আধুনিক মানুষের জীবন পুরাণ,ধর্ম,দর্শন এবং বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তি মানুষের মন ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞান থেকে ধর্মতত্ত্বে, ধর্মতত্ত্ব থেকে দর্শনে উন্নীত হয়। শারীরিক অস্তিত্বের ফলে ভৌতজগত সম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর যে জ্ঞান জন্মায় তা বিজ্ঞানের জ্ঞান। অন্যসব আলোচনার আগে যেহেতু মানুষের অস্তিত্ব মেনে নিতে হয় তাই এটি প্রথম।অস্তিত্ব, অনুভূতি, চিন্তা (Being, Feeling, Thinking) এ ত্রয়ীর মধ্যে সবার আগে অস্তিত্ব, অস্তিত্বের ফলে পরিপার্শ্বের প্রতিক্রিয়ায় আমাদের সুখ-দুঃখ ইত্যাদি নানা অনুভূতি হয়, সে অনুভূতিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনে আমাদের চিন্তা আসে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় দার্শনিক দেকার্তের “I am thinking, therefore I exist” আসলে ভুল, দুই ধাপ পিছিয়ে আছে, ওরকম করে বলতেই যদি হয় তাহলে উলটো করে বলতে হবে, “I exist, therefore I think“।
আমাদের পরিবেশগত অস্তিত্বের কারণে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা রূপরসগন্ধশব্দস্পর্শের অনুভূতি হয়। অনুভূতিপ্রবণ অস্তিত্বের অনুসন্ধান প্রবণতা থেকে যন্ত্র বানানোর মধ্য দিয়ে মানুষ বিজ্ঞানের জ্ঞান রপ্ত করে। মানুষ প্রাণি জগতের খুব অল্প সংখ্যক প্রাণীর অন্তর্গত যারা কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন জিনিসকে হাতিয়ার এবং কাজের উপযোগী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অন্যপ্রাণীর থেকে মানুষের পার্থক্য তার হাত আর মগজে। মানুষ হাতের দ্বারা মগজের ধারণাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারে, নতুন কিছু বানাতে পারে,নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতিকে আরো ভালভাবে জানার মাধ্যমে আরো ভালভাবে খাপ-খাওয়াতে পারে। প্রযুক্তিতে অন্য প্রাণিরাও কম যায় না,বাবুই পাখীর বাসায় ব্যবহারিক যে উপযোগীতা এবং সৌন্দর্য তাতেও প্রযুক্তি আছে। একেবারে আদিম গোত্রভূক্ত মানুষের ব্যবহারিক জিনিসপত্র,শিকারের হাতিয়ারে প্রযুক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাজ হলো প্রকৃতিকে বিকশিত করে তোলা। সেভাবে মানুষের ভাষাও একটা প্রযুক্তি, শিল্প-সাহিত্য, সৃজনশীল কাজে মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
এরপর এ বিপুল বিশ্বজগতের সাথে আমাদের সম্পর্ক, আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদির জ্ঞান হলো ধর্মের জ্ঞান। অজানা, অচেনা জগতের সাথে সংযোগ সাধনে মানুষ তার মানবিক অনুভূতি এবং সম্পর্কের দ্বারাই এগিয়েছে। ধর্ম চর্চায় মানুষ এখনো অন্য মানুষের সাথে আমাদের যেসব সম্পর্ক হতে পারে ঈশ্বরের সাথে মানুষ সেসব সম্পর্কই আরোপ করে। আধ্যাত্মিক চর্চায় মানুষ যেসব ভাবের কথা বলে যেমন, সখ্য বা বন্ধুভাব, দাস্য বা দাসভাব,শান্ত (সাধারণ ভক্তের যে ভাব), বাৎসল্য বা মায়ের ভাব, এবং মধুরভাব বা প্রেমিকা রাধাভাব, ঈশ্বরের প্রতি এরকম নানান মানবিক সম্পর্ক দিয়ে মানুষ তার আবেগ, অনুভূতি, অনুরাগ প্রকাশ করে।
সবশেষে আমাদের মানসিক এবং অতি-মানসিক জগতের জ্ঞান হলো দর্শন। দর্শন আমাদের জানাকে প্রশ্ন করে আসলে কতটুকু জানা গেছে সেটা নিরূপণ করে। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে দর্শনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রমের অবকাশ সবচেয়ে কম। প্রকৃতিগতভাবে একমাত্র দার্শনিক উপায়ে কম পরিমাণ বিভ্রান্তি ঘটিয়ে বাস্তবতাকে উপলদ্ধির চেষ্টা সম্ভব। কৃষি বা পশুপালনের মাধ্যমে মানুষ যখন সমাজ বদ্ধ হয় তখন গোত্র বা জাতিগোষ্ঠীতে যারা যাজক,পুরোহিত, ওঝা বা শামানের ভূমিকা পালন করতো ধর্ম এবং দর্শনের আদিম নিদর্শন খুঁজতে গেলে তাদের মাঝেই সেটা পাওয়া যায়।
আজকে মানুষের যত ধারণা আছে সেগুলো একদিনে তৈরি হয়নি। এসব ধারণা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন স্তর পাড়ি দিয়ে বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। ব্যক্তি জীবনে মানুষের জ্ঞানচর্চার উত্তরণে বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শনের যে ধারাবাহিকতা দেখা যায় ইতিহাসে তার ক্রম কিছুটা ভিন্ন ধরণের। সমাজ বিজ্ঞানের জনক, পজিটিভিস্ট দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ এর মতে, ইতিহাসে দেখা যায় মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান ধারণাসমূহ অর্থাৎ জ্ঞানের সকল শাখা ক্রমান্বয়ে তিনটি ভিন্ন তাত্ত্বিক স্তর অতিক্রম করেঃ প্রথমে ধর্মীয় চিন্তা, তারপরে অধিবিদ্যা বা বিমূর্ত দর্শন এবং পরিশেষে বৈজ্ঞানিক স্তর, অর্থাৎ, ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান।
ইতিহাসকে সরলরৈখিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে সমাজবদ্ধ মানুষের আদিম অবস্থায় সর্বপ্রাণবাদ,ইন্দ্রজাল,পুরাণ আর ধর্মীয় ভাবনার প্রাধান্য ছিল। আদিম গোত্রের শামান,ওঝা,মেডিসিন ম্যান বা ডাইনী এরা ছিল পেশাজীবি আধ্যাত্মিক লোক,শিকারের যে কোন প্রয়োজনে, বিপদে আপদে সেই ছিল গোত্রের মূল ভরসা,পরামর্শদাতা। সামাজিক অগ্রগতির সাথে সাথে একসময় যখন পুরোহিত সমাজ গড়ে ওঠে, তখন তারাই শামান বা ওঝাদের অবস্থান দখল করে। এরপর উদ্ধৃত খাদ্য উৎপাদনের কারণে সমাজে আরো কিছু মানুষ বসে বসে জ্ঞান চর্চার সুযোগ পেল, এরা হলো দার্শনিক, শিক্ষক। পাশ্চাত্যে ইওরোপীয় রেনেসাঁর মাধ্যমে দর্শন থেকে বিজ্ঞানের দর্শন তৈরি হলো, মানুষ প্রবেশ করলো বিজ্ঞানের যুগে। এ যুগে এসে মানুষ বিজ্ঞানের দ্বারা অভিভূত, সবকিছুতে বৈজ্ঞানিক নিয়মনীতির প্রয়োগ হতে লাগল। জ্ঞানের রাজ্যে নতুন নতুন আরো অনেক বিষয়ের আবির্ভাব হলো। কোঁৎ এর সমাজবিজ্ঞান, থেকে কার্ল মার্ক্সের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য সবকিছুতে এখানের বিজ্ঞানের ছোঁয়া।
বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া পুরাণের দুনিয়া থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে এসেছি। বিজ্ঞান এবং পৌরাণিক চিন্তার মধ্যে পার্থক্যের শুরু হয়েছিল সতের ও আঠার শতকে। সেসময় নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরে বেকন, দেকার্তে নিউটন ও আরো অনেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে পুরাতন পৌরাণিক এবং রহস্যবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া সেসময় ভাবা হত যে বিজ্ঞানের পক্ষে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের দিকে পিঠ ফিরিয়েই কেবলমাত্র বেঁচে থাকা সম্ভব। সেসময় আরো ভাবা হতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (লজিক অফ কনক্রিট) দুনিয়া আমাদের প্রকৃত জগৎ থেকে দূরে নিয়ে যায়। বস্তুতঃ সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে গণিতের জগৎকেই প্রকৃত জগত বলে ভাবা হতো। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি পৌরাণিক, রহস্য থেকে বিচ্ছেদের কারণে বৈজ্ঞানিক চিন্তা নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছিল। বর্তমানে আমরা আবার এমন একটা প্রক্রিয়া দেখছি যখন এ বিচ্ছেদের অবসান আসন্ন। কারণ আধুনিক বিজ্ঞান দেখা যাচ্ছে শুধু যে এর গতানুগতিক সংকীর্ণ এবং মসৃণ পথেই ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে তা নয়, বরং সে সংকীর্ণতাকে যথাসম্ভব প্রসারিত করে বহু সমস্যার আত্মীকরণও করেছে যেগুলো হয়ত আগে তার নজরেই ছিল না।
বিজ্ঞান শুধু দু’ভাবে এগুতে পারে; হ্রাসমূলক (reductionism) পদ্ধতি অথবা কাঠামোবাদের (structuralism) সাহায্যে। যখন এক স্তরের জটিল ঘটনাবলী আরেক স্তরে সরল করে প্রকাশ করা যায় তখন এটি হ্রাসমূলক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। যেমন, শারীরবৃত্তীয় বহু ঘটনা আমরা সাধারণ প্রাণরসায়নে নামিয়ে এনে পুরোটা না হলেও অনেকটা ব্যাখ্যা করতে পারি। আর যেসকল ঘটনা এত জটিল যে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় হ্রাস করে ব্যাখ্যা পাওয়া অসম্ভব, তখন সেগুলোর একটির সাথে অপরটির সম্পর্ক অনুসন্ধান করে মৌলিক কাঠামোটিকে বুঝার চেষ্টা করা হয়।
মানুষের বৌদ্ধিক কার্যকলাপের দিকে তাকালে দেখা যায় তার একটা মূল লক্ষ্য ছিল আপাত বিশৃঙ্খল বিষয়ের মাঝে একধরণের শৃঙ্খলা স্থাপন। এটা যদি মানব মনের একটি মৌলিক প্রয়োজনের প্রতি দিক নির্দেশ করে এবং মানুষের মন নিঃসন্দেহে বিশ্বপ্রকৃতিরই একটি অংশ; সেক্ষেত্রে বলা যায় বিশ্ব প্রকৃতিতে শৃঙ্খলা আছে বলেই মানব মনে এ বোধের জন্ম হয়েছে।
গ্রীক দর্শনের কাল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত রেখার ধারণা, বৃত্ত বা ত্রিভুজের ধারণা মানুষের মধ্যে কী করে এল এ নিয়ে জোর বিতর্ক ছিল। সাধারণত দু’টি তত্ত্বের মধ্যে তর্কটা চলতঃ প্রথমটা হল মস্তিষ্ককে একটা ফাঁকা গোলক বলে ধরা হত, সেখানে শুরুতে কিছু থাকে না; অভিজ্ঞতা থেকেই এখানে যা কিছু সঞ্চারিত হয়। চারপাশের অনেক গোলাকৃতি বস্তু দেখতে দেখতে যেটার আবার কোনোটাই নিখুঁত গোল না, মানুষের মাথায় বৃত্তের ধারণা আসে। দ্বিতীয় ধ্রুপদী ধারণাটি প্লেটোর দান। তিনি বলেছিলেন আমাদের মাথায় সরলরেখা, ত্রিভুজ বা বৃত্ত ইত্যাদির ধারণা দেয়া আছে। মাথায় আছে বলেই আমরা যাকে বাস্তব জগৎ বলি, সেখানে এ ধারণাগুলোকে প্রক্ষেপ করতে পারি যদিও আমাদের চারপাশে নিখুঁত সরলরেখা, বৃত্ত বা ত্রিভুজ ইত্যাদি কিছুই নেই।
দার্শনিক যদিও যুক্তির দাবি অস্বীকার করতে পারেন না, তবু মাঝে মাঝে তার চিন্তাধার এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকে যে তা থেকে উদ্ধার পেতে তাকে সমগ্র জীবন এবং জগতের মৌলিক উপলদ্ধির উপর নির্ভর করতে হয়। আবার এ কথাও দার্শনিকের জানা আছে যে নিরীক্ষার বিচারে শেষ কথা বলতে পারে বুদ্ধি নয়,বোধি। “আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে”। বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা আছে। কারণ বুদ্ধির সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন আকাঙ্খা এবং নিজের পক্ষে উপভোগ্য,প্রীতিকর বিষয়গুলো জড়াজড়ি করে মিশে থাকে। দার্শনিক সত্যের প্রকাশে তাই বুদ্ধিকে প্রয়োগ করা চলে না।
যেকোন প্রমাণের জন্য শাস্ত্রে যে দুটি পদ্ধতিকে স্বীকার করা হয় তা হলো, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ এবং পূর্বকৃত প্রত্যক্ষণ হতে অনুমান। এ জগতের কিছু অংশ আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর,কিছু শুধুমাত্র অনুমেয়। কেবল প্রত্যক্ষ এবং অনুমানকে ভিত্তি করে তাই কোন দর্শনই দাঁড় করানো যায় না; কারণ যতটুকু করা যায় বিজ্ঞান সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে কুক্ষিগত করে ফেলে, সেটা আর দর্শনের এখতিয়ারে থাকে না। আধুনিক বিজ্ঞান সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে, জ্ঞানের সকল বিষয়কে ক্রমে সে তার তার করায়ত্ত্বে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ফরাসী দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ এর বিজ্ঞান তত্ত্ব মতে, বিজ্ঞান তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক জ্ঞান এ দু’ভাগে বিভক্ত। তাত্ত্বিক জ্ঞান যেমন পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং এদের সাথে সম্পর্কিত বিদ্যা যেমন উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ভূতত্ত্ব ইত্যাদি। প্রধান ধারাগুলো যেমন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞানকে তাদের গবেষণা ও তাত্ত্বিক পদ্ধতির জটিলতার নিম্নক্রমানুসারে সাজানো সম্ভব। জটিলতার এ নিম্নক্রম আবার গবেষণার বিষয়বস্তুর জটিলতার সাথে ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ জ্ঞানের এ বিষয়গুলোর গবেষণার বিষয়বস্তুর জটিলতা বিপরীতক্রমে বৃদ্ধি পায়।
যেমন রসায়ন পড়ার জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের জ্ঞান প্রয়োজন, কারণ রসায়নের জ্ঞানের বিষয়বস্তু পদার্থবিদ্যার চেয়ে জটিলতর। একইভাবে তালিকায় উল্লেখিত পূর্ববর্তী বিজ্ঞান পরবর্তী বিজ্ঞান অপেক্ষা প্রাচীন এবং জ্ঞানের দিক থেকে অগ্রসর। যেমন জীববিদ্যার চেয়ে রসায়নের জ্ঞান প্রাচীন এবং অগ্রসর।
সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভাষাতাত্ত্বিক নোম চমস্কির কথা থেকেও একই ধারণা পাওয়া যায়।
“মানব প্রকৃতির কিছু ব্যাপার এত জটিল যে তা নিয়ে গবেষণা করা যায় না। যেমন, পদার্থবিদ্যা খুব সহজ প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে। পরমাণু থেকে অণুর আকার একটু বড় হয়ে গেলে তারা সেটা রসায়নবিদের হাতে সমর্পণ করে। অণুর ধর্মাবলী বেশ জটিল হয়ে গেলে তারা সেটা দিয়ে দেয় জীববিজ্ঞানীর হাতে। সমস্যা জীব্বিজ্ঞানীর আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেলে তখন সেটা যায় মনোবিজ্ঞানীদের এক্তিয়ারে এভাবে শেষ পর্যন্ত সব সমস্যা গিয়ে পৌঁছায় ঐতিহাসিক বা ঔপন্যাসিকের কাছে। একটা সিস্টেম যত জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে ততই সেটা থেকে গভীর, এবং তাৎপর্যপূর্ণ গুণাবলী বের করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে।”
বিশ্বজগত বা মানুষকে বুঝতে একজন মানুষের পক্ষে ধর্ম,দর্শন এবং বিজ্ঞানের ধারণা থাকা দরকার। কিন্তু কিভাবে একজন মানুষের পক্ষে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান এবং দর্শনের এত এত শাখার ধারণা নেয়া সম্ভব? পাশ্চাত্য জ্ঞানের জগতের এহেন বিভাজন প্রসঙ্গে বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর মন্তব্য,
“পাশ্চাত্য দেশে জ্ঞানরাজ্যে এখন ভেদবুদ্ধির অত্যন্ত প্রবল হইয়াছে। সেখানে জ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখা প্রশাখা নিজেকে স্বতন্ত্র রাখিবার জন্যই বিশেষ আয়োজন করিয়াছে; তাহার ফলে নিজেকে এক করিয়া জানিবার চেষ্টা এখন লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। জ্ঞান-সাধনার প্রথমাবস্থায় এরুপ জাতিভেদ প্রথায় উপকার করে, তাহাতে উপকরণ সংগ্রহ করা এবং তাহাকে সজ্জিত করিবার বিশেষ সুবিধা হয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি কেবল এই প্রথাকেই অনুসরণ করি তাহা হইলে সত্যের পূর্ণমূর্তি প্রত্যক্ষ করা ঘটিয়া উঠে না; কেবল সাধনাই চলিতে থাকে, সিদ্ধির দর্শন পাই না।”
আজকের সমাজে দেখা যায়, শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকেদের গবেষণার ক্ষেত্রের বাইরের অন্যকিছু সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা থাকে না। মানবিক বিদ্যার গবেষক তার শাস্ত্রীয় গবেষণায় বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটালেও, বিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলো সম্বন্ধে অচেতন, তেমনি বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলী তার নিকটতম গবেষণা ক্ষেত্রের বাইরে মানবিক শিল্প-সাহিত্য এবং দর্শন সম্পর্কে উদাসীন।গত শতাব্দীতে ভৌত রসায়নবিদ এবং ঔপন্যাসিক সি পি স্নো তার বিখ্যাত ‘দ্য টু কালচার’ বক্তৃতায় বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার জ্ঞানগত ফারাক নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। তার মতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এমনকি সামাজিক জীবনে দিনকে দিন দুটি মেরুতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এদের একদলের চিন্তাভাবনা,কথাবার্তা আরেকদল বুঝতে পারে না, ফলে তাদের সম্পর্কের তিক্ততা থেকে মাঝে মাঝে প্রতিকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এদের কারোই অন্যদল সম্বন্ধে ভাল ধারণা নেই। মনোভাবের পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে আলোচনার জন্য সাধারণ এলাকা খুঁজে পাওয়াও ভার। মানবিক শাখার বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন বিজ্ঞানীরা দুর্বিনীত, অহংকারী, অগভীরভাবে আশাবাদী এবং তারা মানুষের অবস্থা (Human Condition) সম্বন্ধে অসচেতন। অপরপক্ষে বিজ্ঞানীরা মনে করে সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের দূরদৃষ্টির অভাব, তারা বুদ্ধিজীবীতার বিরোধী এবং শিল্প ও চিন্তাকে কেবল অস্তিত্বময় মুহুর্তে আটকে রাখতে চায়। স্নো তার সাহিত্যিক বন্ধুদের প্রশ্ন করে দেখেছেন তারা তাপ-গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র কি জিনিস জানে কিনা? দেখা গেল বেশিরভাগের তা জানা নেই। তার মতে এটি বিজ্ঞানের এমন এক প্রশ্ন, সাহিত্যের সাথে যার তুলনীয় প্রশ্ন হবে, সাহিত্যের ছাত্রকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তুমি কি সেক্সপিয়ারের কোন লেখা পড়েছ ? যাহোক স্নো শেষ পর্যন্ত তার বক্তৃতায় দেখান, জ্ঞানের এ বিভাজনের ফলে শিক্ষিত লোকেরা একেকজন ‘মূর্খ বিশেষজ্ঞে’ পরিণত হচ্ছেন।যার কারণে শিক্ষিত মানুষ এখন অন্য বিষয় সম্বন্ধে না জেনে, নিজস্ব গন্ডীর মধ্যকার জ্ঞানগর্ভে গর্বিত হয়ে জ্ঞানের অন্যান্য শাখা নিয়ে অনবরত মূর্খতার প্রমান দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ছাত্র-গবেষকেরা তেমন না জেনেও মানবিক শাখার জ্ঞানের প্রতি তাদের কোন শ্রদ্ধা নেই। বর্তমান সময়ের অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী এ দোষে দুষ্ট, তারা না বুঝে, ভাল করে না জেনে অনধিকার চর্চা করে যাচ্ছেন।