এই সপ্তাহে বিটকয়েন এর শেয়ারের দাম ২০ হাজার ডলার ছাড়াল। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধ্বসের সময় বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির শুরু হয়, আর ২০২০ সালে আরেক ধ্বসের সময় বিটকয়েনের শেয়ার সবার জল্পনা-কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান ট্রেণ্ড চালু থাকলে ভবিষ্যতে বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, এমনকী আমাদের চির পরিচিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আমূলভাবে পরিবর্তিত করে দিতে পারে।
ট্রাডিশনাল অর্থনীতিতে যেভাবে টাকার উৎপাদন, বিপণন ও হস্তান্তর হয় তাতে টাকা ব্যবহারকারী ক্রেতা এবং বিক্রেতা দু’পক্ষকেই ব্যাংক এবং অন্যান্য ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানকে নানারকমের ফি দিতে হয়। এছাড়া যেকোন সময় টাকার মূল্যের অবনমন হতে পারে। ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হলে সম্পূর্ণ টাকা খোয়া যেতে পারে।
টাকার দ্বারা আসলে কী বুঝানো হয়? টাকা-পয়সা একটা বিনিময় রীতি যার মূল্য হলো আস্থা, বিশ্বাস, ট্রাস্ট। আধুনিক রাষ্ট্রে টাকা মানে ট্রেজারি বিল, বাংলাদেশে যেমন লেখা থাকে ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’। ক্রেতা ও বিক্রেতা যদি অন্যকোনভাবে এই আস্থা বা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যাংক এবং ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর ফি গুণতে হয় না। এসব গাণিতিক ট্রানজেকশান যদি এমন হয় কোনভাবেই জালিয়াতি করা সম্ভব হবে না তবে সেটা খুব সহজে জনপ্রিয়তা পাবে। তার উপর এই টেকনোলজি যদি হয় ওপেন সোর্স তবে সোনায় সোহাগা।
বিটকয়েন এর ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছে। ২০০৮ সালের ৩১ অক্টোবর অর্থনৈতিক ধ্বসের ঢামাডোলের মধ্যে সাতোশি নাকামোতো নামে কেউ একজন অনলাইনে ক্রিপ্টোকারেন্সির হোয়াইট পেপার প্রকাশ করেন। কেউ একজন বললাম কারণ সাতোশি যে কে সেটা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। সে পুরুষ না মহিলা, একজন মানুষ না একটা সংঘবদ্ধ দল সেটাও গত বার বছরে জানা যায়নি। সাতোশি বর্তমান সময়ের লিভিং লিজেণ্ড। এখন পর্যন্ত অনেকে নিজেকে সাতোশি বলে ঘোষণা দিলেও সবগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ফ্যাক্ট ইজ রিয়েলি স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান। ভবিষ্যতে কখনো হয়ত জানা যাবে সাতোশি কে ছিলেন কিন্তু আপাতত সেটা জানার কোন উপায় নেই। নাম শুনে জাপানিজ মনে হলেও সে যে জাপানিজ হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই।
“We have proposed a system for electronic transactions without relying on trust. We started with the usual framework of coins made from digital signatures, which provides strong control of ownership, but is incomplete without a way to prevent double-spending. To solve this, we proposed a peer-to-peer network using proof-of-work to record a public history of transactions that quickly becomes computationally impractical for an attacker to change if honest nodes control a majority of CPU power. The network is robust in its unstructured simplicity. Nodes work all at once with little coordination. They do not need to be identified, since messages are not routed to any particular place and only need to be delivered on a best effort basis. Nodes can leave and rejoin the network at will, accepting the proof-of-work chain as proof of what happened while they were gone. They vote with their CPU power, expressing their acceptance of valid blocks by working on extending them and rejecting invalid blocks by refusing to work on them. Any needed rules and incentives can be enforced with this consensus mechanism.” – বিটকয়েন শ্বেতপত্র
সাতোশি তার শ্বেতপত্রে বলেন ট্রাডিশনাল ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে যে আস্থা কাজ করে তারা সেটার ব্যবহার না করে ইলেকট্রনিক বিনিময় প্রস্তাব করেন। যেখানে একটা পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কে যে কোন লেনদেনের রেকর্ড রাখা হবে যেটা অপরিবর্তনীয় এবং খুবই দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হবে। লেনদেনের এই ইতিহাস কেউ পরিবর্তন করতে চাইলে সেটা নেটওয়ার্কের সবাই জেনে যাবে। তখন নেটওয়ার্কের সবাই মিলে সেটা রিজেক্ট করবে। কেউ যোগ দিতে চাইলে সবার সম্মতিক্রমে যোগ দিতে পারবে।
২০০৮ সালের পর থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশেষ করে বিটকয়েন নিয়ে অনেক আলোচনা শুরু হয়। প্রথম দিকে অনেক একে উড়িয়ে দেন। তারপরেও আস্তে আস্তে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। ক্রিমিনালদের একটা বড় সমস্যা টাকার লেনদেন এবং সেটার পরিবহন, যত বেশি টাকা সেটা নাড়াচাড়া, পরিবহন করা তত বেশি সমস্যার। সেজন্য নিরাপদ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ক্রিমিনালদের মধ্যে বিটকয়েন খুব জনপ্রিয়তা পায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তাদের ধরার উপায় থাকে না। ২০১১ সালে গকার ম্যাগাজিনে বিটকয়েনের মাধ্যমে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ড্রাগ কেনার খবর প্রকাশিত হলে সেটা বিটকয়েনের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। একলাফে বিটকয়েনের শেয়ার ১০ ডলার থেকে ৩০ ডলার হয়ে পড়ে। ডার্ক ওয়েবে বিটকয়েন ব্যবহার করে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে অর্থ বিনিময় হচ্ছে কিন্তু তাদের কিছু করার থাকে না। ধীরে ধীরে ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিনিময়কে নিরাপদ করতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা শুরু করে। মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সির গুরুত্ব বুঝতে পারে। মোট কথা ক্রিপ্টোকারেন্সি সিস্টেম এখন এতটাই শক্তিশালী যে যেকোন দেশের কারেন্সি সিস্টেম, বিনিময় প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে।
রিসেন্টলি ভিসা এবং পেপ্যাল এর মত বিখ্যাত কোম্পানি ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা শুরুর পরে বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোর দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। করোনা উত্তর টাকার মূল্যের অবনমন ঠেকাতে বর্তমানে অনেকে বিটকয়েনে বিনিয়োগ করা শুরু করেন। বিটকয়েন এখন কারেন্সি হিসেবে অনেক ম্যাচিওর। ক্রিমিনালদের বদলে এখন ব্যাঙ্কগুলো ( স্যুটেড বুটেড ক্রিমিনাল) বিটকয়েন ব্যবহার করছে।
বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি বেশি প্রচারণা পেলেও যে প্রযুক্তির মাধ্যমে বিটকয়েনের প্রসার সেটা হলো ব্লকচেইন।
“The technology most likely to change the next decade of business is not the social web, big data, the cloud, robotics, or even artificial intelligence. It’s the blockchain, the technology behind digital currencies like bitcoin.” – Harvard business review, May 2016, Don Tapscott and Alex Tapscott
ব্লকচেইন প্রযুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি ডিস্ট্রিবিউটেড। মানে হলো অন্যান্য ফাইনান্সিয়াল ড্যাটাবেইজ যেমন খুব কঠোরভাবে রক্ষা করা হয় ব্লকচেইনে সেটা করা হয় না। ব্লকচেইন সবার জন্য উমুক্ত। বিটকয়েনের ব্লকচেইনে যে কেউ প্রবেশ করতে পারবে।
বিটকয়েন ব্লকচেইনের আরেকটি বিশেষ দিক হলো প্রত্যেকটি বিনিময় ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে সত্যায়িত করা হবে যাতে করে একমাত্র বিটকয়েনের মালিক সেটা বিনিময় করতে পারেন। ব্লকচেইনে এসব বিনিময় কিভাবে সংযুক্ত হবে তাতেও ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। বিনিময়গুলো একেক্টা ব্লক হিসেবে একটা চেইনে সংযুক্ত থাকে সেজন্য এই প্রযুক্তির নাম ব্লকচেইন।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো বিটকয়েনের ব্লক চেইনে কেবল ব্লক আকারে বিনিময় যোগ করা যাবে। একবার যোগ করার পরে সেটা আর ডিলিট করা যাবে না। একবার তথ্য ঢুকানো হলে আর কখনো পরিবর্তন করা বা মুছে ফেলা যাবে না, অডিটের জন্য একটা সূত্র হিসেবে থেকে যাবে।
সবশেষে থাকে প্রুফ অফ ওয়ার্ক যার মাধ্যমে উপরের সবগুলো বৈশিষ্ট্যকে একসাথে কাজে লাগানো হয়। এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয় কিভাবে বিনিময়গুলো একটা ব্লকে যাবে এবং ব্লকগুলো কীভাবে একে অপেরের সাথে শৃঙখলিত থাকবে। কম্পিউটার বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মাইনার’ তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে কে আগে চেইনে নতুন ব্লক যোগ করতে পারবে। নতুন ব্লক যোগ করতে পারলে মাইনাররা তার জন্য বিটকয়েন পায়, যেজন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এর মাধ্যমে অবশ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। যদি কেউ বিটকয়েনের ব্লকচেইনে টেম্পার করতে চায় তাহলে তাকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাইনারদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। মাইনাররা ক্রিপ্টোগ্রাফির ধাঁধার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে যেটা করতে পারলে তারা বিটকয়েনের ব্লকচেইনে একটা বিনিময় যোগ করতে পারবে। এ ধাঁধার চারটি ধাপ, সময়, বিনিময়ের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ, আগের ব্লকের আইডি এবং নন্স নামের একটা র্যাণ্ডম নাম্বার। বাকি তিনটির সাথে নন্স যোগ করা হলে ধাঁধার সমাধান করা যাবে।
প্রুফ অফ ওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আগের ব্লকের আইডি, যাতে ব্লকটি কখন সৃষ্টি করা হয়েছে, এতে কোন কোন বিনিময় সম্পাদন করা হয়েছে, তার আগের ব্লক কোনটি এবং ব্লকের নন্স নাম্বার।
এক কথায় বলতে গেলে বিটকয়েন হলো কিছু হার্ডওয়্যার, অপারেটিং সিস্টেম, এপ এবং এসবের ব্যবহারকারী। বিটকয়েন ব্যবহারের জন্য তাই শক্তিশালী কম্পিউটারের প্রয়োজন হয় এবং বিপুল পরিমাণে বিদ্যুত খরচ হয়। ২০১৯ সালে এক গবেষণায় জানা যায় সারা দুনিয়ায় বিটকয়েন ব্যবহার করার ফলে সুইজারল্যাণ্ডের সমান বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিটকয়েনের বিরুদ্ধে এটি একটি শক্ত অভিযোগ। তবে আরো বেশি প্রতিষ্ঠান ব্লকচেইন প্রযুক্তি গ্রহণ করলে এই সমালোচনা ধোপে টিকবে না।
ক্রিপ্টোকারেন্সি তার শৈশব, কৈশোর পার করে এখন অনেক ম্যাচিওর। দুনিয়ার প্রভাবশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমদিকে একে উড়িয়ে দিতে চাইলেও ব্লকচেইনের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার কারণে আস্তে আস্তে একে এডপ্ট করে নিচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতের দুনিয়ায় ফাইন্যান্সিয়াল বিনময়, টাকার ধারণার আমূল পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা আছে।