মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকা বিচারপতি সিনহা এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে দ্য ওয়্যার কে বলেন, ভারতের উচিত তার দায়িত্ব পালন করা। তিনি বলেন, “যদি প্রতিবেশী দেশে আইনের শাসন না থাকে তবে তা ভারতের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে”।
অনেকের কাছেই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা শেখ হাসিনা আর তাঁর শাসকগোষ্ঠির ঘনিষ্ঠ একজন বলে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে নিজগৃহে অন্তরীণ এবং এক পর্যায়ে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো হয় ২০১৭ সালের শেষের দিকে। সেই ঘটনার এক বছর পর বাংলাদেশের প্রাক্তন বিচারপতি সেদেশের “স্বৈরাচারী সরকারের” বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
বিচারপতি সিনহা তাঁর সদ্য প্রকাশিত স্মৃতিকথা A Broken Dream: Rule of Law, Human Rights and Democracy এর মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, এমন এক হুইসেল ব্লোয়ারের ভূমিকায় হাজির হয়েছেন যার অপেক্ষায় ছিলো বাংলাদেশের মানুষ। সরকারের একসময়ের ঘরের লোক আজ এক নির্দয় শাসক আর তার দমননীতি এবং বেআইনি কার্যকলাপের পদ্ধতির হতচকিত করে দেওয়া বিবরণ প্রকাশ করে তথ্য দিচ্ছেন।
সিনহা তাঁর সমালোচনায় অবিচল, তাঁর এই সমালোচনার এক পর্যায়ে অভিযোগ তুলেছেন এই সরকারের প্রধান আন্তর্জাতিক সহায়তাকারী দেশ ভারতের ওপর। বিচারপতি সিনহা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “জনগণকে নিজস্ব সুরক্ষাবাহিনীগুলোর নিয়মিত দমননীতির সাহায্যে তাদের নাগরিক অধিকারকে হরণ করে শাসন করা যায় না। কোনো স্বৈরাচারী শাসক দেশকে চিরকাল শাসন করে যেতে পারে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষের বিক্ষোভ আরো বেড়ে যাবে এই অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। আর তা ভারতের বিরুদ্ধেও যাবে। কারণ ভারত নিজ স্বার্থে এই স্বৈরাচারী সরকারকে টিকে থাকার জন্য সাহায্য করছে বলে মানুষ মনে করছে”। ইতোমধ্যেই আমাজন এর কিন্ডেলে এই স্মৃতিকথাটি বেস্ট সেলার লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে।
বিচারপতি সিনহা আমাকে তাঁর টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি তাঁর এই মতামত ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছিলেন, যখন তিনি ২০১৫ সালের অক্টোবরে ভারত সফরের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে স্বাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন,
“বস্তুত আমি তাঁকে (মোদি) প্রশ্ন করি, আপনারা কীভাবে এই ফ্যানাটিক, স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন করছেন? আমি তাঁকে এও বলি যে, আইনের শাসন আর বিচার বা প্রশাসনিক বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে আপনাদের এই সরকারকে সমর্থন করা উচিত নয়”।
মোদী তখন কী বললেন?
“তিনি (মোদি) যা হচ্ছে সে ব্যপারে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি এই বিষয়ে কিছু করতে অপারগ, কারণ তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে”।
বিচারপতি সিনহা আমার কাছে আরও বাখ্যা করেন, “ভারত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছে, তাদের নিজস্ব ২৫ হাজার সেনা প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য। আমরা শত্রুভাবাপন্ন নই, বরং ঘনিষ্ঠ দুই দেশ”। একটি আঞ্চলিক মহাশক্তিধর দেশ হিসেবে ভারতেরও দায়-দায়িত্ব আছে। যদি প্রতিবেশী দেশে আইনের শাসন না থাকে, যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে তা নিশ্চিতভাবে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য”।
বিচারপতি সিনহার আশংকা, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের মতোই একটি দেশে পরিণত হয়ে যায় কীনা! যেখানে একটি সাংবিধানিক সরকারের বদলে দুর্বৃত্ত সামরিক সংস্থা আর জিহাদি গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা চলে যায়।
“কেন আমি পাকিস্তানের কথা তুললাম?” তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বাখ্যা দেন, “এটা সবাই জানে যে পাকিস্তানি আইএসআই এতোটাই ক্ষমতাশালী যে ওরা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে— তারা যা বলে তাই মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। আর এইজন্য কী দশা তাও সকলের জানা। আমরা জানতে পারি আমাদের সমপেশার (পাকিস্তানি) বিচারক আর অন্য পাকিস্তানি, যাদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় তাদের থেকে— আজ ৪০ শতাংশ পাক ভুখণ্ড সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের দখলে। আমরা কী এই পরিস্থিতিকে ডেকে আনবো বাংলাদেশে? আমরা কিন্তু ওইদিকেই এগিয়ে চলেছি। এ থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ একমাত্র গণতন্ত্র বা আরো পরিস্কার করে বললে আইনের শাসন”।
এই পর্যায়ে আমাদের আলোচনা চলে আসে বাংলাদেশের প্রধান ইসলামিক গোষ্ঠীগুলো আর তাদের সাথে শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে।
“তারা (আওয়ামী লীগ) বলে জামাত-এ-ইসলামিকে নিয়ে। হ্যাঁ, জামাত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম সমন্ধে কী অবস্থান? এরা তো জামাতের তুলনায় আরো ধর্মান্ধ”। বিচারপতি সিনহা আরো বলেন, “এই সরকার হেফাজতে ইসলামকে মদদ দিচ্ছে— এরা ধর্মকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার হাতিয়ার করছে, এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, মানুষের জাতীয় স্বার্থে বিশ্বাস করে না। তারা চায় কেবলমাত্র ক্ষমতা”।
এই কথার প্রেক্ষিতে তাঁর কাছে সরাসরি জানতে চাই, তিনি ওই “তারা” বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন? “শেখ হাসিনা এবংআওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ”, তিনি আরও বলেন “কীভাবে তিনি (হাসিনা) তাদের শাস্তি দেবেন? তিনি তো নিজেই একবার আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি হেফাজতকে অর্থ সাহায্য করছেন এদের বশে রাখতে। মাওলানা শফি (হেফাজতের আমির) একবার তাঁর (হাসিনা) বিরুদ্ধে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছিল, সেই সময়েও তিনি মাথানত করেছেন আর তাঁকে ভারতে বিশেষ চিকিৎসাসেবা দিতে পাঠিয়েছিলেন।”
https://www.youtube.com/watch?v=ucrUE6L321I
বিচারপতি সিনহা আমাকে অবগত করতে চান এই উগ্র ইসলামি দল হেফাজতের ভীতির বিষয়ে আর আমি আগ্রহ সহকারে শুনি। কারণ তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি সবার আগে আইসিস এর বাংলাদেশে উত্থান নিয়ে সতর্ক করেছিলেন, যখন আমাদের অধিকাংশ মানুষই তা জানতাম না। অক্টোবর, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আইসিস এর ঘাটি নিয়ে খবর পাওয়ার দুই মাসের মধ্যেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অক্টোবরের ৬ তারিখে খবর দেয় “বিচারপতি সিনহা বলেছেন, জিহাদি গোষ্ঠী আইসিস বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি তৈরি করছে”।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার আজও আইসিস বা তার সহযোগি ইসলামি জঙ্গীদের বাংলাদেশে থাকার কথা অস্বীকার করে যাচ্ছে।
“যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকে না, এভাবেই যদি চলতে থাকে তা হলে একদিন এই মৌলবাদীরাই রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নিবে”। বিচারক সিনহা আইনের শাসন এবং জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের এক বিপরীত সম্পর্ককে বাখ্যা করেন এভাবে, “সন্ত্রাসবাদ আর উগ্রতা দেশজুড়ে ছড়াচ্ছে মসজিদ, আর মাদ্রাসাগুলো দিয়ে যার নিয়ন্ত্রণ করছে হেফাজত”।
শেখ হাসিনা কি এই কাজে মদত দিচ্ছেন? আমি জিজ্ঞাসা করি।
“হ্যাঁ, অবশ্যই, এটা সবাই জানে!”
এটা অবশ্য কোনো গোপন বিষয় নয় যে শেখ হাসিনা এই কাজ একাই করছে না। এই মোল্লাদের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক তৈরিতে সহযোগিতা করছে তাঁর সামরিক উপদেষ্টারা: নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী,সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিঞা জয়নুল আবেদিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেলরা যারা বিভিন্ন বিভাগে ডিজিএফআই (Directorate General of Forces Intelligence) এর শীর্ষস্থানে বসে আছেন।
এই পর্যায়ে আমরা এই ডিজিএফআই নিয়ে কথা বলা শুরু করি,এই ডিজিএফআই‘কে গঠন করা হয়েছিল পাকিস্তানের আইএএসআই এর ধাঁচে।
এই ডিজিএফআই বিচারক সিনহার বই-এর একটি বড় আলোচ্য বিষয়। বইটিতে এর ওপরে ৬৩বার উল্লেখ রয়েছে।
বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে কীভাবে প্রধান বিচারপতিকে হুমকি দিয়ে, ভীতি প্রদর্শন করে, প্রধান বিচারপতিকে তাঁর বাড়িতে অন্তরীণ করে এবং এক পর্যায়ে তাঁকে জোর করে নির্বাসনে পাঠায় এই সামরিক বিভাগ; তার বিস্তারিত বলা হয়েছে। এর পুরো কাজটিই করা হয় ডিজিএফআই এর প্রধান মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদিনের নেতৃত্বে।
বইটির অন্য জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে ডিজিএফআইএর অফিসাররা ভীতি প্রদর্শন করে বা ব্ল্যাকমেল করে বিচারকদের বাধ্য করে আদালতের রায় সরকার বা শাসকদলের অনুকূলে দেওয়ার জন্য।
একজন প্রধান বিচারপতিকে নিজ গৃহে অন্তরীণ করে রাখা জেনারেলদের হাতে বা বিচারকদের দমননীতি চালিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার সর্বময় ক্ষমতার উৎস হওয়া একটি সামরিক বিভাগ, এ যেন পুরোপুরি পাকিস্তানের প্রতিচ্ছবি!
আমার এই কথার প্রেক্ষিতে, তিনি কার্যত কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমার সরকারি আবাসে… আমি পুরো অন্তরীণ হয়ে থাকি … ভাবুন কী অসহায় অবস্থা একজন প্রধান বিচারপতির হতে পারে! যদি দেশের প্রধান বিচারপতির এই অবস্থা হয়, একজন কর্মরত প্রধানবিচারপতির, তাহলে বাঁকি বিচারকদের কী অবস্থা ওটা একবার ভাবুন! কী অপমানের বিষয়!”
এই পর্যায়ে টেলিফোনের অপর প্রান্তে তাঁর নিশ্বাসের আওয়াজ আমাকে বিচলিত করে তোলে। আমার পরের প্রশ্ন, যাতে এক ডিজিএফআই কর্নেল যে সামরিক সূত্র অনুযায়ী, এই প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের মধ্যেই শারীরিক আক্রমণ করেছিল বলে জানতাম, তার বিষয়ে আমার এই প্রশ্ন অনুচ্চারিত থেকে যায়। তার বদলে তাঁকে তাঁর গুম বা গোপন আটক নিয়ে প্রশ্ন করি।
তাঁর বই-এ তিনি স্বীকার করেছেন যে একটি নির্দিষ্ট ডিজিএফআই কার্যক্রম আছে যাতে মানুষদের অপহরণ করে তাদের গোপনে বেআইনিভাবে আটকে রাখার ব্যবস্থা আছে। যেমন তিনি বলেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়, “অনিরুদ্ধ রায় বেলারুশের কনসাল জেনারেল এবং একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তাঁকে ঢাকার গুলশান থেকে অপহরণ করা হয় বিকেল ৪:৩০-এ। আমি ডিজিএফআই-এর লেফটেনান্ট কর্নেল নাজিমুদ্দৌলার কাছে জানতে পারি, অনিরুদ্ধ তাদের হেফাজতে রয়েছে। পুলিশ তাঁর স্ত্রীকেও তাঁর মুঠোফোনের ট্র্যাক করে জানায় যে তাকে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কচুক্ষেতে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে”।
কচুক্ষেতে ডিজিএফআই-এর আটক রাখার কর্মকাণ্ড (কুখ্যাত নাম ‘ব্ল্যাক হোল ২‘) ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের আবাসিক অঞ্চলে যে হয় তার ওপর প্রথম জানা যায় মানবাধিকার-এর নজরদারি সংস্থা ‘হিউমান রাইটস ওয়াচ‘-এর ২০০৮ এর প্রতিবেদনে। দ্য ওয়্যার (The Wire) এর ওপর প্রতিবেদন পেশ করেছিল এবং বাংলাদেশের এক বিদ্দজনের এই ধরনের গোপন আটক নিয়ে খবরও করেছিল।
“ওরাই (ডিজিএফআই) এই ধরনের প্রত্যেকটি গুম হয়ে যাওয়ার কাজে যুক্ত,” বিচারপতি সিনহা আমাকে এই কথা বলেন যখন আমি অনিরুদ্ধ রায় এবং বাঁকি এইসব ঘটনার শিকার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জোরপূর্বক নিখোজ হওয়ার ঘটনা সমন্ধে জিজ্ঞাসা করি।
এই ডিজিএফআই তাহলে প্রায় সব ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী? আমি জিজ্ঞাসা করি।
“তা-ই আমার বিশ্বাস, কারণ এটাই সত্য যে তাদের কাজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী”।
আচ্ছা, ডিজিএফআই এর জিম্মা থেকে ছাড়া পেয়ে এই হতভাগ্য লোকগুলি যখন আটকাবস্থা থেকে ফিরে আসেন তখন তারা আর কিছু বলেন না কেন? আমি প্রশ্ন করি।
“কারণ, তাদের ভয় দেখানো হয়, তারা বাধ্য হয় মিথ্যা বিবৃতি দিতে। যদি সত্য কথা বলে তাহলে তাদের আবারও মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গুম, খুন করে ফেলে রেখে দেবে”।
আমরা ডিজিএফআই-এর বাংলাদেশের সমাজের সর্বক্ষেত্রে সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ড, বিশেষত নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষ বা তাদের পরিবার এই সার্বিক মানুষজনের ওপরে কথা বলি। তিনি তাঁর ওই বইয়ে বলেছিলেন,
”তাঁর আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুদের সাহায্য, পরামর্শ সহায়তার কথা; যাতে তিনি ওই বিপদের দিনে তাদের বন্ধুদের পরিচয় দিতে না করেছিলেন কারণ, তাঁরা ভীত ছিলেন। বিচারপতি সিনহা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ”আপনাদের কীসের ভয়?” তাতে তাঁরা বলেছিলেন, যদিও প্রবাসী, তবুও তারা তাদের দেশের আত্মীয়-স্বজনদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। নিরাপত্তা রক্ষীরা এদের অপহরণ করতেই পারে“।
এরপর তিনি নির্বাসিত বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সমন্ধে বলেন যাদের তিনি আমেরিকাতে পেয়েছেন। তারা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার, দুইক্ষেত্রেই ছিলেন। তারা তাঁকে জানিয়েছেন যে তারা প্রতিবেদন করতেন একরকম, আর প্রচার হতো আরেক রকম; এরপরেই তারা শিকার হতেন অত্যাচারের। এক পর্যায়ে তারা দেশ ছেড়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
একপর্যায়ে ফোনের যোগাযোগের সমস্যা থাকায় আবার তাঁকে কল করি। এসময় বিচারপতি সিনহা আরো একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তাঁর মতে এখানেও তাঁর ওপর ডিজিএফআই-এর নজরদারি জারি আছে। তিনি আমেরিকার নিউজার্সিতে আছেন, তাঁর মতে; “আমার কাছে খবর আছে, যে দু‘জন ডিজিএফআই-এর অফিসারকে রাখা হয়েছে এই বাড়ির ওপর নজর রাখতে। তারা নজর রাখছে এই বাড়িতে কে আসছে আর বেরোচ্ছে। পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ির একদম ওপরের তলা থেকে তারা এই কাজ করছে“।
তিনি আরো মনে করেন, ডিজিএফআই বিশেষ কিছু যন্ত্র বসিয়েছে তাঁর ফোনে কথা বলার ওপর খোঁজ নিতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে। তাই এভাবে ঘনঘন সংযোগে বিঘ্ন হচ্ছে। যখন তাঁকে বললাম, নিউজার্সির পুলিশে খবর দিতে; যাতে তারা এই চরবৃত্তির ওপর আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ এই কাজ আমেরিকার ক্ষেত্রে আইনবিরুদ্ধ। তাঁর উত্তর দেওয়ার আগে আবারও ফোন কেটে গেল।
আবার যখন তাঁকে কল করি তখন বিচারপতি সিনহা বলেন, একটা বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে আমেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
”তারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছে, একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক-এ আমার এই বইটি ছাপা হওয়ার পরে। তারা আগ্রহ দেখিয়েছে এবং আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। আমি তাদের সব জানিয়েছি“।
এরপর আমরা আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করি, সাধারণ মানুষের অধিকার বা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কীভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, মানবাধিকার রক্ষা করতে মানুষের অত্যাচার রোধ করার বিষয়ে।
”আমি হতাশ হই, যখন দেখি মানুষের অধিকার সুরক্ষিত নয়”। বিচারপতি সিনহা বলে চলেন, “কারণ সর্বদা কোনো না কোনো হস্তক্ষেপ। এই ধরনের বিচারব্যবস্থা একটি প্রহসন, এক ধরনের প্রহসন যা হয়েই চলেছে“।
এরপর আমরা আটককৃত অবস্থায় খুন বা অত্যাচার নিয়েও কথা বলি। তিনি বলেন, এই কাজগুলো অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটে চলেছে; যদিও সর্বোচ্চ আদালত অতীতে এর ওপর হস্তক্ষেপ করেছে তবুও তা ঘটেই চলেছে। ”উচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশকে সম্মান দেওয়া বা মেনে চলার কাজ এই আইনরক্ষক দপ্তরগুলো মোটেই করছে না”।
আমি তাঁকে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ (বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্যে ‘এনকাউন্টার‘এ মৃত) হত্যাকাণ্ড নিয়েও জিজ্ঞাসা করি।
“এগুলো সব বানোয়াট গল্প, ওরা আটক করা লোকগুলোকে স্রেফ খুন করে- এগুলো বিচার বহির্ভূত হত্যা। এই কর্মকর্তাদের অর্থাৎ পুলিশ বা এই ধরনের অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদের বিচার ও শাস্তি দরকার“।
এরপর আমি আমার বন্ধু শহিদুল আলম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী এই আলোকচিত্র সাংবাদিক আজ বাংলাদেশের জেলে আটক। আমি বিচারপতি সিনহার দীর্ঘনিশ্বাস শুনতে পেলাম, “তাঁর গ্রেফতার অতীব দুর্ভাগ্যের, আমি বাখ্যা দিতে পারছি না। এ এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-কেউ তার স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারে না“।
আমি একজন বিচারবিভাগের কর্মকর্তার কথা ধরে তাকে বলি, ব্যক্তিগত আলাপে তিনি বলেন যে, ডিজিএফআই এক বিচারপতির ওপরে চাপ দিচ্ছে যাতে শহিদুল আলমকে জামিন না দেয়া হয়। এই কথা প্রাক্তন এই বিচারপতিকে মোটেই অবাক করলো না। বরং তিনি বললেন, “এই জন্যই আমি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি বিচারবিভাগের স্বাধীনতার জন্য। এখন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এই লোকগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এ কারণেই”।
অবশেষে তাঁকে করা আমার শেষ প্রশ্ন: প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শেখ হাসিনা সমন্ধে আসলে কী ভাবেন?
“এই অবস্থার অবনতির কারণে আমি কেবলমাত্র শেখ হাসিনাকেই দোষ দিচ্ছি না, তিনি ক্রমান্বয়ে ১০ বছর ক্ষমতায় আছেন- তাঁকে ঘিরে আছে একদল চাটুকার; এই কথা তাঁকে বলাতে তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যান। সঠিক মানুষ সঠিক জায়গায় নেই। ওটাই সরকারের মূল সমস্যা, স্রেফ চাটুকারে ভরে আছে সবখানে”।
অন্যান্য খবর:
Ex-Bangladeshi Chief Justice Cautions India Against His Government
নোট:
ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে দিয়েছেন: পরীক্ষিত চক্রবর্তী