বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অভিজিত রায়সহ নাস্তিক আখ্যা দিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার, এরা ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ শহীদ। ডিজিটালে আবির্ভাব, এনালগে মৃত্যু। এদের নাটাই ছিল নাটের গুরুদের হাতে, যারা দেশে বিভক্তির রাজনীতি করে, নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তাদের হাতে।
আফসোসের ব্যাপার হল, এরা যাদের হয়ে লড়াই করল তারা তাদের স্বীকৃতি দিল না, তাদেরকে রীতিমত অস্বীকার করল। এতে রাষ্ট্র হিসেবে সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার ব্যাপারেও চরম উদাসীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। অভিজিতের বাবা সারাজীবন সরকারি অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতি করেও সন্তান হত্যার বিচার পেলেন না। আজকে যারা ইওরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আছেন তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগা উচিত, দেশের ‘সেক্যুলার’ বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতে কেন তাদের দেশ ছাড়তে হয়? কারা তাদেরকে বলির পাঁঠা বানিয়ে রাজনৈতিক হত্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল? কারা প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করে তারপর প্রয়োজন ফুরিয়ে এলে তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করল? সাপের মাথায় ব্যাঙকে নাচানোর এ খেলায় কিছু ব্যাঙ সাপের পেটে গেলে খেলোয়াড়ের কোন সমস্যা নেই। খুব ভাল করেই জানা আছে, এদের যাবার আর কোন জায়গা নেই, এরা এক্সপেন্ডেবল, প্রভুভক্ত, রাজনীতির দাবাখেলায় এদের ব্যবহার করা যায়। প্রয়োজন হলে আবার তুই বলে ডেকে হাড্ডি ছুঁড়ে মারলে সব সুড়সুড় করে গিয়ে কাছে ভিড়বে, এ ভরসা আছে বলেই তাদের নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর খেলা সম্ভব।
বর্তমানে সারা দুনিয়ায় যে নাস্তিকতা চলছে, যার কারণে আমাদের যুবকেরা খুন হচ্ছে সেটা হল অরাজনৈতিকতা, সুপারফিশিয়াল ধর্মীয় কিছু বিষয়ের চর্বিত-চর্বন, কোনরকম দার্শনিক চর্চা বা সাধনা ছাড়া অযথা হাউকাউ। আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় শুধুমাত্র নৈর্ব্যক্তিক, এবং ব্যবহারিক শিক্ষাটাই আছে, শিক্ষার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেটা সাবজেক্টিভ, সেই ‘দীক্ষা’ সেখানে নেই। কিন্তু মানুষ শুধু শিক্ষা নিয়ে চলতে পারেনা, তার জীবনে দীক্ষাও লাগে। মানুষের জীবনে বিজ্ঞান (লোগোস) যেমন প্রয়োজনীয়, পুরাণও (মিথ) তেমনি দরকার। আধুনিক সমাজে দেখা গেছে, যেখানে মিথ নেই সেখানে নাগরিকেরা নিজেদের জন্য নতুন মিথ তৈরি করে নেয়। বড় বড় শহরে বিভিন্ন গ্যাং, কাল্টের আবির্ভাব এবং তাদের পালনকৃত রিচুয়াল থেকে এর বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার লস এঞ্জেলেস শহরে ৫০০ এর বেশি গ্যাং আছে, এসব গ্যাংয়ে প্রচলিত ধর্মীয় বা সামাজিক পুরাণের অভাবে গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের জন্য নতুন মিথ বানিয়ে সেটাই ধর্মীয় প্রথার মত সিরিয়াসলি পালন করতে থাকে। তাদের গ্যাংয়ে যোগদান, অভিষেক, এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড মারাত্মক রকমের রিচুয়ালাইজড।
বিজ্ঞানের এই যুগে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আমাদের শুষ্ক নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানের সন্ধান দেয়, কিন্তু সেই জ্ঞানের সাথে আমাদের সম্পর্কিত করে না, ফলে আধুনিক শিক্ষিত মানুষ যদি পরিবার থেকে বা কোথাও কোন দীক্ষা না পায়, তাহলে তার জীবনে একটা শূন্যতা থেকে যায়। এ সুযোগটা কাজে লাগায় জঙ্গী নাস্তিক্যবাদ, ‘মিলিট্যান্ট এথেইজম’ এর পাণ্ডা, ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত প্রাণিবিদ রিচার্ড ডকিন্স, রাজনৈতিক পণ্ডিত ক্রিস্টোফার হিচেন্স, দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট এবং নিউরো সায়েন্টিস্ট স্যাম হ্যারিস। এরা সবাই মানুষের জীবনের দার্শনিক ‘বড় প্রশ্নগুলোর’ (Big Question) কোন জবাব দিতে পারে না, কিন্তু মানুষের জীবন থেকে ধর্মকে সরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ধর্মকে প্রতিস্থাপিত করে তারা নতুন কিছুর প্রস্তাব করেন না। শিশুর কাছ থেকে জোর করে খেলনা কেড়ে নেবার আগে তার জন্য অন্য কোন খেলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা না হলে সেটা হবে অমানবিক, ক্রুড় এবং জঘন্য একটা কাজ। মোটের ওপরে এরা বর্ণবাদী, নির্দিষ্ট ধর্মের বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা যুদ্ধবাজ। মানবতা বিরোধী, অনধিকার চর্চাকারী এসব মহাপণ্ডিতেরা বিজ্ঞান দিয়ে সব সমস্যার সমাধান চান।
কিন্তু বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু বুঝা কী সম্ভব? ব্লগার ইমন জুবায়েরের প্রোফাইলের এ কথাটার জবাব কী?
“জীবন যদি কেবল প্রাণ-রসায়ন,
জ্যোৎস্নারাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন।”
যতদূর মনে হয় তাতে বোধ হয়, নিছক আধ্যাত্মিকতা/ধর্মমতের সাথে নাস্তিকদের কোন বিরোধ নেই, তাদের বিষোদগারের অন্যতম কারণ ‘সংগঠিত ধর্মীয় দলের’ (Organized Religious Practice) খবরদারি, শাসন-শোষণ, সামাজিক নিগ্রহ, এবং মানসিক অত্যাচার। কারণ বাউল, সূফি এবং অন্যান্য অনেক মানবিক আধ্যাত্মিক প্রথার প্রতি নাস্তিকদের মনে একটা নমনীয় ধারনা আছে। জীবনের অস্তাচলে এসে নাস্তিকরা কম্যুনিস্ট পার্টি করেও হজ্জ্ব করতে কোন বাধা হয় না। সংগঠিত ধর্ম বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে শাসন-শোষণের হাতিয়ার, বা ভুল বোঝানোর কাজে ব্যবহৃত হলে যতো সমস্যা!
রাজনৈতিক কোন লক্ষ্য বা অভিমূখ ছাড়া প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কি-বোর্ড গুতিয়ে ‘আমি নাস্তিক’, ‘আমি ঈশ্বর মানি না’ বললে কার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হয় আমি জানি না। এর সাথে মৌলবাদের তেমন কোন পার্থক্য নেই। ভারত-পাকিস্তানে যেমন অনেকে আছেন যারা সকালে কিছুক্ষণ ভারত বা পাকিস্তানকে গালি দিয়ে, শাপ-শাপান্ত করে দিন শুরু করে। অনেক তো হল, এবার এসবের ঊর্ধ্বে ওঠা যায় না? কারণ ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা-ব্যবস্থা, আইন, বিজ্ঞান, মিডিয়া, এগুলো সমাজকে নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হাতিয়ার, ক্ষমতাসীনদের কাছে এগুলো সব জনগণকে নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন কৌশল। তাই আসল জায়গায় কাজ না করে, ঘৃণা ছড়ানো নাস্তিক্য কেবল ‘তা না না না’। এ ব্যাপারে সচেতন না হয়ে, সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ না করে বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তক বা দেবতাদের নিয়ে কুৎসা রচনা করে সেই ধর্মমতের কাউকে একটুও টলানো যাবে না, সমাজ পরিবর্তন তো আরো দূরের কথা। তাও যদি আমরা সমাজ পরিবর্তন চাই, আর যদি না চাই, শুধু ‘হিটখোর’ হওয়াটাই যদি একমাত্র ইচ্ছা হয় তাহলে বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, নাস্তিক হয়ে ইওরোপ-আমেরিকার ‘এসাইলাম’ নিয়েও কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি থামবে না। আর যেহেতু নাস্তিক হবার কারণেই শাদা সাহেবরা এসাইলাম দিয়েছে, সুতরাং নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে, রুটিরুজি হালাল করতে, এলেবেলে লেভেলের ‘হিটাকাঙ্খী’, সুপারফিশিয়াল ভার্চুয়াল গার্বেজ পয়দা করে যেতে হবে। ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে গভীর থিসিস ছাড়া এসব প্রচারে বরং সংগঠিত ধর্মের প্রভাব আরো বাড়বে, কারণ আজকের যুগে প্রচারেই প্রসার। ধর্মীয় বিমূর্ত ভাবকে কুৎসা রচনা করে দমানো যাবে না।
বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্ম এবং রাজনীতির যে মিশ্রণ চলছে, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’ তার অবসান না হলে ধর্মীয় ইস্যুতে আস্তিক/নাস্তিক কোন ধরনের আলোচনাই রাজনীতির বাইরে থাকবে না। দেশের প্রতিষ্ঠিত, বড় সব দল ধর্মকে রাজনীতির কারণে ব্যবহার করছেন, যার কারণে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে যাদের খুন করা হলো তাদের খুনীদের বিচার হচ্ছে না। সবাইকে তাই অনলাইনে/অফলাইনে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। অনলাইনে নামে/বেনামে শুধু শুধু ঘৃণা ছড়িয়ে, আঘাত করে কোন স্বার্থসিদ্ধি হবে না। ঘৃণা ছড়ালে তার থেকে আরো ঘৃণা বাড়তে থাকে। শাহবাগে গলা ফাটিয়ে ‘ফাঁসি চাই’, ‘ফাঁসি চাই’ বলেই কী ফাঁসির রায় পাওয়া গেছে? কারণ কারো কারো অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়, তারা যেন শাহবাগে থেকে, অবস্থান নিয়ে ফাঁসির রায় অর্জন করেছেন। না কী আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে আইনী প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়েছে? কোন বয়ানটা ভাল শোনায়, তা আপনারাই ভাল জানেন। তাছাড়া শাহবাগ উত্তর বর্তমান সময়ে তো জামাত বা রাজাকার কোন সমস্যা না, সরকারি দলের রাজাকার হলে তার যুদ্ধাপরাধ মাফ। নিকারাগুয়ার স্বৈর-শাসককে নিয়ে রুজভেল্ট যেমন বলেছিলেন,
“Somoza may be a son of a bitch, but he’s our son of a bitch”
The Stream – The dangers of blogging in Bangladesh
আজকে অভিজিত রায় এবং অন্যান্য ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডকে যদি আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত মনে করি, তাহলে মত প্রকাশের ওপর কণ্ঠরোধকারী ৫৭ ধারা দিয়ে দেশে প্রতিদিন শত শত ব্লগারকে খুন করা হচ্ছে। মত প্রকাশের কারণে একদিকে মৌলবাদের আক্রমণ, আরেকদিকে ৫৭ ধারার খাঁড়া, বাংলাদেশী মানবতা এ দু’ধারী তলোয়ারের নীচে মাথা পেতে আছে। ব্লগার এবং অন্যান্য বিনা বিচারে হত্যা, গুম এসবের বিচার চাইতে হলে আগে এই কালাকানুন সরাতে হবে। তাই যারা নিহত হয়েছেন তাদের সবার হত্যার বিচার এবং দেশে বিদ্যমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিরোধী ‘৫৭ ধারা’র অবসান ঘটাতে হবে। অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে এই দাবিতেই সকলকে সোচ্চার হওয়া উচিত।
– নাজিম উদ্দিন
ইউটাহ, আমেরিকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২১০৭