০
১৫১৮ বার পঠিত
মানুষ মরণশীল। ম্যান ইজ মরটাল। জন্মিলে মরিতেই হইবে। বিশেষ করে একটু খ্যাতিমান মানুষরা টুপ করে মারা যান। মৃত্যু-সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে পৌঁছা মাত্র আপনাকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে যেতে হবে শোকসাগরে। কিন্তু এইখানে নিশ্চিত হতে হবে মৃত্যু-সংবাদটি সঠিক কীনা। মৃত্যু-সংবাদ ভুল হলে লোকে এসে আপনাকে দু’কথা শুনিয়ে যাবে। আবার একই লোকের জন্য অযথা একাধিকবার কষ্ট করে স্মৃতিচারণ লিখতে হবে আপনাকে। যেমন ঘটেছিলো গায়ক মান্নাদের ক্ষেত্রে। একই স্মৃতিচারণ কমপক্ষে পাঁচবার লিখতে হয়েছে উনার অনুরাগীদের।
https://www.facebook.com/nobojug.org/videos/2376497199299251/
মনে রাখবেন একজন মানুষ বৃদ্ধ হয়েছেন জন্য টুপ করে মরে যাবেন; এটা ধরে নেয়া ঠিক নয়। ভ্যাটিক্যানের ক্যাথলিক গির্জার দ্বিতীয় প্রধান প্রয়াত পোপ পল টু দীর্ঘদিন ধরে তার ভক্তদের এরকম ঝক্কিতে ফেলেছিলেন। বারবারই মিডিয়া খবর দিতো, তিনি নেই। কিন্তু একটু পরে জেগে উঠতেন তিনি। আবার অন্তর্জলি যাত্রা চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই অশীতিপর বৃদ্ধকে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে যাবার পর তিনি জেগে ওঠেন। নতুন একটি বিবাহের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাই কারো মৃত্যুর খবর ধরে নিয়ে স্মৃতিচারণ লিখতে বসার আগে জেনে নিন সত্যিই তিনি গেছেন না আছেন; কিংবা ফিরে এসেছেন। এরপরেও একান্ত ভুল করে একটি স্মৃতিচারণ লিখে ফেললেন; তখন তা ডিলিট না করে অনলি মি করে রেখে দিন। কারণ লোকটা তো একদিন মরবেনই। তখন সবার আগে স্মৃতিচারণ পোস্ট পাবলিক করে কৃতিত্বের দৌড়ে আপনি এগিয়ে যাবেন।
এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন, কোন খ্যাতিমান ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; তার অবস্থা আশংকাজনক; এমন খবর শোনা মাত্র একটি স্মৃতিচারণ লিখে পোস্ট ‘অনলি মি’ করে রাখুন। মৃত্যুখবর পাওয়া মাত্র পোস্টটি পাবলিক করে জিতে নিন অসংখ্য লাইক, স্যাড, লাভ, (ভ্রান্তিজনিত) হাসির ইমোটিকন। কেউ ভুল করে স্মৃতিচারণ পোস্টে হাসলে বিরক্ত হবেন না। শেষ পর্যন্ত লাইকের সংখ্যা ম্যাটার করে।
একটি বিষয় উল্লেখ্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে অনবরত সেলফি তুলতে থাকতে হবে। বলা যায় না কে কখন টেসে যায়। ছবিটা কাজে লাগবে। ছবি আপনার স্মৃতিচারণকে পোক্ত করবে। অবশ্য দক্ষ ফটোশপ শিল্পীর সাহায্য নিয়ে সদ্য-প্রয়াত খ্যাতিমান ব্যক্তির সঙ্গে আপনার একটি ছবি তৈরি করাও আজকের যুগে কঠিন কিছু নয়।
এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে কী করে লিখবেন এই স্মৃতিচারণ?
আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে ডাকসাইটে লেখকেরা আছেন; কেউ মারা গেলে তাদের কি বোর্ড হিরের অক্ষরের ঝর্ণা হয়ে ঝরতে থাকে। এমন করে স্মৃতিচারণ লেখেন তারা যেন সদ্যপ্রয়াত খ্যাতিমান তারই সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন, সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন এবং তার সম্পর্কে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত-বাণী বর্ষণ করে গেছেন। এসবে আপনার ঘাবড়ে যাবার কারণ নেই। আপনার বোঝা উচিত আপনার একজন ফেসবুক ফ্রেণ্ডকে দেশের সব খ্যাতিমান এতো সান্নিধ্য আর আশীর্বাদ দিলে উনি আর ফেসবুকে আসার সময় পেতেন না। দেশের গৌরবের স্যাটেলাইট উড্ডয়নের সময় তাকে স্যাটেলাইটের অগ্রভাগে বেঁধে দেয়া হতো।
মনে রাখবেন, বিটিভির এক সাহিত্য অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। বিশ্বের যে কোন খ্যাতিমান সাহিত্যিক মারা যাওয়ার পরেই অনুষ্ঠানে এসে বলতেন, উনাকে মনে পড়ে; একদিন প্যারিসে আমার এপার্টমেন্টের দরজা খুলে দেখি স্বয়ং উনি দাঁড়িয়ে এক বাশকো চকোলেট হাতে। অথচ একই খ্যাতিমান সাহিত্যিক বেঁচে থাকতে উপস্থাপক এ গল্প বলতেন না। ঐ কৌশলটিই এখন ফেসবুকে এসে পড়েছে।
এখনো দুঃশ্চিন্তা করছেন; তা তো বুঝলাম কিন্তু স্মৃতিচারণ লিখবো কী করে! এক লাইন লিখতে গিয়েই কি বোর্ড ভেঙ্গে যাবার জোগাড়। এখন লক্ষ্য করুন নিম্নে বর্ণিত স্মৃতিচারণের স্টাইল।
–উনি শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। শেষ বার যখন উনার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো; তখন বেশ স্বাস্থ্যবান ও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিলো। আমি ক্ষুদ্র মানুষ; দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, কেমন আছো দবির (দবিরের স্থলে নিজের নাম লিখুন)। শুনে আমি তো চমকে উঠি। এও কী সম্ভব!
রহস্যটা উনিই ভাঙ্গলেন। একবার উনি রেলগাড়িতে ভ্রমণকালে আমার সঙ্গে দেখা হয়। তখন উনি আমার সঙ্গে অল্পক্ষণ কথা বলেই মন্তব্য করেছিলেন, তোমার ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় ও আশাপ্রদ। স্যারের কথা ভুল হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছায় (নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার নাম বসিয়ে নিন/ ধর্ম না থাকলে “প্রকৃতির বা বিজ্ঞানে”র ইচ্ছায় যুক্ত করে নিন) আজ আমার ব্যবসা উদ্যোগ বিরাট সাফল্যের মুখ দেখেছে। (আপনার ব্যবসা উদ্যোগ না থাকলে লিখুন, আজ আমি জীবনে সফল হয়েছি)। উনার মৃত্যুতে বুকের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে; বুকটা খাঁ খাঁ করছে। একই শূণ্যতা সারাদেশে। তার এ শূণ্যতা কিছুতেই পূরণ হবার নয়। তবে উনি আমাদের সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন।( উনি লেখক বা চিত্রকর টাইপের কেউ হলে শেষ বাক্যটি লিখুন, তবে উনার সৃষ্টির মাঝে বেঁচে থাকবেন উনি। উনার সাহিত্য-কর্ম বা চিত্রকর্ম নিম্নমানের হলেও একথা লেখা অশোভন যে, তবে উনার অপসৃষ্টির মাঝে উনি বেঁচে থাকবেন)
এই স্মৃতিচারণ লিখতে গিয়ে, দেশ আজ এক সুযোগ্য সন্তানকে হারালো বা তার অবদান জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে টাইপের বাক্য লেখার দরকার নাই। কারণ এসব কথা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী(যদি থাকে); এদের বাণীতে থাকবে। আর কেউ কারো কথা চিরকাল মনে রাখে না। একবিংশ শতকে শোকের আয়ু আরেকটি নতুন ইস্যু চলে আসা পর্যন্ত।
স্মৃতিচারণ করার সময় অতি-আবেগি হয়ে কোন খ্যাতিমান ব্যক্তির সততা-নিষ্ঠার কথা লেখা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে না। কেউ জানে না কে কে সুইস ব্যাংকে কত টাকা পাচার করেছে, তা সে ব্যবসায়ীই হোক, রাজনীতিক বা আমলাই হোক, সংস্কৃতিসেবী কিংবা ইতিহাসবিদই হোক। ফলে সমসাময়িক কালে সততা-নিষ্ঠার মতো বিরল গুণের কথা লিখে অপদস্থ না হওয়াই শ্রেয়।
ওপরের স্মৃতিচারণ লিখন পদ্ধতিটি ছিলো আমি ধর্মী। অর্থাৎ মানুষটা মারা গেছে তবুও আপনি আপনার গল্পই বলছেন। এটিই স্মৃতিচারণ লেখার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। নিম্নে ‘আমি’ বাদ দিয়ে একটি স্মৃতিচারণ লেখার স্টাইল প্রদর্শিত হলো। যদি কখনো “আমি”-র খপ্পর থেকে বের হতে পারেন তবে স্মৃতিচারণ লিখতে পারেন এভাবে।
আজ ————-আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এই বাড়তি বিদ্যুৎ উতপাদনের যুগেও চারপাশের বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা মৃত্যু অনিবার্য। তবু মানতে কষ্ট হয় উনি আমাদের মাঝে আর নেই। (গুগল করে বা উইকিপিডিয়ায় জেনে নিন উনার কবে কোথায় জন্ম, কোন বিষয়ে কাজ করেছেন; সামান্য তথ্য অনুসন্ধান আপনাকে এনে দিতে পারে পর্যাপ্ত লাইক)। (এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো করে লিখবেন) এ বোধ হয় এক এক করে হিরক খণ্ডদের চলে যাবার সময়। (এইখানে হিরকখণ্ড শব্দে ঝুঁকি নেই; কারণ লোকটি গুণী হলে শব্দটা মানিয়ে যাবে। কোন কারণে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে থাকলেও উনাকে হিরের টুকরো বলতে স্মৃতিচারণশাস্ত্রে বাধা নেই)। এরপর লিখুন, যতদূরে যান আপনার আলোয় আলোকিত হবো আমরা। (মনে রাখবেন স্মৃতিচারণে এই লাইন লেখার কারণে লোডশেডিং-এর সময় অন্ধকার অনুভূত হয় না)।
সংক্ষেপে এইছিলো অতিসহজে স্মৃতিচারণ লেখার কিছু কৌশল। সবশেষে ব্যতিক্রমী স্মৃতিচারণের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। এটাকে বলা যায় বিদ্রোহী স্মৃতিচারণ। সাধারণতঃ একজন মানুষ মারা গেলে সবাই উনার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা লিখবে। ফেসবুকে এরকম সময় জুতা মারুম, মাইরা ফালামু, কাইটা ফালামু, গুম কইরা দিমু, ইচ্ছা করে লাডি দিয়া পিডাই জাতীয় জনপ্রিয় অনুভূতির শেয়ার বাজারে ধস নামে। সবাই হঠাত শুদ্ধতার পরাকাষ্ঠা হয়ে পোড়াকাষ্ঠের মতো ধিকি ধিকি জ্বলে। সেইখানে স্মৃতিচারণে বিদ্রোহী হয়ে আপনি একদিকে পাঠকের “মাইরা ফালামু, কাইটা ফালামু”-র তৃষ্ণা মেটাতে পারেন। অন্যদিকে অন্যধারার স্মৃতিচারণ লিখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত অপ্রিয়ভাবে প্রিয় হয়ে উঠতে পারেন সকলের। সেক্ষেত্রে শুরু করতে পারেন এভাবে,
এতো শোকের কিছু দেখতে পাইনা। কেন জানি কখনোই উনারে আমার বিশেষ কিছু মনে হয় নাই। কেউ মারা গেলেই তার সম্পর্কে ভালো কথা বলতে হবে এমন কোন কথা নেই। একবার উনারে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় দেখছিলাম; সালামও দিই নাই।
এরকম বিদ্রোহী স্মৃতিচারণে শোকাচ্ছন্ন পাঠকেরা যারা খ্যাতিমান ব্যক্তির মাজারের খাদেম হয়ে পড়লেন; তারা মন্তব্যে এসে চ-বর্গীয় গালি দেবে; জুতা মারা, মাইরা ফালামুর পসরা সাজিয়ে বসবে; ইনবক্সে দেখে নেবার হুমকিও দেবে। এসব উপেক্ষা করতে পারলে আপনি হয়ে উঠতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত অপছন্দনীয় কিন্তু জনোমনোরঞ্জক।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন