০
৬৮৭ বার পঠিত
মানুষ একসময় পরম যতনে যা গড়ে পরমূহুর্তে সেটাই ভাঙতে চায়। ভাঙা-গড়াই তার নিয়তি, এরমাঝে সমাজ এগিয়ে যায়। মানব জীবনের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সেলফলেস, স্টেইটলেস অবস্থা সৃষ্টি করা।
মানুষ নিজেকে খুব ভালবাসে, আবার চুড়ান্ত বিচারে আসলে ততোটা ভালবাসে না। যে সেলফকে সে জীবন দিয়ে রক্ষা করে সেটাকে ধ্বংস করাই তার অন্তিম আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। একইভাবে রাষ্ট্র নামক যে শাসনযন্ত্র সে ঐতিহাসিকভাবে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে সেটাকে ধ্বংস করাটাই তার চুড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য। স্টেইট যেন সেলফের একটা প্রতিরূপ। কবি গাইছেন-
“আমি যারে ভালবাসি তারে আবার বাসি না।তারে ভাল লাগে না, লাগে না, তারে ভালবাসি না।
বৃক্ষ কাইটা নগর দিলাম, সেই নগরেও টব বসাইলাম।ডান হাতে মোর কাটে বৃক্ষ বাম হাতে তা জানে না।আমি যারে ভালবাসি, তারে আবার বাসি না।
যে মোরগের আজান শুনে ঘুম ভাঙে মোর রোজ সকালেসেই মোরগের মাথা না খাইলে মনটা আমার ভরে না।আমি যারে ভালবাসি, তারে আবার বাসি না।তারে ভাল লাগে না, লাগে না, তারে ভালবাসি না।”
নৈরাজ্যবাদীঃ
রাজনীতিতে সামাজিক বিপ্লব কীভাবে হবে সেটা নিয়ে দুটো মতবাদ দেখা যায়। সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্য, স্টেইট থেকে স্টেইটলেস সমাজ গঠন করতে হবে। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রবিহীন গণমানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন একদল বলে সেটাই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে চলো এখন থেকেই রাষ্ট্রের পতনের জন্য কাজ করি। বর্তমান ব্যবস্থা যেহতু ভাঙতেই হবে তখন সেটাকে জোড়াতালি দিয়ে ধরে রাখার কী দরকার? একটা মানবিক, সাম্যময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করে নতুন করে সমাজ গড়ে তুলতে হবে। নৈরাজ্যবাদী এই দলগুলো মনে করে উত্তরাধিকার প্রথার সুবিধাভোগী পুঁজিপতিরা এমনি এমনি কোন সুবিধা ছেড়ে দিবে না, সেখানে লড়াই হবে। চুড়ান্ত বিচারে যেহেতু লড়াই করতে হবে তখন শুধু শুধু প্যাসিফিস্ট সেজে বিপ্লব আসন্ন করার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে কী লাভ?
সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটঃ
‘এই সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে’ এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু আরেকদল মনে করে বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। মানুষ সামাজিক জীব, তার একটা ইতিহাস আছে। তাদের দৈনন্দিন জীবন, হাসি, সুখ-দুঃখ সবকিছু নিয়ে সে মানুষ। এই মানুষকে সাথে নিয়ে আমরা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাব। মানুষের পরিবর্তন একটা বিশেষ সংখ্যক মানুষের মধ্যে পৌঁছালে তখন সেখানে একটা উল্লম্ফন হবে এবং বিপ্লব সম্পন্ন হবে। যেমন, পানি গরম করলে সেটা আস্তে আস্তে গরম হয়, ফুটতে থাকে তারপরে একসময় বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায়। তার ফেইজ চেইঞ্জ হয়। সামাজিক মানুষের মধ্যে গুনগত পরিবর্তনের জন্য একই প্রক্রিয়া প্রয়োজন, তার একটা ক্রিটিক্যাল মাস, একটা থ্রেশোলড লিমিট আছে। তাই বিপ্লবের জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের হঠকারি হলে চলবে না, তাতে সাময়িক উত্তেজনা আছে, হিরোইজম আছে, কিন্তু প্রস্তুতি ছাড়া আমরা সেরকম পথে হাঁটতে পারি না।
আধ্যাত্মিক জগতেও মানুষের একইরকম উদ্দেশ্য, সেলফ থেকে সেলফলেস হতে হবে। চুড়ান্ত বিচারে সেলফ একটা ইল্যুশান। নেচারে কোন সেলফ নেই, কিন্তু মানুষের সেলফ আছে। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার পারিবারিক, সামাজিক ইতিহাসের কারণে প্রত্যেক সেলফের অনেক সমস্যা থাকে। এই সেলফকে কীভাবে ডিল করতে হবে সেটা নিয়ে ধর্মপ্রণেতাদের মধ্যে বিভেদ আছে।
অদ্বৈতবাদ, বৌদ্ধ দর্শনঃ
জন্মসূত্রে মানুষ তার জীবনে অনেক টক্সিক মানুষ এবং আইডিওলজির এবিউজ সহ্য করে যেগুলো তার সেলফকে গড়ে তোলে। এই সেলফের কারণে মানুষ নিজেকে চিনতে পারতেছে না। সেলফকে তাই ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সেলফ না থাকলে সেলফের যেসব সমস্যা সেগুলোও থাকবে না। সেলফ হলো কুমীরের মত। নদী পার হতে হলে তাকে মারতে হবে, নাহলে সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে। শংকরাচার্য মনে করেন, তুমি যদি আনাড়ির মত মনে কর কুমীরের পিঠে চড়ে নদী পার হবে তাহলে কুমীরের পেটে যাওয়াতেই তোমার জন্মের সার্থকতা। বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে, এখানে দয়া-মায়া করে লাভ নেই। মৃত্যুই যদি শেষ ঠিকানা হয়ে থাকে, তাহলে মুক্তির জন্য বসে থেকে লাভ নেই। এ ধারার অনেকে ‘বডি ডেসপাইজার’, শরীর ও মনকে যতটা সম্ভব উৎপীড়ণ করা, কষ্ট দেয়া এদের ডেইলি রেজিমেন।
প্রেম ভক্তিবাদঃ
আরেক আধ্যাত্মিক ধারা বলে, ‘ইউ ক্যান নট থ্রো দ্য বেইবি আউট উইথ দ্য ডার্টি ওয়াটার’। মাথাব্যথা সারাতে মাথাটাকেই কেটে ফেলা কোনভাবেই মানা যায় না। সেলফ থেকে কারো মুক্তি নেই, জীবন থাকলে সেখানে একটু-আধটু সেলফ থাকবে। কাদার দাগ থেকে যায়। বটবৃক্ষ সমূলে উৎপাটনের পরে সেখানে আবার নতুন করে কুঁড়ি দেখা যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন, “যাবি না যখন, থাক শালা দাস আমি হয়ে“। তাছাড়া আধ্যাত্মিক মুক্তির পরে কোথায় যাবে? এখানেই তো থাকতে হবে। তাই চল সেলফকে ধ্বংস করার বদলে, তাকে শাস্তি দেবার বদলে বর্তমানে থাকি, জীবনটাকে পূর্ণাঙ্গভাবে বাঁচি, জীবনকে আনন্দময় করি। আনন্দময় কোষকে জাগিয়ে জগতের এই আনন্দধামে আনন্দ উপভোগ করি। তাছাড়া কোন রিপুকে দমন করা যায় না। মনের গড়নটাই এমন যে কোন রিপু দমন করার চেষ্টা করলে সেটা আরো চাগিয়ে উঠে। দমন না করে তাকে তার সীমাবদ্ধতাসহ গ্রহণ করতে হবে, সেলফের অনেক সমস্যা আছে কিন্তু সেলফ ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না। ধীরে ধীরে আমাদের আগাতে হবে। নেচারে কোন জিনিস হুট করে হয় না, যেকোন পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি লাগে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে আম পাকে কিন্তু তারজন্য আমগাছটাকে সারা বছর অপেক্ষা করতে হয়। শীত-বর্ষ উপেক্ষা করে টিকে থাকতে হয়। তারো আগে উপযুক্ত পরিবেশে, নিরাপদে চারাগাছ থেকে বড়গাছে পরিণত হতে অনেক বছর লাগে। তেমনি আধ্যাত্মিক পথে আমাদের লেগে থাকতে হবে। হয়ত এই জন্মে মুক্তি হবে না, কিন্তু হতাশ হলে চলবে না, মুক্তির পথে এগিয়ে থাকতে হবে। যাতে পরের জন্মে মুক্তি মিলে।
ব্যক্তি জীবনে অনেকেই সেলফ রিয়ালাইজেশান, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, সেলফলেস অবস্থা অর্জন করেছেন বা কাছাকাছি গিয়েছেন। একেবারে সেলফলেস হয়ে বেঁচে থাকা যায় না, তারপরেও যতটুকু সমভব সেটা অর্জন করেছেন। যাকে আমরা বলতে পারি ব্যক্তির মুক্তি। রাষ্ট্রের কাছ থেকে মুক্তি পেতে হলে সেটা হতে হবে সমষ্টির মুক্তি। ব্যক্তির মুক্তি অনেক হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রের মুক্তি সেটা এখনো বাকি। সেজন্য অনেক মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন