০
৯৪২ বার পঠিত
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা(এমএন লারমা) একটি বিপ্লবী নাম, একটি মহান প্রগতিশীল আদর্শের নাম, একটি অনুপ্রেরণার নাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে “এমএন লারমা” একটি বীরত্বের নাম।
“এমএন লারমা” কে ছিলেন? তার ব্যাক্তিত্ব, নৈতিক প্রগতি, জুম্ম জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, মহান এই মানুষটির মহান আদর্শগুলোকে জেনেও আমরা অনেকেই গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনা, অনুধাবন করতে পারিনা, অনুসরণ করতে পারিনা। যে কারণে আমরা এবং আমাদের তরুণ সমাজ জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা, প্রগতিশীল চিন্তাধারা, নৈতিক আদর্শ ও সংগ্রামী ভাবধারার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
ব্যাক্তিগতভাবে আমার এমএন লারমা নামের এই মহান মানুষটিকে বাস্তবে দর্শন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। যখনি এই মহান মানুষটির কথা আমি শুনেছি তখন থেকেই আমার সমস্ত চিন্তা ধারার মূলে আমি এমএন লারমা নামের মহান মানুষটিকে দর্শন করার চেষ্টা করেছি, মহান মানুষটির নৈতিক প্রগতিশীলতাকে অবলোকন করার চেষ্টা করেছি, বারে বারে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করেছি মহান মানুষটির বিপ্লবী আদর্শকে, জুম্ম জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামী চেতনাকে। আমি মনে করি আমাদের সবার মহান বিপ্লবী নেতা এমএন লারমার ব্যাক্তিত্ব ও মহান আদর্শকে নিখূতভাবে জানা দরখার। বিশেষত জানা দরখার তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে। আমরা যদি এমএন লারমার বিপ্লবী আদর্শ ও সংগ্রামী চেতনাকে জানার চেষ্টা না করি তাহলে সেটা হবে আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনা অর্থাৎ নিজেকে নিজে ঠকানো।
জুম্মজাতীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রামী ইতিহাসে এমএন লারমা ছিলেন একজন অগ্রসেনানীর ভূমিকায়। আজকে জুম্ম জনগণের কাছে যিনি জাতীয় অগ্রদূত বলে বিশেষভাবে পরিচিত তিনিই হলেন “এমএন লারমা”।পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সহ বিশ্বের সকল অধিকারহীন মেহনতি মানুষের স্বাধীনতা কায়েমের পক্ষে এমএন লারমার বজ্রকন্ঠ ছিলো সবসময় সোচ্চার। তিনি কখনো নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখেননি বা প্রাধান্য দেননি। বড় করে দেখেছেন অধিকারহীন মানুষদের সামগ্রীক স্বার্থকে। ১৯৫২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এমএন লারমা। তিনি সেসময় আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে কাপ্তাই বাঁধের ফলে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৯৮০ সালে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে লেখা হয়েছিলো, কাপ্তাই বাঁধের ফলে যেসব আদিবাসী পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের পুনর্বাসনের জন্য ৫১ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার রাখা হয়েছিলো, কিন্তু মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছিলো। ষাটের দশকের দিকে মহান নেতা এমএন লারমা আদিবাসীদের বঞ্চনার বিষয়ে একটি প্রচারপত্র লিখে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের কাছে বিতরন করেন। তথসময়ের সরকার তাকে জননিরাপত্তা আইনে বন্দী করে কয়েক বছর আটক করে রাখে। এমএন লারমা তার সংগ্রামী জীবনে ভয়কে কোনভাবে পরোয়া করেনি বরং তার সংগ্রামী কাজে সকল প্রতিবন্ধকতা সহ বাধা বিপত্তিতে এমএন লারমার সাহসিকতার বিকাশ হয়েছিলো তীব্র থেকে তীব্রতর। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্র কতৃক যে নিপীড়ন, নির্যাতন সহ শোষণ বঞ্চনা চালানো হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় সেসকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এমএন লারমা ছিলেন সদা সর্বদা প্রতিবাদের প্রথম সাড়িতে। তিনিই জুম্ম জাতীকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। জুম্ম জাতীর চিন্তা-চেতনায় সংগ্রামী অনুপ্রেরণার স্পৃহা মজুত করেছিলেন। জুম্ম তরুণ সমাজকে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনায় বলিয়ান করে তুলেছিলেন। জুম্ম জাতীর সংগ্রামী চেতনায় জাতীয় মুক্তির বীজ বপন করে জুম্ম জাতীকে অবতীর্ণ করেছেন বিপ্লবী চেতনার মধ্যবৃত্তে। এমএন লারমার হাত ধরেই জুম্মজাতী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে ইস্পাত আন্দোলনের স্পৃহা নিয়ে বজ্র কন্ঠে প্রতিবাদ করতে হয় তা রপ্ত করেছিলেন। মহান এই মানুষটির বিপ্লবী সংগ্রামী চেতনায় ছিলো আপোষহীন ও নিস্বার্থবাদী মহান আদর্শ। অথচ এমএন লারমা নামের এই মানুষটির আদর্শিক গুণাগুণ গুলো আমাদের বর্তমান তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজ ক’জনই বা মূল্যায়ন করে, ক’জনই বা উপলদ্বি করে, অনুসরণ করে।যে মানুষটি আমাদের জাতীয় মুক্তির জন্য জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইস্পাত সংগ্রাম করে গেছেন ব্যাক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে আজকে সেই মহান মানুষটি বেশি অংশের তরুণ সমাজের কাছে অচেনা হয়ে আছে।
আমাদের আরো গভীরভাবে মহান বিপ্লবী নেতা এমএন লারমা সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে এই মহামতি ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষটির আদর্শ ও চেতনা সম্পর্কে।মহান নেতার মহান আদর্শ ও চেতনাগুলোকে গভীরভাবে অধ্যায়ন করতে হবে, অনুশীলন করতে হবে। বিশেষত জুম্ম তরুণ সমাজকে এমএন লারমাকে গভীরভাবে চিনতে হবে।তার মহান আদর্শগুলোকে জেনে মননে ধারণ করতে হবে। ধারণ করে জুম্ম জাতীর মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে, যেভাবে জুম্মজাতীর মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন মহান নেতা এমএন লারমা। হয়তো আমরা তার সমতুল্য করে অগ্রচর হতে পারবো না, কিন্তু মহান মানুষটির আদর্শ ও চেতনা ধারণ করে জুম্মজাতীর মুক্তির সংগ্রামের ইস্পাত আন্দোলনে সহস্র শক্তির উৎস হয়ে দাড়াতে পারবো।
কথায় আছে “প্রবীণের হাত ধরে নবীণের পথ চলা”, তাহলে হোক না শুরু মহান নেতার আদর্শে আমাদের তরুণ সমাজের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামী পথচলা। যে পথচলায় আমাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণার উৎস হবে মহান নেতার মহান আদর্শগুলো। মহান নেতার স্বপ্ন ছিলো এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে “স্বাধীন জুম্মল্যান্ড” হিসেবে গড়ে তোলা। যে মানুষটি একসময় আমাদের জন্য সংগ্রাম করতে করতে নিজের জীবনকে নির্দ্ধিধায় উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় মুক্তির নিমিত্তে, সেই মানুষটার স্বপ্নকে আমরা সহস্র তরুণ কেন থমকে যেতে দেবো? আমরা কি চাই না নিজের মাতৃভূমিতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে? মহান নেতা এমএন লারমা যদি জুম্মদের সামগ্রীক স্বার্থে, সংগ্রামে, বিপ্লবে তার জীবনের পুরোটা সময় ব্যায় করতে পারে তাহলে আমাদের তরুণরা কেন পারবে না? পারতেই হবে।
হে নবীণ, তোমরাই পারবে মহান মানুষটির মহান স্বপ্নগুলোর বাস্তব রূপ দিতে। তোমরাই পারবে মহান মানুষটির মহান আদর্শ গুলোকে ধারণ করে রাষ্ট্রীয় শোষণ বঞ্চনার পাহাড় ভেদ করে “এমএন লারমা” নামের মহান মানুষটির “স্বাধীন জুম্মল্যান্ড” স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দান করতে।
হে নবীণ, তোমরাই পারবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নির্যাতনের দেয়াল ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মায়ের পরাধীনতার গ্লানী মুছে দিয়ে মায়ের মূখের স্বাধীনতার হাসি ফোঁটাতে। প্রতিটা বোনের মনন থেকে নিরাপত্তাহীনতার আতংক দূর করে স্বাধীনভাবে দীপ্ত প্রত্যয়ে ছুটে চলার স্বপ্ন দেখাতে। আর কতদিন পরাধীনতার ভার কাঁধে নিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে। যেখানে এমএন লারমার মত মহমতিরা জুম্ম মুক্তির সংগ্রামে মৃত্যুকে পরোয়া করেনি, সেখানে আমাদের এত মৃত্যুর ভয় কিছের?
পরিশেষে বলবো, জুম্ম জাতীর অগ্রদূত মহান বিপ্লবী নেতা “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা”(এমএন লারমা) জুম্মজাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে ইস্পাত আন্দোলন করে গেছেন জীবনের শেষ মুহুর্থ পর্যন্ত আপোষহীন নেতৃত্ব ও তার দূরদশী চিন্তা-চেতনা ও মহান বিপ্লবী আদর্শের মধ্য দিয়ে। এই মাননুষটি কেবল মহান নয়, এই মানুষটি আমাদের জুম্মমুক্তির সকল সংগ্রামী শক্তির উৎস, বিপ্লবী অনুপ্রেরণা, প্রগতিশীলতার উদ্ভাবক, মহান আদর্শের প্রতীক ও জুম্মজাতীর উজ্জল নক্ষত্র। জুম্মজাতীর ইতিহাসে এমএন লারমা বেঁচে থাকুক অবিস্মরণীয় মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে।
-মহান নেতা এমএন লারমা
-লও লও লাল সালাম।
বিঃদ্রঃ আমার এই লেখাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থী কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রকাশনা “রঁদেভূ” এমএন লারমার প্রয়ান দিবস ১৭তম সংখ্যা ১০ই নভেম্বর ২০১৯-এ প্রকাশিত।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন