০
১৮০৬ বার পঠিত
আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বিষয়ে সরাসরি কোনো ‘স্যাটাস’ সামাজিকমাধ্যমে নেই। আমার ছেলের মৃত্যু, এরচেয়ে বড় কোনো বেদনা পৃথিবীতে আর নেই। এ বেদনাকে অতিক্রম করার শক্তি কোন যাতনারই নেই। আমার বাবা মারা গেছেন, চলে গেছেন মা’ও। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যক্তিগত ‘স্ট্যাটাস’ আমার ছিলো না। যা রয়েছে তা সবই গণমাধ্যমে প্রকাশিত রচনার শেয়ার।
কেনো নেই, এ ব্যাখ্যাটা দেয়া প্রয়োজন মনে করিনি এতদিন। আজ দিচ্ছি বিশেষ কারণে। সেই বিশেষ কারণটা উল্লেখ না করেই বলছি, প্রথমত নিজের কষ্ট আর ব্যর্থতা দুটোই গোপন রাখা ভালো। অনেক মনীষীরাও তাই বলেন। নিজের কষ্ট প্রকাশ মানে সমবেদনা চাওয়া। বন্ধু আর প্রিয়জনকে কষ্ট দেয়া এবং শত্রুদের করুণা করার সুযোগ দেয়া। আমি ব্যক্তিগত ভাবে দুটোই চাই না। আমি চাই না, আমার বন্ধু ও প্রিয়জনরা আমার কারণে কষ্ট পাক, একই সাথে নিজেদের কষ্টের স্মৃতিগুলো স্মরণ করুক। আর শত্রুদের করুণা কষ্টের পরিমান আরো বাড়িয়ে দেয়, মনে প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। আমি চাই না হিংসা আমাকে গ্রাস করুক।
যার ফলেই আমি অন্যদের সাথে ব্যবহারে স্বাভাবিক থাকতে চেয়েছি। এমনকি পারতপক্ষে কর্তব্যকাজ থেকেও বিরত হইনি। আমার ছেলের মারা যাবার পরও অফিসিয়াল কাজ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। সামাজিক জীবনেও স্বাভাবিক থাকার যথা সম্ভব চেষ্টা করেছি। বলতে পারেন, ভাঙা পাঁজর ইস্ত্রি করা শার্টের নিচে লুকানোর চেষ্টা ছিলো সেটা এবং এখনো রয়েছে। হয়তো সবক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় উৎরে গেছি।
যারা সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তাদের দায়বদ্ধতা থাকে অনেক। তাদের ব্যক্তিগতকে অনেকটাই ‘গত’ করতে হয়। আমার ছেলের মৃত্যুকে আমি সমাজের ক্রমশ মৃত্যু হিসাবেই আখ্যায়িত করেছি। আমাদের সমাজ যে ক্রমেই মরে যাচ্ছে, সামাজিক শৃংখলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তারই পরিণতি আমার ছেলের মৃত্যু। আমি আমার ছেলের মৃত্যু দিয়েই সামাজিক শৃংখলার মৃত্যুটাকে দেখতে চেয়েছি। আমার ফাগুনকে একা ছেলে হিসাবে দেখিনি, সব তরুণদের প্রতিভূ হিসাবেই দেখেছি।
ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা। একজন প্রতিশ্রুতিশীল গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন। হ্যাঁ পুত্রকে আপনি করেই বলছি। বলছি এ কারণে যে, সে শুধু আমার পুত্র নয়, দেশের গণমাধ্যমে তরুণদের প্রতিনিধি। যার মধ্যে ছিলো মেধা ও সততার অনন্য সমন্বয়। যা আমাদের তরুণদের মধ্যে এখন বড় জরুরি। ফাগুন রেজা এমন তরুণদেরই একজন, যে বেঁচে থাকা তরুণদের জন্য উদাহরণ। সুতরাং ফাগুনের মৃত্যুটাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিইনি, নিয়েছি সামাজিক মৃত্যুর উদাহরণ হিসাবে, ভেঙে পড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃশ্যচিত্র হিসাবে।
ছেলের পর চলে গেলেন আমার মা। তিনিও ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পন্ন মানুষ। তিনিও মানুষের জন্য কাজ করেছেন কর্মক্ষম থাকাকালীন। অথচ এখন অনেক কর্মক্ষমই আছেন যাদের কাজ হলো শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অথচ ব্যক্তি যে সমাজেরই অংশ, ব্যক্তির সনম্বয়েই গড়ে উঠে সমাজ এবং সে সমাজ ব্যক্তির নিরাপত্তা আর বিকাশের জন্যই, সে কথা ভুলে যান তারা। সমস্যাটা এখানেই। আমার বাবাও গেছেন চার বছর হলো। তিনিও ছিলেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। একটা সুস্থ সমাজ নির্মানের চিন্তা আর প্রচেষ্টার মিলিত রূপ সেই দায়বদ্ধতা।
এসব কারণেই একান্ত ব্যক্তিগত ‘স্ট্যাটাস’ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে আমার কাজ করে দিয়েছে অনেক গণমাধ্যম। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার বাবা আব্দুর রেজ্জাক, মা জাহানারা রেজ্জাক এবং ছেলে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন তাদের সবার কথাই জানিয়েছে তারা। আমি তাদেরকেই ‘শেয়ার’ করেছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে শেয়ার দিয়ে জানালে যা হতো, তারচেয়ে কোনো অংশেই কম হয়নি সে সব শেয়ারে। স্বজনরাও জানতে পেরেছেন, জানতে পেরেছেন পরিচিত-অপরিচিত জনরাও।
সবশেষ জানাই, চার্লি চ্যাপলিনের একটি উক্তি রয়েছে এরকম, ‘আমি বৃষ্টিতে হেঁটে যাই, যাতে আমার অশ্রু কেউ না দেখে’, এ উক্তিটি আমার ভীষণ রকম প্রিয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল না হলেও আমি তাই করতে চাই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন