০
১৫২৩ বার পঠিত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত বুধবার দাবি করে বলেছেন, “ভারতে এখন আর কেউ প্রকাশ্যে মলত্যাগ করেন না”।
নরেন্দ্র মোদির এই দাবি যে কতোটা হাস্যকর এটা হয়তো তিনি নিজেও জানেন। তারপরও তিনি হাস্যকর দাবি থেকে সরে আসেন নি।
প্রায় ২ যুগ আমি ভারতে যাতায়াত করেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি সমগ্র ভারতবর্ষ, দিনেরপরদিন। শহর থেকে গ্রাম, কিংবা গ্রাম থেকে শহর; ঘুরে বেড়ানো প্রিয় শখের বিষয় ছিল বলে মনপ্রাণভরে ভারত ভ্রমণ করা সম্ভব হয়েছে।
ভারতে ঘন ঘন যাতায়াত, বেড়ানো এবং অবস্থানের কারণে সঙ্গতকারণেই প্রচুর বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীও রয়েছে সেখানে। বন্ধুতার মাঝে যাতে কোনোরূপ নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিক বিবেচনায় ভারতের সামাজিক অসঙ্গতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান ত্রুটির বিষয় মনখুলে বলতে পারি না। পাছে কেউ মনে করে যে আমি বোধ হয় ভারতের দূর্নাম করছি।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কেউ কেউ প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন- বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমি নাক গলাই কেন? কেন নাক গলাই এটা ইতোপূর্বে বহুবার ব্যাখ্যা করেছি। তাই আর নতুন করে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজনবোধ করিনা।
আজ যে কারণে এই স্ট্যাটাস লিখতে বসেছি সেটা আর কিছুই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর মিথ্যাচার ও চাপাবাজির প্রেক্ষিতে দু’লাইন কথা লেখা।
কয়েকমাস আগে সাঁইথিয়া (সম্ভবত) এলাকার এক ফেসবুক বন্ধু (আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি বিধায় বর্তমানে অবন্ধু) নাম আনওয়ারুল ইসলাম। মুসলিম নামধারী আইডিতে সারাক্ষণ ইসলাম বিদ্বেষী ও যৌন সুড়সুড়িমূলক পোস্ট দেয়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ চোখে পড়েনি। নামটি মুসলিম হলেও এটি তার ফেইক আইডি, প্রকৃতপক্ষে তিনি হিন্দু পরিবারের এবং তার নামের শেষাংশ ‘গোস্বামী’ (সঙ্গত কারণেই তার আসল নাম প্রকাশ করলাম না)। জনাব ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ তার ফেসবুক টাইমলাইনে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন অনেকটা এরকম-
“বাংলাদেশের কোন এলাকার লোকজন সবচেয়ে বেশী খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে?”
উক্ত পোস্টে বিশ্রীভাবে অনেকেই মন্তব্য করে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিলেন যে, বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে। আমি ওই পোস্টে ছোট একটি কমেন্ট করেছিলাম এরকম-
“আপনি বাংলাদেশের কোন কোন এলাকা চেনেন?”
এর জবাবে তিনি মন্তব্য করেছিলেন তিনি কিছুই চেনেন না বলেই জানতে চাইছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জনাবের জানতে চাওয়ার আগ্রহ দেখে আনন্দিতই হয়েছিলাম বৈকি! কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের স্যানিটেশন ব্যবস্থা সম্পর্কে মিনিমাম জ্ঞান রাখেন না, তারা যখন বিশ্রীভাবে মিথ্যাচার করে কমেন্ট করছিলেন সেখানে জনাব লাভ রিএক্ট দিয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে আমি পূনরায় কমেন্টে লিখলাম-
“আমি ভারতবর্ষের অলমোস্ট সব রাজ্য ভ্রমণ করেছি। অনেক অনেক শহর ঘুরেছি। সেখানে শহরের খোলা সড়ক, রেললাইন কিংবা ফুটপাথের ওপরেও লোকজনকে ধূতি-প্যান্ট উঁচিয়ে মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখেছি। আমার মতে ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খোলা জায়গায় অনিরাপদ মলমূত্র ত্যাগ করা, অর্থাৎ স্যানিটেশন সমস্যা ভারতের অন্যতম সমস্যা। অপরদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে এই সমস্যা নাই। বহুবছর আগেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বাংলাদেশে।”
এই মন্তব্যের পরপরই আক্রমণ শাণিত হতে শুরু করেছিল তাঁর ও স্ট্যাটাসের কমেন্টবক্সে। আক্রমণ বলতে গালিগালাজ আর খিস্তিখেউর আর কী! খিস্তিখেউর চর্চায় আমি বরাবরই পিছিয়ে বলে ক্ষান্ত দিয়ে রণক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। ওই ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ আইডিটাকেও আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি কিছুদিন পরেই।
এর কিছুদিন পরে ভারতের দিল্লির সড়ক ও ফুটপাথে হেলমেটবিহীন মোটরবাইক চালানোর একটি ছবি পোস্ট করেছিলাম। ওই পোস্টে একজন তো দাবি করে বসলেন যে তিনি দিল্লিতেই থাকেন, অথচ এরকম কোনো দৃশ্য নাকি তিনি কোনোদিন চোখে দেখা তো দূরের কথা, কারুর কাছে শোনেনও নি! হাস্যকর দেশপ্রেম! দেশপ্রেম ভালো, কিন্তু নিজের দেশের লজ্জাকর বিষয়গুলো অস্বীকারের মাঝে আমি কোনো দেশপ্রেম খুঁজে পাই না।
আমি নিজের চোখে কয়েকডজনবার দিল্লির রাজপথে প্রসাব করতে দেখেছি। সে প্রসাব গড়িয়ে পুরো সড়ক মাখামাখি এবং সেখানে লোকজন চলাচল করছিল নাক চেপে ধরে। এসব তো নিজের চোখে দেখা। সবশেষ দেখেছি (দিল্লিতে) ২০১৫ সালের নভেম্বরে। ভারতের যেসব শহরে এই কর্ম চোখে পড়েনি তার মধ্যে বাঙালুরু এবং বিশাখাপত্তনম অন্যতম। এছাড়া প্রতিটি শহরেই মানুষজন কমবেশী প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারে। এসব বিষয় হয়তো অতি উৎসাহী কোন কোন ‘দেশপ্রেমিক’ আপত্তি জানাতে হামলে পড়তে পারেন জানি, কিন্তু নিজের বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না; এটাও জানি।
এবার ফিরে আসি মোদীর মিথ্যাচার প্রতারণামূলক দাবি প্রসঙ্গে।
বিশ্বের অন্যতম সংবাদ সংস্থা ডয়েচেভেলে একটি ছোট্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনের মাঝে ছোট একটি ভিডিও ক্লিপস-ও রয়েছে। সেখানে ভারতে যে এখনো প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করার অভ্যাস রয়ে গেছে তা তুলে ধরা হয়েছে।
https://www.facebook.com/dw.bengali/videos/522501311934820/
ভিডিওটি দেখে আমি মোটেই অবাক হইনি। কারণ এরচেয়ে বহু বহু নোংরা দৃশ্য আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি যা ভিডিওতে দেখানো রুচিকর হবে না। মোদী মিথ্যাচার করার পরেও স্যানিটেশনে ‘উন্নতি’র জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কার পেয়ে যান! এরচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কীইবা হতে পারে! ভারতের যেসব বন্ধুরা প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছেন, তাঁরা বরং স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নতির জন্য আন্দোলন করতে পারেন। কারণ আমার মতে ভারতের জনগণের সুস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম বিষয় হলো নিরাপদ টয়লেট ব্যবস্থা।
প্রসঙ্গক্রমে ছোটবেলায় শোনা একটি কৌতুক মনে পড়ল-
“গান্ধীজী তখন ব্রিটিশদের হটানোর জন্য আন্দোলন করছেন। তিনি চিন্তা করলেন কী উপায়ে ব্রিটিশদের তাড়ানো যায়। তিনি জানতেন, ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাবে না। তাই তিনি অনেক ভেবেচিন্তে মোক্ষম এক উপায় বের করলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন, ব্রিটিশদের কেউ কিছু করবে না শুধু তারা যে রাস্তা দিয়ে চলাচল করে, সেই স্থানে সবাই মলমূত্র ত্যাগ করবে। ব্রিটিশরা পড়লো মহাবিপদে, চারদিকে মানুষের বিষ্ঠা, দুর্গদন্ধ। তারা ইংল্যান্ডে চিঠি পাঠালো ভারতীয়দের স্বাধীনতা দিতে হবে। আর এটাই ছিল গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলন। তাই আজও ভারতীয়রা তাদের পূর্বপুরুষদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভুলে যেতে চান না বলে এখনো কিছু দেশপ্রেমিক প্রকাশ্যে মলত্যাগ করে।”
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন