ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী। ‘পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ব্রিটিশ শাসকদের আইন’ শিরোনামে তাঁর এই লেখাটি ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমে প্রকাশিত হয়। লেখাটি এই প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মের পাঠকদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে শেয়ার করলাম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বৃদ্ধি ও সান্ধ্যকালীন কোর্স শুরুর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করে আসছে এ বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে। বিভিন্ন সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ করেছে। আমরা জেনেছি, আন্দোলনের মুখে বিশবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ধিত ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করেছে, কিন্তু সান্ধ্যকোর্সের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। শিক্ষার্থীরাও তাদের আন্দোলন জারি রেখেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ করছিলেন, তখন তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সশস্ত্র পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সশস্ত্রভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সহিংস হামলা চালায়। টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কিছু ছাত্রকে পুলিশের পাশে থেকে গুলি করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তাদের পরিচয় জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে।
ছাত্রদের ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন যুক্তিযুক্ত কিনা বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সান্ধ্যকোর্স চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যৌক্তিক কিনা সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা তুলে রেখে আপাতত দুটি আইনি দিক নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
প্রথমত, পুলিশের উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র হামলা নতুন বিষয় নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। তখন যেমন পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এবারও হয়তো নেবে না। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায়, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালেও এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যায়। আমাদের ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে সন্ত্রাস একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, আর এটি বজায় রাখতে গেলে কাউকে না কাউকে তো সন্ত্রাসচর্চা করতে হবে।
সেটি যদি দলান্ধ ছাত্র নামের সন্ত্রাসীরা করে তাহলে লাভ দুই ধরনের– হালুয়া-রুটির বিন্দুপরিমাণ ভাগ দিয়েই এসব সারমেয়দের লালন-পালন সম্ভব, আর পরবর্তীতে এদের ক্ষমতায় বসিয়ে লুটের রাজনীতির তালুক জারি রাখা যায়। নতুন করে কাউকে তৈরি করতে হয় না। সরকার পরিবর্তন হলেও এই সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় না। নাম আর চেহারা শুধু পাল্টায়।
সে যাই হোক– ঘটনা-পরবর্তী সময়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে যখন বলেন– ছাত্রলীগ তাদের উপর আক্রমণ মোকাবেলা করতে গিয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে, তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না কেন শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বন্ধ হয় না। জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস বন্ধ করার দায়িত্ব ছাত্রলীগের নয়– পুলিশের। পুলিশ যদি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে অন্য কোনো সরকারি বাহিনীকে দিয়ে সে কাজ করানো যেতে পারে। কিন্তু সেখানে সরকারি দলের কিংবা অপর কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের ছাত্রদের সশস্ত্র প্রতিরোধে ঠেলে দেওয়া বা সন্ত্রাস প্রশ্রয় দেওয়া– আইনের শাসনের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী।
হয়তো আইনের শাসনের প্রতি আমাদের শাসকদেরই তেমন বিশ্বাস নেই বলে, এ ধরনের অত্যুক্তি করার আগে ভাবা হচ্ছে না এর পরিণামে কী হচ্ছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিস্কার করেছে, যারা পিস্তল নিয়ে হামলা চালিয়েছেন, যাদের ছবি পরিষ্কারভাবে টেলিভিশনে দেখা গেছে। পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি প্রায় সব ক’টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে– বহিষ্কার করাটাই শেষ আইনি প্রক্রিয়া, এরপর আর কিছু করার দরকার নেই। যাদের নেতা তারা যদি মাফ করে দিয়ে থাকেন তবে আর কার কী বলার থাকতে পারে?
এই হল আমাদের দেশের আইনের অবস্থা! আইন তার নিজের নিয়মে চলছে! এইসব তথাকথিত ছাত্ররা কোথা থেকে এত অত্যাধুনিক অস্ত্র পেল, অর্থের যোগানই-বা কে দিল? এসব প্রশ্ন কেউ উত্থাপন করছেন না। পুলিশের কোনো মাথাব্যথা নেই। পুলিশসহ সাধারণ নাগরিকগণ ধরেই নিয়েছেন ছাত্রনেতা হলে তাদের কাছে অস্ত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে একটু-আধটু গোলাগুলি না হলে, কেউ মারা না গেলে মনেই হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হচ্ছে!
জয়তু সশস্ত্র ছাত্ররাজনীতি। ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা ‘ছাত্ররাজনীতি’ না হয়ে সেটি প্রতিরোধে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হামলার নাম যতদিন ‘ছাত্ররাজনীতি’ থাকবে ততদিন আমরা এসবই পাব। তাদের কেউ কেউ আবার দলবাজির কারণে শিক্ষকও হয়ে যাচ্ছেন। আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি– চারজন সহকারি প্রক্টর এই হামলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন! আগের অভ্যেস এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারেননি বোঝা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেননি। তাদের সহযোগী বলে কথা।
ছাত্রলীগ নেতারা নিজেদের উদ্যেগে হামলা চালিয়েছে এমনটি ভাবার কারণ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের একমাত্র উদাহরণ নয়– এর আগে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখেছি এ রকম সশস্ত্র হামলা, শিক্ষক পেটানো, ছাত্রীধর্ষণ। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত এক প্রক্টর তো তারই এক ছাত্রীকে আক্রমণ করে বসেছিলেন ২ অক্টোবর, ২০১২ তারিখের সংঘর্ষের সময়!
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কী চলছে তা সহজেই অনুমেয়। তাই তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেকে অপমান করতে চাই না। দলীয় নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান কোথায় নামছে তা রীতিমত শংকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময় এ নিয়ে ভাববার।
২ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষে মূলত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আহত হলেও, ৩ ফেব্রুয়ারি মতিহার থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি এবং ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় ১০৫ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ৪৭৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় কোথাও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কিংবা চারজন প্রক্টরের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
অর্থাৎ তারা বাংলাদেশের আইনে কোনো অপরাধ করেননি এবং তাই তারা কোনো মামলায় আসামী নন। ক্ষমতার কাছাকছি থাকার এই এক সুবিধা। কোনটি অপরাধ আর কোনটি অপরাধ নয় তার ব্যাখ্যা শুদ্ধ বদলে যায়! অথচ এসব মামলার পর থেকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন– তাদের অপরাধ গুরুতর– তারা ক্ষমতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। তাদের আস্পর্ধার সীমা টানা জরুরি।
তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেবল কঠোর নন– অতিমাত্রায় কঠোর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা তদন্তে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামানকে আহবায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি ইতোমধ্যে ছাত্রদের আন্দোলনে ‘উস্কানিদাতা’ হিসেবে আটজন শিক্ষককেও চিহ্নিত করেছেন বলে একটি সংবাদপত্র ৬ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট করেছে।
এই আটজনের মধ্যে কেউ কেউ সেদিন ছাত্রছাত্রীদের সহিংস হামলা থেকে বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমরা একটু সভ্য হলে, এই সাহসী শিক্ষকরা তাদের মানবিকতা ও সাহসিকতার জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হতেন। কিন্তু কার কাছে এসব প্রত্যাশা করছি? সবাই তো ‘চোখ বন্ধ করে’ দেখছেন সবকিছু।
নব্বইয়ের দশকে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছে এখন তার সিকিভাগও নেই, অথচ সন্ত্রাস বেড়েছে বৈ কমেনি। যতদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে না ততদিন ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে বের হয়ে আসবে না। আর এই চলমান নষ্ট রাজনীতি নিয়মিত অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাবে। এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার যার উপরই হোক না কেন বা যে দলের নেতা কর্মীরাই করুক না কেন, তা দেশের প্রচলিত আইনে ‘অপরাধ’।
এই ‘অপরাধ’ ছাত্র ব্যতীত অন্য কেউ করলে যে শাস্তি তা একজন ছাত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নাগরিককে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। তাই এদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
দ্বিতীয়ত, নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়টি ডালভাতে পরিণত হয়েছে। পুলিশকে গুলি করতে এত খুশি আর কখনও দেখা যায়নি যতটা বর্তমান সময়ে দেখি।
আগে পত্রিকায় পড়তাম– ‘‘ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন, … জন আহত…।’’ কিন্তু আজকাল সেসব আর দেখা যায় না। পুলিশ কখন একটি সমাবেশের উপর গুলি চালাতে পারে বা এই গুলি চালানোর আগে ও পরে তাদের কী কী করণীয় আছে তা সাধারণ নাগরিকের জানা প্রয়োজন বলে মনে করছি। এবার সেসব বিষয়ে আলোকপাত করব।
পুলিশ মূলত পরিচালিত হন পুলিশ আইন, ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল, ১৯৪৩ এর মাধ্যমে। পুলিশ আইনের ১২ নং ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্যে বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। একই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তিনি পুলিশ কখন ‘শক্তি’ প্রয়োগ করতে পারবে তা নির্ধারণ করতে পারেন।
পুলিশ রেগুলেশনের ১৪৩ প্রবিধানে বলা হয়েছে– “১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৩০(৩) ধারা অনুযায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত হোক বা না হোক, একটি সমাবেশ বা শোভাযাত্রাকে কেবলমাত্র ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৮ ধারা অনুসারে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করা যেতে পারে, অর্থাৎ কেবলমাত্র–
(১) সমাবেশ বা শোভাযাত্রাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭ (১) ধারা অনুসারে যথারীতি ছত্রভঙ্গ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অথচ ছত্রভঙ্গ হয়নি; অথবা–
(২) সমাবেশ বা শোভাযাত্রা এমনভাবে পরিচালিত হয় যে, তারা ছত্রভঙ্গ না হবার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বলে প্রদর্শন করে।
পুলিশ রেগুলেশনের ১৪৩ প্রবিধানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কর্তৃক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি প্রদানের একটি বিধানের কথা বলা হচ্ছে যেটি মূলত পুলিশ আইনের ৩০ (৩) ধারার মূল বক্তব্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের সভা-সমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, তাই পুলিশের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেহেতু প্রতিবাদ হচ্ছিল তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার প্রশ্নও অবান্তর ছিল। তাহলে শিক্ষার্থীদের এই সমাবেশ অবৈধ ছিল কি ছিল না, তা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে?
এখন দেখা যাক, কোন জমায়েতকে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে ‘অবৈধ’ সমাবেশ বলছে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৪১ ধারা অনুসারে, “পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ ‘বেআইনি’ সমাবেশ হিসেবে গণ্য হবে যদিও-ই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য এমন হয় যে–
প্রথমত, অপরাধমূলক শক্তিপ্রয়োগ বা এ ধরনের শক্তিপ্রয়োগের ভঙ্গি করে সরকার বা আইন পরিষদ বা কোনো সরকারি কর্মচারিকে তার আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন করা; বা
দ্বিতীয়ত, কোনো আইন বা আইনানুগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে বাধা প্রদান করা; বা
তৃতীয়ত, কোনো দুষ্কর্ম বা অপকর্মমূলক অনধিকার প্রবেশ বা অন্য কোনো অপরাধ সংঘটন করা; বা
চতুর্থত, কোনো ব্যক্তির প্রতি অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে কোনো সম্পত্তি অর্জন বা দখল করা অথবা কোনো ব্যক্তিকে যাতায়াতের অধিকার বা পানির ব্যবহার বা তার দখল বা অধিকারভুক্ত অন্য কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বা
পঞ্চমত, অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে কোনো ব্যক্তিকে এমন কোনো কাজ করতে বাধ্য করা অথবা করতে বাধা দেওয়া, যা তিনি আইনত করতে বাধ্য নন।”
উপরের সংজ্ঞা থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি সমাবেশ তখনই অবৈধ হবে যখন সেই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি অপরাধ করার মনোবৃত্তি নিয়ে সরকারি কাজে বাধাদান কিংবা অন্যের ন্যায়সঙ্গত অধিকারে হস্তক্ষেপ করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। রাজশাহীর ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিলেন ভুক্তভোগী এবং তাদেরই অধিকার খর্ব করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। তাহলে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থের জন্য সমাবেশ অবৈধ হবে কেন?
সেই সমাবেশ যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকে বেআইনি ঘোষণা দিয়ে থাকেন তাহলেও এই সমাবেশ অবৈধ হবে না। আমাদের সংবিধান শান্তিপূর্ণ সমাবেশের যে অধিকার দিয়েছে তা কোনো কর্তৃপক্ষ আইন করেও খর্ব করতে পারেন না। আর যদি করেন তবে সংবিধানের ২৬ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সেটিকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হবে।
যদি আলোচনার স্বার্থে ধরে নিই যে, ২ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ অবৈধ ছিল তারপরও প্রশ্ন আসে, সেদিন পুলিশের বলপ্রয়োগ বা গুলি করা যথাযথ ছিল কিনা? এ ক্ষেত্রে পুলিশের ‘রুলজ অব এনগেইজম্যান্ট’ কী হবে? সেজন্যে দেখা দরকার পুলিশ কখন, কীভাবে বলপ্রয়োগ করতে পারে? পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ১৪৫ অনুসারে দাঙ্গা ও গোলযোগের সময় পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও সশস্ত্র পুলিশ দল মোতায়েন করতে পারে। একই আইনের প্রবিধান ১৫১ অনুসারে, ‘যখন কোনো দাঙ্গা দমন বা বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য নিয়োজিত একটি সশস্ত্র দলের সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন, তখন–
(১) পুলিশ দলের অধিনায়ক কর্তৃক পুলিশের দায়িত্ব বিন্যাস কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না।
(২) কখন বলপ্রয়োগ করতে হবে এবং কখন গুলিবর্ষণ করতে হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি দায়ী থাকবেন।
(৩) যখন প্রয়োজন দেখা দেয় তখন তিনি পুলিশ দলের অধিনায়ককে বলপ্রয়োগ বা গুলি চালানোর নির্দেশ দিবেন, কিন্তু এ ধরনের নির্দেশাবলী প্রদানের পর তা প্রতিপালনের জন্য দলবিন্যাসের এরুপ অফিসারের স্ববিবেচনা ব্যাহত করবেন না।
(৪) প্রবিধান ১৫৩ (গ) (২) দ্বারা নির্ধারিত সতর্কবাণী প্রচার করবেন।
(৫) প্রবিধান ১৫৫ (ঘ)-এর অধীনে গুলি চালানো বন্ধ করার জন্য অধিনায়ককে নির্দেশদানের ক্ষমতা তার আছে।
(৬) যখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয় তখন তিনি প্রবিধান ১৫৬ (গ) এর অধীনে বর্ণিত একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিবর্ষণের সময় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন বলে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়নি। তাহলে ধারণা করা যায় পুলিশ নিজ উদ্যেগে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ১৫৩ (ক) পুলিশকে তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়–
(১) ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগ করার জন্য (দণ্ডবিধি আইনের ৯৬-১০৬ ধারা);
(২) বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য (ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭-১২৮ ধারা);
(৩) কোনো কোনো পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য (ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারা)।
আত্মরক্ষার অধিকার সাধারণ নাগরিকের যেমন আছে তেমনি পুলিশেরও সেই অধিকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৯৯ ধারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ অনুমোদন করে না। তাছাড়া প্রবিধান ১৫৩(খ)অনুসারে, ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার মতো জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল কিনা তা প্রমাণের দায়িত্ব গুলিবর্ষণকারীর অথবা গুলিবর্ষণের নির্দেশ প্রদানকারী অফিসারের উপর বর্তায়। ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পুলিশ গুলি ছুঁড়েছিল বলে দাবি করেনি।
তাহলে বাকি থাকে বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার বিষয়টি। বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার ক্ষেত্রে, প্রবিধান ১৫৩ (গ) (১) অনুসারে, জনতার উপর গুলিবর্ষণের আদেশ একটি চরম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এ পদক্ষেপ গৃহীত হবে সকল ব্যবস্থা শেষে যখন জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য তা একান্তভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়ে বা যখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা এ ধরনের অফিসারের উচ্চ পদমর্যাদার অফিসার বিবেচনা করেন যে, অন্য কোনোভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব নয় কেবল তখনই ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
প্রবিধান ১৫৩ (গ) (২) অনুসারে, জনতার উপর গুলিবর্ষণের আদেশ প্রদানের পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত না থাকলে পুলিশ দলের অধিনায়ক পুলিশ অফিসার দাঙ্গাকারীদের পূর্ণাঙ্গ এবং অনেকবার সতর্ক বাণী প্রদান করবেন যে, তারা যদি অবিলম্বে ছত্রভঙ্গ না হয় তবে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হবে।
উপরোক্ত প্রবিধান থেকে দেখা যায় যে, গুলি করার পূর্বে অনেকগুলো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়– গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত একটি ‘চরম’ ও ‘শেষ’ ব্যবস্থা এবং ‘অনেকবার’ সতর্কবাণী প্রদান করবেন। এখানে ‘অনেকবার’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে সতর্কবাণী প্রদান করাকে সত্যিকারের সতর্কবাণী প্রদান করা বোঝানো হয়েছে, যাতে সমাবেশকারীরা বুঝতে পারেন যে, তাদের শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি তারা সরে না যান।
তাই এই সতর্কবাণী প্রদান করার বিধান কেবল নিয়ম ক্ষার জন্যে নয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জেনেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় গুলিবর্ষণের আগে পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কোনো প্রকার সতর্কবাণী প্রদান করা দূরে থাক, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন বলেও মনে হয় না। তাহলে কার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়েছে?
প্রবিধান ১৫৩ (গ) (৩) এ বলা হয়েছে, দাঙ্গা দমনে অথবা দাঙ্গাকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার কাজে নিয়োজিত সকল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য গুলিবর্ষণের পূর্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার থেকে ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদার কোনো পুলিশ অফিসারের আদেশের জন্য অপেক্ষা অবশ্যই করবেন।
এখানেও উল্লেখ্য যে, ম্যাজিস্ট্রেট, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার থেকেও উপরের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার আদেশের জন্য অপেক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, এই বিধান নিকট অতীতের প্রায় সকল গুলিবর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেই মানা হয়নি।
এ তো গেল গুলিবর্ষণের পূর্বের বিধি-বিধান সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, এবার দেখা যাক যদি পুলিশ গুলিবর্ষণ করে তারপরে তাদের কী কী করণীয় থাকে। পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ১৫৬ মোতাবেক, কোনো বেআইনি জনতার বিরুদ্ধে বা একটি ক্ষুদ্র দলের বিরুদ্ধে অথবা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে, পুলিশ যখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তখন নিম্নলিখিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে–
(ক) অধিনায়ক পুলিশ অফিসার যত শীঘ্র সম্ভব মৃতদেহগুলো যদি থাকে, শবাগারে এবং আহতদের হাসপাতালে প্রেরণ করবেন;
(খ) তিনি গুলির খোসাগুলো সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করবেন ও ইস্যুকৃত রাউন্ডের সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন;
(গ) অনুচ্ছেদ ৪ এর অধীনে কার্যক্রম গৃহীত হবার সঙ্গে সঙ্গেই যদি ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন তবে তিনি এবং অধিনায়ক পুলিশ অফিসার প্রথমে–
(১) ঘটনা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ নিখুঁত প্রতিবেদন এবং তারপর,
(২) ব্যবহৃত ও ইস্যুকৃত গুলির সংখ্যাসহ ঘটনার সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের একটি নিখুঁত ও বিস্তারিত বিবরণ প্রস্তুত করবেন।
(ঘ) সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি জরুরি টেলিগ্রামযোগেও বিস্তারিত বিবরণ টেলিগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো দ্রুত মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠাতে হবে–
(১) যদি ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন, তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে, পুলিশ সুপারকে, কমিশনারকে এবং মূখ্য সচিবকে অনুরূপ প্রতিবেদন পাঠাবেন, এবং
(২) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং ইন্সপেক্টর জেনারেলকে অধিনায়ক পুলিশ অফিসার কর্তৃক প্রতিবেদন প্রেরণ করা হবে।
কোনো সংবাদমাধ্যম এ পর্যন্ত গুলিবর্ষণের ঘটনার পর পুলিশ তাদের করণীয় কর্তব্য পালন করেছে কিনা সে সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। আমরাও মতিহার থানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সে রকম কোনো বক্তব্য পাইনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, পুলিশ এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো প্রতিবেদন প্রস্তুত কিংবা প্রেরণ করেননি। এই লেখা যদি তাদের চোখে পড়ে তাহলে হয়তো, পুরনো তারিখ উল্লেখ করে প্রতিবেদন বানাবেন।
পুলিশ কর্তৃক এরূপ প্রতিবেদন প্রেরণ করার বিধানের পাশাপাশি পুলিশ কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের পর নির্বাহী তদন্তেরও বিধান রাখা হয়েছে। পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ১৫৭ (ক) অনুসারে, যখনই পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে থাকে, তখনই গুলিবর্ষণ যুক্তিসঙ্গত হয়েছে কিনা এবং এ প্রবিধানসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব নিম্নোক্তদের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে–
(১) যদি একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে কমিশনার কর্তৃক তদন্ত হবে;
(২) যদি একজন [মহকুমা] ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী পুলিশ সুপার গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্ত হবে;
(৩) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মনোনীত একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করবেন।
এই তদন্তের সময় কোনো পক্ষের আইনজীবী কর্তৃক প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নেই, তবে যদি কোনো পুলিশ অফিসারের আচরণ বিচার্য বিষয় হয় তবে তাকে প্রশ্ন করা ও সাক্ষীদের জেরা করা এবং মৌখিক বা লিখিতভাবে বিবৃতি প্রদানের অনুমতি দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ আছে [প্রবিধান ১৫৭ (ঙ)]।
প্রবিধান ১৫৭ (চ) অনুসারে, অনুসন্ধান শেষ হবার পর অনুসন্ধানকারী অফিসার যথাযথ মাধ্যমে সরকারের নিকট প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন এবং ইন্সপেক্টর জেনারেলের নিকট পেশ করার জন্য একটি অনুলিপি পুলিশ সুপার বা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেলের নিকট হস্তান্তর করবেন।
আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না উপরোক্ত আইনি বিধানসমূহ অনুসরণ করা হয়েছে কিনা। নাগরিক হিসেবে আমার অধিকার আছে জানার। আমারই ছোট ভাই যখন পুলিশের গুলিতে আহত হয় তখন এটি জানা আমার অধিকার। পুলিশ, ছাত্রলীগ আর ভ্রষ্ট প্রক্টরদের আঘাতে যখন আমার বোনটি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন এটি জানা আমার অধিকার। আমি সেই অধিকারের দাবি নিয়ে বলছি– জবাব চাই কেন রাজশাহীতে গুলি চলল?
আমাদের দেশে মোটামুটি সকল আইনই লিখিত। কিন্তু আইন না মানার প্রবণতা কেবল সাধারণ মানুষ নয় বরং সর্বস্তরেই প্রোথিত। সাধারণ জনগণ আইন না মানলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আর প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী যদি সেটি না মানেন তাহলে মৃদু তিরস্কার– এই অসম আইনি বিধান ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই আছে। আমাদের জাবাদিহিতা কেবল একপাক্ষিক। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে, সবার আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি।
২ ফেব্রুয়ারি সাধারণ শিক্ষার্থীরা সশস্ত্র ছিলেন না, তাদের কাছ থেকে পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রকার সহিংসতা আশংকা করছিলেন বলেও মনে হয় না। ৬ জানুয়ারি থেকে যে আন্দোলনের শুরু তাতে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো সহিংসতা হয়নি। তাহলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করল কেন? কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন– পুলিশ তো রাবার বুলেট ছুঁড়েছে, সত্যিকারের গুলি তো ছোঁড়েনি।
১৮৬১ সালের পুলিশ আইন কিংবা ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশন কোথাও রাবার বুলেটের উল্লেখ নেই, থাকার কথাও নয়। কেননা রাবার বুলেট সাম্প্রতিক সময়ের আবিস্কার। তাই যদি বিদ্যমান আইনের সরল ব্যাখ্যা করি তাহলে সকল প্রকার গুলিই ‘গুলি’ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই রাবার বুলেট বলে আইনি বিধান অনুসরণ না করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া রাবার বুলেটেরও যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে শারীরিক ক্ষতি করার।
এছাড়াও আকস্মিক গুলির কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী যারা কখনও সন্ত্রাসের কিংবা সহিংসতার মুখোমুখি হননি তাদের মনে এই ঘটনা গভীর ছাপ ফেলতে বাধ্য। এতে শিক্ষার সহজ পরিবেশ যেমন বিঘ্নিত হতে পারে তেমনি ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সময় থাকতে সাবধান হওয়া জরুরি।
সর্বোপরি, পুলিশ যেসব আইনের দ্বারা পরিচালিত হয় তা সেই ঔপনিবেশিক আমল কিংবা পাকিস্তান আমলে তৈরি করা। এসব রদ্দি-মার্কা আইনের সংস্কার পুলিশের নিজের প্রয়োজনেই করা দরকার। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি নামে ১৮৬০ সালের যে আইনের মাধ্যমে আমরা অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তি নির্ধারণ করছি তা-ও সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি। ১৮৬০ সাল থেকে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে, অপরাধের ধরনও পাল্টে গেছে। ইংরেজরা আমাদের শাসন করার চিন্তা মাথায় রেখে যেসব আইন প্রণয়ন করেছিল তা আমরা বাইবেল মনে করে এখনও প্রয়োগ করে যাচ্ছি, অথচ খোদ ইংল্যান্ডেই এসব রদ্দিমার্কা আইন আর নেই।
আমরা এসব আইন পরিবর্তনের কথা ভাবছি না; কারণ দীর্ঘদিন অন্যের দ্বারা শাসিত হওয়ার কারণে আমাদের মননে এখনও শাসিত হওয়ার সেই প্রবণতা রয়ে গেছে, যা থেকে সত্বর বের হওয়া ভীষণভাবে আবশ্যক।
লেখক: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।