আমরা বহুসংস্কৃতির পরিসরে এবং বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখানেও সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতি ও উপজাতির পরিচয়। আধুনিক আচরণে আমরা ছাঁচে ঢালা অপরিবর্তনীয় নিয়মের (স্টেরিওটাইপ) ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না।
আমি এখানে যাদের কথা বলছি তারা প্রান্তিক মানুষ। চেহারা দিয়ে তাদের বিচার করা হয়। এই ধরনের প্রান্তিক মানুষের অবস্থা ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্ববীক্ষায় কতোটা প্রভাব ফেলে তা বিচার্য। এ দিয়ে দেখা যায় পশ্চিম ইউরোপে কোনো কোনো গোষ্ঠীকে কীভাবে বহির্ভূত (Outsider) বা বহিরাগত (Stranger) করে রাখা হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে এই বহিরাগতদের ভয়ঙ্কর, অজানা হুমকীর প্রতীক বলে মনে করা হয়। শরীরের রূপ দিয়ে কীভাবে বহিরাগতদের ছাঁচে ঢেলে চিহ্নিত করা হয় তা দৃশ্যকলায় প্রতিফলিত। বিশেষ করে উত্তর-আধুনিক যুগের ভাবনায় বহিরাগত চিহ্নিত করার বিষয়টি গভীরে প্রোথিত।
সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক ক্রিস উইডন[1] মনে করেন, অনেক পশ্চিম ইউরোপিয় সমাজে একতান্ত্রিক শক্তির শিকড় রয়েছে অমীমাংশিত ঔপনিবেশিক ভাবধারায়। পশ্চিমী নয় এমন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে এই শক্তির আচরণের সূত্রে এই প্রয়াস দেখা যায়। এতে তৈরি হয়েছে চাপা উত্তেজনা। এই জাতিগোষ্ঠীগুলিকে তাদের চেহারা, ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ‘আলাদা’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ধরে নেওয়া হয়, এই আলাদা মানুষগুলি পশ্চিম ইউরোপের সমাজভূক্ত নয়। এইভাবে মানুষ চিহ্নিত করার প্রয়াস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে।
পশ্চিম ইউরোপের ঔপনিবেশিক নীতির কাল শুরু হয় মোটামুটি ষোড়শ শতকে। তা অব্যাহত ছিল বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। সামরিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সাদা চামড়ার মানুষ অন্যান্য দেশে গিয়ে জাঁকিয়ে বসে এবং ওইসব দেশের মানুষ এবং সংস্কৃতিকে অবদমন করে। এই জাঁকিয়ে বসার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, বেলজিয়ানরা কঙ্গো দখল করেছিল, ইংরেজরা ভারতকে উপনিবেশ বানিয়েছিল। দৃষ্টান্তের তালিকা দীর্ঘ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই উপনিবেশের প্রজাদের ছোটলোক, বর্বর এবং অসভ্য ভাবা হতো। শক্তির এই গতি ও রূপ এখনও অনেক ইউরোপিয় সমাজে স্পষ্ট দেখা যায়।
তবে ঔপনিবেশিক আমলের মতো এখন আর শাসক আর শাসিতের মধ্যে তফাৎ খোলাখুলিভাবে দেখানো হয় না। এখন বরং অনেক সূক্ষ্মভাবে তার প্রকাশ ঘটে গণমাধ্যম, ভাষা এবং নিত্যদিনের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে।
সমকালে ক্রমবর্দ্ধমান যোগাযোগের আবহে পশ্চিম ইউরোপও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং পরিযায়ের (Immigration) ধারণার মুখোমুখি। এই বাস্তবতায় তাদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পরস্পরকে কীভাবে চেনে এবং সংজ্ঞায়িত করে? সংক্ষেপে ‘বহির্ভূত’ বা ‘বহিরাগত’দের চিহ্নিত করে?
‘বহিরাগত’ ও ‘বহির্ভূত’ চিহ্নিতকরণ:
যারা কোনো নির্দিষ্ট জায়গার অধিবাসীদের পরিচিত নয়, তারাই বহিরাগত। বহিরাগতদের চেনা হয় তাদের চেহারা, আচরণ এবং ভাষা দিয়ে। অজ্ঞাতদেরকে যে যে নাম দেওয়া হয় তার কয়েকটি হলো ‘বিদেশি’, ‘বহির্ভূত’, ‘রহস্যজনক’, ‘বাস্তুহারা’ (Refugee) এবং ‘পরক’।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে ওঠে জানার ধারণার মধ্য দিয়ে। কেউ যদি আমাদের ঘনিষ্ঠ হয় তবেই তাকে আমরা জানি বা চিনি। যদি কাউকে আমরা না চিনি তবে তিনি বা তারা ‘বিদেশি’ বা অপরিচিত। একইসঙ্গে আমরা এও জানি যে, তারা আমাদের কেউ নন। যদিও তাদের আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। এতে একটি আপাতবিরোধিতা তেরি হয়: অজ্ঞাতকে আমরা চিনি কীভাবে?
সারা আহমেদের অভিমত,
বহিরাগতকে চেনা যায় তার মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তেই। তিনি বলেন, যিনি ‘আমাদের’ থেকে আলাদা সেই অজ্ঞাতকে চেনার উদ্যোগে আমরা যা বিবেচনা করি তা সত্যকে অতিক্রম করে যায়। এবং তা অবয়বহীন। একে আমরা একটি মুখ এবং অবয়ব দিই। এইভাবে বহিরাগতকে চিহ্নিত করার জন্য অবয়বহীনকে অবয়ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়েই আমি গবেষণা করে দেখছি।[2]
সমসময়ের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ভিন্নতার মুখোমুখি হওয়ার মধ্যে জানা ও অজানা সম্পর্কিত এই বিপরীত ধারণা স্থান পায়। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আচরণে অনেক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। পরিবহণে অগ্রগতির মতো ঘটনার মাধ্যমে বিশ্বায়ন ঘটছে। এই অগ্রগতি গতিশীলতা সহজতর করেছে, মানুষ বেশি বেশি করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারছে। ক্রিস রামফোর্ড বলেছেন, ভুবনজোড়া সংযোগের যুগে বহিরাগতদের বিষয়টি আর স্পষ্ট নয়। রামফোর্ডের যুক্তি, বহির্ভূত ‘আজ আসে, আগামীকাল থেকে যায়’। বহিরাগতদের সঙ্গে ‘বহির্ভূত’-এর সবসময় মিল দেখা যায় না।[3]
সময়সময়ের বহিরাগত অন্যরকম,কারণ আমরা নবাগত কে তা বুঝতে পারিনা। এর দু’টি কারণ – আজকের শহরের বিপুলায়তন, এই শহরের বাসিন্দাদের বেশি করে স্থানবদল। বহিরাগতকে তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যে আপাতবিরোধ তা জোরালো রূপ পায় রামফোর্ডের বলা ভুবনজোড়া সংযোগের কথায়। অন্যদিকে বর্ধিত চলমানতা, তথ্য সম্প্রচার ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা এই মায়াবী ধারণা দেয় যে, আমরা অনেক বেশি সংযুক্ত। বর্ধিত সংযোগে আবার এই ধারণাও তৈরি হয় যে, মানুষের এখন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক তুলনায় কম। একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য প্রধান প্রধান শহরগুলির ক্ষেত্রে। রামফোর্ড বলেছেন, এর ফলে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের অনুভূতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। অপরিচয় সমাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় এক ধরনের বাস্তবতা এবং তা বিশ্বায়নের অভিজ্ঞতাজাত। ফলে আমরা কারা সে নিয়ে আর নিশ্চিত নই, এবং কে আমাদের গোষ্ঠীভূক্ত আর কে বহিরাগত তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে।[4]
রামফোর্ডের দাবি, আমরা আর স্পষ্ট করে কারা কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, কারা নয়। তাই আমাদের অন্যান্য অর্থসূচকের ওপর ভরসা করতে হবে। সমসময়ের বহিরাগতদের রূপ বৈচিত্র্যে ভরা। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘পর্যটক’ এবং ‘বেআইনি অভিবাসী’, ‘বিশ্বস্ত পরিব্রাজক’ এবং আরও নানা পরিচয়বাহী মোড়কের মানুষ। রামফোর্ড জোর দিয়ে বলেছেন, কে একটি নির্দিষ্ট শহরের মানুষ তা নির্ধারণ করা অসম্ভব হলেও বহিরাগত সম্পর্কে যে স্থির চিত্রকল্প রয়েছে তা হারিয়ে যায় নি। বহিরাগতের তকমা আসল পার্থক্যসূচক আলাদা অর্থসূচকের ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে মাত্র। এগুলি হলো আলাদা আলাদা গায়ের রঙ বা পোশাকবিধি। এইসব অর্থসূচক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত ধারণা এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এই ধারণা ও কাঠামোর উৎস গণমাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন নেদারল্যান্ডসে একশোর বেশি সংস্কৃতি রয়েছে পাশাপাশি। সেখানে কাজের সন্ধানে গিয়ে অনেক বিদেশি নাগরিক হয়ে বসবাস শুরু করেন। এ নিয়ে পাঁচশোর বেশি মামলাকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালে একটি গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটির শিরোনাম, ‘Verdachte met buitenlands uiterlijk krijgt eerder celstraf’[5]। এর বাংলা ভাষান্তর মোটামুটি এইরকম, ‘শাদা চামড়ার নয় এমন সন্দেহভাজনদের অন্যান্য সন্দেহভাজনদের চেয়ে আগে কারাবন্দি করা হয়’। নিবন্ধটিতে এইভাবে সরাসরি একটি ছাঁচেঢালা নেতিবাচক ধারণা তৈরির কথা তুলে ধরা হয়েছে। গবেষকরা উপসংহারে বলেছেন, যাদের চেহারায় অহল্যান্ডিয় বা বিদেশি /বহিরাগতদের ছাপ রয়েছে এমন সন্দেহভাজনরা যাদের দেখতে হল্যান্ডিয় বলে মনে হয় তাদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক বেশি সাজা পান। যারা দেখতে অহল্যান্ডিয় তাদের জেলে পোরার সম্ভাবনা পাঁচগুণ বেশি। আর তারা যদি ডাচ ভাষায় কথা না বলেন তবে তাদের কারাবন্দি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায়ই ২০ গুণ হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে ‘ওরা’ পরিচিতি আরোপ করা হয় পার্থক্যের ভিত্তিতে। আর এই পার্থক্য নির্ণয় করা হয় নরগোষ্ঠীর বহিরঙ্গের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। এইভাবে দেখা যায় পশ্চিম ইউরোপিয় সমাজ এবং এক্ষেত্রে হল্যান্ডের সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রধানত নির্ধারিত হয় ‘আমরা ওরা’র ভিত্তিতে। যারা সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতির অঙ্গনে ব্রাত্য তারাই ‘ওরা’। বিশ্বায়নে স্থানভিত্তিক অবস্থানগত পরিচয়জ্ঞাপনের সংকেত হারিয়ে গেছে। ফলে বহিরঙ্গের পার্থক্য দিয়ে চিহ্নিতকরণের প্রবণতা বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে। মানুষের বহিরঙ্গভিত্তিক এমন অজস্র ছাঁচ দিয়ে কোনো সমাজে বাইরে থেকে যারা আসে এবং থাকে তাদের চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বহিরঙ্গ সাধারণভাবে অপরিবর্তিত থাকে। আর এ দিয়েই পার্থক্য এবং আধিপত্য স্থির হয়।
হোমি কে ভাবা’র একটি প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘The Other Question: Stereotype, discrimination and the discourse of colonialism’[6]। এতে ভাবা বলেছেন, গায়ের রঙের মতো শরীরে দৃশ্যমান চিহ্নকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা হয় পার্থক্য অস্বীকার করা, ছাঁচে ঢালা ধারণা জোরালো করা এবং সেইসূত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন,
“আমি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখবো এই ছাঁচে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীর অপরিবর্তনীয় ছবি ধরে রাখা হয়। Stereotype (দৃঢ় /অপরিবর্তনীয়) কথাটির ব্যুৎপত্তিগত উৎস গ্রিক শব্দ ‘Stereos’ যার ইংরেজি অর্থ ‘Firm, Solid’, যা দিয়ে বদ্ধমূল ধারণা বোঝায়।
অপরিবর্তনীয় চিত্রকল্প:
স্টেরিওটাইপ শব্দটি তৈরি করা হয় ১৭৯৮ সালে। এ দিয়ে তখন একটি মুদ্রণ প্রক্রিয়াকে বোঝানো হতো। মূলতঃ এই শব্দটি একটি অপরিবর্তনীয় ধাতব প্লেটকে বুঝাতো। এই প্লেট ব্যবহার করে পরপর একই ছবি তৈরি করা হতো[7]। পরে Stereotype কথাটি রূপকার্থে ব্যবহার করা হয় মানুষের প্রসঙ্গে। এখন এই শব্দটির মূল তাৎপর্য হারিয়ে গেছে। এখন Stereotype বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে পূর্ব ধারণাপ্রসূত এবং অতি সরলীকৃত একটি ধারণা।
শব্দটির এই তাৎপর্য নিয়ে ব্যবহার শুরু হয় ১৯২২ সালে। মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯২২ সালে প্রকাশিত তার ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ (জনমত) নামক বইয়ে শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। রূপকার্থে একই ধারণা হুবহু বা তাতে সামান্য পরিবর্তন এনে পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করা বলতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
লিপম্যান বলেছেন, Stereotype হলো ব্যক্তিগত নয়, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত একটি দোমড়ানো আভ্যন্তরীণ ছবি। এই অপরিবর্তনীয় ছবিটি তৈরির পর থেকে হুবহু ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। একে অভিজ্ঞতা বা প্রমাণ সাপেক্ষে চ্যালেঞ্জ করা হয় না। লিপম্যান এও বলেছেন যে, এই ছাঁচ একটি সাধারণীকরণ যা শ্রেণী তৈরি করে এবং তা জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয়, এমনকী দক্ষভাবে তাদের পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। লিপম্যান মনে করেন,
“টাইপ বা আদর্শ এবং সাধারণীকরণকৃত হিসেবে না দেখে বিষয়গুলিকে নতুনভাবে এবং বিশদে দেখার প্রয়াস শেষ হয়ে যাচ্ছে, ব্যস্ত সব বিষয়ে তা কার্যক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত।”[8]
ছাঁচে ঢালা অতি সরলীকরণ বিভিন্ন কারণে কাজে লাগানো হয়। লিপম্যান এর প্রয়োজনীয়তা এবং দক্ষতা প্রসঙ্গে আলোচনায় অতিসরলীকরণ না বলে সাধারণীকরণ কথাটি ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে এর মধ্যে রয়েছে নেতিবাচক তাৎপর্য। আমি এখানে লিপম্যানের প্রসঙ্গ টানলাম এই কারণে যে, তিনিই প্রথম সামাজিক ঘটনা বর্ণনা করার জন্য ‘Stereotype’ কথাটি ধারণা হিসেবে তুলে ধরেছেন। স্টেরিওটাইপ কোনো গোষ্ঠীর সাধারণীকরণের ওপর জোর দেয়। ফলে তা তুলে ধরে একটি ভ্রান্ত ছবি। আমি এই কারণেই এই ইস্যুটির ওপর আলোকপাত করছি। স্টেরিওটাইপ এক্ষেত্রে ‘বহিরাগত’কে অসম্পূর্ণভাবে তুলে ধরেনা, তবে তা ক্ষমতার সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। ক্ষমতার সম্পর্কের সঙ্গে স্টেরিওটাইপিং সংযোগ খতিয়ে দেখার একটি পথ হলো এর সঙ্গে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের সম্পর্ক পরীক্ষা করে দেখা।
ফেটিশ হিসেবে স্টেরিওটাইপ:
ভাবার মতে স্টেরিওটাইপের কাজ হলো ‘বহিরাগত’ তৈরি করা। স্থায়িত্বের (Fixity) ধারণাটি একটি আদর্শভিত্তিক নির্মাণ। এতে বহিরাগতের ধারণাকে সমর্থন করে। এজন্যই ভাবা ঔপনিবেশিকতা নিয়ে আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, বিশেষ করে জাতি ও লিঙ্গ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাকে। ‘স্টেরিওটাইপড’ ব্যক্তিকে বহিরাগতের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। তাদের ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় এবং মনে করা হয় তারা একটি বড় গোষ্ঠীর সদস্যমাত্র।
ভাবা ‘সত্য-শাসন’ কথাটি ব্যবহার করেছেন বহিরাগতকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিহ্নিত করার জন্য। সত্য-শাসন কথাটি নেওয়া হয় মাইকেল ফকল্টের লেখা থেকে। ফকল্ট বলেছেন, সত্যের ‘নিরপেক্ষ’ বৈশিষ্ট্য প্রশ্নাতীত নয়। সত্যের বদলে ফকল্ট সত্য-শাসন (regimes of truth) শব্দ-বন্ধটি ব্যবহার করেছেন। এদিয়ে আমরা বুঝতে পারি সত্য কীভাবে একটি ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যে স্থাপিত। তাঁর মতে সত্যের সীমানা নির্ধারণ না করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভাবা বলেছেন, এই কারণেই উপনিবেশ স্থাপনকারীরা উপনিবেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে সবকিছু জানতে চান। তারা তাদের আহৃত এই জ্ঞান দিয়ে উপনিবেশের অধিবাসীদের চিহ্নিত করেন এবং তাদের ওপর ‘যথাযথ’ আচরণ আরোপ করেন। এইভাবেই তারা উপনিবেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই অর্থে ক্ষমতার হাতিয়ার হয় জ্ঞান।
উপনিবেশ পত্তনকারীদের আহৃত জ্ঞান উপনিবেশের অধিবাসীদের ভাবমূর্তিতে নতুন তথ্য সংযোজন করে বটে তবে অধিবাসীদের ছবি তাতে মৌলিকভাবে পাল্টে যায় না, তা একইরকম থেকে যায়। এই অপরিবর্তিত অবস্থা তৈরি করা হয় উপনিবেশের প্রজাদের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এটি একটি ভাষাগত প্রক্রিয়া যা প্রজা এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যকে তুলে ধরে।
ভাবা বলেন, ‘বহিরাগত’ (other) সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে মূল পর্যায়ের একটা জ্ঞান তৈরি হয়। তবে এতে তা ‘বহিরাগত’ স্বীকৃতি পায় না। কারণ উপনিবেশ পত্তনকারীরা তাদের নিজেদের জ্ঞান অস্বীকার করেন। তা করা হয় ক্ষমতা কাঠামো অক্ষত রাখার স্বার্থে। এতে স্টেরিওটাইপিং এবং পরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পরস্পর বিরোধিতার সহাবস্থান দেখা যায়। জানা এবং জ্ঞান বনাম জ্ঞান-ভ্রান্তির এই সহাবস্থান পৌন:পুনিকতার কারণে দৃঢ় হয়। এই সহাবস্থান বহিরাগত সংক্রান্ত স্থিরচিত্রে প্রকাশ পায়। এই স্থিরচিত্র প্রসঙ্গে ভাবা কী দাবি করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য:
উপনিবেশবাদী আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাববাদী বৈশিষ্ট্য হলো আদারনেস নির্মাণে অপরিবর্তনীয়তা সংক্রান্ত ধারণা। উপনিবেশবাদী আলোচনায় সাংস্কৃতিক/ ঐতিহাসিক/ জাতিগত পার্থক্য একটি সংকেত (sign)। তা পরিচয় নির্মাণের একটি পরস্পরবিরোধী পথ। এতে একদিকে যেমন থাকে অপরিবর্তনীয়তা তেমনি অন্যদিকে থাকে বিশৃঙ্খলা, বিকৃতি এবং ভয়ঙ্কর পৌনঃপুনিকতা। স্টেরিওটাইপ একটি কৌশল যা প্রধানতঃ প্রসঙ্গ থেকে অপ্রসঙ্গে চলে যায়। স্টেরিওটাইপ তাই এমন এক ধরনের জ্ঞান এবং পরিচয় স্থাপন প্রক্রিয়া যাতে রয়েছে দুদোল্যমানতা। এই দুদোল্যমানতা সবসময় বিদ্যমান এবং তা অবশ্যই আগ্রহের সঙ্গে বারবার তুলে ধরতে হবে।[9]
অতি সরলীকৃত ধারণা (Stereotype) বর্ণনা করতে গিয়ে ভাবা বলেছেন যে, এটি একটি ভাববাদী প্রক্রিয়া যা একটি জনগোষ্ঠীকে বহিরাগত (Other) বলে চিহ্নিত করে। তাঁর মতে, এটি একটি পরস্পরবিরোধী কৌশল। কারণ এতে বিশৃঙ্খল অবস্থাকে স্থায়িত্ব (Fixity) দেয়। যাকে বা যাদের সম্পর্কে অতি সরলীকৃত ধারণা তৈরি করা হয় তাদের এই ভাবমূর্তি পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। তাদের সবসময়ই বহিরাগত বলে ধরে নেওয়া হয়। আবার এই ধারণাটি অবিরাম তুলে ধরতে হয় যাতে তা কার্যকর হয়। এর উৎস ভয়ের মতো আবেগ। আর এই সরলীকৃত ধারণাজাত ভাবমূর্তি পৌনঃপুনিকতার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক ধারণায় পরিণত হয়। ভাবা বলেছেন স্টেরিওটাইপ একটি সংকেত (sign)। সংকেত কথাটি এসেছে ফার্ডিনেন্ড ডি সসারের দেওয়া সূত্র থেকে। এই সূত্র অনুসারে সংকেতের থাকে দুটি অঙ্গ- সূচক (Signifier) এবং সূচিত (Signified)। সসারের মতে সূচক হলো সংকেতের শরীরি রূপ বা শব্দের গঠন, যা আমরা দেখতে পাই, ছুঁতে পারি, যার গন্ধ বা স্বাদ নিতে পারি। গঠনটি হতে পারে মুখের অভিব্যক্তি, ধ্বনি, শব্দ, আলোকচিত্র ইত্যাদি। সূচিত হলো একটি ধারণা বা বিষয় যা আমাদের মনের মধ্যে আবির্ভূত হয়। তা আবির্ভূত হয় যখন আমরা সূচকটি পড়ি বা শুনি। ইন্টারনেটের অভিন্ন ব্রাউজারে ‘Prominent Stereotypes’ লিখে অনুসন্ধান করে আমি এই ধারণাটি কী তা আবিস্কার করি। নিচে এই অনুসন্ধানের কয়েকটি ফল তুলে ধরছি। এতে ‘সূচক’ এবং ‘সূচিত’ ‘সংকেত’ গড়ে তুলেছে।
সূচকঃ ইহুদি, শ্বেতাঙ্গ, মুসলিম
সূচিতঃ লোভী, বুদ্ধিজীবী, মৌলবাদী।
এই দৃষ্টান্তে এবং এই ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্তে সংকেতের পৌনঃপুনিক ব্যবহার স্টেরিওটাইপ তৈরি করে। এই পৌনঃপুনিকতা এমন এক বাস্তব তৈরি করে যার প্রমাণযোগ্য ভিত্তি নেই। কারণ ইহুদিদের সবাই লোভী নয়, সব শ্বেতাঙ্গ মানুষ বুদ্ধিজীবী নন, সব মুসলিম মৌলবাদী নন। কিন্তু পৌনঃপুনিক ব্যবহারের সূত্রে এই ভাবমূর্তি অপরিবর্তনীয় হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ভাবা মনোবিশ্লেষণমূলক যে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন সেগুলি হলো ফোবিয়া (আতঙ্ক) এবং ফেটিশ (অন্ধভাবে অনুসৃত নীতি)। এতে স্টেরিওটাইপ এক ধরনের অন্ধভাবে অনুসৃত নীতি হিসেবে দেখা দেয়। ভাবার মতে, উপনিবেশ পত্তনকারী এবং উপনিবেশের প্রজাদের মধ্যে সম্পর্ক স্টেরিওটাইপ বজায় রাখে। ভাবা আভাস দিয়েছেন যে, তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরস্পরবিরোধী এবং দুইয়ের পার্থক্যের স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি এই স্ববিরোধিতা তৈরি হয়। এর সঙ্গে সিগমান্ড ফ্রয়েডের ফেটিশিজম তত্ত্বের সম্পর্ক পাওয়া যায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী পুত্র যখন আবিষ্কার করে যে তার এবং তার মায়ের জননেন্দ্রিয় একইরকম নয় তখনই অন্ধভাবে অনুসৃত নীতির আবির্ভাব ঘটে। এই আবিস্কারের মধ্য দিয়ে পুত্র তার সঙ্গে মায়ের পার্থক্য বুঝতে পারে। সে মায়ের কাল্পনিক পুরুষ জননেন্দ্রিয়ের বিকল্প কোনো নতুন বস্তুর অন্ধ অনুসন্ধান শুরু করে (Fetishise)। ফ্রয়েড তুলে ধরেন যে, ছেলেটি যুগপৎ এই ধারণা জিইয়ে রাখে যে, তার মায়ের পুরুষ জননেন্দ্রিয় রয়েছে এবং জানে যে তা নেই। তিনি বলেন, ছেলেটি পএই স্ববিরোধীতায় নিজেকে জড়িয়েছে খোজাকরণের ভয়ে। এই স্ববিরোধিতা দূর করার জন্য সে একটি অন্ধভাবে অনুসরণযোগ্য বস্তু তৈরি করে তার ভাবনায়। ভাবা মনে করেন, জ্ঞান এবং জ্ঞানমুক্তির মাধ্যমে যে ঔপনিবেশিক স্টেরিওটাইপ তৈরি হয় ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। ভাবার মতে, অন্ধভাবে অনুসৃত নীতি পার্থক্যকে অস্বীকার করার প্রয়াস। এই হিসেবে তা খোজাকরণের সমস্যা নিয়ে পৌনঃপুনিকতার মতোই। প্রতীকি জগতে অনুপস্থিতি এবং উপস্থিতির সংযোগ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বশর্ত হলো লিঙ্গ পার্থক্যের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি অস্বীকৃত হয় যখন কোনো একটি বিষয় বা বস্তুর ওপর ভাবনা বা দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। এতে পার্থক্যটা আড়াল করা হয় এবং আদর্শ উপিস্থতি ফিরিয়ে আনা হয়। অন্ধভাবে অনুসৃত নীতি স্থিরীকরণ এবং স্টেরিওটাইপের মধ্যে কার্যকরী সম্পর্ক তুলনায় বেশি প্রাসঙ্গিক।[10]
ভাবা আরো বলেছেন, প্রধান শক্তি নিজের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য বোঝে এবং তার সামগ্রিকতা লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে। তা খোজাকরণের (Castration) ভয় যেমন মায়ের সঙ্গে পার্থক্য নির্ণয়ের মূহূর্তের সঙ্গে সংযুক্ত হয়,তেমনি যে মূহূর্তে উপনিবেশ পত্তনকারী উপনিবেশের প্রজাদের সঙ্গে তার পার্থক্য বুঝতে পারে ভাষার মাধ্যমে, সেই মহূূর্তে পরিচয়ের সংকট দেখা দেয়। তখন উপনিবেশ পত্তনকারী প্রজার গায়ের রঙের মতো নতুন কিছু ফেটিশ তৈরি করে ভারসাম্য (Ambivalence) রক্ষার জন্য। কীভাবে উপনিবেশের প্রজা কিংবা নিগ্রোকে মেনে নেওয়া হয় তা বোঝার জন্য ফেটিশবাদের সাধারণ তত্ত্ব এবং সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার ব্যবহারের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য স্বীকার করে নিতে হয়। তাহলেই বর্ণবাদী বক্তব্য বোঝা যায়। ফ্যানন একে বলেছেন উপত্বক স্কিমা বলেছেন।এটি যৌন ফেটিশ এর মতো গোপন নয়। স্টেরিওটাইপে সাংস্কৃতিক এবং বর্ণবাদী পার্থক্যের ক্ষেত্রে এটি প্রধান সৃচক (Signifier)। তা সবচেয়ে দৃষ্টিগোচর ফেটিশ একে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক সমাজে প্রতিদিন যে বর্ণবাদী নাটক চলে তাতে এটি প্রকাশ্য ভূমিকা নেয়।[11] এইভাবে Fetishized বিষয়টি ঔপনিবেশিক স্টেরিওটাইপে অবদান রাখে এবং তা আদর্শগতভাবে উপনিবেশবাদীর প্রয়োজনমতো কাজে লাগানো হয়। বর্ণ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে উপনিবেশের প্রজাদের অবস্থান স্থির করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই নিয়ন্ত্রণ পরিভাষা স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। বর্ণ এবং সংস্কৃতির মতো শব্দ অনিরপেক্ষ। তা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুক্তিতে (Baggage) স্টেরিওটাইপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। ভাবার ধারণা, এই ভারসাম্য (Ambivalence) যুগপৎ ঔপনিবেশিক আকাঙ্খা এবং ঘৃণার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জ্যাকস লাকান ‘কাল্পনিক মঞ্চ’র ধারণা দিয়েছেন।
উপনিবেশবাদী আকাঙ্খা ও ঘৃণা এই ‘কাল্পনিক মঞ্চ’-এর সমান্তরাল। লাকান তার প্রবন্ধ ‘The Mirror stage’ -এ বলেছেন কাল্পনিক বিষয়টির দুটি অংশ থাকে – ‘কল্পনা করা’ এবং ‘কাল্পনিক ব্যবস্থা’ (Imaginary order)। উদাহরণ হিসেবে তিনি আয়নায় একটি শিশু যখন প্রথম তার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় তখন তার নিজের সম্পর্কে যে ধারণা এবং তজ্জাত প্রতিক্রিয়া হয় তা তুলে ধরেছেন। এই অভিজ্ঞতার আগে শিশুটি মনে করে পৃথিবীটা বিশাল এবং সমগ্র, আর সে-ই আসল পৃথিবী। আয়নায় নিজের ছবি দেখে সে আনন্দিত হয় কারণ এই প্রথম সে তার নিজের দেহের গঠন দেখতে পায়। তখন তার মনে হয় তার দেহের নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতে। লাকান বলেছেন,শিশুটির উপলব্ধির এই পর্যায়টি হলো তা যখন একজন ভাষা এবং বর্ণনার স্তরে পৌঁছে এবং সমাজের অংশ হয়ে ওঠে। এইভাবে ব্যক্তি মানুষ ‘কাল্পনিক ব্যবস্থা’ (Imaginary order) থেকে প্রতীকী ব্যবস্থায়’ (Symbolic order) ঢোকে। ভাবা মনে করেন, এই আয়না-স্তর ঔপনিবেশিক ভারসাম্য বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কীভাবে ফেটিশবাদ ঔপনিবেশিক প্রভুর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভুত্বের অনুভূতি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন, ভাবা তা বর্ণনা করেছেন। ভাবা যখন লাকানের তত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনেছেন তখন জোর দিয়ে বলেছেন দৃশ্যমান ফেটিশবাদের ওপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ। তিনি বলেছেন ফেটিশবাদ প্রধান ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার/তাদের কাল্পনিক ব্যবস্থার মধ্যে সংবদ্ধতা (Coherence) এবং নিয়ন্ত্রণ দেয়। এদিয়ে নিজের এবং অন্যদের পরিচয় পায়।
ক্রিস উইডেন বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে সংকটে পড়লেই পরিচয় একটি ইস্যু হয়ে ওঠে।[12] ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জঙ্গি হানার পর পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হুমকির উপলব্ধি বেড়ে যায়। অনেকে মনে করেন এটি উপলব্ধির একটি নতুন মোড় নেওয়ার তারিখ। এর পর থেকেই বিপজ্জনকভাবে উপলব্ধ সন্ত্রাসবাদী আতঙ্ক গণমাধ্যমে ব্যপকভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। পাশাপাশি উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে আসা অভিবাসীগণ ক্রমবর্ধমান হারে দমনকারী শাসন ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পশ্চিম ইউরোপিয় সমাজে এই আতঙ্কে Xenophobia বাড়তে থাকে, বিশেষ করে পরিচয়ের প্রশ্নে। পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেহ মূল বিবেচ্য বিষয় হয়। সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দেহ দৃশ্যমান উপস্থিতির সংকেত। দৃশ্যমানতার পরিসরে দেহ, বর্ণ, শ্রেণী এবং লিঙ্গের মতো সামাজিক মান নির্ধারক। কীভাবে পোশাক পরা হয়, কীভাবে ভূমিকা পালন করা হয় এবং কীভাবে কথা বলা হয় তা দেহের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এই ধরনের আলোচনা এখনো কতটা শক্তিশালী প্রভাব ফেলে? কীভাবে বর্ণবাদী বিভিন্ন ধারা এখনও মানুষের শ্রেণী পরিচয় নির্ধারণ করে এবং কীভাবে এদিয়ে মানুষ নিজেদের দেখে? ভাবা স্টেরিওটাইপকে ক্ষমতা ও প্রাধান্যের ভাববাদী কৌশল হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন প্রান্তিক এবং প্রধান গোষ্ঠীর জোড়া সম্পর্ক। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের সংজ্ঞায়নে তা এখনও প্রাসঙ্গিক। ভাবা বলেছেন, অপরিবর্তনীয় বর্ণ এবং জাতি পরিচয় মোহজনক, মিথ্যা এবং কাল্পনিক।[13]
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, ব্যক্তি মানুষের অহংবোধ এবং ব্যক্তি মানুষ তার চারপাশের জগৎকে কীভাবে দেখে তার ওপর প্রভাব বজায় রাখে স্তর বিন্যস্ত সামাজিক বিধি। এও স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীনদের চিরকালীন হাতিয়ার হলো স্টেরিওটাইপ। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে পার্থক্যের রেখা সরিয়ে দেওয়া সহজ নয়, তাও স্পষ্ট। আবার আমার মনে হয় স্টেরিওটাইপ নির্মাণের বিপরীত সংগ্রাম প্রান্তিক করে দেওয়া মানুষের জন্য একটা ফাঁদ মাত্র।
References
Books:
- Ahmed, Sara. On Being Included Racism And Diversity In Institutional Life. Durham, NC: Duke University Press, 2012.
- Ahmed, Sara. Strange Encounters: embodied others in post-coloniality. London: Routledge 2001, 2000
- Bhabha, Homi K. The Location of Culture. London. London: Routledge, 1994.
- Kurylo, Anastacia. The communicated stereotype: from celebrity vilification to everyday talk. Lanham: Lexington Books, 2013
- Lippmann, Walter. Public Opinion. New York: Harcourt, Brace and Co, 1922.
- Rumford, Chris. The Globalization of Strangeness. UK: Palgrave Macmillan, 2013.
- Simmel, Georg. The Sociology of Georg Simmel. Translated by Kurt Wolff. New York: Free Press.
- Weedon, Chris. Identity and culture: narratives of difference and belonging. Maidenhead: Open University Press, 2009
Website:
[1] Chris Weedon, Identity and culture: narratives of difference and belonging (Maidenhead: Open University Press, 2009
[2] Sara Ahmed, Strange Encounters: Embodied Others in Post-Coloniality (London: Routledge 2001, 2000), 3.
[3] A statement originally made by George Simmel in 1908 in his essay The Stranger. Published in Georg Simmel, The Sociology of Georg Simmel, trans. Kurt Wolff (New York: Free Press, 1950).
[4] Chris Rumford, The Globalization of Strangeness (UK: Palgrave Macmillan, 2013), 10.
[5] https://www.nrc.nl/nieuws/2012/03/14/verdachte-met-buitenlands-uiterlijk-krijgt-eerder-celstraf-a1446837
[6] Bhabha, The Location of Culture, 66–84
[7] Anastacia Kurylo, The communicated stereotype: from celebrity vilification to everyday talk (Lanham: Lexington Books, 2013), 2.
[8] Walter Lippmann, Public Opinion (New York: Harcourt, Brace and Co, 1922), 59.
[9] Bhabha, Location of Culture, 66.
[10] Bhabha, Location of Culture, 74.
[11] Bhabha, Location of Culture, 78.
[12] Chris Weedon, Identity and culture: narratives of difference and belonging,1-22.
[13] Bhabha, Location of Culture, 107.
হোমি কে. ভাবা’র সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
সারা আহমেদ সম্পর্কে জানতে এখানে দেখুন।
নোট:
নিবন্ধটি নবযুগ ব্লগের সহযোদ্ধা Culture Project এর লেখক আভান ওমর-এর ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন অব বডিজ নিবন্ধের অনুসরণে লিখিত।
এপ্রিল ১৫, ২০১৮; ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
সমস্যাটা জিনেটিক ও প্রবৃত্তিগত। এর মূলে রয়েছে আমাদের সুগন্ধ থেকে দুর্গন্ধ, সুন্দর থেকে অসুন্দর, কিংবা কালো, সাদা বা লাল রঙকে একে অপর থেকে পৃথক করার ক্ষমতা। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’তে প্রেয়সীর জন্য গোলাপ কিনতে গিয়ে দোকান থেকে আমরা সবচেয়ে তরতাজা, বড় ও দেখতে সুন্দর ফুলটিই কেনার চেষ্টা করি – যদিও এর মাঝে নিহিত আমাদের গোলাপে-গোলাপে বৈষম্য চর্চা।
ভিন জাতীয়তা ও সংস্কৃতির স্ত্রীকে নিয়ে দেশে গেলে অনেকেই দেখতে আসে — আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী। তাদের বেশীর ভাগ জিজ্ঞেস করে আমার স্ত্রী রীতিমত রোজা-নামাজ পালন করে কিনা? যারা একটু উচ্চ শিক্ষিত, তারা জিজ্ঞেস করে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে কিনা? সে বাংলা শিখেছে কিনা, না শিখলে অবশ্যই শিখতে হবে, ইত্যাদি। নানান ছল-ছুতোয় এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাই। উদার সমাজগুলোতে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বা জাতি-বিবেধ্মূলক প্রশ্ন সাধারণত কেউ জিজ্ঞেস করে না। এবং তা সম্ভব হয়েছে মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিগুলোকে অবদমিত করে, প্রবৃত্তিগুলোর উপর কৃত্তিম আস্তরণ ঢেলে। এবং আমাদের মৌলিক প্রবৃত্তির এ অবদমন, তার উপর ঢেলে দেওয়া কৃত্তিম আস্তরণই আমাদেরকে তথাকথিত সভ্য করে তোলে। তবে বিশেষ পরিস্থিতির মুখে সে কৃত্তিম আস্তরণ সহজেই উবে যায়, অন্ততঃ জনতার অংশ-বিশেষের মধ্যে। বিগত ২-৩ দশক ধরে গড়ে উঠা বিশেষ পরিস্থতির প্রেক্ষাপটে আমরা পাশ্চাত্যে জনতার অংশ-বিশেষের মধ্যে মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তি জেগে উঠতে দেখছি — বিশেষত মুসলমানদের বিষয়ে।