০
৭১৬ বার পঠিত
মহাভারত একটি অতুলনীয় গ্রন্থ। কুরুক্ষেত্রের মাঠে সংঘটিত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধই এর প্রধান কাহিনী। আধুনিক যুক্তিবাদী পাঠকের উপযোগী করে তার তাৎপর্য্য এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু নামে দুই রাজার কথা আছে। ধৃতরাষ্টের দুর্য্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতি শতপুত্ত্রের নাম ছিল কৌরব। তার ভ্রাতা পাণ্ডুর ছিল যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন প্রভৃতি পাঁচ পুত্ত্র, তারা পাণ্ডব নামে পরিচিত। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে পাণ্ডুই রাজকার্য্য চালাতেন। কৌরব ও পাণ্ডেবরা বড় হলে দুর্য্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে কে রাজা হবে তাউ নিয়ে বিরোধ দেখা দিল। তখন পাণ্ডবদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থে আলাদা রাজ্য করে দেওয়া হল। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির অক্ষক্রীড়া বা পাশাখেলায় আসক্ত ছিলেন। তিনি অক্ষক্রীড়ায় পণ রেখে কৌরবদের কাছে নিজের রাজ্য ও স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। তার ফলে তাদের বনে যেতে হয় এবং শেষমেশ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বেঁধে যায়। সেই যুদ্ধে পাণ্ডবরাই জয়ী হন, রাজ্যপাট ফিরে পান। বাস্তবে কোনো রাজা কী অক্ষক্রীড়ায় নিজের রাজ্য এবং স্ত্রীকে হারাতে পারেন বলে মনে হয় না। তাহলে এইসব কাহিনীর মানে কী?
কাহিনীর অর্থে প্রবেশ করার আগে অক্ষক্রীড়া শব্দের অর্থ আলোচনা করি, কারণ অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের অতিরিক্ত আসক্তিই ছিল যত নষ্টের গোড়া। অক্ষক্রীড়া মানে পাশাখেলা। এর অপর নাম, দ্যূতক্রীড়া, দেবন, সমাহ্বয় ইত্যাদি। পাশাখেলাকে অক্ষক্রীড়া বলে কেন? কোনো বস্তু যেমন তার অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণিত হয়, তেমনি অক্ষক্রীড়ায় দ্রব্যের বিনিময় বা মালের হাতবদল হয় (এদিকের মাল ওদিকে যায়)। প্রসঙ্গত, অক্ষবাট মানে হাটতলা, যেখানে পণ্যের বিনিময় হয়। আজকের দিনে World Trade Center-কেও অক্ষবাট বলা চলে। অক্ষকে ইংরেজীতে বলে Axis। বাংলা অক্ষ এবং ইংরেজী axis শব্দের উচ্চারণ ও অর্থের মিল লক্ষণীয়। ‘অক্ষণ‘ মানে মাল দেওয়া নেওয়া হতে পারত, কিন্তু বাংলায় এই অর্থে ‘অক্ষণ’ শব্দটি প্রচলিত নাই। বাংলায় না থাকলেও ইংরেজীতে অনুরূপ উচ্চারণ ও অর্থবিশিষ্ট একটি শব্দ আছে, সেটি হল auction (অক্ষণ?), যার অর্থ নিলাম। নিলামে মাল দেওয়া-নেওয়া হয়। অক্ষক্রীড়াকে পাশাখেলা বলে কেন? এই খেলায় এ পাশের মাল ও পাশে যায় বলেই তাকে পাশাখেলা বলে। একে সমাহ্বয় বলে কেন? মাল নিয়ে ডাকাডাকি হয় বলেই একে সমাহ্বয় (সম আহ্বান>সমাহ্বয়) বলে। অক্ষক্রীড়াকে দেবন বলে কেন? মাল দেওয়া-নেওয়া হয় বলেই ইহা দেবন। প্রসঙ্গত, যারা দেবন করেন তাদের দেবতা বলে এবং তারা যে লোকে থাকেন তাকে দেবলোক (স্বর্গ) বলে। অনেক পুণ্য করে (বুঝুন পণ্য বিক্রয় করে অনেকে টাকা করে) দেবতারা সুখস্বর্গে বাস করেন। অবশ্য প্রাচীন ভারত পণ্যবিক্রয় করাকে পুণ্য বলত না, বরং পাপ বলত। যুগ পাল্টায়, সূর্য্যবংশ (সমাজতন্ত্রের বংশ) চলে যায়, চন্দ্রবংশ (ধনতন্ত্রের বংশ) আসে, পণ্যবিনিময় স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করে।
মহাভারতে বর্ণিত অক্ষক্রীড়া আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতীক। কৌরবরা ছিল যৌথতার পক্ষে আর পৃথার পুত্ত্র পাণ্ডবরা ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের (পৃথক হওয়ার) পক্ষে। যৌথতা গিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যবসা বাণিজ্যের যুগ আসছে, এই প্রেক্ষিতে মহাভারতকে বুঝে নিতে হবে। মহাভারতের চরিত্রগুলির কোনোটিই ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নয়। এ হল ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় রচিত ভারতের ইতিহাস; সেখানে ব্যক্তিগুলি নয়, ক্রিয়াগুলিই প্রধান। যেমন ধৃরাষ্ট্র আসলে কোনো ব্যক্তির নাম নয়, যেসব অন্ধ আইন রাষ্ট্রকে ধরে রেখেছিল সেগুলিই ধৃতরাষ্ট্র। কবিতার খাতিরে কবি সেইসব আইনকে ব্যক্তি রূপে কল্পনা করেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই আইনগুলির কথাই বলতে চেয়েছেন। পণ্ডু মানে উদীয়মান (ফলত পাণ্ডুর) ধনতন্ত্রকে বুঝতে হবে।
মধ্যম পাণ্ডব ভীম আসলে ধনতান্ত্রিক প্রচারব্যবস্থার প্রতীক মাত্র। পাণ্ডুর পুত্ত্র বলা হলেও সে আসলে ছিল পবনপুত্ত্র এবং গদাধর। পবন মানে বায়ু বা আজকের ভাষায় বলতে গেলে মিডিয়াকে বুঝতে পারেন। ভীম বলতে আসলে জোরালো ধনতান্ত্রিক প্রচারকে বুঝতে হবে যা যাকে যুদ্ধে হারাণো কঠিন সেই অপশাসক দুর্য্যোধনকেও ধরাশায়ী করে দিয়েছিল। ভীম ছিল অর্জ্জুনের অগ্রজ। ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধও আসলে বাকযুদ্ধের প্রতীক। সেক্ষেত্রে গদা বলতে গদ গদ কথা বলাই বুঝতে হবে যা বায়ুবেগে উড়ে যায় এবং দুর্য্যোধনকেও পরাস্ত করে। আজকের দিনেও দেখা যায় যে মিডিয়া শাসককে ক্ষমতাচ্যূত করার ক্ষমতা রাখে। মহাভারতে আছে ভীম দুঃশাসনের রক্তপান করেছিল। এও একটি প্রতীকী বর্ণনা মাত্র। এর প্রকৃত অর্থ হল অপশাসনের (দুঃশাসনের) শক্তিশোষণ (রক্তপান) করা। যৌথতাবাদী কৌরবদের হারিয়ে তবেই ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার সম্ভব হয়েছিল।
ভীমের ভাই অর্জ্জুনের কথাও বলি। অর্জ্জুন শুক্ল ধন অর্জ্জন করে বলেই তার নাম অর্জ্জুন। তার আর এক নাম ধনঞ্জয়, মানে যে ধনকে জয় করে। তার রথের সারথি হয়েছিল কৃষ্ণ। নানা স্তরে কৃষ্ণ কথার নানা অর্থ হয়। বর্ত্তমান ক্ষেত্রে কৃষ্ণ মানে কৃষ্ণধন বুঝা চলে। সাদা টাকা (অর্জ্জুন) ও কালে টাকা (কৃষ্ণ) মিলে সব কাজ হাসিল হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, কালো মানেই কিন্তু খারাপ নয়। কৃষ্ণলীলার বিস্তারিত তাৎপর্য্য আমরা অন্যত্র বলেছি।
প্রসঙ্গত, গীতা মহাভারতেরই অন্তর্গত। কৃষ্ণ কেমন করে অর্জ্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন সে বর্ণনা গীতায় আছে। কেউ কেউ মনে করেন এখানে কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়ে খুবই অন্যায় করেছেন। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে আমার মনে হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি কোনো ঐতিহাসিক, রক্তক্ষয়ী মহাসমরের কাহিনী নয়। যে স্থানে কী করতে হবে তা ঠিক হয় তাই কুরুক্ষেত্র। এই কুরুক্ষেত্রের অবস্থান হরিয়ানায় বলে আমার মনে হয়নি, বরং কবির মনের ভিতরেই এর অবস্থান। কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়েছেন মানে তিনি অর্জ্জুনের কী করা উচিত তাকে সেই কর্ত্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং ধনতন্ত্রের আগমনকে তরাণ্বিত করেছেন। গীতা একটি অতুলনীয় গ্রন্থ এবং এই টাইমলাইনের অন্যত্র আমরা গীতা নিয়ে আরও বিশদে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেছি।
কৌরব পক্ষের একজন গুরুত্বপূর্ণ যোদ্ধা ছিল কর্ণ। তার ছিল সহজাত কবচ আর কুণ্ডল। কর্ণচরিত্রের তাৎপর্য্য কী? কর্ণ মানে কান। দোকানের দুটি কান থাকে (তাই তাকে দোকান বলে, দো মানে দুই)। এই দুটি কান হল ক্রয়বিভাগ ও বিক্রয়বিভাগ, এদের একটি দিয়ে মাল ঢুকে আর অন্যটি দিয়ে বের হয়। কর্ণকে সরকারী দোকানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কর্ণের কবচকুণ্ডলের তাৎপর্য্য কী? উত্তর : কবচ মানে যা কায়কে বাঁচায়। কর্ণের কবচকুণ্ডলকে ব্যবসার লাইসেন্সের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কর্ণ অর্জ্জুনের কাছে হেরে যায়। বাস্তবে সরকারী দোকান সর্ব্বদা মুখ থুবড়েই পড়ে।
পাণ্ডব শব্দটির মধ্যেই পণ শব্দটি আছে। পণ মানে দেবন, আদান-প্রদান, বাজী, সত্যঙ্কার ইত্যাদি হয়। আপণে মাল বিক্রী করতে গেলে পণ বা সত্যঙ্কার (‘তুমি ইহা দিলে আমি উহা দিব’) করতে হয়। প্রসঙ্গত, ‘পাণ্ডববর্জ্জিত স্থান’ শব্দগুচ্ছের অর্থ বলছি। এ হল এমন স্থান যেখানে হাটবাজার (অক্ষবাট) নাই, ব্যবসা-বাণিজ্য হয় না। পাণ্ডবরা স্বাভাবিকভাবেই এমন স্থান বর্জ্জন করেন।
মহাভারত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় লেখা রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাসের বই। তথাকথিত নাস্তিকতা মহাভারত পড়ার পথে বা ধর্ম্মকে বুঝার পথে কোনো বাধা নয়। প্রতীকী শব্দার্থবিধিতে পড়লে মহাভারতে বর্ণিত বহু কাহিনীই অসম্ভব বলে মনে হয়, তবুও সেখান থেকে ধর্ম্ম কী তা বুঝে নেওয়া যায় এবং এর সাহিত্যমূল্য উপলব্ধি করা যায়। যারা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে অভ্যস্ত তারা মহাভারত থেকে ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের কাহিনী বুঝে নিতে পারবেন। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে প্রায় সমগ্র মহাভারত বোধগম্য হতে পারে। যারা এ বিষয়ে অধিক জানতে চান তারা খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ‘ পাঠ করুন। মহাভারতের অর্থ সম্বন্ধে সকলের মতামত কাম্য।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন