০
১২৭১ বার পঠিত
ইউরোপ, আমেরিকাতে মনুষ্য বসবাসের অনেক, অনেক আগে থেকে ভারত পৃথিবীর গরিষ্ঠ মানুষের বাসস্থান। একাদিক্রমে মনুষ্য বসবাসের ইতিহাসে ভারত ও চীন চিরকাল দুই জনবহুলতম দেশ। এদেশে অন্তত ষাট হাজার বছর ধরে আমরা বাস করছি।
সারা পৃথিবীর মানুষের নজর ছিল এই দেশে। ওদের আগমনে, আক্রমণে ভারত ছিল তালিকায় সবসময় এক নম্বরে। এদেশে তৈরী হয়েছে পৃথিবীর প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। তবে আর্যরা আসবার পরে এক মহামন্থন হয়েছিল। দেশের আদি অধিবাসীদের প্রান্তিক করেছে দেশের সংখ্যালঘু বহিরাগত ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতা ধরে রাখবার প্রয়োজনে বর্ণ ব্যবস্থা দূরে ঠেলে দিয়েছে সংখ্যাগুরু মানুষকে।
আশ্চর্য, নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরী করেছে, জাতের দেওয়াল দিয়েছে, আবার বাস্তবতার পরিচয় দিয়ে এদেশের কৃষ্ণা সুন্দরীদের বিয়ে করেছে। পরবর্তীতে বহিরাগতদের কাছে টেনেও নিয়েছে। কেউ লীন হয়েছে, কেউ পাশে থেকে গেছে, কেউ প্রান্তে স্থান নিয়েছে।
তুর্কি ও মুঘলের আগমনের পরে নিজেদের ভিন্নতা নিয়েও ওরা পাশাপাশি একসাথে থেকেছে। একবার পৃথিবীর দিকে তাকান। আব্রাহামিক ধর্ম যেখানে গেছে সেদেশে প্রায় শতভাগ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে। ভারতে ব্যাপক ধর্মান্তর হয়নি। সুফী মতবাদ, আকবরের মতো সম্রাট, হিন্দুদের আত্মমর্যাদা ও বৈচিত্র্য হয়তো বাফার হিসেবে কাজ করেছে, শান্তি রাখতে সাহায্য করেছে। প্রান্তিক, বনের মানুষ তাদের জীবনযাপন পরিবর্তন করেনি। আলাদা হবার অভিমানে স্বমর্যাদা নিয়ে থেকেছে।
তবে এদেশে এসে পাঠান, মুঘলরাও এখানকার উষ্ণ, আর্দ্র জলবায়ুতে ভিজে গেল। নতুন যুদ্ধাস্ত্রর সন্ধান আর করলো না। দেশ জয় ছেড়ে দিলো – ওই উত্তর থেকে দক্ষিণ আর দক্ষিণ থেকে উত্তর। দুই হাজার বছর আগে মৌর্য্য যুগেও এর থেকে সাম্রাজ্য ছোট ছিলো না।
লক্ষ্য করবেন, ভারত থেকে কেউ বাইরে আক্রমণে যায় নি। দেশজ মানুষ, মৌর্য্য, শক, হুন, পাঠান, মুঘল কেউ না। বাণিজ্য করেছে দূর দেশের সাথে, তবে যুদ্ধ জয়ে যায় নি।
আসলে আমাদের মধ্যে হয়তো এক অতি প্রাচীন জীবনদর্শন আছে। একবার মনে করুন আরণ্যকের রাজু পাঁড়ে। ঘন অরণ্যের মধ্যে সাত্তিক প্রকৃতির রাজু পাঁড়ে; সারাদিন পরে সন্ধ্যার আগমনে পুঁথিপাঠ ও পূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ভুলে যায় জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাস করে দুই পয়সা করার কথা। ভানুমতী ও তার পিতামহ। যুগ যুগ ধরে তারা তাদের প্রাচীন জীবনযাপন গর্বের সাথে পালন করেছে।
‘… এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম! ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই মাটির ঘরের জ্যোৎস্না-ওঠা দাওয়ায় সরলা বন্যবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষি গল্প করিত ….আর ওর ওই সতেজ সরল মন! দয়া আছে, মায়া আছে, স্নেহ আছে।… ভাবিতেও বেশ লাগে। কি সুন্দর স্বপ্ন! কি হইবে উন্নতি করিয়া?’
এই ভিজে আবহাওয়ায় নরম মানুষ নিজেদের মধ্যে আচঁড়াআঁচড়ি করেছে, তবে বিদ্রোহ করেছে কম। বিপ্লব পড়েছে বইতে। অস্ত্রে জং ধরেছে। পাশে ইউরোপ দেখুন, তুলনা করুন।
যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় নিজের জাতপেশায় তুষ্ট থেকেছে। আর বৃষ্টিভেজা দিনে ঘরে গিয়ে দুমুঠো খেয়ে বৌকে পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছে। হয়তো এ সুখের কথা না। তবে এ সত্য।
এখানে মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়।
বহু নির্বাচন হবে। বহু রাজা-রাণী প্রাচীন এ দেশে এসেছে, আসবে। ক্ষুদ্র স্বার্থে, ক্ষমতার নেশায় একের বিরুদ্ধে অন্যকে নামিয়ে দেওয়া অন্যায়। খেপিয়ে দেওয়া অধর্ম।
হনুমানেরও প্রয়োজন নেই। মাথা ঢেকে, সালাফিদের বন্দনারও দরকার নেই। ধর্ম ওরা পালন করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। পালন করবে। একবার ধর্মের রাজনীতিতে সবার হাত কিন্তু পুড়েছে! ভাববাদী মানুষকে উস্কে দিলে ভবিষ্যৎ কিন্তু কারো আয়ত্তে থাকবেনা।
আসল কথা বলুন। যে জন হাজার বছর ধরে প্রান্তিক তারা কি শহরে আপনাদের পরিবারের মতো চারতলা বাড়ি হাঁকাতে পারবে! নিদেন পক্ষে ছোট্ট একটু রোজগার। ওরা মোমের পুতুল নয়, রোজগার করতে চায়। করতে দিন।
আর যারা শহরে থেকেও প্রান্তিক, তাদের কি হবে! ওরা যে স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যাচ্ছে। সামান্য রোজগারের জন্য দিনে চোদ্দ-পনের ঘন্টা খাটে। পারেন তো স্বপ্ন দিন। স্বপ্ন পূরণ করুন।
শুদ্ধ স্বপ্নকে সত্য করুন। নয়তো বেশী দিন লাগবে না। যাদের ছবিতে আজ শহর সজ্জিত, সে যাবে হাওয়ায় উড়ে। আজ নয়তো কাল।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন