০
৫৯১ বার পঠিত
রাস্তায় পড়া এক সেন্ট কুড়িয়ে নিচ্ছে এক মেয়ে, মুখ তুলতেই দেখি রিনা। দিদি গ্লুক আনবে। গ্লুক মানে ভাগ্য। জার্মানিতে এই এক সেন্টের বড় কদর সববয়সী জার্মান মেয়েদের কাছে। এক চলতি সংস্কার। ভাগ্য ফিরবে। আসবেই, ঠিকই আসবে বললাম রিনাকে। বহুদিন পরে তোমায় দেখলাম। হ্যাঁ দিদি,এদিকে তেমন আসা পড়ে না তো, অনেক দূরে বাসা আমার দিদি, শহরের প্রান্তে। ভাড়াটা তাই কম। মেয়ে ক্লাশ থ্রিতে উঠল। বাঃ বেশ বড় হয়ে গেছে। তাই তো ফুল টাইম জব করতে পারি। স্কুলের পরে ও একাই হরটে চলে যায় (হরট= জার্মানিতে স্কুল দুপুরে শেষ হবার পর শিশুরা এখানে খেলাধুলো, হোমওয়ার্ক করতে পারে, যাকে আফটার স্কুল কেয়ার সেন্টারও বলা যেতে পারে। অতি সামান্য খরচায় খাবার ব্যবস্থাও থাকে। বিশেষ করে যাদের মায়েরা পেশায় যুক্ত, সেসব বাচ্চারা ওখানেই বিকাল পাঁচটা অবধি নিশ্চিন্তে থাকতে পারে)।
দিদি আসবেন আমার নতুন বাসায়, সম্পুর্ণ আমার। নিশ্চয়ই যাব বলে বিদায় নিলাম রিনার কাছ থেকে।
রিনার সাথে প্রথম দেখা হয় প্রায় আট বছর আগে। ও সবে তখন এ দেশের মাটিতে পা দিয়েছে। বিদেশে এসে প্রথম দিকে সবাই বড় অসহায় থাকে। এক ভাষা দুই আবহাওয়া। দুটিকেই বৈরি মনেহয় যারপরনাই। সংগ্রামটা শুরু হয় প্রথম দিন থেকেই। রিনার বাড়ি ফরিদপুর। কবি জসিমুদ্দিনের দেশ। ওখান থেকেই সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক করে ওর চাচা। চাচা রক্তের নয়, তারচেয়েও বেশি আপন।
খুব ভালো রোজগার, রেস্তরাঁ আছে। জার্মানির মত দেশে থাকে। দেখতেও বেশ। আপত্তি করেনি রিনা সুলতান। সদ্য বি,এ পাশ করে চাকরির চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে সে, ঠিক তখনি চাচা এই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। যাইহোক, বিয়ে হয়ে যায় টেলিফোনেই। কারণ পাত্র সবে দেশ থেকে আসায়, বছর দুয়েক এর মধ্যে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই বলে।
রিনা প্রথমেই এসে জানতে পারে যে রেস্তোরাঁ নাম করে রাজীব বিয়ে করেছে, সেটা বন্ধু রফিকের। সেখানে সে কাজ করে, ম্যানেজার অর্থাৎ হেড কেলনার, ওয়েটার অর্থাৎ মুখ্য খাদ্য পরিবেশক।
এই মিথ্যাচারটা রিনার সহ্য হয়নি, বরং বেশ অপমানিত বোধ করে সে। কেন এমন করলে আমার সাথে, আমার পরিবারের সাথে। রাজীবের উত্তর, এটা কী এমন মিথ্যা। রফিকের দোকান মানেই আমার দোকান। আমরা পরানের দোস্ত। ওর মানেই আমার।
এই মিথ্যে দিয়ে শুরুটা রিনা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। সারাদিন একাই থাকে ঘরে, রাজীব গভীর রাতে ফেরে, তাই ঘুমিয়ে থাকে বেলা বারোটা অবধি। স্নান খাওয়া সেরে দুটোর আগেই কাজে চলে যায়। সপ্তাহে একদিন পাওনা ছুটি নেয়না। কারণ দেশে জমি কিনবে ওর আব্বা।
আমাকে স্কুলে ভরতি করে দাও। আমি ভাষা শিখতে চাই। এত তাড়াহুড়ার কী আছে। সব আস্তে আস্তে শিখবে। আমার বাসায় একা ভালো লাগেনা যে। বিয়া করলে সব অ্যাডজাস্ট করতে হয়। রিনার দুপুর ফিরে দেখে সেই নীল আকাশ। দিগন্ত খোলা মাঠ। পাখিদের সন্ধ্যার বচসা। মায়ের হাতের রান্না। আহা, মনেহয় যেন কত হাজার বছর সে না খেয়েই আছে।
শুনছো, প্রায় দু’বছর হতে চলেছে মাকে আব্বুকে দেখিনা। আর তো মাস চারেক বাদেই আমাদের দেশে যাওয়া, তাইনা। তুমি যাবে? কেন? জাননা, দু’জনের প্লেনের টিকিটের কত দাম? আমি ত যাচ্ছি দরকারি কামে। যাব আর আসব। জমিটা রেজিস্ট্রি হলেই চলে আসব। তুমি কদিন একটু কান্তা ভাবির সঙ্গে থেকো। একটু এডজাস্ট করে নাও।
কান্না গুলিয়ে ওঠে শরীরের সব ফোকরে। শুধু চেপে থাকে রাজীবের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার অপেক্ষায়। বমি করে দুবার নেতিয়ে থাকে সারাদিন ড্রইংরুমের সোফায়।
তখন এখানে হেরবসট। হেমন্তকাল। পাতা ঝরে যায় সব গাছের। একা একা দাঁড়িয়ে থাকে সব গাছ। রিনার ও নিজেকে গাছের মতই মনেহয়। আব্বু মা ভাই বোন নদী মাঠ হারিয়ে একা একা বাঁচা। এ কেমন জীবন। একেই কী বলে সংসার। এ কেমন সংসার। সংসার তো মিলেমিশে বেঁধে ঘর করা। এত ছাড়াছাড়া ভাব। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে, কেন এই বিবাহবন্ধন।
রাজীব ফিরে এলো। ছ সপ্তাহ পরে। দেখ তোমার বাসা থেকে কত কিছু পাঠিয়েছে, যা যা তুমি পছন্দ কর। রিনা সোফা থেকেই উত্তর দেয়। ঠিক আছে, রান্নাঘরে রেখে দাও। এখানে এসো। একটা কথা আছে।
আমি মনেহয় মা হতে চলেছি।
মা, মানে কী? সন্তান? আমাদের? নাতো কাদের। আমার? আমি তো দেশে ছিলাম!
প্রথমে কোন কথা আসেনা মুখে। কিছুক্ষণ পরে ডুগরে কেঁদে ওঠে আজ রিনা। তুমি এত নীচ! ছিঃ ছিঃ।
নীচের কী হল। আমি শুধু আমার না থাকার কথা বললাম।
আকাশ ভাঙ্গা শব্দটার মানে রিনা অনুভব করল সেদিন। পেটে হাত বোলাল। দীর্ঘনিঃশ্বাস এল। অনেক দেরী হয়ে গেছে। রিনা মানল।
একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিল রিনা, নাম রাখল রাশা। মেয়ের জন্মদিনে রাজীব বেশ অনেক লোককে ডেকে ছিল। বাঃ খুব ভালো আয়োজন করেছ, বলেছিলাম। দিদি তেমন কী আর, ছেলে হলে দেখতেন, সব ভরিয়ে দিতাম।
রাজীব চেনাল নিজেকে।
মেয়ে হবার পর অত্যাচারটা বাড়তে থাকে। রিনাকে কারুর সাথে মিশতে না দেওয়া। ফোন কল লিস্ট চেক করা। প্রতিটা কেনাকাটার বিল চেক করা। ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কিছু মুখ বুজে মেনে নিলেও ভাষা শেখা বন্ধ করায় চেষ্টা করায়, রিনা প্রথম প্রতিবাদ করে ওঠে।
বিদেশে ভাষা যে প্রথম ভরসা, তা এতদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছে। সব আপত্তি সত্বেও স্কুলে যাওয়া সে বন্ধ করেনি।
চলতে থাকে সংসার। যেমন চলে নদী, আপন ছন্দে। দু’পারের মানুষজনের সুখদুঃখ অভাব অভিযোগ, কিছু না দেখার ভান করে।
একদিন খুব সকালে টেলিফোন এলো। এত সকালে সচরাচর বিদেশে কেউ ফোন করেনা। যার কণ্ঠস্বর শুনলাম সে রিনা। অর্ধেক কথা বুঝলাম। কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। যেটা বুঝলাম তা,
রাজীবের জার্মান মেয়ে মারিয়ন ফোন করে তার পরিচয় দিয়েছে। তার মায়ের সাথে রাজীবের যে কথা হয়েছিল, তা রাজীব রাখেনি। তাই সে আজ সরাসরি কথা বলতে চায় বাবার সাথে। মারিয়ন আজ সতেরোয় পা দিয়েছে।
এদেশে থাকার জন্য বিদেশি মেয়ের সাথে সন্তান জন্ম দেয়। বাচ্চা দেখিয়ে থাকার অনুমোদন পায়। সেই অনুমোদনে পার্মানেন্ট ভিসার স্ট্যাম্প পড়লেই। বিদেশি বউ বাচ্চা ছেড়ে, দেশ থেকে দেশীয় মেয়ে নিয়ে চলে আসে।
কী বিচিত্র, এত প্রাণহীন কী করে মানুষ হতে পারে। বিদেশি দেশী সব মেয়েদেরই ঘর মোছার ন্যাকড়া মনে করে এরা।
এই ঘটনার আরও বেশ কিছুদিন পর রিনার সাথে দেখা, বাজার করতে গিয়ে।
বেশ অবসাদ ভরা মুখ। কেমন আছো জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে হল না।
এগিয়ে এসে নিজেই কথা বলল। দিদি, রাজীব আমাকে কী বলেছে, শুনবেন?
কী?
কী করব, তোমাকে আগে বলতে পারিনি, ভয়ে। আমার আগের বিদেশি বউ এর ঘরে একটা মেয়ে আছে। বুঝোইত এখানের কাগজের জন্যই তো, এগুলা করতে হয়েছিল।
যাইহোক, তুমি, রিনা একটু অ্যাডজাস্ট করে নাও।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন