মক্কার সহিংস ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটটি মুহাম্মদের ইসলাম ও সাম্যবাদের দর্শন প্রচার বন্ধে মরিয়া হয়ে ওঠে। কাবাগৃহে লাত-মানাত-উযযা নামের তিনটি মূর্তি সাজিয়ে রেখে বছরের পর বছর তীর্থব্যবসা চালিয়ে আসছিলো তারা। এই মূর্তি তিনটিকে তারা ব্যবহার করেছে ব্যবসার বিনিয়োগ হিসেবে। ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদ অর্জনের জন্য এই দুষ্টচক্রটি তীর্থ যাত্রীদের একরকম লুন্ঠন করতো প্রতিবছর। আর তারা চেয়েছিলো নিজেরাই সম্পদের পাহাড় গড়বে; সাধারণ মক্কাবাসীকে তারা দারিদ্র্যে ম্লান দাস জীবন মেনে নিতে বাধ্য করবে।
কিন্তু মুহাম্মদ যখন ইসলামের সাম্যবাদের বার্তা নিয়ে আসেন এবং পার্থিব মূর্তিব্যবসার অশুভ চক্রটিকে রুখে দিয়ে একক সৃষ্টিকর্তার কথা সাধারণ মানুষকে জানান; স্বাভাবিকভাবেই তা সাধারণ মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। এ এমন এক ঈশ্বর যাকে খুশী করতে কোন টাকাপয়সা খরচ করতে হয়না; তার একমাত্র চাওয়া মানুষ মানুষের কল্যাণে ব্রতী হবে।
ক্ষিপ্ত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পক্ষে আবু জাহেল এবং আবু সুফিয়ান মুহাম্মদকে ইসলামের দর্শন প্রচারে বাধা দিতে একটি জোট তৈরী করে। মুহাম্মদের চাচা আবু তালেবকে তারা বারবার চাপ দেবার পরেও মুহাম্মদকে তিনি তাদের কাছে হস্তান্তরে রাজী হননি। তাই আবু তালেবের হাশিম গোত্রকে মক্কায় অবাঞ্চিত ও একঘরে ঘোষণা করে আবু জাহেল গ্যাং। আবু জাহেল কথা বার্তায় অত্যন্ত অশালীন ছিলো। তার বক্তৃতাগুলো ছিলো খিস্তির আর অযৌক্তিক আক্রমণের অপরিশীলিত শব্দে ভরা। আবু সুফিয়ান কিছুটা যৌক্তিক ছিলেন; এবং আইন-কানুনের তোয়াক্কা করতেন। আবু জাহেলের চাপাচাপিতে সিদ্ধান্ত হয় মক্কা নগরীতে কেউ হাশিম গোত্রের সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য বা খাদ্য বিনিময় করবে না। দূরান্তে মালামাল বহনকারী ক্যারাভানগুলোতে হাশিম গোত্রের কোন পণ্য পরিবহন করা নিষিদ্ধ হলো।
মুহাম্মদের নিজের পরিবারের ঘরের শত্রু বিভীষণ আবু লাহাবকে আবু জাহেল ব্যবহার করতে চেষ্টা করে আবু তালেবকে সরিয়ে হাশিম গোত্র প্রধান হতে। যাতে মুহাম্মদকে শায়েস্তা করা সহজ হয়ে যায়।আবু তালেবের বয়স ঐ সময় ষাটের ওপরে, চারপাশের চাপে শরীরটাও ভালো যাচ্ছিলো না। কিন্তু তিনি নিরাপোষ থাকেন। আবু লাহাবের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ হাশিম গোত্রের বিরুদ্ধে খিস্তিযুক্ত শব্দে আবু জাহেল কাবাগৃহের প্রবেশ পথে একটি নোটিশ টাঙ্গিয়ে দিলে; তার বিপরীতে আবু তালেব সুন্দর শব্দ ব্যবহার করে তির্যক সব ছড়া লিখতে শুরু করেন। আবু জাহেলের খিস্তির বিপরীতে আবু তালেবের এই স্যাটায়ারের ব্যবহার উনার সাংস্কৃতিক মননটি সুচিহ্নিত করে। মানুষ মন দিয়ে তার ছড়া শুনতে থাকে। বিতরণ হয় এর কাছ থেকে ওর কাছে। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে পেরে ওঠে না আবু জাহেল। মক্কার লোকও হাশিম গোত্রকে সেইভাবে বর্জন করেনা।আর সেসময় বিভিন্ন গোত্রের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে শুধু মুখের কথায় হাশিম গোত্রকে একঘরে করা সম্ভব ছিলোনা। এর বিপরীতে অন্য গোত্রের মানুষের মধ্যে ইসলামের দর্শনের অনেক অনুসারী তৈরী হয়। আর মুহাম্মদের সততার উপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠা যে আত্মপরিচয়; সেইসঙ্গে তার যে প্রজ্ঞার উদ্ভাস তা আকৃষ্ট করে অনেককেই। আবু জাহেলের নিজের ছোট ছেলেটিই মুহাম্মদের অনুসারী হয়ে উঠেছিলো।
আবু জাহেলের গ্যাং-টি দিন দিন হিংস্রতর হতে থাকে। যেসব দরিদ্র মানুষ ইসলামের সাম্যভাবনায় আকৃষ্ট ছিলো তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। বিলাল নামে একজন ক্রীতদাসের বুকের ওপর ভারী পাথর তুলে দিয়ে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। আবুবকর এসে বিলালকে প্রাণে বাঁচান। এসময় মুহাম্মদ পথে বেরুলেই অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকে আবু জাহেল গ্যাং-এর লোকেরা। দিনের পর দিন উপমানবদের এই অশ্রাব্য গালাগাল সহ্য করেন মুহাম্মদ ও তার অনুসারীরা। মুহাম্মদ তাঁর অহিংস নীতিতে অটল থাকেন। অনুসারীদের তিনি একই মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। মুহাম্মদের এই অহিংস আন্দোলন পরিচালনার মানবিক কৌশলটির সঙ্গে পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশে গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের মনোভঙ্গীর অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এসময় মক্কার পরিবেশ খুবই অশান্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পরিবারে আবু জাহেলদের ভোগবাদ বনাম মুহাম্মদের সাম্যবাদের ভাবনার সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আদর্শিক অনৈক্যের কারণে অনেক পরিবারে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। মুহাম্মদের বড় মেয়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এই আদর্শিক টানাপোড়েনে। মুহাম্মদের অনুসারী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ওসমান উনার বড় মেয়েকে বিয়ে করেন এবং ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান রাজার আমন্ত্রণে একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে সেখানে চলে যান। ইথিওপিয়ার রাজার মনে হয়েছিলো, মুসা যা বলেছেন, যীশু যা বলেছেন, মুহাম্মদ তো সেই একই এক ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত সাম্যবাদের কথা বলছেন। মক্কার বেশ কিছু ইসলামের আদর্শের অনুসারী ইথিওপিয়ায় চলে যান মক্কার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি কাটলে ফিরে আসার প্রত্যয়ে। এটা আজকের যুগের রাজনৈতিক আশ্রয়ের মতো ছিলো না; মক্কা থেকে যারা ইথিওপিয়ায় যান তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বিনিয়োগবান্ধব ছিলেন। ফলে ইথিওপিয়ার রাজার জন্যও তাদেরকে বোঝা মনে হয়নি; বরং উন্নয়ন সহায়ক মনে হয়।
এদিকে মক্কায় দিনকে দিন পরিস্থিতি তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে। আবু জাহেল গ্যাং-এর অবিরাম খিস্তি-রগড়, নোংরা কথায় ইসলামী দর্শনের অনুসারীদের মন বিষিয়ে ওঠে। মুহাম্মদ তাদের বারবার অহিংস থাকতে বলায় তারা তা মেনে নেয়। কিন্তু সেই আবু জাহেলদের খিস্তিবাজি মুসলমানদের মনে এক গভীর ক্ষত তৈরী করে। সে কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ স্যাটায়ারকে বিনোদনের অংশ হিসেবে নিতে পারলেও; মুসলমানদের মাঝে সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস পড়ে বা ডেনমার্কের পত্রিকার কার্টুন দেখে অথবা যে কারো সামান্য প্ররোচনায় অতিপ্রতিক্রিয়া জানানোর একটি ভুল প্রবণতা তৈরী হয়েছে বলে মনে হয়। অথচ স্যাটায়ারের চর্চা করেন মুহাম্মদের চাচা আবু তালেব সেই কবে; মুহাম্মদ নিজেও আবু জাহেলদের গালাগাল সহ্য করেছেন সহজভাবে।
এইসময় একদিন মুহাম্মদকে খুবই আপত্তিজনক গালাগাল করে বসে আবু জাহেল তার ক্যাডারদের নিয়ে। মুহাম্মদের ছোট চাচা হামজা এসে তাদের বেদম পিটুনী দেন। মক্কায় দুজন সুপরিচিত ছিলো যোদ্ধা হিসেবে; একজন এই হামজা আর একজন ছিলেন উমর। উমর খেজুরের ওয়াইন পান করতেন। একটি মদ্যপ অবস্থায় তাকে আবু জাহেল মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেয়। কারণ যারা আবু জাহেলের পক্ষে সামাজিক পুলিশী ও গালাগাল করে বেড়াচ্ছিলো, তাদের নিজেদের ঘরের দিকেই নজর ছিলো না। উমরের নিজের আত্মীয় স্বজন ইসলামের অনুসারী হয়েছে শুনেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। সে সবাইকে খুন করে ফেলবে এমন ক্রোধ নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ীতে পৌঁছে দেখে তারা মুহাম্মদের উচ্চারিত কথাগুলো সুর করে সমবেতভাবে আবৃত্তি করছে কিংবা গাইছে। কারণ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক শান্তিময় সুরের মুর্ছনা।উমর আবু জাহেল গ্যাং-এর লোক বলে মদ্যপ অবস্থায় যা-তা বলতে থাকে। কিন্তু কেউ সেদিকে মনোযোগ দেয়না। একসময় উমর তাদের উচ্চারিত উন্মুখ শব্দমালার সুর মূর্ছনায় ও ক্রমশঃ অর্থের ব্যঞ্জনায় মুগ্ধ হয়ে সুবোধ বালকের মতো বসে থাকে। তার মনে হয় নেশা তো ওয়াইনে নেই; বরং মাতোয়ারা করে এই চমৎকার শব্দ আর সুরের ইন্দ্রজাল। ফলে মক্কার দুই সেরা যোদ্ধা হামজা আর উমর ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নে মুহাম্মদের সহযোদ্ধা হয়ে পড়েন।
কিন্তু মুহাম্মদ যুদ্ধের মানুষ ছিলেন না; তিনি ছিলেন শান্তির মানুষ। তিনি বলেছিলেন, যে যার বিশ্বাস নিয়ে থাকুক। আমরা তো কাউকে জোর করে কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলছিনা। মুহাম্মদ তাঁর সমন্বয়ী মনোভাবের কারণে মক্কায় বিভাজন চাননি। শুধু চেয়েছেন মক্কার ভোগবাদের বিপরীতে মানবিক সাম্যবাদ। তিনি তাই কাবা গৃহে এক সমন্বয়ী বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবু জাহেলদের মূর্তি ব্যবসার তিন নাম লাত-মান্নাত-উযযাকে ঈশ্বরের কন্যা বলে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেন। এতে সাময়িকভাবে মক্কায় ইসলামের একেশ্বর ভাবনার প্রতিপক্ষরা খুশী হয়। আপাতঃ একটি সাম্যাবস্থা ফিরে আসে মক্কায়।
কিন্তু বাড়ী ফিরে মুহাম্মদের মনে হয়, তিনি অন্তর্গত আলোকায়নের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যে ভাবনায় যুক্ত; সেখানে তো এরকম দেবীর ধারণা নেই। দ্রুত সংকট সমাধানের তাগিদে এবং মানসিক চাপে তার ভেতরের ভুল প্রবৃত্তি এই মিথ্যাটি তাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে। অধিকাংশ মানুষই নিজের ভুল লুকিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে রাখে। কিন্তু মুহাম্মদ ভুল স্বীকারে কুন্ঠিত ছিলেন না। কারণ তিনি তো মানুষ। মানুষ মাত্রেই ভুল করে; যেটা ঈশ্বর করেন না। সেখানেই তো মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের পার্থক্য। মুহাম্মদ আরো উপলব্ধি করেন সংকট সমাধানের কোন চটজলদি পথ নেই; পথটা দীর্ঘ হলেও আদর্শের প্রশ্নে নিরাপোষ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। মুহাম্মদ মক্কাবাসীর সামনে স্বীকার করেন,ঈশ্বরের তিন কন্যার বিষয়টি তার ভেতরের মুহূর্তের ভ্রান্তি বা স্যাটানিক ভার্সেস। এখন ভুল স্বীকারের সংস্কৃতিতে তো মানুষ অভ্যস্ত নয়। আবু জাহেল গ্রুপ চট করে মুহাম্মদকে মিথ্যাবাদী ট্যাগিং করে। আবু জাহেল গ্যাং-এর ট্যাগিং আর গুজব উপজীব্য করে একই ভঙ্গীতে বিংশ শতকে এসে সালমান রুশদী লিখে ফেলেন স্যাটানিক ভার্সেস নামে এক গসিপ গ্রন্থ।কারণ গসিপ বিক্রী হয় ভালো। তবে মুহাম্মদের পরিবারেই যেখানে বিনোদনমূলক সুষমার স্যাটায়ার প্রচলিত ছিলো; সেখানে তিনি রুশদীর নিম্নমানের রগড় গ্রন্থকে খুব একটা গ্রাহ্য করতেন বলে মনে হয়না। কারণ তিনি আবু জাহেলদের একই রকম কুতসিত গালাগাল শুনে নিজেকে বলেছেন, ঝিনুক নীরবে সহো। কারণ শেষ পর্যন্ত তো সৎ উদ্দেশ্যেরই বিজয় আসে।