০
৬২৮ বার পঠিত
এর আগেও লিখেছি আমাদের ভিডিওপ্রীতির কথা। রিফাত হত্যাকান্ড এতটা আলোচিত হতো না, যদি ভিডিও না থাকতো। খাজিদা এখন সুস্থ, তারপরেও তার কথাটা আমরা ভুলে যাইনি। কারণ বদরুলের কোপানোর ভিডিও ছিলো বলে। এক্ষেত্রে যাদের ভিডিও নেই তারা দুর্ভাগা।
এমনি এক দুর্ভাগা হলেন নাটোরের গুরুদাসপুরের শিক্ষিকা লতিফা হেলেন মঞ্জু। গত ২৩ জুলাই রাতে এই শিক্ষিকার বাড়িতে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকান্ডের পর তার দেহ ফেলে দেয়া হয়েছে বাড়ির পাশের পুকুরে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা মঞ্জু তার মার বাড়িতে থাকছিলেন। ঘটনার সময় তার মা ছিলেন পাশের বাড়িতে। নিজ বাড়িতে ফিরে দেখেন সারা বাড়িতে রক্তের চিহ্ন, মঞ্জু কোথাও নেই। মায়ের আর্তচিৎকারে লোকজন এসে খোঁজাখুঁজির পর মঞ্জুর লাশ পায় বাড়ির পাশের পুকুরে।
সারা বাড়িতে রক্ত, মেয়ে নেই, কোপানো লাশ উদ্ধার হয়েছে পুকুর থেকে। নৃশংস একটি খুনের ঘটনা। কিন্তু মেইনস্ট্রিমের বলে দাবীদার অনেক কাগজেই এই খবরটি নেই। একজন শিক্ষিকাকে ঘরে ঢুকে কোপানো হলে, তার মৃতদেহ পুকুরে ফেলে দেয়া হলো, এটা নিয়ে তো তোলপাড় হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি? হয়নি ঘটনাটির কোন ভিডিও নেই বলে। ভিডিও থাকলে এটা নিয়েও হয়তো তোলপাড় হতো।
‘হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করছি সংশয় থেকে। অনেক সময় অনেক বড় ঘটনার ভিডিও থাকলেও বিষয়টি উল্টো দিকে টার্ন নেয়। যেমন প্রিয়া সাহার ঘটনা। এরচেয়ে বাজে ভাবে প্রকাশ্যে কেউ আমাদের দেশকে ছোট করেছেন এমন ঘটনা নেই। হ্যাঁ অভিযোগ হয়েছে, তা রাজনৈতিক। দেশে রাজনৈতিক সমস্যা আছে এটা সারা বিশ্বই জানে। এনিয়ে কথা হবে, হচ্ছে। কিন্তু আমরা সম্প্রদায় এবং জাতি হিসাবেও এতটা সাম্প্রদায়িক, এতটা বর্বর তা এমন প্রকাশ্যে নালিশের মাধ্যমে জানান দিলেন প্রিয়া সাহা! যে নালিশের ভিডিওটাও প্রকাশ্যে, গণমাধ্যমে। তারপরেও কোথায় যেন বাধা, প্রতিবাদের ঢেউ উঠতে গিয়েও আবার শান্ত। আর এজন্যেই ‘হয়তো’ শব্দটা ব্যবহার করা।
তবে, খুন-জখম, গণপিটুনি এসবের ভিডিও থাকলে, তা স্পার্ক করবেই। রেনু’রটা যেমন স্পার্ক করেছে। কল্লা কাটা, ছেলেধরা গুজবের কারণে গণপিটুনিতে আরো নারীর মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তাদের ভিডিও নেই। তাই তাদের কয় সন্তান, সেই সব সন্তানদের কে দেখবেন এমন প্রশ্নগুলো উঠে আসেনি গণমাধ্যমে। মৃত্যুর খবর পর্যন্ত এসেই থেমে গেছে সব। ভিডিও থাকার কারণে রেনু’র বাচ্চা তুবা’র নামও জানে সবাই। কেউ কেউ তার দায়িত্বও নিতে চান। অথচ অন্য যেসব নারী মারা গেছেন, তাদের নামও হঠাৎ প্রশ্নে মনে করতে পারবেন না অনেকেই।
সিনেমার মৃত্যুদৃশ্য যেমন মানুষের চোখ অশ্রুসজল করে তোলে, তেমনি বাস্তবের মৃত্যুদৃশ্যের দৃশ্যায়ন হলে মানুষ খুব খায়। সুতরাং ভিডিও থাকাটা জরুরি। এর আগে বলেছিলাম যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন সাথে সব-সময় একজন ভিডিওগ্রাফার রাখেন। বলাতো যায় না কখন কি হয়ে যায়। হয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্যটা চিত্রায়িত থাকলে, মানুষের সহানুভূতি সাথে বড়কর্তাদের লম্ফঝম্ফ সবই দৃশ্যমান হবে।
টাকা থাকলে টাকা বৃদ্ধির মতন, দৃশ্য থাকলে অন্য দৃশ্যও মঞ্চায়ন হয়। আর দৃশ্য না থাকলে পরবর্তী দৃশ্যও দৃশ্যমান হয় না, হবে না। গুরুদাসপুরের সেই শিক্ষিকার মতই গণমাধ্যমের এক কোনার খবরে জায়গা হবে। মৃত্যুদৃশ্যের চিত্রায়ন না হওয়ায় সব জায়গা থেকে বিস্মৃত হবে সেই শিক্ষিকা মঞ্জুর নাম। অথচ সচিত্র হওয়ায় রেনু থেকে যাবেন বেশ কিছুদিন। অন্তত অন্যকোন ভিডিও তথা চিত্রায়িত দৃশ্যপট হাজির না হওয়া পর্যন্ত।
পুনশ্চ : আমার ছেলে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। সাংবাদিক ফাগুন রেজা। তাকেও হত্যা করা হয়েছে। গলা চেপে, মাথায় আঘাত করে মারা হয়েছে তাকে। কিন্তু সেই মৃত্যুর কোন চিত্রায়িত দৃশ্য ছিলো না। যার ফলেই যতটা তোলপাড় হবার কথা ছিল অতটা হয়নি। আধাআধি হয়েছে। মিডিয়ার মানুষজনের একটি অংশ এগিয়ে এসেছে। কিন্তু একটি অংশের কাছে দৃশ্যমান হয়নি ব্যাপারটি, হয়তো ভিডিও থাকলে হতো।
আমাদের অনেকেরই হয়তো ভিডিওপ্রীতি বেশি। রিফাতের ভিডিও কাউকে উত্তেজিত করেছে, তারা জেগেছেন। আবার মিন্নির কথিত ভিডিও হয়তো শিহরিত করেছে, অনেকে ঘেমেছেন। মোট কথা ভিডিও থাকাতেই তারা জেগেছেন এবং ঘেমেছেন। অর্থাৎ রিয়েক্ট করেছেন।
শেষে আবার বলি, ভিডিও থাকাটা সেজন্যেই জরুরি। সবচেয়ে জরুরি যাদের ভিডিওপ্রীতি বেশি তাদের জন্য। কারণ তাদের বেশির ভাগই হাই-প্রোফাইলড, কিছু ঘটলে এবং তার ভিডিও থাকলে প্রোফাইলটা আরো ভারী হবে। আর প্রোফাইল ভারী হওয়াটা তাদের জন্য সত্যিই বড় দরকারি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন