১৭৮৪ বার পঠিত
প্রথম আলো’তে মাটির ময়না’র আনু কাহিনি পড়লাম। চমকে উঠিনি। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিশু শিল্পি চা-পান বিক্রি করে এটাও নতুন কিছু নয়, অন্তত আমাদের দেশে। আনু অর্থাৎ নুরুল ইসলামের কাহিনি সেই গতানুগতিক। প্রতিভা আর মেধার বিপর্যয়, আত্মসমর্পন আর অবদমন অনেক দেখা হয়েছে। নিজেও ভুক্তভোগী। কিন্তু নুরুল ইসলামকে নিয়ে প্রথম আলো’র যে রিপোর্টিং তাতে যে জিনিস নতুন দৃশ্যমান হয়েছে তা হলো, কিছু প্রগতিশীলের চরিত্র। যাদের আমরা নমস্য ভাবি।
প্রয়াত তারেক মাসুদ নুরুল ইসলামের মতন গুণী অভিনেতার শ্রমের মূল্য পরিশোধ করেননি। একজন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিশু শিল্পিকে যেভাবে সুযোগ করে দেয়া তার কর্তব্য ছিলো, তা না করে তিনি নিজ বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেব কাজ করিয়েছেন। এমন কী সে কাজ করতে গিয়ে নুরুল ইসলামের এক সময়ের সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য স্কুলের পড়াশোনাও ছাড়তে হয়েছে। অর্থাৎ আগে তো সুবিধা বঞ্চিত ছিলেনই, তারেক মাসুদ তাকে আরো বঞ্চিত করেছে।
তাকে বাড়ির কাজে লাগিয়ে সেই কাজেরও মজুরি শোধ করেননি তারেক মাসুদ। একেবারে প্রথম আলো’র ভাষাতেই বলি, ‘সিনেমার শুটিং শেষে তারেক মাসুদের বাসাতেই কাজে লেগে গিয়েছিলেন নুরুল। কিন্তু অভিনয়টা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। বাসার কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনাও হয়নি।’ বুঝলেন ও শুনলেন তো সো-কল্ড গুণীদের গুণের কাহিনি। অথচ এদেরকেই আমরা ফি বছর স্মরণ করি। আমাদের সো-কল্ড জীবিত নমস্যরা প্রতিবছরই তাদের স্মরণে গুণগান করেন। আমরা বুঝি আর না বুঝি তাদের সিনেমা বা অন্য কাজের প্রশংসায় অনর্থক বিগলিত হই। না হলেও তো লাইনে টিকে থাকা যাবে না। তাদের ভক্ত, অনুরাগীরা হামলে পড়বেন। আর সমালোচনা করলে তো একেবারে ফান্ডামেন্টালিস্ট বানিয়ে দেবে আপনাকে।
ছবি: প্রথম আলো থেকে নেয়া
আপনি সত্যি বলতে গেলে তাই হবে। এই নুরুলের কথা যদি প্রথম আলো না বলে আপনি বলতেন তাহলে দেখতেন অবস্থাটা। ব্যঘ্রচর্ম পরা ভেড়াগুলো ঝাপিয়ে পড়তো আপনার উপর। এখনো বলবে, নুরুল তো আর অভিনয় করেনি তাকে দিয়ে তারেক মাসুদ করিয়েছেন। ভালো পরিচালক টেবিল চেয়ারকে দিয়েও অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন। এ কথাটি যে কতটা মিথ্যা যারা সিনেমার সাথে রয়েছেন তারা জানেন। একজন বিখ্যাত পরিচালককে বলুন তো হিরো আলমের কাছ থেকে উত্তম কুমারের অভিনয় করিয়ে নিতে। দেখুন তো এমন পরিচালক খুঁজে পান কিনা।
আমাদের চরিত্রই এই, নুরুল’রা চায়ের দোকান করে, আর চায়ের দোকান যাদের করার কথা তারা ‘লম্ফঝম্ফ’ করে। আজিব ব্যাপার। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, বড়ই আচানক কারবার। হুমায়ূনের কথা যখন এসেই গেলো তখন বলি। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় কাজ করার ইচ্ছা সব অভিনেতারই ছিলো। কিন্তু যারা হুমায়ূনকে জানেন, হুমায়ূন কতটা চুজি ছিলো, কাকে দিয়ে কী করানো যাবে এ ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস ছিলো, তারা জানেন। পরিচালক যদি চেয়ার টেবিল দিয়েই অভিনয় করাতে পারতেন তবে হুমায়ূন আহমেদকে তার চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা খুঁজতে হতো না।
যাকগে, প্রথম আলো অনেক বিষয়েই সমালোচনার যোগ্য হলেও কিছু বিষয়ে আলোচনার দাবি তারা করতেই পারে। তারমধ্যে অবশ্যই রয়ে যায় নুরুল ইসলামকে তথা মাটির ময়না’র আনু’কে নিয়ে করা প্রতিবেদনটি। ধন্যবাদ প্রথম আলো।
পুনশ্চ: আমাদের ভেতর-বাহিরের অবস্থা কমবেশি একই রকম। এমন প্রতিবেদন করতে গেলে আমাদের অনেক নমস্যদেরই নমঃ নমঃ শুরু হয়ে যাবে।
*** ছবির জন্য প্রথম আলো’র প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ডিসেম্বর ১৭, ২০২০; ৫:৩১ পূর্বাহ্ন
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন না, “বড় বড় মানুষও ছোট ছোট মানুষ”। যারা তাদের কাজের মাধ্যমে নাম, সম্মান, মর্যাদা কামিয়েছেন তাদেরকেও মানুষ হিসেবে দেখলে সমস্যা হবার কথা না। আমরা সবাইকে দেবতা বানিয়ে তারপরে তাদের পূজা করি, তাতেই যত গোল বাঁধে।