১
১২১১ বার পঠিত
জ্ঞানের উৎপত্তিটা প্রশ্ন থেকে। প্রশ্নের ধারাবাহিকতায় আসে উত্তর, আর উত্তরই জ্ঞান। প্রশ্ন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। মানুষের মনের দ্বন্দ্ব মেটাতেই প্রয়োজন জ্ঞানের। উত্তরটা তাই। সুতরাং একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের প্রশ্ন এবং জ্ঞানের দ্বন্দ্বে তাকে জ্ঞানের দ্বারাই উত্তর দেয়া সম্ভব। আদালতের কাজ স্বীকৃত জ্ঞান অনুযায়ী আদেশ দেয়া। জ্ঞান আদালত নির্ধারণ করে না। একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে জেলে দেয়ার আগে এটা ভাবা উচিত সকল পক্ষের। বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ব্যাপারটি তাই। তার বক্তব্য ভুল হলে, শিক্ষা বিভাগ আছে তাকে শুধরে দেয়ার জন্য। তিনি যদি ভুল বলেন, ভুল শিক্ষা দেন তবে তার চাকুরি চলে যাবে। কিন্তু তাকে ধরেমেরে আইনের কাছে সোপর্দ করার মানে হলো প্রচলিত নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো।
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোটা বোধহয় অলিখিত আইন হয়ে উঠছে। যশোরে এক শিক্ষককে হুমকি দেয়া হয়েছে। যার অডিও এখন সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল। সেখানেও দেখা গেছে প্রচলিত নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর প্রচেষ্টা। যেমন ‘হুটার’ বা সাইরেন এখন সরকারি নয় বেসরকারি গাড়িতেও লাগানো থাকে। একটু প্রভাবশালী হলেই গাড়িতে হুটার লাগানো এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন রাস্তায় সবাইকে জানিয়ে যাওয়া ‘মুই কি হনুরে’। এটাও নিয়মের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি। এমন বৃদ্ধাঙ্গুলি এখন সব জায়গাতেই প্রদর্শিত হচ্ছে। অর্থ-বিত্ত-প্রভাব যার আছে তাদের সবার মধ্যেই একটি অদৃশ্য ‘হুটার’ লাগানো। সবাইকে বলছে, দেখো আমি এসেছি, ‘দেখো মুই কি হনু’।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অদৃশ্য ‘হুটার’ এখানেও। আমার এক স্যার বলতেন, ‘প্রচুর বই পড়ে, কিন্তু বোঝার ক্ষমতার নেই, এমন মানুষ থেকে দূরে থাকবে’। এক সময় প্রচুর বইপড়া মানুষ ছিলেন। তাদের অনেকেরই বইয়ের মূলকথা অনুধাবনের সামর্থ্য ছিলো না। মস্তিষ্ক নিতে চাই তো না। আর এখন অবস্থা আরো ভয়াবহ। বোঝার দরকার নেই, পড়াও বাদ দিয়েছেন। এর-ওর কাছ থেকে শুনেই রীতিমত বোদ্ধা হয়ে যান। আর সেই বোদ্ধাগিরি প্রকাশের জন্য তো সামাজিকমাধ্যম রয়েছেই। একজনকে দেখলাম সাম্প্রতিক সংস্কৃতি বিষয়ে আলাপে লিখছেন, ইসলাম এ ভূখণ্ডে এসেছে এগার শতকে। আরেকজন আপত্তি করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যেন। বললেন, রেফারেন্স দিন। যখন বিপরীতে প্রমাণ করে দেয়া হলো ইসলামের আগমনের শতক হলো সপ্তম। সেই বোদ্ধা চুপ করে গেলেন।
তবে এসবই খুচরা আলাপ। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ আলাপ হলো, একজন বললেন, মুসলিম সংস্কৃতি মরু-সংস্কৃতি। বাংলায় মরু-সংস্কৃতির কোনো জায়গা নেই। বাংলায় থাকলে বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে থাকতে হবে, মানতে হবে, এমনটা। কী ভয়াবহ কথা। অর্থাৎ মুসলিম থাকতে হলে, ‘বাঙালি’ত্ব থাকবে না! কী ভয়ানক সাম্প্রদায়িকতা। কতটা সাম্প্রদায়িক হলে, কতটা মূর্খ হলে এমন বলা যায়।
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। একসময় সতীদাহ প্রথা সংস্কৃতির অংশ ছিলো। সতীকে জীবন্ত দাহ করার আগে রীতিমত উৎসব হতো। বাজনাবাদ্য সহকারে সতীকে চিতায় তোলা হতো। এই ভয়াবহতাও সংস্কৃতির অংশ ছিলো এবং তা স্বীকৃত। এটা পরিবর্তিত হয়েছে। এই যে টিপ বিষয়ে সংস্কৃতির কথা যারা তুলছেন তাদের যদি টিপ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তারা সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলবেন, এটা সৌন্দর্য চর্চার বিষয়। কিন্তু কেউ যদি টিপকে রেসিজম তথা বর্ণবাদের প্রতীক বলেন তবে কি ভুল হবে? হবে না। এক সময় বর্ণাশ্রম অনুযায়ী টিপের শ্রেণিবিন্যাস করা হতো। অর্থাৎ তা হতো জাতপাতের ধারা মেনে। ব্রাহ্মণদের সাদা টিপ, ক্ষত্রিয়দের লাল, ব্যবসায়ীদের সবুজ, ছোটজাতের নমঃশূদ্রদের কালো। আমরা যদি আদি-সংস্কৃতি মানতে যাই, তাহলে তো রেসিজমকে স্বীকার করে নিতে হয়। একই ভাবে সংস্কৃতির গোড়া খুঁজতে গেলে অনেকের নিজের গোড়াই আলগা হয়ে যাবে। দেখা যাবে নিজের সাথে নিজের বৈপরীত্যের অসংখ্য চিত্র।
হালে অনেকে বলতে শুরু করেছেন পানি বলাটা ঠিক নয় জল শব্দটি ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির অংশ। একটু নোট দিয়ে রাখি, ‘বাঙালি’ শব্দটি নিয়েই অনেক কথা রয়েছে। আমরা বাঙাল না ‘বাঙালি’ তা নিয়েও দ্বন্দ্বটা কম নয়। আরেকদিনের আলোচনায় তা বলবো। ‘বাঙালি ছিলামরে’, এই আনন্দও হয়তো তাতে প্রশ্নের মুখে পড়বে। যাকগে, এখন কথা বলি জল ও পানি শব্দ নিয়ে। জল শব্দটি হলো সংস্কৃত শব্দ। পানিকে অনেকে বলেন তদ্ভব। কিন্তু এ বিষয়েও দ্বিমত রয়েছে। অনেকে বলেন পানিই মূল শব্দ। জল সংস্কৃত এর সংস্কার করা রূপ। মজার ব্যাপার হলো প্রাচীন বাংলায় পানি শব্দটিই ব্যবহার হতো, জল নয়। উদাহরণ দিই বাংলা ভাষার কথিত আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে।
‘তিণ ন চছুপহী হরিণা পিবইই ন পাণী।
হরিণা হরিণির নিলঅ ন জাণী।।’
অর্থ হলো, বন্দি হরিণ আতঙ্কে পানিও পান করে না। এসব রচনা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে। আর ইসলামের আগমন ভারতবর্ষে ৭ম শতকের শেষে হলেও মুসলমানদের ভারত বিজয়ের শুরু ১২ শতকে। সুতরাং কেউ যদি বলেন, বাংলা ভাষাতেও জোর করে মুসলমানরা পানি শব্দটি ঢুকিয়েছে তাহলে তারা মুসলমানদের সংস্কৃতিকে মরু-সংস্কৃতি বলার মতন মূর্খদেরই দলে। যেমন, উর্দুতে আছে এবং মুসলিমরা বলেন ভেবে পানি শব্দটির উৎপত্তি উর্দু থেকে বলেন অনেকে। কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে আরবি বা ফার্সি উদ্ভুত বলতেও বাদ যান না। এদের জন্য কৃষ্ণের কীর্তন থেকে উদাহরণ দিই। যে লীলাকীর্তনকে তারা বলেন বাংলার ‘আদি-সংস্কৃতি’। এমন বলাও অবশ্য প্রশ্নের বাইরে নয়। সেই কীর্তনেই খোদ রাধার আকুলতায় এসেছে পানি শব্দটি।
‘আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।।’
কী বুঝলেন? রাধাও ‘পাণী’ তথা পানি’র কথাই বলেছেন, জল নয়। সুতরাং ‘সংস্কৃতি দাদা’দের অবস্থা হলো কলকাতার ষোলআনা ফাঁকি বাবুদের মতন। তাদের ভাষায় যা আদিবাংলা সে বাংলায় পানি শব্দের ব্যবহার ছিলো সর্বজনে, পক্ষান্তরে জলের ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ। জল, বাঙালি এই শব্দগুলির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তা জোরালো হয় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। আর এই যে কথিত ‘সংস্কৃতিতত্ত্ব’ সেটার শুরুও সেখান থেকে। যা মূলত রাজনৈতিক এবং এখনও তাই। রাজনৈতিক কারণে এই সাংস্কৃতিক তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। পানির ব্যবহার এক পশ্চিমবাংলা ছাড়া কোথাও নেই, থাকলেও তা বাংলাভাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আদি বাংলা সংস্কৃতিতে যে আলাপ নেই, সেই বায়বীয় আলাপকেই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে হাল সময়ে। যার ফলেই জলকে আদি-সংস্কৃতি বলা হচ্ছে আর পানিকে মরু-সংস্কুতি। কাগজে পানিবদ্ধতা না লেখে লেখা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। পানি না লিখে লেখা হচ্ছে পানীয়জল। ওই জোক এর মতন, ‘একটা এল দিলেও চলে, দুটো দিলে পিলার শক্ত হয়’।
অনেকে কথায় কথায় হাজার বছরের সংস্কৃতির আলাপ তোলেন। প্রশ্ন করে দেখুন তো, হাজার বছরের আলাপ পরে তার আগে সংস্কৃতি কী তার সঠিক উত্তর দিতে পারেন কিনা। কোন সংস্কৃতির কথা বলেন তারা। তারা যে সংস্কৃতির কথা বলেন তা হলো আর্য সংস্কৃতি। অ্যারিয়ান সিভিলিজেশন। অ্যারিয়ানরা কী ভারতীয় উপমহাদেশের, বলে দেখুন কী জবাব দেন সেই সংস্কৃতির বাবুরা। যে ভূখণ্ডে বাদ্যযন্ত্র বলতে নাল আর বীণা। রাগ বলতে ইমন। সাহিত্য বলতে গেলেই আর্য সাহিত্য। সেখানে হাজার বছরের সংস্কৃতির বড়াই একটা বড় বাহুল্য। মূর্খতা প্রমাণের বাহুল্য। হ্যাঁ, এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতির সান্নিধ্যে ক্রমে ক্রমে নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। সংস্কৃতির ধারাই তাই। সংস্কৃতি মানেই সংস্কারকৃত রূপ। হাজার বছরের সংস্কৃতি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা সংস্কারহীনদের এসব কে বোঝাবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
এপ্রিল ৮, ২০২২; ১১:৪০ অপরাহ্ন
ভালো লেখা। ❤️