ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান শুরু হয়,গুপ্তযুগে। হিন্দুধর্মকে শাশ্বত ওসনাতন বলে ঘোষিত হয়। ঋগ্বেদের যুগে আর্য্যদের ব্রহ্ম ও পুনর্জন্ম সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিলনা। যদিও উপনিষদে ‘ব্রহ্ম’বিশ্বচেতনার নির্বিশেষ রূপ হিসেবে বর্ণিত আছে। পুরাণ ও রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় এই সময়। ব্রাহ্মণগণ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কৌশলে এগুলি লিপিবদ্ধ করার সময় প্রচুর অলৌকিক ও অপ্রাকৃত ঘটনার সংযোজন বাল্মীকি ও বেদব্যাসের নামে চালিয়ে দেন। উদাহরণ স্বরূপ, বেদব্যাসের মহাভারতে শ্লোক সংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজার, গুপ্তযুগে লিপিবদ্ধ মহাভারতে শ্লোক সংখ্যা একলক্ষ।
পণ্ডিতদের মতে এই গুপ্তযুগেই পুরাণগুলিও লিপিবদ্ধ করার সময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সঙ্কীর্নমনা ব্রাহ্মণরাই ভারতের সমস্ত প্রাচীন শাস্ত্রের যথেচ্ছ বিকৃতি সাধন করেন।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য এই যে, অত্যন্ত কুরুচিকর ভাবে চিরশত্রু বৃহস্পতির চরিত্র হনন করে একটি দীর্ঘজীবি শব্দ বন্ধও প্রচলিত করেন।তাচ্ছিল্যতার কারনে এইজন্য হীনবুদ্ধির কোন ব্যক্তিকে ‘বুদ্ধির বৃহস্পতি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
উত্তর ও দক্ষিণভারতের বেদাশ্রিত আচার সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি কিছুটা আলাদা ছিল বলে মনে করা হয়। ধনে মানে বনিক সম্প্রদায়ও ছিল তৎকালীন ব্রাহ্মণদের প্রায় সমান। উদন্তপুরীরাজের সাথে বারংবার যুদ্ধে বিদ্ধস্ত বল্লাল সেন বনিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রচুর অর্থসাহায্য দাবি করেন। বনিক সম্প্রদায় অস্বীকার করায়, শাসন ব্যবস্থায় অসহযোগিতার কারনে বহু বনিককে কৌলীণ্য হারাতে হয়। এমনকি ওই বনিক শ্রেণীকে শিক্ষা দীক্ষা ও সান্নিদ্ধ দেওয়ার কারনে, বহু ব্রাহ্মণকেও ব্রাহ্মন্যধর্ম থেকে অধঃপতিত হতে হয়। সূবর্ণবনিকদের পৈতেধারণ নিষিদ্ধ হলো। বনিক শ্রেণী প্রতিশোধ স্পৃহায়, অর্থের দৌলতে নিম্নদাস ও ভৃত্যশ্রেণীকে হাত করতে আরম্ভ করে। বল্লাল অনোন্যপায় হয়ে কৈবর্ত্য, মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকার ইত্যাদিদের সৎ শূদ্রের পর্যায়ে উন্নিত করেন এবং উচ্চবর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখে অবশিষ্ট ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণত্ব ঘুচে গেল। তাঁরা ব্রাহ্মণ সমাজে পতিত হলেন।
কোন কোন পণ্ডিত মহলের মতে, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সঙ্গে জড়িত আদিশুরই নাকি প্রথম বাংলায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন। তার আগে ব্রাহ্মণ ও ছিলনা, বেদ চর্চাও ছিল না।
বাঙালী সমাজে পদবীর ইতিহাস চর্চায় যে আবহ তৈরী হয়েছে, কৌলীন্য প্রথার কুয়াশা অপসারণের জন্য সে রকম আগ্রহ মোটেই ছিলনা। বাঙালী কুলীন ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মনদের কুলগৌরব কাহিনী ছত্রিশ জাতের বঙ্গভূমীতে আজও অপ্রতিহত। একসময় ব্রাহ্মণদের কুলভঙ্গের অপরাধে অনেককেই সমাজে পতিত হতে হতো। কুলীনদের কুলই ছিল সর্বস্ব। সেই কুলগৌরবে এক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ একাধিক বিবাহ করে কুলীন কন্যা পিতার কুল রক্ষা করতেন।
বঙ্গভূমীর অধিকাংশ জনপদই গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, বাঙালী সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থার ছকে বাঁধা পড়ে।
পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিস্তার লাভ করে। কৌশলে স্থানীয় অব্রাহ্মণদের কাছ থেকে জমি নিয়ে মন্দির নির্মান করে দেব দেবীর পূজা শুরু করে, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র রচনাকে আশ্রয় করে
ব্রাহ্মণ্য সমাজের সংরক্ষণী মনোভাব বাংলায় আত্মপ্রকাশ করে। ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থার শীর্ষস্থানে যে ব্রাহ্মণরাই থাকবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারন সমাজ রক্ষকরাই সমাজের ভক্ষক হন। নানা গোত্র প্রবর ও বিভিন্ন বৈদিক শাখার ব্রাহ্মণরা যে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম শতক থেকেই উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসেছেন, একথা বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন।
কুলশাস্ত্র কাহিনীর কেন্দ্রে আছেন আদিশুর। আদিশুর সম্ভবত কোলাঞ্চ-কনৌজ বা কাশী থেকে পঞ্চব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন। এই সঙ্গে কৌলিন্য প্রথার ইতিহাসও জড়িত। কৌলিন্য প্রথার বিবর্তনের সাথে বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের নাম ও জড়িত। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সাথে জড়িত আদিশুরের পৌত্র ক্ষিতিশুর ও তৎপুত্র ধরাশুরের নামও। বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলকাহিনীর বর্মনরাজ শ্যামল বর্মন ও হরি বর্মনের নাম জড়িত। কুলজী গ্রন্থমালার ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে যদিও পণ্ডিতগণ দ্বিধাবিভক্ত। এই ভ্রান্ত ধারণা অদ্ভূত এক প্রভাব বিস্তার করে আছে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, তাহল আদিশুরই নাকি প্রথম বাংলায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন। আদিশুর কাহিনী এবং কৌলিন্য প্রথার সাথে ব্রাহ্মণদের গাঞী বিভাগও জড়িত। গাঞীর উদ্ভব গ্রাম থেকে ; যে গ্রামে যে ব্রাহ্মণ বাস করতেন, সেই গ্রামের সাথে উপাধ্যায় বা আচার্য্য যুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পদবীগুলো সৃস্টি। যেমন, গঙ্গ, বন্দ, ভট্ট, চট্ট, মুখো ইত্যাদি।
অধুণা বাংলায় যে ছত্রিশ জাতের ছোঁয়া পেলে বর্ণহিন্দু বিধবা বা ছুঁৎমার্গী বর্ণগর্বিত মানুষ নিজেকে অশুচী জ্ঞান করেন, সেই ছত্রিশ জাতের মধ্যে কারা পড়েন? এদেশে বৈজ্ঞানিক উপায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে এই সমাজে রক্তে অস্থি মজ্জায় মিশে আছে ছত্রিশ জাত। সে সব অত্যাশ্চর্য্য তত্ত্ব, তথ্য প্রকাশ পেলে, বর্ণহিন্দুদের জাত্যাভিমানে যথেষ্ট আঘাত লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত ‘বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে ব্রাহ্মণ বর্ণ ছাড়া ছত্রিশটি জাতকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১) উত্তম সঙ্কর বিভাগ।
২) মধ্যম সঙ্কর বিভাগ।
৩) অধম সঙ্কর বিভাগ।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কিন্তু এই তিন বিভাগ ছাড়াও চতুর্থ বিভাগে আরও পাঁচটি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ব্যবসায়িক কাজের কারনে প্রথম বিভাগটি জলচল ছিল, দ্বিতীয় বিভাগটি সম্ভবত জলাচল ছিল।এখন সহজেই অনুমেয় যে, স্বর্ণ বণিক ও তৈলকার মধ্যম সঙ্কর, গন্ধ বণিক উত্তম সঙ্কর। ব্যবসার কর্মগত বর্ণবিভাগের ফলে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যে বিভিন্ন জনের বর্ণ মিশে থাকাই স্বাভাবিক। এই কারনে পুরাণ বা স্মৃতিশাস্ত্রে বারংবার বর্ণসঙ্কর ও জাতিসঙ্করের কথা উচ্চারিত হয়েছে। ব্রাহ্মণকে এই সঙ্কর জাতি হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারন এই সব পুরান ও স্মৃতিশাস্ত্র গুলো প্রায়শই তাদেরই রচনা। নরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মনরা যে পরিমান সঙ্কর বিভাগে, অধিকাংশ বর্ণই প্রায় সমবৈশিস্টের সঙ্কর।
তৎকালীন সমাজপতিগণ উচ্চ সঙ্কর জাতি ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন। বিত্তশালী না হয়েও এই উচ্চবর্ণ বিত্তশালীদের অনুগ্রহ লাভ করেছেন।ফল স্বরূপ তাঁদের অন্যায় অপরাধ গুলোচাপা পড়ে গেছে জাতগর্বের কারনে।
মনুর মতে যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণের সবর্ণা স্ত্রী অধিকারী হতে পারবেন।সবর্ণা স্ত্রী না থাকলে ক্ষত্রিয়জাত স্ত্রী সে অধিকার পেতে পারতেন। কিন্তু বৈশ্য বা শূদ্রজাত স্ত্রী সে অধিকার পেতেন না। এমনকি ব্রাহ্মণ ও শূদ্রজাত স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে তা অনৈতিক হিসেবে গন্য হতোনা। স্বল্প প্রায়শ্চিত্য করে সে দোষ খণ্ডন করা যায়। সে কালে কামলোলুপ জমিদাররাও ব্রাহ্মণদের সাথে একজোট হয়ে স্পর্শ্ব দোষের বিধান দিতেন।
একই রক্ত, একই গড়ন,
তবে কেন ওরা ব্রাহ্মণ?
গবেষণা লব্ধ বহু তত্ত্ব, তথ্যের একত্রীকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, বাঙালি উচ্চ নীচ জাতের মধ্যে শরীরের রঙ,কেশ, চক্ষু,ও গড়নে এমনকি রক্তেও কোন পার্থক্য নেই। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, কুল গরিমা উচ্চবর্ণের আত্মরতির সম্মোহন ছাড়া কিছু নয়। নরতত্ত্বের দিক থেকে চারি বর্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। জাত বিভাজনের আর্থিক ও সামাজিক ধর্ম কর্মের অধিকারই এমন প্রভেদ সৃস্টি করার কারন।
ভবদেব ভট্টের রচনা থেকে জানা যায়, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রমানে ব্রাহ্মণ শ্রেণী কিভাবে প্রকৌশলে চতুরতার সহিত খাদ্যাখাদ্যে ও আচার বিচারে কিরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। নট, নর্ত্তক, ধোপা, কর্মকার, কাপালিক, কৈবর্ত্ত, ভীল, চণ্ডাল, শুঁড়ি, স্বর্ণকার ইত্যাদি এমনকি নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবি ব্রাহ্মণদের রন্ধনকৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো।শূদ্রের পাককৃত ও স্পর্শ্বকৃত খাদ্য গ্রহণে ব্রাহ্মণদের পূর্ণ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান ছিল। ক্ষত্রিয়ের দ্বারা পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে অর্দ্ধ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলতো। বৈশ্বদের পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে তিন চতুর্থাংশ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করেও ব্রাহ্মণদের দোষ মুক্তি ঘটতো। অপর দিকে শূদ্রদের পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য যদি ক্ষত্রিয় গ্রহণ করে, তাহলে তাদের পূর্ণ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। কিন্তু বৈশ্বদের পাককৃত বা স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে অর্দ্ধ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলতো। অন্যদিকে শূদ্রের দ্বারা পাক করা সুস্বাদু খাদ্য বিপদকালে ব্রাহ্মনদের গ্রহনে বাধা ছিলনা। সে ক্ষেত্রে শুধু দুঃখ প্রকাশ করলেই দোষ খণ্ডন হয়ে যেত।
ব্রাহ্মনদের এইসব চাতুর্য্যে ভরা নির্দেশাবলীতে প্রমান হয়, কোথাও লঘু পাপে গুরুদণ্ড, আবার কোথাও বা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের বিধান ছিল। এসব দেখে আজও সমাজ জাত বিচারে ছোট বড় খোঁজে। সম যোগ্যতা বিশিষ্ট তফশিলি জাতি বা উপজাতির পুত্র বা কণ্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রবল ভাবে নাসিকা কুঞ্চন চলে।
বর্ণাশ্রম_প্রথা
আনুমানিক চার হাজার বছর আগে, ভোল্গাতট, মতান্তরে জার্মানি বা পোল্যাণ্ডের দিক থেকে আর্যরা তৎকালীন ভারতে এসেছিল। তবে শিকার বা খাদ্যসঙ্কটে পড়ে যে আগমন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্থানীয় অনার্যদের সাথে শুরু হয় লড়াই। পরাজিত অনার্যরা নিহত হন কেউবা অন্যত্র পালিয়ে বাঁচেন। নারীর লুন্ঠিত হন।
অনার্য নারীদের সাথে অত্যধিক মিলনের ফলে পরবর্তী কালে জাতিগত বিশুদ্ধতা হারানোরm ভয়ে আর্য নেতৃত্ব কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেন। ভারতীয় সমাজে বর্ণাশ্রম পথার সূচনা। অতিরিক্ত সম্পদ ও সুখ ভোগের জন্য অনার্যদের দিয়ে যুদ্ধ, পাহারাদার, কৃষিকাজ, পশুপালন নির্মান, আবর্জনা পরিস্কার ইত্যাদি দৈহিক শ্রমের কাজ করানো হতো। কালক্রমে ভারতীয় জনসমাজ আর্য-অনার্য-মোঙ্গোল-দ্রাবিড়-শক -হুন-যবন-পাঠান-ও অন্যান্য জন গোষ্ঠীর বর্ণ সঙ্কর এক উন্নত জনজাতিতে পরিনত হয়। সম্পদের ভোগ দখল একদিকে যেমন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হানাহানির কারন,তেমনই শ্রেণী বিভাজন ও রীতিনীতি কঠোর করে ব্রাহ্মণ কুলের জন্ম হয়।সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্যপ্রয়োজন পড়ে সুলভ শ্রমের, জোরদার করা হয় দাস ও বর্ণব্যবস্থাকে। নারীর স্থান হয় অন্তপুরে,রাজা আর ব্রাহ্মণদের অঙ্কে। ব্রাহ্মণ্যবাদকে চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা করতে আনুমানিক তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত হয় শ্রুতি সঙ্কলন বেদ। বিশ্বভাবনার সঙ্কলন ঋকবেদ, ঋকমন্ত্র গীত আকারে সামবেদ।যজ্ঞের মন্ত্র সঙ্কলিত যজুর্বেদ, চিকিৎসা শাস্ত্র শত্রুদমন এবং সৃস্টি রহস্যের মন্ত্র সঙ্কলিত অথর্ববেদ।
দখলকৃত ভূভাগ সম্পদ ও শ্রম সেবাকে কায়েম রাখতে রাজতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রুর উদ্ভব। সমস্ত সম্পদের অধিকারী হলেন রাজা। নীতি রক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী, যারা ক্ষত্রিয়। রাজার পরের ক্ষমতাদারীরা হলেন এই ব্রাহ্মণ শ্রেণী। কৃষিজীবী, ব্যবসায়ীরা হলেন বৈশ্য। আর অনার্য ও পরাজিত শত্রুরা হলেন শূদ্র। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের রমনে অনার্য নারীর গর্ভে সৃস্টি বর্ণসঙ্করের।
বৈদিক যুগের শেষ পর্বে আসে মহাকাব্যের যুগ, অর্থাৎ রামায়ণ, মহাভারতের যুগ। রাজতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র গভীরভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। বেদান্তের অন্যতম ধারা দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ। বৈদিক ভাববাদকে আশ্রয় করে পুনর্জন্মবাদের জন্ম দেন শঙ্করাচার্য্য। অন্যদিকে বাস্তববাদী কপিল ও সযুগ্যা রৈক্যা, সৃস্টি হয় সর্বাপেক্ষা অবৈদিক, জনপ্রিয় বস্তুবাদী ধারা চার্বাকের লোকায়ত সংহিতা। অন্য দুটি সম সাময়িক ধারা হলো জৈনীয় ও বৌদ্ধ ধর্ম। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল বাস্তববাদী এবং বেদ ব্রাহ্মণ ও ঈশ্বর বিরোধী ভারতীয় দর্শন তন্ত্রের ধারা যা বহু সাধকের সম্মিলিত চিন্তার ফসল। প্রমাদ গুনলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, রাশ আলগা হওয়ার ভয়ে চার্বাকীয় লোকায়ত ধারাকে অবদমিত করার চেষ্টা চালান হলো। জাতিভেদ বর্ণবৈষম্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিধান সাধারণ মানুষের মনে প্রচণ্ড অসন্তোষ ও নৈরাশ্যের জন্ম দিয়েচিল। চলল বেদ বিরোধী বস্তুবাদী চর্চা। বৈচিত্র এল লোকায়ত দর্শনে। পুরোনো কাশ্যপ, অজিত কেশকম্বলি, পাকুধা কাত্যায়ণ, সঞ্জয় বেলাতিপুত্ত,, মাখালি গোশালা, নিগন্থ নাথপুত্ত প্রমুখদের ভাবনায় ও সক্রিয়তায়।
মনুষ্যকুলে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, আর দেবকুলে দেবরাজ ইন্দ্র, এদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যখনই মুনি ঋষিরা তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে মহর্ষি বা ব্রহ্মর্ষি হওয়ার চেষ্টা করেছেন,নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে পিতামহ ব্রহ্মার উপদেশে উর্বশীদের পাঠিয়ে তপস্যা বা যজ্ঞ ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালানে হয়েছে। রামায়ণে দেখতে পাই শূদ্র শম্বুক দেবলোক জয়ের অভিপ্রায়ে দেবত্ব লাভের জন্য তপস্যার কারনে রামচন্দ্র কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন।
এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজ নির্দেশিত ন্যায় নীতি ও শিষ্টাচার কি দেখতে পাই? রামের বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতম আচরণ। এটা কি প্রাচীনতম বর্বর সংঘাত নয়?বর্ণ প্রাধাণ্য নিরঙ্কুশ করার ঘৃণ্যতম প্রচেষ্টা নয় কি? অব্রাহ্মণ সংস্কৃতিকে নির্মূল করার কৌশল নয় কি? এ বিষয়ে পুরাণ ও মহাকাব্য গুলোতে ছড়িয়ে আছে ভুরি ভুরি উদাহরণ।জাতপাতের ব্যাধিতে আক্রান্ত ভারতীয় সমাজে গরু ছাগলের মত হরিজন নিধন চলেছে। হাতের কাজ ও কায়িক শ্রমকে চিরদিন হেয় করা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্বভাব ও লক্ষণ।
নীতি ও ধর্মানুশাসনের ব্যপারে ব্রাহ্মণদের এত হেল দোল ছিল না। কিন্তু নীচু শ্রেণীর মানুষরা অমান্য করলে অপরাধ বলে গন্য হতো। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের এক উৎকট আত্মম্ভরিতা ছিল। উপবীতকে অস্ত্র করে জীবনে প্রতিষ্ঠা এবং অন্ধ সংস্কারের অচলায়তনে বাস করার প্রবনতা ছিল প্রকট। ধর্ম সম্পর্কে নানারকম পরষ্পর বিরোধী শাস্ত্র বাক্যের মধ্যে ধর্মের উৎপত্তির বিষয় জানা যায়। আচার থেকে ধর্মের উৎপত্তি। আচার সর্বস্ব ধর্মের থেকে সৃষ্টি হয় নানা বাছবিচার স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বিধি নিষেধ। ধর্মের হাত ধরে এল আচার সর্বস্ব কুসংস্কার।
পূর্ব ভারত ছিল দার্শনিকদের জন্মক্ষেত্র। এই এলাকার মানুষ চিরদিন যুক্তি, বুদ্ধিকে হৃদয় ও আবেগের উপর স্থান দিয়েছে। আসলে বাঙালি চিরদিন যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির উপাসক। বাসুদেব, গদাধর, জগদীশ প্রভৃতি যুক্তির উপাসকরা তার মধ্যে অন্যতম।
ভারতীয় সমাজে শাস্ত্রীয় বিধানই মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রক্তের মধ্যে জাগিয়েছে ঘৃণার মারাত্মক জীবানু, যা আজ এ সমাজে প্রাণঘাতী ব্যাধীর ন্যায় আতঙ্কের। লড়াইটা তাই মানুষের সপক্ষে অমানবিকতার বিরুদ্ধে। অথচ পুরাকালে এ দেশেই নাকি তেমন সমাজ ছিল যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল না। জীবন ধারনের জন্য অন্নের অধিকার সমান ভাবে স্বীকৃত ছিল। ভাগবতেই আছে তার প্রমান। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী অন্নলাভ দেহী মাত্রেই অধিকার। তার বেশী আত্মসাৎ করা দণ্ডনীয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় সাধারণ মানুষের অধিকার সম্বন্ধে যে দেশের ধর্মগ্রন্থে এমন উদার মত প্রকাশ ঘটেছে, সেক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় বিধানগুলো মানুষ সম্বন্ধে অমানবিক কেন? সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সাধারণ মানুষের সুযোগ সুবিধা গুলোকে কৌশলে অপ্রকাশিত রেখেছেন। কারন সাধারণ মানুষ যদি ব্রাহ্মণের সমান রসদের ভাগীদার হন, তাহলে কুলগর্ব নির্মূল হয়ে যাবে, নীচকুল ব্রাহ্মণদের আজ্ঞাবহ থাকবেন।বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ সাগর সঙ্গম’ রবী ঠাকুরের ‘অনধিকার প্রবেশ’ এসব তথ্যের জলন্ত উদাহরণ। বেদেই বোধ হয় সর্বপ্রথম, সমাজে অস্পৃশ্যতার, ভেদাভেদের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতাতে আছে গুন ও কর্ম অনুসারে বর্ণভেদের কথা। অথর্ব বেদে কর্মে বা বৃত্তিতে কোন উচ্চ নীচ ভেদাভেদ ছিলনা। শক্তিশালী দাসদের অনার্য হিসেবে দেখা হতো। মনুস্মৃতিতে দাস প্রথার উল্লেখ আছে।সমস্ত শূদ্র ছিল ব্রাহ্মণদের দাস। এদের আবার বেশ কয়েকটা ভাগ ছিল, যেমন বংশ পরম্পরায় দাস, উপঢৌকনে প্রাপ্ত দাস, দাসীর গর্ভজাত দাস, অন্নের জন্য স্বেচ্ছায় বরন করা দাস, যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের থেকে প্রাপ্ত দাস ইত্যাদি।যারা আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করতোনা তাদেরকে দস্যু নামে অভিহিত করা হতো।
যজ্ঞস্থলে শূদ্রদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কোন ঘৃণ্য কাজকে শূদ্রোচিত কাজ বলে বর্ননা করা হতো। কোন কোন যজ্ঞে শূদ্র ও সারমেয়দের দিকে তাকানো একই অপরাধ বলে গন্য করা হতো। শূদ্রের বেদপাঠের অনুমতি ছিলনা, এমনকি শূদ্রের বাড়ীতে ব্রাহ্মণদের বেদপাঠও নিষিদ্ধ ছিল। শূদ্র যদি কোন ব্রাহ্মণকে আঘাত করতো, তাহলে তার সেই অঙ্গ কেটে দেওয়া হতো। কিন্তু অনুরূপে ব্রাহ্মণের একই কাজে কোন শাস্তির বিধান ছিল না।
মনুসংহিতায় পুরুষকে বীজ এবং নারীকে ক্ষেত্র হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণেরা সব বর্ণের নারীর সাথে যথেচ্ছ ভাবে সহবাস করে পুত্র উৎপাদন করতে পারবে। সব বর্ণের নারীর গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত পুত্রেরা সমান অধিকার পেতেন না। ব্রাহ্মণ পুরুষের সব বর্ণের নারীরকাম চরিতার্থ করার অধিকার থাকলেও, শূদ্রের সে অধিকার ছিলনা। শূদ্রেরা সম জাতীয় ব্যতীত অন্য কোন নারীতে সম্ভোগ করার বিধান ছিলনা। শূদ্রের ঔরসজাগ সমস্ত পু্ৃত্রের সামনাধিকার ছিল।
পুত্র উৎপাদনকে যতই ধর্মীয় রূপ দেওয়া হোক না কেন, বহুবর্ণা নারীতে যৌন সম্ভোগ ও যৌন অপরাধ কে শাস্ত্র সম্মত করাও ব্রাহ্মণদের অসংযমী যৌন জীবনের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
নারী যাতে ব্যভিচারিনী না হয়, তার জন্য নানা বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ আছে মনুসংহিতায়। কিন্তু ব্যভিচারী পুরুষ সম্মন্ধে কোন নির্দেশ নেই। কোন প্রেম ভালোবাসার বালাই নেই, আছে শুধু ক্ষেত্রস্বরূপা নারীতে কাম চরিতার্থ করার বাসনা। নারী শুুধু মাত্র পুরুষের কাম চরিতার্থ করা আর পুত্র উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ (পুত্রী বা কন্যার উল্লেখ দেখা যায়না)। নারীর নিজের কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া নেই।
পুরুষের প্রয়োজনে যোন ব্যভিচারকে ধরে রাখার জন্য প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে গণিকাবৃত্তিকে। এই বৃত্তি সেই প্রচীন কাল থেকেই অনুমোদিত।অথচ সেই পতিতাদের সমাজের বাহিরে ঠেলে পাঁচিল তোলা হয়েছে কার স্বার্থে? এটা অবশ্যই সমাজপতিদের শ্রেণীস্বার্থ সুরক্ষিত রাখার কৌশলি প্রচেষ্টা।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী ‘পতিব্রতা’ হলো একপতি। পতি ভিন্ন দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্তি থাকলে ‘কুলটা’, তিন পুরুষের প্রতি আসক্ত হলে ‘বৃষলী’। চার পর পুরুষের প্রতি আসক্তা হলে ‘বেশ্যা’, সাত পর পুরুষের প্রতি আসক্তা হলে ‘যুঙ্গী’। তাট বেশি পুরুষের প্রতও আসক্তি থাকলে ‘মহাবেশ্যা’।
পক্ষান্তরে পুরুষের ক্ষেত্রে তেমন কোন নিদান নেই। পুরুষ শত নারীতে আসক্ত হলেও সৎ(যদি সতীর পুংলিঙ্গ সৎ হয়)।
মহাভারতে গণিকার অন্নগ্রহণ, গণিকা সংসর্গকে পাপ বলা হয়েছে। এমনকি যমের দক্ষিণ দুয়ারের দিকে বা নগরের দক্ষিণ প্রান্তে গণিকালয় নির্মানের নিদান আছে।