৫৮৩ বার পঠিত
“ভারতে আর দশটা ধর্ম্মের মতো নাস্তিক্যও একটি ধর্ম্ম এবং তার জন্ম হয়েছে আস্তিক্যর প্রায় সমবয়স্কতায়।”
-শ্রীনৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
সামাজিক মাধ্যমে জনৈক বন্ধু মন্তব্য করেছেন যে নাস্তিকদের কোনো জায়গা নাই। আরও কেউ কেউ এমনটা ভেবে থাকতে পারেন। কেউ কেউ মনে করেন পৃথিবীর সবাই আসলে আস্তিক এবং কোনো মানুষ নাস্তিক হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। আমি এদের কথার বিরোধিতা করি। আমি নিজে একজন নাস্তিক, আমার বহু নাস্তিক বন্ধু আছেন ও তারা দিব্যি বেঁচেবর্ত্তে আছেন এবং নানা ভালো কাজ করে চলেছেন। তবু যারা বলেন যে নাস্তিকতার কোনো জায়গা নাই তাদের কথার মর্ম্ম আমাদের ভেবে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি।
ভারতবর্ষে নাস্তিকতা আস্তিকতার মতোই পুরাণো। আদিতে নাস্তিকতা শব্দটি একটু নিন্দনীয়ই ছিল। বর্ত্তমানে এই শব্দটি আর নিন্দনীয় নয়, যদিও কেউ কেউ এখনও নাস্তিকদের অপছন্দ করেন। আজকাল নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়ছে এবং বহু বিদগ্ধ ও জ্ঞানীগুণী মানুষ নিজেকে নাস্তিক বলতে লজ্জা পান না।
আস্তিকতা ও নাস্তিকতা বলতে আমরা কী বুঝব? একজন উপরওয়ালা বা নিয়ন্তায় বা পরমেশ্বরে বিশ্বাস করাকে আস্তিকতা এবং সে বিশ্বাস না করাকে নাস্তিকতা বলা হয় বলে আজকাল কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু শব্দগুলির উৎসমূল আরও অনেক গভীরে, যা ধীরে ধীরে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছি। ভারতীয় দর্শনে মীমাংসক নামে দার্শনিকগণ পরমেশ্বর বা উপরওয়ালায় বিশ্বাস করতেন না। তবু ওরা আস্তিক বলেই গণ্য হন, নাস্তিক বলে গণ্য হন না। আবার গৌতম বুদ্ধকে নাস্তিক বলা হয়, তার কারণটা এমন নয় যে তিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করতেন না (বুদ্ধ ঈশ্বর সম্বন্ধে নীরব ছিলেন, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলে ধরার রেওয়াজ আছে)। আসলে বুদ্ধ বেদ মানতেন না বলেই তাঁকে নাস্তিক বলা হয়। বৈদিক কর্ম্মকাণ্ড তাঁর সময়ে মৌলবাদের নামান্তর হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি বৈদিক যাগযজ্ঞগুলি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন। এর থেকে পরিষ্কার হল যে ঈশ্বর বিশ্বাসই আস্তিকতা এবং ঈশ্বর না মানাই নাস্তিকতা এমনটা নয়। শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে ‘ঈশ্বর মানিয়াও বেদ না মানিলে নাস্তিক।’ অতএব ঈশ্বরবিশ্বাসীরাও নাস্তিক হতে পারেন এবং ঈশ্বর অবিশ্বাসীরাও আস্তিক হতে পারেন (যথা মীমাংসকরা)।
তাহলে দেখা গেল মূলে রয়েছে বেদ।
প্রশ্ন: বেদ কী জিনিষ?
বেদ শব্দটি আসে বিদ্ ধাতু থেকে। বিদ মানে জানা, বেদ মানে আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত জ্ঞানের আধার। প্রাতিষ্ঠানিক বেদ বলতে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব্ব বেদ ইত্যাদি গ্রন্থগুলিকে বোঝায়। বেদের সঙ্গে আছে ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ, গণিত, শিক্ষা ইত্যাদি ছয় বেদাঙ্গ যেগুলি খুবই উচ্চাঙ্গের জ্ঞানের আধার এবং সারা পৃথিবীর সকলের সম্পদ। ব্যাকরণের মধ্যে পাণিনির ব্যাকরণ মানব মনীষার একটি শ্রেষ্ঠতম অবদান রূপে পাশ্চাত্যেও স্বীকৃত হয়েছে। বৈদিক গণিতও যথেষ্ট উন্নত। যাস্কের নিরুক্ত পৃথিবীর প্রথম অভিধান। এই সব বইয়ের টীকাটীপ্পনী সহ এক সুবিশাল বৈদিক সাহিত্য গড়ে উঠেছে যা দিয়ে একটি ছোটোখাটো লাইব্রেরী বানানো চলে। এই বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারের প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ধারের কাজ এখনও ঢের বাকী আছে। তবে বেদে যা আছে আধুনিক বিচারে তার অনেক কিছু ভুল বের হবে বা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে না। সেই ভুলগুলির জন্য প্রাচীনদের অশ্রদ্ধা করা উচিত নয়, বরং আমাদের উচিত হবে তাঁদের বক্তব্যের মর্ম্ম বুঝার চেষ্টা করা ও ভুলটা বর্জ্জন করে ঠিকটা গ্রহণ করা এবং জ্ঞানে জ্ঞান যোগ করে ঋষিতর্পণ করে জ্ঞানপ্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে চলা। বেদের মধ্যে যেসব যাগযজ্ঞ ইত্যাদির কথা আছে সেগুলি আজকের দিনে অপ্রয়োজনীয়। বুদ্ধ প্রমুখ নাস্তিকেরা এইসব যাগযজ্ঞ করে কোনো লাভ আছে বলে মনে করেননি।
প্রশ্ন: বেদের মধ্যে ঈশ্বরের স্থান কোথায়?
উত্তরে জানাই যে বেদের আদি অংশে ঈশ্বর শব্দটি নাই। বেদের অন্তিমে উপনিষদে আছে ব্রহ্মের কথা। কেউ ব্রহ্মে বিশ্বাস করলে তিনি আস্তিক এবং যিনি ব্রহ্ম মানেন না তিনি নাস্তিক এমনটা বলা হয়। এখন প্রশ্ন : ব্রহ্ম কী জিনিষ? ঈশ্বর বলতেই বা কী বোঝায়?
বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে ব্রহ্ম মানে তত্ত্ব, জ্ঞান, আত্মা, সত্য, মোক্ষ, অতিমহৎ, ব্রহ্মজ্ঞান, শব্দ ইত্যাদি। যেমন ধরুণ বৈয়াকরণ ভর্তৃহরির বিখ্যাত ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থের প্রথম ভাগটির নাম ‘ব্রহ্মকাণ্ড’। এখানে ‘ব্রহ্মকাণ্ড’ মানে ‘theoretical part’ বা তাত্ত্বিক অংশ বলে বুঝতে হবে। এর থেকে ব্রহ্ম মানে theory বা তত্ত্ব বলে বুঝা যায়। শব্দকে ব্রহ্ম বলে কারণ শব্দ দিয়েই আমরা চিন্তা করি এবং শব্দে শব্দে সম্পর্ক বুঝলে বস্তু জগতকেও বুঝা যায়। সেদিক থেকে যিনি প্রকৃতির নিয়মে (তত্ত্বে বা theory-তে) বিশ্বাস করেন তাকে আস্তিক বলা যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ। সেই সম্পর্কজ্ঞানের উপলব্ধিই ব্রহ্মজ্ঞান। সুতরাং তথাকথিত নাস্তিকদের অনেকেই বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রকৃতির নিয়মে গভীরভাবে বিশ্বাসী হলে তাদেরকেও সসম্মানে আস্তিক বলা যেতে পারে। ব্রহ্ম মানে সত্য বলে যিনি সত্যে বিশ্বাস করেন তিনিও আস্তিক। যিনি নিজেকে বিশ্বাস করেন তিনিই আস্তিক, গ্রামাঞ্চলে এমন কথাও অনেকে বলেন। এটিও আস্তিক শব্দের সঠিক প্রয়োগ বলে গণ্য করা যেতে পারে বলে আমার মনে হয়। আস্তিক শব্দের অর্থ বেদে বিশ্বাসী, পরলোকে বিশ্বাসী, ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ব্রহ্মে বিশ্বাসী, শ্রদ্ধাবান ইত্যাদি হয়। নানা প্রামাণ্য অভিধান ও বইয়ে এই অর্থগুলি পাওয়া যায়। এই দিকে থেকে বিচার করলে পৃথিবীর কেউই নাস্তিক নয়, সে কথা মানা যেতে পারে।
এবার আসি ঈশ্বর শব্দের অর্থে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ‘-এ ঈশ্বর শব্দের অর্থগুলি হল প্রভু, আঢ্য, ঈশনশীল, রাজা, পতি, পরমেশ্বর ইত্যাদি। তাই শব্দার্থকে সঙ্কুচিত না করলে বলা যায় যে আমরা প্রতিনিয়ত নানা রকমের ঈশ্বরের দেখা পাই। তবে পরমেশ্বরের ধারণাটা সবাই করতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ পারেন। এই ধারণা খুবই শক্ত হলেও সেটা যে বিজ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হবেই এমনটা নয় বলে রিচার্ড ফিনম্যানের মতো দিকপাল পদার্থবিজ্ঞানী এবং আরও বহু চিন্তাশীল মানুষ মনে করতেন / করেন। আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ এক ধরণের ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ওরা ঈশ্বর শব্দের যেরকম অর্থ করেছেন সেগুলিকে ভুল বলা চলে না বলেই আমি মনে করি (ভিন্ন মত কাম্য)। আমার মতে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথকে আস্তিক বলা চলে বটে, তবে নাস্তিকতা থেকে ওরা খুব একটা দূরে নন। আইনস্টাইন যে অর্থে ঈশ্বর কথাটা ব্যবহার করতেন তা প্রায় নাস্তিকতার নামান্তর এবং গভীর বিচারে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার সীমারেখা অদৃশ্য হয়।
তাহলে নাস্তিক কে এবং নাস্তিকতার দরকারটা কোথায়? আমার মতে তার দরকার আছে। যারা যাগযজ্ঞ, অর্থ না বুঝে ধর্ম্মাচরণ ইত্যাদি করাতে বিশ্বাস করেন না তাদের নাস্তিক বলতে হবে। ‘পৃথিবীর কেউই নাস্তিক নয়’ না বলে নাস্তিকদের জন্যও জায়গা ছেড়ে দেওয়া দরকার এবং শব্দার্থের নিয়মে তাতে অসঙ্গতি হয় না। যারা ব্রহ্ম, ঈশ্বর প্রভৃতিতে বিশ্বাস করেন না (হতে পারে এই শব্দগুলির অর্থ ভাল করে না বুঝে অথবা জনমানসে এই শব্দগুলির অর্থ নিয়ে নানা বিভ্রান্তি থাকার ফলে) তাদের আমরা তথাকথিত অর্থে নাস্তিক বলতে পারি। ঈশ্বর (?) না মানলেও এদের অনেকেই মানুষের জন্য অনেক ভাল কাজ করেন। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ প্রভৃতি আস্তিকরা এদের গুণগানই করেছেন। সুতরাং নাস্তিকতার কোনো জায়গা নাই একথা বলা চলে না।
আমি নাস্তিকতাকে একটি ধর্ম্ম বলেই গণ্য করি। অবশ্য বহু আস্তিক এবং নাস্তিক নাস্তিকতাকে কোনো ধর্ম্ম বলে মনে করেন না। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম্ম শব্দের যা অর্থ তাতে করে নাস্তিকতাকে ধর্ম্ম বললে দোষ হয় না। ধৃ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ধর্ম্ম শব্দের অর্থ ‘লোকধারক’ অথবা ‘শরীরসাধন যে কর্ম্মের অপেক্ষা করে’ (দ্র. ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’)। তাহলে যেসব কর্ম্ম নাস্তিকদের ধরে রাখে তাকে ‘নাস্তিকতা ধর্ম্ম’ বললে ভুল হয় না। বাংলা ও সংস্কৃতে ধর্ম্ম শব্দের অর্থ এতই ব্য়াপক যে তা অক্সিজেনের ধর্ম্ম, মানুষের ধর্ম্ম, সমাজের ধর্ম্ম থেকে শুরু করে নাস্তিকদের ধর্ম্মকেও বোঝাতে পারে। বিখ্যাত লেখক ও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত মাননীয় শ্রীনৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয় বলেন,
“ভারতে আর দশটা ধর্ম্মের মতো নাস্তিক্যও একটি ধর্ম্ম এবং তার জন্ম হয়েছে আস্তিক্যর প্রায় সমবয়স্কতায়।”
তাঁর এই কথা একদম ঠিক। তবে নাস্তিকতাকে আলাদা ধর্ম্মমত না বলে হিন্দুধর্ম্মেরই একটি শাখা রূপে বিবেচনা করা হয়। এরা চার্ব্বাক দর্শনে বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদি সম্বন্ধে এরা নানা প্রশ্ন তুলেন। দার্শনিক জিজ্ঞাসা হিসাবে এদের প্রশ্নগুলির গুরুত্বপূর্ণ মূল্য আছে। কিন্তু শুধুমাত্র চার্ব্বাক দর্শনে মজে গিয়ে ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখাগুলিকে অবহেলা করতে হবে তা কিন্তু নয়। যখন যেটা দরকার তখন সেই দর্শনটা বা তার প্রয়োজনীয় অংশটি কাজে লাগাতে হবে।
আমি একজন নাস্তিক হলেও আস্তিকদের নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই। আস্তিক ও নাস্তিক দুই দলেই আমার বহু বন্ধু আছেন। আমি ভারতীয় ঐতিহ্যের জন্য গর্ব্ববোধ করি। ভারতীয় ঐতিহ্য মানে শুধু আস্তিকতা বা শুধু নাস্তিকতা নয়। ভারতবর্ষ সমন্বয়ের সাধনা করেছে। এই ভারতবর্ষকে ভাল বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আস্তিক ও নাস্তিকরা পরস্পরের সঙ্গে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হোন, এই কামনা করি। বন্ধুরা নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আরও আলোকপাত করলে বাধিত হব। আস্তিকরাও তাদের বক্তব্য রাখতে পারেন। অনুরোধ করব কেউ কুতর্ক করবেন না।