এমন সময় ঘুম হতে জাগার কথা ছিল না। জন রবিনের সামনের সেলুলোজ পর্দায় একটি লাল বাতি টিপ–টিপ দেখে জনের বুঝতে দেরি হলো না। হার্ট বিট বেড়ে গ্যালো জনের, যেকোনো স্পেসসীপ যাত্রীর বেলায় এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হার্ট-বিট নিয়ন্ত্রন রাখাই বীরত্বের কাজ, অন্তত মহাকাশ যাত্রীর বেলায়। এসময় কি জেসিকাকে জাগানো ঠিক হবে? পর মুহূর্তেই চুপসে গ্যালো জন। কারন সে এখন আদিম কোন পৃথিবীর মানব নয় যে ভয় পেলেই হাউ-কাউ করে লোক জড়ো করবে। অন্যের দারগ্রস্থ হবে। বরং এটাও কাপুরুষতা। তাকে তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর উন্নতির চরম পর্যায়ে সর্বাধুনিক পাতাল ল্যাব্রেটরিতে। সেই সময়ের সেরা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার মিঃ অ্যাসেঞ্জ সারা জীবনের সমস্ত মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন জন রবিন, জেসিকা, দ্যা ভিঞ্চি,লিসা, বোস-স্টাইন ও গারশিয়া সহ এক ঝাক মানব শিশু, যাদের জীনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সেরা সেরা বিজ্ঞানী,গনিতবিদ ও দারশনিকদের সর্বচ্চ গুণাবলী। ভাবতেই একা-একা লজ্জা পেলো রবিন।
ঘুমঘর হতে বেরোনোর আগে জেসিকার দিকে এক পলক দেখে নিল। আহ বেচারী…! অস্ফুটভাবে মুখ হতে বেরিয়ে আসল জন রবিনের।
চোখ-মুখ ভ্যাপারাইজড টিস্যু দিয়ে মুছে দ্রুত চলে গ্যালো স্পেস-শীপ কন্ট্রোল রুমে। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্যে থাকা রোবট এক্স-৭ মাথা নাড়িয়ে সন্মান জানলো।
স্যরি মিঃ রবিন, তোমাকে নির্ধারিত সময়ের আগেই জাগানোর জন্য। এ ছাড়া কোনো পথ দেখছিলাম না। বলেই হলোগ্রাফিক চতুর্মাত্রিক ভিউ প্যানেলের দিকে দৃষ্টি আহ্বান করলো এক্স-৭।
ভিউ প্যানেলের দিকে তাকাতেই যেন মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে গ্যালো।
যে সবুজ লাইন বরাবর স্পেস-শীপ যাওয়ার কথা তা হতে ৩.১৪১৪১ ডিগ্রীতে বেঁকে যাচ্ছে যা পাইয়ের মানের সমান। পাইয়ের মান অনুসারে স্পেস-শীপ কে ঘুরিয়ে গন্তব্য বরাবর রাখতে পারার মতো যথেষ্ট জ্ঞান রোবটের নেই। এটা ভেবে অসময়ে ঘুম জাগার ক্রোধ মিলিয়ে গ্যালো রবিনের।
স্পেস স্ক্যান করে দেখলো স্পেস-শীপ যাচ্ছে সরাসরি একটি কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে।
নিজের সহ অভিযাত্রীদের নিশ্চিত মৃত্যু সেই সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ আবিস্কার এই স্পেস-শীপের মায়ায় মনটা হুহু করে উঠলো। কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে যাওয়া মানে অভিযাত্রী সহ স্পেস-শীপ ধংস এবং এক নিরুদ্দেশ অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া অসীম শীতলতায়। পুনর্জন্মে যদি বিশ্বাস থাকতো কিংবা মৃত্যুর পর অনন্ত জীবনের, তবে এই মুহূর্তে ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে নিয়তিকে মেনে নেওয়া যেত।
ছি কি সব ভাবছি প্রাগৈতিহাসিক কালের মূর্খ মানবদের মতো।
হাত কড়মড় করে সোজা হয়ে বসলো রবিন। ইয়েস ই হ্যাভ টু সেভ, অ্যান্ড আই হ্যাভ টু সেভ অল বলে কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রাখলো। ইতিমধ্যে প্রায় আলোর গতিতে ছুটতে থাকা স্পেস-শীপ কৃষ্ণ গহ্বর বলয়ের অনেকটা কাছে চলে এসেছে। বলয়ের মধ্যে ঢুকে গেলে আর ফেরানো যাবে না।
ঘামতে লাগলো অসহায়ের মতো পৃথিবীর সেরা মানবদের সমন্বয়ে সৃষ্ট মানব জন রবিন।
রবিনের নিউরনের অস্বাভাবিক কম্পাঙ্ক ও স্পেস-শীপের গতিপথ চ্যুত হওয়ায় কন্ট্রোল রুম হতে স্বয়ংক্রিয় সাইরেন বাঁজতে লাগলো। ঘুম ঘরেও সাইরেন বাঁজতে লাগলো। জেগে উঠলো একে একে জেসিকা, দ্যা ভিঞ্চি, লিসা, বসু-স্টাইন ও গারশিয়া। সবাই চোখ-মুখ ভ্যাপারাইজড টিস্যু দিয়ে মুছে দ্রুত চলে গ্যালো স্পেস-শীপ কন্ট্রোল রুমে। সবাই হলোগ্রাফিক চতুর্মাত্রিক ভিউ প্যানেলের দিকে তাকালো। দেখলো স্পেস-শীপ কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে ছুটে চলেছে। সবার শরীর যেন স্পেস-শীপের নীথর হয়ে আটকে গ্যালো। কন্ট্রোল রুমের দিকে গ্যালো সবাই। দেখে দলপতী রবিন ঘামছে আর ঘামছে। ঘাম লোমকুপের গোরা হতে গড়িয়ে না পরতেই আদ্রতাহীন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কনো কাজে লাগতে পারি মিঃ রবিন? অফিসিয়াল ভঙ্গিতে বলল জেসিকা। আর কেউ না থাকলে শুধু রবিন বলেই সম্বোধন করে জেসিকা।
— পাইয়ের এক্সাক্ট ভেলু দরকার এই মুহূর্তে। আর কিছু নয়।
– পাইয়ের ভ্যালু একটা ইনফিনিভ বিষয়। আমাদের পূর্ব পুরুষগণও সমাধান করতে পারেন নি।
— আমরা পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেশী মেধাসম্পন্ন ভুলে গেছো মিস জেসিকা?
– ভুলিনি কিন্তু উনাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান হতে আমরা খুব একটা এগুতে পারিনি, মিঃ রবিন। আর দীর্ঘকাল ঘুমঘরে থাকতে থাকতে আর স্পেস-শীপের মেরামত নিয়ে মাথা খাটাতে খাটাতে আমাদের মেইন স্টাডিই করা হয়নি।
— তুমি কি বলতে চাও? ভুলে যেও না এটা স্পেস-শীপ, লাইব্রেরী নয়। নতুন কোন উপযোগী গ্রহ পেলে সেখানে সাধ মিটিয়ে পরাশুনা করিও। নাচ করিও, গান করিও।
– তুমি যা-তা বলছো, জন রবিন ! অথচ দলপতি হয়ে এমন কথা এই মুহূর্তে বলাটা ঠিক হলো না নিশ্চয়।
— কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয় সে শিক্ষা তোমার কাছ হতে নিতে হবে না। তুমি এখন যেতে পার।
– না। না। যেতে পারি না। নিজের সহ সতীর্থদের মৃত্যু মাথায় নিয়ে আমি চলে যেতে পারি না।
— আদেশ অমান্য করছো? জানো ? আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ব্লাস্ট করে দিতে পারি।
?
– তুমি এই মুহূর্তে আমাকে ব্লাস্ট করা, আর ব্লাক-হোলে মারা যাওয়ার মাঝে খুব একটা ব্যাবধান নেই।
তুমি রেগে গেছো। আর রেগে গেলে নেতৃত্য হতে চলে যেতে হয় নিশ্চয় জান !
অনেক সময় ব্যয় করেছো। কন্ট্রোল প্যানেল আমার হাতে ছেড়ে দিতে পার, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।
দলপতির আসন হতে গলা নেমে আসলো জন রবিনের।
I am extremely sorry for my sorry for my rudeness. Hope you can handle it. বলেই কন্ট্রল-রুম ছেড়ে দিলো রবিন।
আরও একটা লাল বাতি জ্বলে উঠলো স্পেস-শীপে।
স্পেস-শীপে যেন মৃত্যুর হীম হাওয়া বইয়ে গেলো। সবার বুকের ভিতর ধুক ধুক আরও বেড়ে গ্যালো। নিশ্চিত মৃত্যুপুরীতে যেতে আর কতো দেরী তার প্রহর গুণতে লাগলো।
পাই-ভ্যালুর হিসাব বাদ দিয়ে ১.১৪২ এর সাথে ২ গুনন দিয়ে অতিক্রান্ত দুরত্তের একটা সহজী সমীকরণ করে যে কৌণিক মান পাওয়া গেলো সেটা দিয়েই বিপরীত দিকে স্পেস-শীপ ঘুরিয়ে দিল।
সেই সাথে আরও একটা সুপার এটোমিক থ্রাস্টার চালিয়ে স্পেস-শীপ কে দ্বিতীয় মাত্রায় সুপার ডাইভ দেবার আগে সবাইকে সেফটি বেল্ট বেধে নিতে সঙ্কেত পাঠাল। তার পর দ্রুত স্পেস-শীপ কে দ্বিতীয় মাত্রায় সুপার ডাইভ দিল। সাথে সাথে লাল বাতি একটি নিভে গেলো। সবার দৃষ্টি হলোগ্রাফিক চতুর্মাত্রিক ভিউ প্যানেলের দিকে। স্পেস-শীপ ফিরে আসছে সবুজ রেখা বরাবর। স্বস্তি ফিরে এলো সবার মাঝে।
কন্ট্রোল রুম হতে বেরিয়ে আসলো জেসিকা। এতোক্ষণ রবিন যেন মৃত্যু পুরীতে ছিল। জেসিকা বেরিয়ে আসতেই জরিয়ে ধরলো। অনেক হয়েছে দলপতি রবিন। স্বপ্নিল গ্রহে যেতে পারলেই হবে আলিঙ্গন। এবার ছাড়ো। দ্যাখো সবাই তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
সবাই ওয়াইন নিয়ে বসেছে। একমাত্র রোবট এক্স-৭ আর রবিন ছাড়া। এতোবর আহম্মক নয় রবিন যে
এমন একটা ধকলের পরে ওয়াইনের পেয়ালায় ঠোঁট লাগাবে। অথচ কাউকে বাধাও দিল না। হাজার হলেও একটা মৃত্যুর মুখো-মুখি হতে ফিরে এসেছে সবাই। যাক করুক একটু আনন্দ। আর ওয়াইন খেলে সব ভুলেও যেতে পারবে। তাছাড়া আবার তো ঘুম-ঘরে যেতে হবে। না হলে অতি তারাতারি বৃদ্ধ হয়ে যাবে।
রবিন আবার চলে গ্যালো কন্ট্রোল-রুমে। ব্যাক ট্রেছ করে আগের গতিপথ দেখছে। দেখতে পেলো তারা ঘুম ঘরে দের আলোক বর্ষ দূরত্ব যাওয়ার পর পর ই হঠাৎ করে গতিপথ ওমেগা ভ্যালুর সমান বদলে গেছে। ট্রেচ করে দেখলো অন্য একটি স্পেস শীপ হতে এই রেডিও অয়েভ দিয়ে কন্ট্রোল রুমে কেউ ঢুকেছিলো। বুঝতে বাকি রইলো না কে এই কাজ করেছে। এটা হ্যামিল্টনের কাজ।
হ্যামিল্টন অন্য একটি স্পেস-শীপের দলপতি। উভয়ের স্পেস-শীপ পরস্পর হতে ৯০ ডিগ্রী কৌণিক ছুটেছিল মহাকাশে, নতুন গ্রহ নতুন আবাস্থলের সন্ধানে।
ওয়াইনের আসর ভঙ্গ। রবিনের মন বিষণ্ণ।
কি ব্যাপার জল খেলে না যে? এতোবড় একটা বিপদ হতে ফিরলাম মুখ খুলল বোস-স্টাইন।
রবিন বলল এই সম্ভাব্য দুর্ঘটনার হাত ছিল হ্যামিল্টনের।
সাথে সাথে সবাই গর্জে উঠলো। এবার একটা পাল্টা ব্যবস্থা নাও। ওদের স্পেস-শীপ ব্লাস্ট করে দাও।
মুখ তুলল এবার জন রবিন …
জান, এই লোভের জন্য ক্ষমতার জন্য মানব জাতী (আমাদের পূর্বপুরুষ) ধ্বংস হয়ে গ্যাছে।
তোমরা সবাই জান, পৃথিবী তখন জ্ঞান বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষ সাধন করলো। ধার্মিকতা, সাম্রদায়িকতা ও শোষণ ও চরম আকার ধারন করলো। সবার হাতেই মারণাস্ত্র উঠে গেলো। তার পর মেতে উঠলো একে অপরের বিরুদ্ধে। শুরু হলো যুদ্ধ। অবশ্য সেই যুদ্ধ বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় নি। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পৃথিবীর সব জীবকুল, প্রানীকুল পুড়ে ঝলসে গেলো।
আমাদের ভাগ্য ভালো আমরা ছিলাম পাতাল ল্যাব্রেটরীতে। আর আমাদের ল্যাব্রেটরীকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছেন মিঃ অ্যাসাঞ্জ। তার পরের ঘটনা তোমরা সবাই ভালো ভাবে জানো, আমাদের অভিযানের কথা। পরিত্যাক্ত ধুসর পৃথিবীর কথা।
আমি চাই না আবার আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে নিজেরা ধংস হয়ে যাই। মুছে যাই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ জলে ভরে উঠলো রবিনের।
চলবে >>>
আগস্ট ২৫, ২০১২; ৫:৫৮ পূর্বাহ্ন
বাহ বেশ দারূণ লেখা তো? আলাদা ভাবে ভালো লাগল।
আগস্ট ২৭, ২০১২; ৮:৫৫ অপরাহ্ন
ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো ।
মহাকাশের পথে সাথে থাকার আহ্বান রইলো
আগস্ট ২৫, ২০১২; ১:৪১ অপরাহ্ন
বাহ, চমৎকার একটা সাইন্স ফিকশন হচ্ছে—এক নাগাড়ে পড়ার মত।চলতে থাকুক সিরিজটা
আগস্ট ২৭, ২০১২; ৯:০৬ অপরাহ্ন
সাথে থাকুন দেখি স্পেস-শীপ কে কোন উপযোগী গ্রহে ল্যান্ড করাতে পারি কিনা
আগস্ট ২৬, ২০১২; ৭:০১ পূর্বাহ্ন
বন্ধু জাহাঙ্গীরের কল্পনা জগৎ অত্যন্ত উর্বর — হোক সে পদ্য কিংবা গদ্য লিখায়।
ফিকশন লেখক হিসেবে জাহাঙ্গীরের একজন অত্যন্ত সফল লেখক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কেবল আগ্রহ ও স্পৃহা ধরে রাখতে পারলেই হয়।
আগস্ট ২৭, ২০১২; ৯:১১ অপরাহ্ন
অনেক অনুপ্রাণিত হলাম আলমগীর ভাই ।
চলার পথে অনেক মহাজাগতিক- ডাস্ট , তাই আগাতে পারছিনে । তবে শীঘ্রই পরবর্তী অংশটুকু লেখার চেষ্টা করবো ।
আগস্ট ৩০, ২০১২; ৬:৫৯ পূর্বাহ্ন
মশলাদার এক সাযেন্স ফিকশনের আশায় বসে থাকলাম,পরবর্তি পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক
সেপ্টেম্বর ১, ২০১২; ২:২৩ অপরাহ্ন
গল্পের সবগুলো দিকই ভালো লাগলো। উপস্থাপনাও নান্দনিক।