’৭৬ সালের মে মাস। ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা মিছিল বেরুবে রাজশাহী থেকে। ১৬ তারিখ মিছিল, আমি তার দু’দিন আগে আস্তানা গাড়লাম। ‘সংবাদ’- এ তখনও আমার চাকুরি হয়নি। তবে খবর-সবর পাঠাই, প্রায় প্রতিদিন তা নামে ছাপা হয়। বার্তা সম্পাদক ছিলেন তখন সন্তোষ দা, মানে এখনকার সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও ‘অনিরুদ্ধ’ নামের প্রখ্যাত কলামিস্ট শ্রী সন্তোষ গুপ্ত। ‘আজাদ’ যখন বন্ধ, অনেকের মতো বেকার, একটি কীটনাশক ওষুদ কোম্পানীতে চাকুরি করি, সন্তোষদাকে চিঠি লিখলাম একটা চাকুরি পাওয়া যায় কি-না! সন্তোষদা পোস্টকার্ড পাঠালেন কয়েক লাইনের, যা অর্থ দাঁড়ায় ‘সংবাদ’- এর জন্য উত্তরাঞ্চলভিত্তিক খবর ও ছবি পাঠাতে পারেন, ভালো হলে ছাপা হবে, কিন্তু চাকুরির ব্যাপারে আমি কোনো সুপারিশ করতে পারবো না, আপনার নিজের কাজের যোগ্যতায় যদি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আদায় করতে পারেন, করুন। পরে শুনলাম, ‘সংবাদ’- এ এখন কোনো পদ-ই খালি নেই, পত্রিকা বন্ধ থাকার পর কেবলই খুলেছে, পুরাতনদেরই অনেককে এখন পুনঃনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
তবু কাজ শুরু করে যেতে লাগলাম। রোজ রোজ খবর আর ছবি-ফিচার পাঠাই, বেশ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। নিয়োগপত্র না থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়কটি ‘আইটেম’ সন্তোষ দা ‘লীড’ (প্রধান শিরোনাম) হিসেবে ছাপালেন। উৎসাহ বেড়ে গেলো, কাজের যোগ্যতা দেখিয়েই ‘সংবাদ’-এ ঢুকতে হবে। পকেটের পয়সা খরচ করে এদিকে ওদিকে ট্যুর শুরু করলাম। ব্যাপারটা জেদের মতো হয়ে দাঁড়ালো। এমন সব খবর আর ছবি পাঠাবো, ‘সংবাদ’ যেনো ছাপতে বাধ্য হয়। এজন্যে অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে, পত্রিকা কি ধরনের নিউজ চায়, তার পলিসি কি।
ফারাক্কা মিছিলের খবর শুনে এসে পৌছুলাম রাজশাহী শহরে। কিন্তু নিয়োগপত্র ছাড়া একজন সাংবাদিক, কোথায় পাত্তা পাবো? তাছাড়া ‘সংবাদ’ থেকে দু’জন ঝানু রিপোর্টার আর দু’জন ফটোগ্রাফার ইতিমধ্যেই রাজশাহীতে পাঠানো হয়েছে মিছিল কাভার করার জন্য। তাদের সাথে কথা বলাও মুশকিল, পাত্তা দিতে চায় না। ঢাকা থেকে আসা নামী-দামী সাংবাদিকদের সাথে ওঠা-বসা, কথা-বার্তা, ভীষণ এক ব্যাপার। আমি তাদের পাশে পাশে ঘুরতাম, ভয়ে ভয়ে, বিনয়ের সাথে। তাদের চলা-ফেরা, কথাবর্তা, অঙ্গভঙ্গি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম আর অবাক হয়ে যেতাম! আহ্ কী রকম সুন্দর এই ঢাকার সাংবাদিক! কি রকম কায়দা করে হাঁটে, কি রকম কথা কয়! আমি যদি এরকম হতে পারতাম!
‘সংবাদ’ থেকে আসা একজন রিপোর্টার, পরে আমার সহকর্মী হয়েছিলেন, আমাকে বলেন দোকান থেকে সিগারেট কিনে আনতে। আনি। পান আনতে বলেন। আনি। ফটোগ্রাফার জানতে পান, রাজশাহী শহরে ‘ইয়ে’ মানে কোথায় পাওয়া যায়। হাত ইশারা করে বেঁটে-খাটো বোতলের আকার বোঝান তিনি। বুঝতে পারি। বিনয়ের সাথে দেখিয়ে দেই। আরেকজন, হাতের তালু গোল করে জানতে চান, এখানে ‘ইয়ে’ পাওয়া যায় না? বুঝতে পারি তিনি কি চান। মনে মনে বলি, সাংবাদিকতা করতে এসে মদ-বেশ্যার দালালী করতে হবে নাকি? কিন্তু মুখে বিনয়ী থাকি। প্রতিবাদ করলে যদি বলে দেয় যে, ছেলেটি কথা শোনে না। আমার তো সবার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। চাকুরি চাই, নিয়োগপত্র পেতে হবে।
১৬ মে মিছিল শুরু হয়। মিছিলের আগে মাদ্রাসা ময়দানে জনসভা। ভাসানী এলেন নীল গাড়ীতে চেপে। জনসমুদ্র গর্জে উঠলো। খুব অল্প সময়ের জন্য তিনি বক্তৃতা করলেন। বহু সাংবাদিক, বহু ফটোগ্রাফার। এর ভেতর কোন রকমে কয়েকটি ছবি তুললাম মঞ্চের নিচ থেকে। মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম, উঠতে দেয়নি, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে নিচে। আপনি কোন্ পত্রিকার? পরিচয় দিতে পারি না। নিয়োগপত্র নেই, নেই পরিচয়পত্র। মঞ্চে ভাসানীর বক্তৃতার পর চলে এলাম রাস্তায় এই রাস্তা ধরেই ভাসানী এগিয়ে যাবেন, অর্থ্যাৎ
তাঁর নেতৃত্বে মিছিলটি শুরু হবে। আমার ছবি তোলার আদৌ প্রয়োজন নেই, তার ওপর ছোট্ট ভাঙ্গা ক্যামেরা। তবু ছবি তুলছি একের পর এক। আসলে নিছক একটা খেয়াল কাজ করছিলো।
ভাসনী মঞ্চ থেকে রাস্তায় নামলেন। ফটোগ্রাফাররা দৌড়ে গিয়ে উঠলেন একটা হুডখোলা জীপের ওপর। এই জীপটি মিছিলের আগে আগে যাবে। জীপ থেকে মিছিলের ছবি তোলা হবে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো অন্যরকম। জীপের ড্রাইভার ভুলে নাকি অজ্ঞাতবশতঃ গাড়ীটির মুখ ঘুরিয়ে নিলো পূর্ব দিকে। অর্থ্যাৎ মিছিল যেদিকে যাচ্ছে তার ঠিক উল্টোদিকে। তারা ‘গাড়ী ঘোরাও’ ‘গাড়ী ঘোরাও’ বলে চিৎকার জুড়লো। কিন্তু মিছিলের মানুষ বানের তোড়ের মতো ধেয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ। প্রচন্ড ভীড় আর চাপ। জীপ ঘোরানো অসম্ভব। কি আর করে তারা। জীপ থেকে লাফিয়ে নেমে মিছিলের অগ্রভাগে ছুটলো, কিন্তু মানুষের বানে এগোনো অসম্ভব ব্যাপার। আর ভাসানীকে সামনে নিয়ে মিছিলটি ইতিমধ্যে এগিয়ে গেছে সামনে, আধ মাইল মতো।
আমি দেখলাম ভাসানীকে সামনে রেখে ছবি পাওয়া আমাদের ফটোগ্রাফারদ্বয়ের পক্ষে অসম্ভব। অথচ, এ রকম ছবি তোলা আছে আমার ক্যামেরায়। ভাসানী মঞ্চ থেকে নামবার সাথে সাথে ভাসানীসহ মিছিলের তুলে রেখেছি। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম এই ছবি নিয়ে এক্ষুণি ঢাকার পথে রওনা হবো। রাত বারোটার আগে পৌঁছুতে পারলেও ছবিটি হয়তো ধরানো যাবে। মিছিল এগুতে লাগলো, আর আমি মাদ্রাসা থেকে সোজা চলে এলাম উল্টোদিকে, নাটোর বাসস্ট্যান্ডে। নাটোর থেকে ঈশ্বরদী যাবো দু’টোর ‘রকেট’ ধরে তারপর আবার বাসে করে পাবনা হয়ে নগরবাড়ী ঘাট। পকেটে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা। আমি মোটামোটি একটা ধারণা করে নিলাম যে, পরিস্থিতি যা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ‘সংবাদ’-এর ফটোগ্রাফার দু’জনের মধ্যে কারোই সম্ভব নয় ছবি বা ফিল্ম ঢাকায় পাঠানো। (অবশ্য, অন্যান্য পত্রিকায় ফিল্ম গেছে বিবিসি প্রতিনিধির গাড়ীতে)।
নাটোর বাস স্ট্যান্ডে আসবার সাথে সাথেই দেখি একটা লোকাল বাস ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চেপে বসলাম। ঠিক দু’টোয় নামলাম নাটোর স্টেশনের পাশের রাস্তায়। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিলো, সেই সাথে ঝড়ো বাতাস। তাকিয়ে দেখি, রকেট ট্রেনখানা প্লাটফরম থেকে কেবলি ছেড়ে দিয়েছে। এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। স্পীড নেবে। মহা মুশকিল। এই ট্রেন ধরতে না পারলে ঈশ্বরদী পৌঁছানো অসম্ভব, আর কোনো উপায় নেই। কি করি! সোজা এসে দাঁড়ালাম রেল লাইনের ওপর। ইঞ্জিনখানা এগিয়ে আসছে, ড্রাইভারের মুখ দেখা যায়, তিনি মুখখানা কাত করে আমাকে দেখছেন। আমি একেবারে বেপরোয়ার মতো দাঁড়িয়েছি, যেনো ট্রেন থামাতেই হবে। এই অবস্থায় আমি ইঞ্জিনের সামনে দু’হাত জোর করে দাঁড়ালাম। কাঁধের ক্যামেরাটি উচিয়ে দেখালাম তাকে। ড্রাইভার সাহেব, পরে পরিচয় হলো, ননবেঙ্গলি, পার্বতীপুরে বাড়ী, তার এক ছেলে আমাদের সাথে পড়তো, তিনি, লক্ষ্য করলাম গাড়ীর গতি কমিয়ে এনেছেন। লাইন থেকে সড়ে দাঁড়ালাম। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ট্রেনখানা দাঁড়িয়ে পড়লো। লাফিয়ে উঠলাম ইঞ্জিনে, ড্রাইভার সাহবের আঁটো ঘরটিতে। ‘কেয়া হুয়া’? বাংলা উর্দুতে কোনোরকমে বোঝালাম আমার পরিচয় আর ঈশ্বরদী যাবার প্রয়োজনীয়তা। ভাসানীর কথা শুনে ড্রাইভার সাহেব খুব খুশি। একবার ভাসানী গিয়েছিলেন পার্বতীপুরে, মিটিং করেছিলেন, সেখানে নাকি হাজির ছিলেন ইব্রাহীম নামের ঐ ড্রাইভার। ট্রেন চালাতে চালাতে সেই গল্প শোনালেন। আমার মাথায় তখনো ঝড় বইছে। যেভাবেই হোক, রাত বারোটার আগে ঢাকা পৌঁছুতে হবে।
ঢাকায় পৌঁছুলাম এগারোটায়। অফিস তখন বংশালে, সেখানে যেতে যেতে সাড়ে এগারোটা বাজলো। দেখি, সন্তোষ দা তাঁর টেবিলে বসে আছেন দু’হাতে মাথা গুজে। রাজশাহী থেকে ছবি তো পাননি, কোনোরকম খবরও এসে পৌঁছায়নি।
আমি আদাব জানালাম। ফিরে তাকালেন সন্তোষ দা। আমাকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, জড়িয়ে ধরলেন বুকে। বললেন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি। এই বলে, নিজেই অফিসের বাইরে চলে গেলেন সন্তোষ দা। একটু পরেই নান আর গরুর মাংস এলো। আর চা। আমি লিখতে বসলাম। লেখার পর খাওয়া।
পরদিন ‘সংবাদ’-এর প্রথম পাতায় ফারাক্কা মিছিলের লীড নিউজ এলো ছয় কলাম জুড়ে। খবরটি ছাপা হলো নামে। দু’টি ছবিই ছাপা হলো নাম দিয়ে। রাতে, অফিসেই পত্রিকার ফাইলের ওপর শুয়ে থাকলাম। আনন্দে ঘুম আসেনা।
সকাল বেলাই টেলিফোন। সন্তোষ দা বাসা থেকে ফোন করেছেন। জানালেন, আহমদুল কবির সাহেব আমার সাথে কথা বলতে চান। ঠিক এগারোটায় অফিসে আসবেন তিনি। আমি যেনো হাজির থাকি।
অপেক্ষা করছি। সময় মতো এলেন কবির সাহেব। ডাকলেন কামরায়। দরজা ঠেলে ঢোকার সাথে সাথে প্রথম কথা, ‘তোমার কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। কি চাও তুমি? এই শুনে, হাঁটু বুক গলা তিন-ই কেঁপে উঠলো আমার। মিনমিনে কণ্ঠে বললাম, ‘একটা চাকুরি।’
[লেখাটি বগুড়া থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন- ‘স্পর্ধায়’ প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরে লেখাটি আবার প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের গণমাধ্যম সাময়িকী ‘নিরীক্ষা’তে মার্চ-এপ্রিল ১৯৯৬ সংখ্যায়।]