের দাগ।
আহা! আমার কমরেডরা তাদের কিশোর হাত দিয়ে বন্দুকের ট্রিগার টিপতেও ভুলে যায়। আর তখন বিকট শব্দে ঘুমন্তগ্রামগুলো জেগে উঠে একটানা গুলির শব্দে। চিত্রা-নবগঙ্গা-মধুমতি-পশুর নদীর পাড় থেকে ওড়ে যায় বাদুরের দল। সঙ্গমরত তরুন-তরুনীরা তৃপ্তির শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
সেই কালশাপ ফেলিছি বিষাক্ত নি:শ্বাস তার। আমি বুঝি, টের পাই, কিন্তু তারে আমি পারি না সরাতে। বরং প্রায়শ আজকাল ভাবি, সে বরং খুন করে নিয়ে যাক আমাকে। কি দায় পড়েছে জীবন টেনে টেনে নি:শ্বেষ করার।
আমার মাথার ওপর কেউ ঝুকে বসে বলেনি, এই প্রেমের দিব্যি। কাজ ফেলে চলে এসো এই মধ্য দুপুরে প্রেমের কাব্যে আজ বৃষ্টি নামাবো আমরা।
তবু বৃষ্টি নামে এই ঘোর অকালে শীতকে পাত্তা না দিয়েই। আর আমি ভাবি, কবে একবার দেখেছিলাম এক মৌলভী সোলেমানি খোয়াব নামা নিয়ে মাটির উপর আকিবুকি দাগ কাটছে। তার বাম হাতে আমার ডান হাত। ধ্যানস্থ্য মুখ থেকে তিনি বললেন, এই ছেলের ওপর থেকে শনির প্রভাব কাটবে না। সে নিরুদ্দেশ হবে।’
সোলেমানি খোয়াব নামার সেই মানুষটিকে আজো খুজছি। সেই খোয়াবনামা আর আকিবুকিগুলোর জটিল সমীকরণ এখনো অন্ধের মত হাতড়ে বেড়াচ্ছি। যদি আমার স্মৃতিকাতর গ্রামে একবার ফিরে আসতো সে। তা না হলে এই বেহুদা শনির জীবন টেনে টেনে ক্লান্ত থেকে আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমার নিরুদ্দেশ যাত্রার কোন দিনক্ষণ পাচ্ছি না।
প্রিয় বাবা,
একদিন পৃথিবী আশ্চয্যে সুখে মাতবে এমনটা আজকাল প্রায় ভাবি। কোন এক বাবা তার প্রিয় সন্তানের কনিষ্ট আঙ্গুল চেপে ঘাসের ওপর হেটে যাবে দুরে কোথাও। এমন দৃশ্য দেখতাম। অল্প বয়সে বাবা মরে যাওয়ায় বাবার হাত ধরে দুরে কোথাও যাওয়া হয়নি। নিজে বাবা হলে সন্তানের কনিষ্ট আঙ্গুল ধরে পৃথিবী দেখানোর ইচ্ছেও ছিলো। কিন্তু আজকাল মনে হয় মৃত্যুর গন্ধ পাই। রক্তের সুগারের মাত্রা বাড়ছে ক্রমশ। উচ্চ রক্তচাপও তার সীমা ছাড়াচ্ছে। কোন এক শীতের সন্ধ্যায় যদি মরে থাকি তাহলে এইসব শব্দগুলো নতুন নতুন অর্থ তৈরী করবে নিজেই। বড় লড়াইয়ের ময়দানে যাওয়ার আগেই মৃত্যুর গন্ধ এসে কেন লাগে নাকে? কে তাহারে জাগাতে পারে জীবনের দিকে?
শৈশবের সেই দুর্দান্ত দিনগুলোর মতো আজও যেন কোথায় একটা উজ্জ্বল আলোর রেশ রয়ে গেছে। এই কি তবে ভালোবাসা। কিন্তু প্রতিদিন উদয়-অস্ত বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আমার আর কিইবা করার আছে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা ছাড়া। কিন্তু কেন যেন মনে হয় সেই সব দিনের মধ্যেই পড়ে আছে আমার সত্যিকারের জীবন।
অদ্ভুত দম বন্ধ করা বিশ্রী সময় জন্মেছিলাম। জন্মের দাগ থেকে কোনদিন প্রজাপতি হয়নি, শুধু শুয়োপোকারা আমার শার্টের আস্তিন থেকে নেমে গেছে প্রতিক্ষণ শৈশবে ফেলে আসা জাফরান রঙের বিকেলের দিকে।
মানুষই হয়ে জন্মে ছিলাম। কিন্তু কবে যে শিয়াল ও শকুনের খাদ্য হয়ে গেলাম, তা এখন আর মনে পড়ে না। দিন যত গড়ায় মনে হয় দ্রুত তোমার কাছে আসছি।
জুন ১৯, ২০১৭; ৩:০৪ পূর্বাহ্ন
খুব মর্মস্পর্শী লেখা। অনেক অনেকদিন পর আপনাকে ব্লগে দেখতে পেলাম। আপনার লেখা মিস করি।