০
৮৩৪ বার পঠিত
আজ ঐতিহাসিক ৩০ জুন, মহান সান্তাল ‘হুল’ দিবস। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিবস। সুদখোর মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ-অত্যাচার ও পুলিশ-দারোগার নির্যাতনে অতিষ্ঠ সান্তাল জনগণ মুক্তির পথ খুঁজতে ১৮৫৫ সালের এই দিনে সিদো মূরমূ এবং কানহু মূরমূ তাঁদের নিজ গ্রাম ভগনাডিহিতে এক গণসমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময় সুদখোর মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ ও ঠকবাজীতে সান্তাল জনগণ নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। মহাজনের ঋণ যতই ফেরৎ দিক, কখনও শোধ হতো না। বংশ পরম্পরায় পরিশোধ করতে হতো, ঋণ পরিশোধের নামে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সারাজীবন গোলাম করে রাখা হতো। পুলিশের সহায়তায় তারা সান্তালদের গরু-ছাগল কেড়ে নিতো, জমি কেড়ে নিতো, প্রতিবাদ করলে গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখতো। ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিকার চাইলে উল্টো অত্যাচারের খড়গ নেমে আসতো।
গণসমাবেশ আয়োজন প্রক্রিয়ার লড়াকু সৈনিক ছিলেন তাঁদের আপন দুই ভাই চাঁন্দ মূরমূ, ভায়রো মূরমূ এবং বিদ্রোহী-লড়াকু-প্রতিবাদী দুই বোন ফুলো মূরমূ এবং ঝানো মূরমূ। সিদো-কানহু, চান্দ-ভায়রো চার ভাই সান্তাল সমাজের ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আম গাছের ডাল কাঁধে নিয়ে দামিন-ই-কোহ্ এলাকার চারশতাধিক সান্তাল গ্রামে গণসমাবেশের প্রচার করেন। ফলে দুর্গম গহীন বনাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও ৩০ হাজার, মতান্তরে ৫০ হাজারেরও অধিক, সান্তাল জমায়েত হয়েছিলেন। সেদিনের ঐতিহাসিক গণসমাবেশে সমবেত জনতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিদো-কানহু তাঁদের আবাসভূমিকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। সমবেত জনতা রাজ্যের সকল দায়-দায়িত্ব সিদো-কানহু’র ওপর অর্পণ করেন। তাঁরা সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশরাজকে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেন, সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে তাঁরা রাজ্যের সকল দায়-দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ঐতিহাসিকদের মতে সেটিই ছিল উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশীদের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। উল্লেখ্য যে ঐতিহাসিক সেই বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে আতঙ্কিত হয়ে তৎকালীন কোলকাতা কেন্দ্রিক ব্রিটিশ বেনিয়ার পাচাটা বাঙালী বুদ্ধিজীবিরা ও তাদের পত্রপত্রিকাগুলো বিরোধিতা করেছিল, বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশদেরকে সহায়তা করেছিল।
সেই ঐতিহাসিক গণসমাবেশের মাধ্যমে উত্থাপিত দাবিসমূহ বড় লাটকে জানানোর উদ্দেশ্যে হাজার হাজার সান্তাল নারী-পুরুষ সিদো-কানহুর নেতৃত্বে কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে পারগানা সাম টুডু প্রেরিত সংবাদ আসে যে জঙ্গিপুরের মহেশ দারোগা এলাকার অত্যাচারি সুদখোর মহাজন কেনারাম ভগত এর সহযোগিতায় ৬/৭ জন সান্তাল সামাজিক নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে ভাগলপুরে নিয়ে যাচ্ছে। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহেশ দারোগা ও তার সঙ্গিসাথীদের পথ রোধ করে সান্তাল নেতাদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়। এ সময় মহেশ দারোগা সিদো-কানহুকে আটক করতে উদ্যোত হলে সমবেত জনতা মহেশ দারোগা ও কেনারাম ভগতসহ তাদের দলের ১৯ জনকে সেখানেই হত্যা করে এবং ‘হুল হুল,’ ‘হুলে হুল’ স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। শুরু হয় হুল! গোটা সান্তাল এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়। তীর ধনুকে সজ্জিত সান্তাল নারী-পুরুষ যোদ্ধারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৮ মাস যুদ্ধ করে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য। এই গণযুদ্ধে দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চলের সান্তাল ছাড়াও কামার-কুমার, তাঁতি ও মোমিন শ্রেণির মুসলমান কৃষকসহ সর্বস্তরের শোষিত নির্যাতিত জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। হুলে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধারা পরাজয় বরণ করেছিলেন কিন্তু আত্মসমর্পণ করেননি। আজও আমাদের দেশ ও সমগ্র উপমহাদেশ তথা বিশ্বজুড়ে সুদখোদ মহাজন ব্যাংক ডাকাত লুটেরা দুর্নীতিবাজ, ড্রাগ নেশাদ্রব্য ও অস্ত্র ব্যবসায়ী, জুয়াড়ি খুনি শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলমান, থেমে নেই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তা তাদের ভূমি এবং অস্তিত্ব নিয়ে এক চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। সরকারি ভূমি কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে নামীয় ভূমিকে “শত্রু সম্পত্তি” বানিয়ে নিয়েছে, যে জমিতে আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে, ভোগ দখল করে আসছে সেই জমি এবং আদিবাসীদের কবরস্থানগুলো প্রভাবশালী বাঙালিদেরকে লীজ দিয়ে আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করছে। সরাসরি পুলিশ বাহিনী নিজের হাতে আগুন দিয়ে সংখ্যালঘু জাতীসমূহের ঘরাবিড় জ্বালিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করছে। এইভাবে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার জগৎনগর মৌজার সান্তালদের জমি প্রথমে “শত্রু সম্পত্তিতে” পরিণত করে প্রভাবশালী বাঙালিদের লীজ দিয়ে এক পর্যায়ে একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তা ক্রয় করে নিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী জগদল মৌজার জনৈক সান্তাল আদিবাসীর ৭.৫ একর জমি মইশড় মৌজার এক ভূমিদস্যু জাল দলিল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও সিভিল মামলা দায়ের করেছে এবং তাদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পত্নীতলা উপজেলার সুবর্ণপুর গ্রামের একটি ওরাঁও পরিবার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ইন্ধনে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর এ ধরণের অত্যাচার নিপীড়ন নিত্যদিনের ঘটনা। এভাবেই দখলদারদের হুমকী, পুলিশ ও প্রশাসনের হয়রানি, মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করতে না পেরে উত্তর বঙ্গের আদিবাসীগণ ক্রমেই ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছেন।
সমগ্র উত্তর বঙ্গসহ পাহাড়ে ও সারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও আদিবাসীদের এই হলো অবস্থা। সর্বত্রই তাদের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে এবং জাতিগত অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার মুখে। ২০১১ সালে ৩০শে জুন হুল দিবসেই সংবিধানের ১৫দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও আদিবাসীদের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে তাদের জাতিগত পরিচয় নির্ধারন করা হয়েছে ‘বাঙালি’ হিসেবে, বানানো হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। হুল দিবসে এইভাবে সংবিধান সংশোধন করে শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে চরমভাবে অপমানিত করেছে। স্থানীয় ও জাতীয় দুই দিক থেকেই তারা অস্তিত্ব হারাতে চলেছে।
এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাবার একটিই মাত্র পথ রয়েছে। সেই পথ হলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এবং সংগ্রামের পথ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রাম করেই আমাদের অধিকার আদায় করতে হবে, টিকে থাকতে হবে। সংগঠিত না থাকলে আমরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো, হারাতে হবে সর্বোস্ব, সংগঠিত থাকলে আমাদের সব থাকবে। আসুন, আমরা সকল আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও নিপীড়িত দরিদ্র বাঙালী শ্রমিক কৃষক ১৮৫৫ সালের মত আবারো একতাবদ্ধ হই, আমাদের অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠায় গণসংগ্রাম গড়ে তুলি। জনগণের রাষ্ট্র গড়ে তুলি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন