২১০২ বার পঠিত
আপনি যখন বলবেন, এই কোম্পানির অষুধ নকল। যা খেলে মানুষের প্রাণ যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন কথার সাথে ফুটনোটে যোগ করবেন, তবু ওই কোম্পানির বিকল্প নেই। তখন নিশ্চিত আপনি একজন ‘বলদ’। বলদকে কমাযুক্ত করেছি এ জন্য যে, আমি কনফিউজড বলদকে এতবড় অপনামের সাথে যুক্ত করাটা উচিত হলো কিনা।
আমাদের দেশে এ ধরণের বলদের অভাব নেই। মুশকিল হলো এসব বলদ হালের কাজে থাকলে কোনো আপত্তি ছিলো না। এরা রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির কাজে। ওই গল্পটার মতো। উগান্ডার মন্ত্রী গেলেন অ্যামেরিকায় কনফারেন্সে। গিয়ে ভাবলেন, এসেছেন যখন মগজটাকে রিপেয়ার করে নিয়ে যাই। গেলেন মগজ সারাইয়ের দোকানে। দোকানি বললেন, একমাস পরে ডেলিভারি পাবেন। মন্ত্রীর উত্তর, নো প্রবলেম। এক মাস যায়, দুই মাস যায়, যেতে যেতে ছয় মাস। মন্ত্রী মগজ নিতে আসেন না। এদিকে দোকানি অস্থির, মগজ ছাড়া ওই ভদ্রলোক মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন কী করে, এমন ভেবে। ছয় মাস যাবার পর ফোন ধরলেন সেই মন্ত্রীকে, মগজ নিয়ে যাবার তাগিদ দিলেন। মন্ত্রী সেই তাগিদে তাচ্ছিল্যের সাথে জানালেন, সামনের মাসে আরেকটা কনফারেন্স রয়েছে। সরকারি খরচে আসবো, সারাইয়ের বিলটাও তারমধ্যে ধরিয়ে দেবো। দোকানি বললেন, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু মগজ ছাড়া মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন কী করে? মন্ত্রীর সোজা উত্তর, এখানে ওই কাজে মগজ লাগে না, জিহ্বা লাগে।
যাক গে, যে দেশের যে ভাও। চলুক মন্ত্রণালয় জিহ্বা দিয়ে।
দুই.
বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম নিয়ে রীতিমত হাউকাউ চললো কিছুদিন। এখনো পেঁয়াজ এক’শ টাকার উপরে বিকাচ্ছে। অথচ এ নিয়ে কারো তেমন বিকার নেই। মানুষ এই দামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশের মানুষের অভ্যস্ত হয়ে যাবার গুন অবিশ্বাস্য। আমার কথাই ধরুণ। পুরানো ধাঁচের বাড়ির নিচতলায় আমি থাকি। বর্ষার দিনে মোটামুটি বৃষ্টি হলেই আমার শোবার ঘরে পানি ঢুকে যায়। ময়লা পানিতে ঘর সয়লাব। প্রথম দু’একবার বলি, এমন অবস্থায় বাস করা অসম্ভব। তারপর আর কী, অভ্যস্ত হয়ে যাই। নুসরাত মারা গেলো, এর আগে গেলো তনু, এরপর আরো অনেক। আমরা দু’একবার ফুঁসে উঠার মশক করলাম, তারপর আবার কী, অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
ভোট দেখছি। বলছি, কী হচ্ছে এসব। সাংঘাতিক টাইপ সাংবাদিকরা বলছেন, এভাবে চলবে না, অবস্থার উত্তরণ চাই। উত্তরণটা কী? সেটা হলো অভ্যস্ত হতে চাওয়া, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। অভ্যস্ত হতে হতে, অভ্যস্ততার সাফাই গাইতে কেউ বলে উঠেন বিকল্পও তো নাই। হায়রে সাফাই, আহা অভ্যস্ততা!
গল্প বলি। দুই পেয়াদার গল্প। এক পেয়াদার স্ত্রী বেশ সুন্দরী। তার কাছে প্রতিদিন রাজদরবারের উঁচুদরের লোকজন আসেন, ইয়ে-টিয়ে করেন তারপর চলে যান। আরেক পেয়াদার খায়েশ জাগলো। সেও একদিন গেলো। কিন্তু তার কপালে ইয়ে-টিয়ে না জুটে জুটলো স্বামী পেয়াদার উত্তম-মধ্যম। মুখ দিয়ে কথা বলার শক্তি নেই, তবু সেই পেয়াদা জিজ্ঞেস করলো, রাজদরবারের লোকদের ইয়ে-টিয়েতে তো আপত্তি করো না, আর আমি বন্ধু মানুষ আমাকেই কিনা শুইয়ে দিলে। স্বামী পেয়াদার রাশভারী উত্তর, তুই তো আমার সমানই, রাজদরবারের লোকেরা ক্ষমতাবান আর সম্মানী মানুষ। ছোটলোকের ইয়ে-টিয়েতে সম্মানহানি হয়, ক্ষমতাবানদেরটায় বাড়ে। ক্ষমতাবানদের বিকল্প নেই। ক্ষমতাবানদের সাথে অভ্যস্ত হতে হয়।
তিন.
আমার নিহত সাংবাদিক ছেলে ফাগুন, ফাগুন রেজা’র কলিগ প্রদীপ দাস। চমৎকার তরুণ। ঋজু এবং ধারালো। সামাজিকমাধ্যমে লিখলেন, ‘পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাজগুলো সাধারণ মানুষের উপকারে আসে না।’ কিভাবে আসবে? তারাতো উপকারের কথা ভেবে কাজ করেন না, পুরস্কারের কথা ভেবে করেন। উদাহরণ দিই, ঢাকা শহর পরিষ্কারের আয়োজন গিনেজ বুকে উঠেছে। বিপরীতে ঢাকা শহর কি এখন ফকফকা? লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য রেকর্ড সৃষ্টি করা। রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীতে দেশপ্রেমের রেকর্ডের কী অবস্থা, সৃষ্টি হয়েছে কি? হয়নি। হলে, লাখো কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেতো না।
তাই প্রদীপদের বলি, যতই আলো জ্বালাতে চেষ্টা করুন না কেনো, আপনার মাথার উপর বসে আছে ‘বিকল্প নাই’ ভাবার লোকেরা। প্রদীপের নিচেও রয়েছে অন্ধকার। আপনি-আপনারা অন্ধকারের বিশালতায় প্রদীপ জ্বালানোর অসম্ভব চেষ্টা করছেন। আমার ছেলেও করেছিলো। ফাগুনের ভেতরেও আগুন ছিলো, তাকে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। তার জন্য দায়ী ‘বিকল্প নাই’ ভাবা লোকেরাই।
চার.
টিআইবি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ন্যূনতম ২৬ হাজার ৪’শ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। বাংলাদেশে কর্মরত রয়েছেন আড়াই লাখের মতন বিদেশি। যাদের মধ্যে কর দেন মাত্র সাড়ে ৯ হাজারের মতন। এরা করও দেয় না, আবার টাকাও পাঠায় বেআইনি ভাবে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে লোকসান দুদিক থেকেই। ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালেও তো সেখান থেকে অন্তত কয়টা টাকা দেশ পেতো। তাদের ক্ষেত্রে কর-কর্তারা ‘স্পিকটি নট’। অথচ আমাদের সাধারণদের উপর চলে স্টিমরোলার। প্রশ্ন করতে চাইলে, উপরে বলা দুই পেয়াদার গল্পটি আবার দেখে নিতে পারেন।
পাঁচ.
বাংলাদেশে ‘কাউয়া’ শব্দটির ইদানিং আলাদা কদর ও আমেজ রয়েছে। এই আমেজ আরো বৃদ্ধি করেছে ভারতের একটি খবর। গণমাধ্যম ‘জাগো নিউজ’ জানিয়েছে, তামিলনাড়ুতে মুরগির নামে ‘কাউয়া বিরিয়ানি’ খাওয়ানো হচ্ছে। খবরটির শিরোনাম ছিলো, চিকেন বিরিয়ানির নামে ‘কাউয়া বিরিয়ানি’। তামিলনাড়ুর হোটেলগুলোতে মুরগির বদলে বিরিয়ানিতে কাকের গোশত দেয়া হচ্ছে। খবরটির ট্রিটমেন্ট নেগেটিভ হলেও, এর পজিটিভ দিকটি নজর-আন্দাজ করা ঠিক হচ্ছে না। অখাদ্য ‘কাউয়া’রাও যে খাদ্য তালিকায় অর্থাৎ জাতে উঠছে এ বিষয়টিও খবরের ট্রিটমেন্টে আনা উচিত ছিলো।
কে শোনে কার কথা। কত উচিতইতো আমরা নজর-আন্দাজ করে যাচ্ছি। ৭০ শতাংশের উপর মানুষ ভোট দিচ্ছে না, এটা নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই। বিজিত প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে কতটুকু ভুল বললো সেই শতাংশের পরিমাপে আমরা অস্থির হয়ে উঠি। পরস্পর জড়িয়ে যাই ‘গ্রামীণ কাইজা’য়। বলিহারি এমন শহুরে বুদ্ধিজীবীদের তেমন চিন্তার অপ্রতিরোধ্য বাহুল্যতায়!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন