০
১৪৭৪ বার পঠিত
ভুলেই গিয়েছিলাম উনিশ’শ চুরানব্বই’য়ে ঢাকার মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচনের শুরু হয়েছিলো। এর আগে নগরকর্তা নগরের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হবে এমন চিন্তা কারো মাথায় আসেনি। কেনো আসেনি সেটা আজো রহস্য। আজকে যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন তা সেই চুরানব্বইয়ের ধারাবাহিকতাতেই।
যা হোক, রাত পোহালেই নির্বাচন। তবে রাতটা বড় মুশকিলে। ‘মিডনাইট ইলেকশন’ বলে একটি কথা এখন বহুল প্রচলিত। এ কথা অনেকেই বলেন, দিনের ভোট নাকি রাতেই হয়ে যায়। অবশ্য নির্বাচন কমিশন এবার ইভিএম নামক যন্ত্রে ভোটের ব্যবস্থা করেছেন। যে যন্ত্র প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা অ্যামেরিকার অনেক রাজ্যেও বাতিল ঘোষিত হয়েছে। তারা প্রচলিত ব্যালট পদ্ধতিকেই উৎকৃষ্ট মনে করেছে। অ্যামেরিকা ভাবুক তাতে কী। আমরা আমাদের ভাবনা ভাববো। আমাদের নির্বাচনে অন্যদের ধারণা আমরা ধার করতে যাবো কেনো! আমাদের নির্বাচন নিয়ে অন্যদেরও এতো আগ্রহ কেনো! সেইজন্যেই কূটনৈতিক পাড়ার দৌড়ঝাপকে সমঝে করতে বলা হয়েছে।
‘মিডনাইট ইলেকশন’ নিয়ে আলাপ শুরু না করতেই দৈনিক মানবজমিন দক্ষিণের ঊনষাট নম্বর ওয়ার্ডের কদমতলী কেন্দ্রে প্রবেশ নিয়ে বিতন্ডার খবর দিয়েছে। সন্ধ্যা সাতটাতেই একপক্ষ কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলো। সেখানে শাসকদলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা স্লোগান সহযোগে কেন্দ্রে ঢোকার সময় পুলিশ সহযোগে বাধা দিয়েছে শাসকদল মনোনীত প্রার্থীর লোকজন। সেমসাইড বলতে পারেন। এখানে আমাদের বা অন্যদের পার্টি নেই, সবাই এক পার্টি।
‘মিডনাইট ইলেকশন’ এর আরেকটি নামও এখন প্রচলিত, ‘লাইলাতুল ইলেকশন’। রাতের ইলেকশন হিসাবে নামটা এমন হয়েছে। ‘শুদ্ধ ইলেকশন’ হিসাবে অনেকেই আখ্যা দেন এ ধরণেরর ‘মিডনাইট নির্বাচন’কে। পবিত্র এসব নির্বাচনের ফলাফল আগেই ঘোষণা করা হয়। নিশ্চিত করে দেয়া হয় কোন পার্টি জিতবে এবং সেটা ‘আমাদের পার্টি’। এমনকি ভোটের শতাংশের হিসাবও দিয়ে দেয়া হয়। এটা নিশ্চিত দূরদর্শিতা। এমন দূরদর্শি মানুষজনই আমাদের প্রয়োজন। সেই নাকি সফল রাজনীতিক যে আগামি দেখতে পায় এবং সে অনুযায়ী চিন্তা করতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা আরো এগুনো, আমরা দেখতে নই, আগামি তৈরি করতে পারি। অ্যামেরিকাও যা পারে না।
কূটনৈতিক ‘অপতৎপরতা’ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাদের এমন তৎপরতা নজিরবিহীন বলছেন কেউ কেউ। বাঙালের স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে অনেকেরই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ওয়ান/ইলেভেনে কূটনৈতিকদের তৎপরতার কথা আমরা ভুলে বসেছি। ভুলে বসেছি বর্তমানের আগের সংসদ নির্বাচনের পূর্বে কূটনৈতিকদের দৌড়ঝাপের কথা। তখনো বিশেষ দেশের কূটনৈতিকরা বিশেষ তৎপরতা দেখিয়েছেন।
একজন ইতিহাসের অধ্যাপকের আলাপ পড়লাম। একটি দৈনিকের সাথে কথা বলেছেন তিনি। অনেকে সাক্ষাতকার বলবেন একে, বলুন। আমার কাছে মনে হয়েছে আলাপচারিতা। তিনি বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। ইতিহাসবিদরা কি ইতিহাস বিস্মৃত হন! ভোটকেন্দ্রে যাওয়া কি খুবেই সহজসাধ্য কাজ! ওনার মতে এবার সিটি ইলেকশনে উৎসবের মতো কিছু একটা হয়েছে। সুতরাং তার আশা নির্বাচন সুষ্ঠূ হবে। উনার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক। আমরাও ইতিহাসবিদের ইপ্সিত ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রইলাম।
আশার কথা পড়তে-শুনতেই গণমাধ্যম জানালো আরামবাগের ভোটকেন্দ্রে গুলি হয়েছে। গুলির একটা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে লাগায় এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এলাকা অন্ধকার। এই অন্ধকার অনেক কাজের অন্ধকার। হুমায়ূন আহমেদের হিমু যে অন্ধকারের জীবদের কথা বলে, তারা এমন অন্ধকারেই পথে নামে।
কথা বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম লেখাটি শুরু করেছিলাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রত্যক্ষ ভোটের কথা নিয়ে। উনিশ চুরানব্বই থেকে যার শুরু। এই শুরুটা হয়েছিলো খালেদা জিয়ার সময়ে। আজ তিনি দুর্নীতির দায়ে জেলে। মানুষ তাদের নগরকর্তা পছন্দ করার অধিকার পেয়েছিলেন তখন থেকেই। না, এর জন্য কোনো আন্দোলন প্রয়োজন হয়নি। হরতাল, অবরোধ, অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়ার মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আম-পাবলিক ভোট দিয়ে নগরের কর্তা বাছার সুযোগ পেয়েছিলো। বিনা-মাগনায় যা পাওয়া যায় তার মূল্য দিতে আমরা বোধহয় আজো শিখিনি। শিখলে অন্তত অনুশোচনা না হোক আত্মসমালোচনাটা করা যেতো।
এখানে একটি গল্প বলে নেই। এক লোক বাগান থেকে দুই ঝুড়ি আপেল কিনলো। এক ঝুড়ির আপেল মিষ্টি, আরেক ঝুড়ির টক। দুটি ঝুড়িই সে বাজারে নিয়ে গেলো এবং বিক্রির জন্য রাখলো। তবে দামের ক্ষেত্রে একটু দুষ্টু বুদ্ধি খাটালো সেই লোক। মিষ্টি ঝুড়ির আপেলের দাম রাখলো নামমাত্র। আর টক ঝুড়িরর দাম রাখলো বেশি। বাজারের লোকজন দাম বেশি দেখেই ভাবলো ওই ঝুড়ির আপেলই বোধহয় বেশি মিষ্টি। কেউ খেয়ে দেখলো না। এর ফলে টক আপেলগুলি সহজেই বিক্রি হয়ে গেলো। আর বিক্রি না হওয়া মিষ্টি আপেলগুলো নিয়ে গেলো সেই ব্যক্তি নিজে খাবার জন্য। কী বুঝলেন। বোঝার কিছু নেই, গপ্পো তো গপ্পোই।
যারা সব কিছু জানেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভুলে গেছি, তাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ইতিহাসবিদদের ইতিহাস থেকে একটু জানান দিই। ঢাকাকে পৌরসভার ঘোষণার পর থেকেই শাসক মনোনীত ব্যক্তিরাই হতেন পৌরকর্তা। উনিশ’শ নব্বইয়ে ঢাকা পৌরসভা কর্পোরেশনে পরিণত হয়। পদটাও চেয়ারম্যান থেকে উন্নীত হয় মেয়রে। তখনও সেই শাসকের মনোনীত জনই মেয়র হলেন। অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সেই প্রথম মনোনীত মেয়র ছিলেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। উনিশ’শ চুরানব্বই, তখনকার খালেদা সরকার সিটি কর্পোরেশনের কর্তা নির্ধারণের ভার ছেড়ে দিলেন ভোটারদের হাতে। উনিশ’শ চুরানব্বইয়ের ত্রিশে জানুয়ারি নির্বাচন হলো। হেরে গেলো ক্ষমতাশীন বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাস। বিপুল ভোটে জয়ী হলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ। বিএনপির হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছিলো জনগণকে তাদের নগরকর্তা নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে। একশ ত্রিশ বছর আগের সিস্টেম ভেঙে সরাসরি নির্বাচন দিয়েছিলো তারা। এটাই ইতিহাস। ভুলে যাওয়ার উপাখ্যান নয়।
পুনশ্চ : মানুষের বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভুলে যাওয়াটা স্বভাব। কারা কতদিন দক্ষিণ এশিয়া শাসন করেছে তাও ভুলে যায় তারা। কাদের আমলে ভারতীয় উপমহাদেশ সভ্যতার যুগে প্রবেশ করেছে তাও বিস্মৃত হন উনারা। সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে গর্ব করা এই উপমহাদেশের দু’একটা বাদে বাদ্যযন্ত্র, রাগ-রাগিনি সবই যে ধার করা তাও বিস্মৃত হন দক্ষিণ এশিয়ার হালের ইতিহাসবিদরা। ভুলতে ভুলতে সভ্যতা কাকে বলে সেটাও ভুলতে বসেন, বসেছেন তারা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন