১০৭২ বার পঠিত
বাতাসের পুকুরে মানুষ যেন একটা মৃগেল মাছ। মৃগেল যেমন পানিতে সবচেয়ে নীচের স্তরে কাদার কাছাকাছি থাকে, মানুষও মৃগেলের মত তার বসবাসের মাধ্যম বাতাসের সর্বনিন্ম স্তরে মাটির কাছাকাছি থাকে। এভাবেই মানুষ ও মৃগেল অভিযোজিত। পরিবেশের কারণে পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা, খাদ্যাভ্যাস এগুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।
পুকুরে কার্প জাতীয় মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল একসাথে চাষ করা হয়। কাতলা মাছ এডভেঞ্চারাস, পানির উপরিস্তরে থাকে, ফ্রেশ পানি এবং খাবার খায়, মনে চাইলে বাতাসও খেতে পারে। মাঝে-মধ্যে লাফ দিয়ে ব্যারিয়ার ক্রস করার আনন্দ নিতেও কাতলার কোন সমস্যা নেই। কাতলা মাছ রুইয়ের মত মদন চেহারার বা মৃগেলের মত চিমসা না হয়ে পাতলা হতে চায় যাতে দ্রুত সাঁতরাতে পারে। শরীর বাঁকা করে ছোট মাছকে ভয় দেখাতে পারে। তবে উপরের স্তরে থাকার কারণে যে কোন সময়ে কাতলার জীবনে বিপদ নেমে আসতে পারে। জাল ফেলা হলে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই। পুরাণে আছে ‘রোহিত রাজেন্দ্র’ মানে, রুই মাছের রাজা। রুই মধ্যপন্থী, তার কাতলার মত চ্যাপ্টা হবার দরকার নেই, তাই বলে একেবারে কম চ্যাপ্টাও নয়। মধ্যভাগ একটু ভারিক্কি হলে তাকে মাতবর হিসেবে মানাবে ভাল। মৃগেলের মত চিমসা লম্বা না হলেও লম্বাতেও রুই কম যায় না। দুইদিকেই সে আছে।
সবার নীচে কাদার মধ্যে থাকে, কাদা খায় মৃগেল মাছ। তিনজনের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল। সাঁতরানোর ক্ষমতা থাকার পরেও সে উপরের পানিতে সাঁতার কাটতে যায় না। তলানিতে যেসব খাবার পাওয়া যায় তাতেই সে সন্তুষ্ট। এরজন্য তাকে খেসারতও দিতে হয়ে। সমাজে রুই-কাতলার যেমন মর্যাদা, মৃগেলের তেমন মর্যাদা নেই। কখনো শোনা যায়নি রুই-মৃগেল বা কাতলা-মৃগেল। বড়সড়, হোমড়া-চোমড়ারা সব সময় রুই-কাতলা।
মাছ আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীমাতৃক বাংলায় মাছ অন্যতম খাদ্য উপাদান, লিন প্রোটিন, গুড ফ্যাট এর ভাল উৎস। খাদ্যের উৎস্য হিসেবে তো বটেই মাছের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো অনেক গভীর। সাহিত্য, পুরান, ধর্ম, বিবর্তন সবকিছুতেই মাছের সাথে আমাদের যোগ-সম্পর্ক আছে।
মৎসাবতারঃ
হিন্দু ধর্মে দশ অবতারের মধ্যে একজন হলেন মৎসাবতার। দুনিয়া যখন পানিতে ডুবে ছিল, সকল প্রাণির বাস যখন পানিতে ছিল তখন মাছেরাই ছিল রাজা। মৎস্যপুরাণে বর্ণিত আছে কীভাবে মৎস্যাবতার অল্পসংখ্যক মানুষের প্রাণ রক্ষা করেন।
বিবর্তনবাদঃ
পানিতেই সর্বপ্রথম প্রাণের আবির্ভাব হয়। মাছেদের মধ্যে কিছু মাছ ডাঙ্গায় উঠে আসলে আস্তে আস্তে তারা বিবর্তিত হয়ে ডাঙ্গার সমস্ত প্রাণির উৎপত্তি ঘটে। আমাদের সকলের মধ্যে একটা মাছ বাস করে। পানি দেখলে গড়পড়তা মানুষের উত্তেজিত হয়ে যাবার কারণও আমাদের সেই অতীতের পানির জীবন। এখনো সকল প্রাণি ভ্রূণ থাকাকালীন সময়ে জীবনের প্রথম অংশ মায়ের পেটে বা ডিমের ভেতরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। মাছের মত সবার ফুলকা বা কানকুয়া ( gills) থাকে।
মৎসেন্দ্রনাথ ওরফে মীননাথঃ
তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে ৮৪ সিদ্ধার মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মীননাথ যার সাথে মৎসেন্দ্রনাথের অনেক মিল আছে। তাঁর নামে কিংবদন্তী চালু আছে, তিনি বঙ্গোপসাগরের তীরে নৌকা দিয়ে মাছ ধরতেন, একবার একটা বড় মাছ তাকে গিলে ফেলে কিন্তু তাঁর সুকর্মের জন্য তিনি রক্ষা পান। মাছের পেটে থেকে সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন।
“In the Tibetan hagiography of the eighty-four mahâ-siddhas, the following story is told of Mina Nâtha (who probably is identical with Matsyendra). The fisherman spent most of his time in his small boat in the Bay of Bengal. One day, he hooked a huge fish that pulled so hard on his fishing line that he was thrown overboard. Like Jonah in the biblical story, Mina ended up in the fish’s enormous stomach, protected by his good karma.”
–Feuerstein, Georg- The Yoga Tradition: Its History, Literature, Philosophy and Practice
মৎস্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তী হলো। প্রাচীনকালে কোন এক শুভক্ষণে তাঁর জন্ম হয় এবং দৈব নির্দেশে তাকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সাগরের বড় একটা মাছ তাকে গিলে খেয়ে ফেলে এবং সেখানে সে অনেক বছর বাস করে। একসময় মাছটি সাগরের তলদেশে যায়। সেখানে শিব তাঁর ওয়াইফ দেবী পার্বতীকে গোপন যোগবিদ্যা শেখাচ্ছিলেন। মৎসেন্দ্রনাথ মাছের পেটে থেকে সেগুলো শুনতে পেলে সেখানেই যোগচর্চা শুরু করেন। এভাবে বারো বছর সাধনা করার পরে সে সিদ্ধিলাভ করে। এজন্যে তাকে বলা হয় মৎসেন্দ্রনাথ মানে মাছেদের রাজা, ‘Lord of the Fishes‘।
বাইবেলে জোনা, মানে ইউনুস নবীর গল্প আছে যাকে মাছ গিলে ফেলে কিন্তু তার কিছু হয় না তিনি মাছের পেট থেকে জীবিত বের হয়ে আসেন।
বেলি অফ দ্য হোয়েল বা মাছের পেটের মানে কী? কেন এই মটিফ ব্যবহার করা হয়?
মাছের পেটের মটিফ অনেক জায়গায় এসেছে। এটার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো, পুরুষ হবার প্রক্রিয়ায় দীক্ষার সময়টা মানুষকে অনেকটা সময় একা একা কাটাতে হয়। কোন একটা বিষয়ে জানতে হলে সেটার ভেতরে ডুবে যেতে হয়, যাতে মনে একটা “swallowed up” অনুভূতি হবে।
“You go in one person and come out the other side with a completely transformed consciousness.”
‘বেলি অফ দ্য হোয়েল’ পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বাহিরের কারো কাছ থেকে মনোযোগ বা প্রশংস পাওয়া যায় না।
গোপাল ভাঁড়ের মৎস্যাবতার কৌতুকঃ
গোপাল ভাঁড়ের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। গোপালের সাথে তাঁর এক প্রতিবেশি মৌলভির বাগড়া বাঁধে। দুজন দুজনকে পঁচাতে চাইত, একজন আরেকজনকে শাস্ত্র আলোচনায় হারাতে চাইত। একবার মৌলভি তাঁর খাবার সময়ে গোপাল ডেকে পাঠাল, গোপাল আসলে তাকে বলল,
গোপাল, এই দেখ তোমাদের দশাবতারের এক অবতারকে ভক্ষণ করছি। মৌলভি মাছ-ভাত খাচ্ছিল।
গোপাল না বুঝার ভান করে বলল, অবতার মানে তৃতীয় অবতার?
মৌলভি তখন গুনে দেখল, মৎসাবতার, কূর্মাবতার, বরাহাবতার…। মানে শুকর, ছি ছি! তার খাওয়ার রূচি চলে গেল। 😛
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন