বর্তমান সময়ের শিক্ষিত মানুষকে তাড়া করে ফিরছে এক ভুত, সে ভুতের নাম বিজ্ঞানবাদের (scientism) ভুত। বিজ্ঞানের জয় জয়াকারের এ যুগে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ ভুতের আবির্ভাব। বিজ্ঞান সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে, বিজ্ঞানই সকল জ্ঞানের সেরা, এই বিশ্বাসের নাম বিজ্ঞানবাদিতা (scientism)। বিজ্ঞানবাদীদের ধারণা পদার্থবিদ্যা দিয়ে বস্তুজগত, ডারুইন দিয়ে জীবজগত আর নিউরোসায়েন্স দিয়ে মনোজগত বুঝে ফেলা যাবে। এগুলো অতি সরলীকরণ, বিজ্ঞানের জন্য অনেক বড় ঘোষণা।
বিজ্ঞানের গর্বে গর্বিত বিজ্ঞানী মনে করেন দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিদ্যা ইত্যাদি সবকিছুর ব্যাপারে সে তার মতামত দিতে পারবে। এটা খুবই স্বাভাবিক, সুসময়ে মানুষ এরকম আইল ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে চায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মনে রাখা উচিত এসকল বিষয় ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করছে, এজন্য জ্ঞানের প্রায় সব শাখার পেছনেই বিজ্ঞান নামটা আছে। নতুন করে বিজ্ঞানীকে গিয়ে ঐসকল শাখার বিষয়বস্তুর উপরে ফোঁপর দালালি করে লোক হাসানোর দরকার নাই।
এ কাজ যে শুধু পাতি বিজ্ঞানীরা করছে তা নয়। আত্মম্ভরিতা, হামবড়া ভাবটা উপরদিক থেকেই চুঁইয়ে পড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিশিষ্ট ডাক্তার, পাশ্চাত্য যুদ্ধংদেহী নাস্তিক্যবাদের পান্ডা স্যাম হ্যারিসের কথা। ভদ্রলোক বিজ্ঞানের মোহে এমন মোহ মুদ্গার অবস্থায় আছেন যে তিনি দর্শনের নীতিশাস্ত্রকে বিজ্ঞান দিয়ে সরাতে চান, তার মতে ‘all-we-need-is-science’। ২০১০ সালে ‘বিজ্ঞান কিভাবে মানুষের মূল্যবোধ নির্ধারণ করতে পারে’ এ নিয়ে বই লিখে, লোক হাসিয়ে, ভালো একটা সমালোচনার মুখে পড়ে ভদ্রলোক আর ওমুখো হননি। তার বইয়ের শিরোনামঃ ” The Moral Landscape: How Science Can Determine Human Values” । একটা মানুষ কি পরিমান নির্বোধ হলে বিজ্ঞান দিয়ে মানুষের মূল্যবোধ মাপতে যায়।
একটা সত্য ঘটনা/ তথ্য এবং মূল্যবোধের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য আছে। কোন একটা তথ্য নিয়ে আমরা যৌক্তিক গবেষণা করতে পারি, কিন্তু মূল্যবোধকে নিয়ে তা পারি না। কিন্তু হ্যারিস সাহেবের মতে বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা সেটা পারি, সঠিক মূল্যবোধ হলো সেটা যা মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন করে। কিন্তু আমরা কিভাবে বুঝব, কোনটা নীতিগতভাবে সঠিক কাজ? হ্যারিসের মতে, আমাদের সচেতন মানসিক অবস্থায় যে কাজ আমাদের সর্বোচ্চ কল্যান সাধন করে সেটাই নীতিগতভাবে সঠিক কাজ।
হ্যারিস আসলে আমাদের নতুন কিছু বলতে পারেননি, তার ‘নীতিশাস্ত্রের জমিন’ আমেরিকান প্রয়োগবাদের মাঠের কোনায় আশ্রয় নেয়। তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য খারাপ ছিল এটা বলা যাবে না, প্রয়োগবাদীদের ‘greatest happiness of the greatest numbers’ প্রতিষ্ঠা করাই তার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু প্রয়োগবাদীদের যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল হ্যারিসের কাছেও সেসকল প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। যদি আমরা ধরেও নেই যে বিজ্ঞানের দ্বারা মূল্যবোধ পরিমাপ করা যাবে,তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কিভাবে আমরা দুজন ভিন্ন মানুষের সুখাবস্থা/কল্যানের তুলনা করব? নাকি আমরা একটা সর্বমোট কল্যানাবস্থার কথা ভাবব? যদি সচেতন মানুষের মানসিক অবস্থাই শুধু বিবেচনা করতে হয়, তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় কাউকে মেরে ফেললে কি কোন দোষ হবে? বর্তমানের সুখাবস্থার সাথে কিভাবে ভবিষ্যতের সুখাবস্থার তুলনা করব? যুক্তি দিয়ে যখন নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধ তৈরির চেষ্টা করা হয় তখন সেটা ফেইল করতে বাধ্য কারণ যৌক্তিক এনালিসিস সেটা করার উপযুক্ত নয়।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও এ দোষে দুষ্টঃ গুগলের একটা কনফারেন্সে তিনি বলেছেন, “philosophy is dead”। ভদ্রলোক অনেকদিন যাবত এরকম বলে এসেছেন। এটা ঠিক যে,সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে দার্শনিকেরা তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি। তাই বলে এতবড় দাবী করা আত্মম্ভরিতা ছাড়া আর কিছু নয়। মূলতঃ তার কথা থেকে আস্কারা পেয়েই হালের পাতি বিজ্ঞানীরা বাড়াবাড়ি করছে। দর্শন যে এখনো ফুরিয়ে যায়নি এটা হকিং এর বিরোধীতা থেকেই বুঝা যায়, কোন দার্শনিক হয়ত পদার্থবিদ্যা নিয়ে তার হামবড়া ভাবে পানি ঢেলে দিয়েছিল। অথবা নিজেই বুঝতে পারছেন কার সাথে বিরোধ লাগতে পারে,তাই আগে থেকে সাঙ্গোপাঙ্গ মিলে প্রি- এম্পটিভ এটাক শুরু করে দিয়েছে।
দর্শন নিয়ে আরেকজন বিজ্ঞানী বলছেন, দর্শন শাস্ত্রের আর কিছু দেয়ার নেই। ওরা এখন শুধু ভাষা নিয়ে গবেষণা করবে। এটা ঠিক যে বিষয় হিসেবে দর্শনের আগের জৌলুস নেই,তারপরেও দর্শন এখনো মানুষকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। প্রত্যেক মানুষের একটা দার্শনিক অবস্থান আছে। দর্শন শাস্ত্র ভাষা দর্শনে আকৃষ্ট হবার পেছনেও ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। আর ভাষা দর্শনই এখনকার একমাত্র দর্শন নয়।
বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাতকারে চমস্কি বলেছিলেন, ‘ প্রকৃতির কিছু ব্যাপার এত জটিল যে তা নিয়ে গবেষণা করা যায় না। যেমন, পদার্থবিদ্যা খুব সহজ প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে। পরমাণু থেকে অণুর আকার একটু বড় হয়ে গেলে তারা সেটা রসায়নবিদের হাতে সমর্পণ করে। অণুর ধর্মাবলী বেশ জটিল হয়ে গেলে রসায়নবিদ সেটা দিয়ে দেয় জীববিজ্ঞানীর হাতে। সমস্যা জীববিজ্ঞানীর আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেলে তখন সেটা যায় মনোবিজ্ঞানীদের এক্তিয়ারে, এভাবে শেষ পর্যন্ত সব সমস্যা গিয়ে পৌঁছায় দার্শনিক, ঐতিহাসিক বা ঔপন্যাসিকের কাছে। একটা সিস্টেম যত জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে ততই সেটা থেকে গভীর, এবং তাৎপর্যপূর্ণ গুণাবলী বের করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে।”
বিজ্ঞানবাদীতার সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকে ভুল করে বিজ্ঞানের সমালোচনা করেন। বিজ্ঞান চর্চা করুন, বিজ্ঞানবাদীতার নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রেখেও বিজ্ঞানবাদীতাকে পরিহার করা যায়।
কেন সায়েন্টিজম বা বিজ্ঞানবাদীতার সমালোচনা করতে হবে?
বিজ্ঞানবাদীতা ইতিহাসকে স্বীকার করে না, সমাজবিদ্যা, শিল্প-সাহিত্যের সাথে তার বৈরিতার সম্পর্ক। বিজ্ঞানবাদীতা নিজেকে সেরা মনে করে। বিজ্ঞানবাদী মনে করে বিজ্ঞানে সবকিছুর জবাব আছে। অন্যসব বিষয়, মানবিক, সাংস্কৃতিক জগত বিজ্ঞানের কাছ থেকে শিখবে।
বিজ্ঞান কী তাহলে সবার সেরা ?
বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগের প্রতি কোন বাধা আসলে সেটাকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সকল বিরোধকে বাতিল করে দেয়া যাবে না।
বিজ্ঞানই মানুষের জ্ঞানের রাস্তায় একমাত্র হাতিয়ার নয়। বস্তু জগত যার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ করা যাবে বিজ্ঞান সেসব নিয়ে সাধারণ সত্য প্রকাশ করে। এর বাইরে তার এখতিয়ার নেই। ভালবাসা, মিনিং, নৈতিকতা, জীবনের লক্ষ্য-আদর্শ, চেতনা এগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানের কোন ধারণাই নেই। শুধু যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না, বিজ্ঞান চলতে পারে।
যুক্তির সাথে আবার আবেগের সম্পর্ক। যুক্তির নৌকা সেজন্য চড়ায় ঠেকে যায়। যুক্তির সাথে অযৌক্তিক প্রেম, ভালবাসা আছে বলেই মানুষ। যুক্তিবাদী দার্শনিকেরা আস্তিক ঘরানার। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানবাদী যুক্তিবাদীদের মধ্যে নাস্তিকের সংখ্যা বেশি। যুক্তির পথে থেকে নাস্তিক হওয়া যায় না।
ধর্মই শুধু বিশ্বাস করে না, বিজ্ঞানও অনেকগুলো বিশ্বাস নিয়ে সামনে আগায়। বিজ্ঞানী যেগুলোকে বলে স্বতঃসিদ্ধ। এগুলোর কোন প্রমাণ নেই, মানুষ স্বজ্ঞার মাধ্যমে এগুলোকে সত্য ধরে নেয়। এরপরে বিজ্ঞান কীভাবে ‘বিশ্বাস’ নিয়ে ধর্মকে আক্রমণ করতে যায়?
উনিশ-বিশ শতকে দার্শনিকেরা দেখলেন বিজ্ঞানের সাথে সমস্যা আসলে যুক্তির সাথে অযুক্তির সমস্যা। আমাদের জীবনের সবকিছুই যৌক্তিক বা র্যাশনাল নয়, অযৌক্তিক অনেক বিষয় আমাদের অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীবন থেকে অযুক্তিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। যেমন কোন ফিল্ড ম্যানুয়াল দিয়ে মানব জীবন পরিচালিত করার চেষ্টা করা হলে সেটা হবে হাস্যকর। অথবা বাচ্চা লালন-পালনের উপর একটা বৈজ্ঞানিক, যুক্তি সম্মত বই রচনা করা হলে দেখা যাবে যাদের সত্যিকারের বাচ্চা লালন-পালনের অভিজ্ঞতা আছে তারা সেটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। জীবনকে কোন সমীকরণ দিয়ে ধরা যায় না।
there’s something about being a human being that’s lost when we’re using purely rational analysis to try to explain it
মানুষ হিসেবে আমরা বাস্তবতার যে অভিজ্ঞতা পাই সেটা বিজ্ঞানের সাথে মোটেই মিলে না। সময়ের ব্যাপারটাই ধরা যাক। সময় মাপার জন্য আমাদের ঘড়ি আছে। কিন্তু সময় নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ঘড়ি দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। ভাল সময়ে ঘড়ির কাঁটা যেন দ্রুত ঘুরে, সময় খুব তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়। অপরদিকে অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। যৌক্তিক বিশ্লেষণ তাই বিশ্বজগতের অনেক কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও মানুষকে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।
দার্শনিক রিচার্ড রর্টি বলেন-
“ বিজ্ঞানের বড় ও স্থায়ী তত্ত্বগুলো স্থায়ী হয়েছে কারণ তারা বাস্তবতার কোন একটা অবস্থার সাথে ম্যাচ করে অথবা বিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে সেগুলোকে মেনে নিয়েছেন যেমন করে রাজনীতিবিদেরা ঐক্যমতের মাধ্যমে চলমান রাজনীতিকে ঠিক রাখে।”
“The longest lasting and most frequently relied upon theories stable because they match a stable reality or because scientists get together to keep them stable as politicians get together to keep existing political Arrangements intact.”
বিজ্ঞান নতুন কিছু আবিষ্কার করে না, বিশ্বজগতের অন্তর্নিহিত কাঠামোকে ধরার চেষ্টা করে না। বিজ্ঞানী বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বজগতের বুঝার একটা ভার্সন তৈরি কর। এসব তত্ত্ব সমকালীন সকল বিজ্ঞানীদের জানা ও বুঝার দরকার পড়ে, এবং সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর উপর ভিত্তি করে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা চলে সেটাই বিজ্ঞান।
“science is not discovering and accessing the intrinsic structure of the universe science is creating one version of understanding what we have access to and what necessarily goes along with that is this understanding”
এডমান্ড বার্ক মনে করতেন, সামাজিক কাঠামোর গঠনরীতি প্রণয়নের সময় আমাদের কৌশল কখনো পুরোপুরি যৌক্তিক হওয়া ঠিক না। এটা না করার জন্য বার্ক অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করেন। যেমন, সমাজে কোন চিন্তা যৌক্তিক কোনটা অযৌক্তিক এটা আগে থেকে ঠিক করে দেয়া ঠিক না। বিশেষ করে একটু মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাই আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুনিয়ার যেকোন ইস্যুকে আমরা র্যাশনালাইজ করতে পারি।
আমরা যুক্তিকে মূল্য দিব, বিজ্ঞানকে মূল্য দিব কিন্তু তাতে দেবত্ব আরোপ করব না। যুক্তি ও বিজ্ঞান কী জিনিস, কীভাবে কাজ করে সেটা আমাদের বুঝতে হবে।
“We should value reason we should value science but not deify them we should understand them for what they are.”
ইওরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকিত মানুষ প্রকল্পের একটা বড় সমালোচনা হলো ‘এইজ অফ রিজন’ মানব ইতিহাসের একটা ভয়ংকর সময় যখন মানুষ যুক্তি দিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে (cultural imperialism) জাস্টিফাই করেছিল।
বিজ্ঞান কী আমাদের সত্যের সন্ধান দিতে পারে?
সত্যানুসন্ধানের জন্য বিজ্ঞানে দুটি বহুল ব্যবহৃত তত্ত্বের একটি হলো ‘করেসপন্ডেস থিওরি‘, সাদৃশ্য বা সাযুজ্যের তত্ত্ব। এর মূল কথা হলো, সত্য এমন একটা বিষয় যার অন্য আরেকটা সত্যের সাথে সামঞ্জস্য আছে। এই তত্ত্ব মনে করে বিশ্বজগতের একটা বাস্তবতা আছে। “Realist effort to base the search for truth on a belief in objective reality”। বিজ্ঞান সেই বাস্তবতাকে আবিষ্কার করে, সেটাকে বিবৃত করে। এসব বচন বাস্তবতার সাথে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারে সেটাই সত্যের পরিমাপ।
সামঞ্জস্য তত্ত্বের বড় সমস্যা হলো মানুষ জীবনে যেসব এলাকায় সত্য খুঁজে এই তত্ত্ব সেগুলোকে কাভার করতে পারে না।
আরেকটি তত্ত্ব হলো সঙ্গতি বা সংসক্তির তত্ত্ব (coherence theory)। কোন একটি ধারণ তখনই সত্য যখন এটা অন্য অনেকগুলো ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। ইউক্লিডের জ্যামিতিতে আমরা সঙ্গতির একটা ভাল উদাহরণ পাই। কোন স্বতঃসিদ্ধ যদি স্বতঃসিদ্ধ না হয় তাহলে অন্য স্বতঃসিদ্ধগুলো দিয়ে সেটাকে সমর্থন করা গেলে সেটা নিজে আরেকটি স্বতঃসিদ্ধে পরিণত হয়। কোন একটা স্বতঃসিদ্ধকে পরিবর্তন করা হলে অন্যসবগুলোতে সেটা প্রতিফলিত হয়।
সংসক্তির তত্ত্ব মোটেই বলে না যে সত্য বিভিন্ন ধারণার সঙ্গতির উপর পুরোপুরি নির্ভর করে। বিজ্ঞানীদের কাজের দিকে তাকালে বুঝা যায় বাস্তবতার ব্যাখ্যার চেয়ে তাদের বিভিন্ন ধারণাগুলোর মধ্যে সঙ্গতি আছে কী না সেটাতে তারা বেশি ইন্টারেস্টেড।
টমাস কুন তাঁর ‘দ্য স্ট্রাকচার অফ সায়েন্টিফিক রেভুল্যুশানস’ বইতে বলেছেন, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় কারণ সেগুলো অন্য তত্ত্বগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
“Scientific theories are considered true because they cohere with other theories.”
কুনের মতে প্রত্যকে বিজ্ঞানী একটা চিন্তার কাঠামো ধরে কাজ করেন যাকে বলা যায় প্যারাডাইম। বিজ্ঞানীদের কম্যুনিটি এই প্যারাডাইমের ব্যাপারে একমত হয়ে সেটাকে তাদের কাজের মূল ভিত্তি-কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করেন। নতুন কোন তত্ত্ব যদি প্যারাডাইমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে তাহলে সেটাকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়। বিজ্ঞানের সত্যকে কুন বলেন, ঐক্যমতের ভিত্তিতে সত্য, ‘consensus theories of truth’ অথবা, “human centered conception of truth”।
বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইমঃ
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে বিজ্ঞানী নিউটন এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বের পার্থ্যক্যঃ
নিউটনের মতে দুটি বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে। গ্রহগুলোর কৌনিক ভরবেগ আর মাধ্যাকর্ষণের মধ্যে সামঞ্জস্যের কারণে তারা নিজেদের কক্ষপথে ঘুরতেছে।
আইনস্টাইনের মতে বড় বড় ভরের বস্তুগুলো তাদের চারপাশের স্পেইস বা ফাঁকা স্থানকে বাঁকা করে। গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশের এই বাঁকা অংশ দিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। তাদের মধ্যকার আকর্ষণ কোন ফ্যাক্টর নয়ৎ
সামঞ্জস্য তত্ত্ব অনুসরণ করে দার্শনিক কার্ল পপার মনে করেন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বাস্তবতার একটা মৌলিক বিষয়। নিউটনের তত্ত্ব বিষয়টাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু আইনস্টাইন আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমাদের বস্তু বিশ্বের ঘটনাপঞ্জীর আরো সত্যতর একটা বর্ণনা হাজির করেছেন। একটা অবজেক্টিভ রিয়ালিটিকে এখানে আছে বলে ধরে নেয়া হয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে আমরা আরো ভালোভাবে সেটা বুঝতে পারব সামঞ্জস্য তত্ত্ব এই আশাবাদ নিয়ে থাকে।
কুনের কাছে মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে নিউটন এবং আইনস্টাইনের তত্ত্ব জাস্ট দুটি প্যারাডাইম বা মডেল। যেসব ব্যাখ্যা দুটি ভিন্ন সময়ের বিজ্ঞানীদের দ্বারা সাদরে গৃহীত হয়েছিল।
বিজ্ঞানের সত্যানুসন্ধানের জন্য আরেকটি দর্শন ব্যবহৃত হয়,যেটাকে বলা হয় প্রাগম্যাটিজম বা প্রয়োগবাদীতা। এই তত্ত্ব বিশ্বজগতের কোন চিত্র হাজির করে না, কিন্তু গণনা বা হিসাব করার জন্য একটা যান্ত্রিক মাধ্যম দেয়। যেগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা জগত সম্পর্কে ভাল ভবিষ্যদবাণী করতে পারে। পদার্থবিদ্যার কোপেনহ্যাগেন ইন্টারপ্রিটেশান তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় প্রয়োগবাদীতার ব্যবহার করেন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বঃ আগে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন নিউটনের বলবিদ্যা দিয়ে বস্তুবিশ্বের সকল গতি ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা যাবে। কিন্তু বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং আরো অনেকে মতামত দেন, কোয়ান্টাম লেভেলে নিউটনের সূত্র কাজ করে না।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী কোন বস্তু কণার ভর অথবা বেগ পরিমাপ করা যাবে কিন্তু দুটো একসাথে করা যাবে না। সেজন্য বোর মত প্রকাশ করেন যে, কোয়ান্টাম লেভেলে আসলেই কি আছে সেটা জানার চেষ্টা না করে আমাদের উচিত একে পরিমাপ/গণনার একটা পদ্ধতি হাতিয়ার (calculating tool) হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। এটা প্রাগম্যাটিজমের একটা প্রয়োগ।
আইনস্টাইনের মন-মানসিকতা ছিল বাস্তববাদী। জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি একটা ‘সমন্বিত ফিল্ড থিওরি’ বানানোর বিফল চেষ্টা করেন। যেটা সফল হলে কোয়ান্টাম জগতের ঘটনাগুলোর একটা বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যেত।
একটা সত্য দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে গেলে সেটা ব্যর্থ হবে। তেমনি যেকোন একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে সবরকম বৈজ্ঞানিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও সেটাও ব্যর্থ হবে। বিজ্ঞান দিয়ে দুনিয়ার বাকি সব বুঝানো তো আরো দূরের ব্যাপার।
বিজ্ঞানের আলোচনায় ভারতবর্ষে বিজ্ঞান বলতে কি বুঝানো হতো সেটাও জানা দরকার। বিজ্ঞান শব্দটি অনেক পুরাতন, সায়েন্সের বাংলা অনুবাদ করে বিজ্ঞান বাংলায় প্রবেশ করেনি, আগে থেকেই ছিল। উপনিষদে আছে আত্মা আমাদের শরীরে মোট পাঁচ ধরণের কোষ দিয়ে আবৃত। এরমধ্যে এক প্রকার কোষের নাম বিজ্ঞানময় কোষ।
“বহিজগৎ এবং অন্তর্জগৎ বিষয়ক বিবিধ জ্ঞানের নাম বিজ্ঞান। ইহা হইতেই কল্পনা, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার প্রাদুর্ভূত হয়; ইহা সর্ব্বদা বীজভাবে জীবের চিত্তে বৰ্ত্তমান থাকে; এবং সমাধি ও সুষুপ্তি অবস্থাতেও ইহা বিনষ্ট হয় না। যে জীবের যত প্রকার জ্ঞান থাকে সেই সমস্ত জ্ঞানের সমষ্টিই সেই জীবের বিজ্ঞানময় কোষ।”
সবশেষে বলা যায় বিজ্ঞান কোন অন্তিম দর্শন বা প্রজ্ঞা নয়। এটি একটি কৌশল, টুল বা হাতিয়ার। জাগতিক, পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা একটা প্রতিষ্ঠিত মডেলের ভিত্তিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরিমাপ চালিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান। নতুন সিদ্ধান্তগুলো সত্য হতে হবে এমন কোন কথা নেই, কিন্তু ইতোমধ্যে ধরে নেয়া স্বতঃসিদ্ধ এবং মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অথবা এমন হতে পারে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ফলাফল থেকে আমরা সঠিক জানতে পারব না কী ঘটছে কিন্তু সেটা যদি আমাদের বস্তুজগতকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে তাহলে একটা ‘ক্যালকুলেটিং টুল’ হিসেবে বিজ্ঞানের গুরুত্ব কমে যায় না। কিন্তু এতে করে কোনভাবেই বিজ্ঞানকে অন্য সব বিষয়ের উপর ছড়ি ঘুরানোর অধিকার দেয়া হয় না।