আজ ১২ই সেপ্টেম্বর অভিজিত রায়ের ৪৪তম জন্মদিন। তরুণ যুবক বিজ্ঞান লেখক এবং প্রখর যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক অভিজিৎ রায়’কে দু’বছর আগে ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে ইসলামের পতাকা বহনকারী দুষ্কৃতিরা হত্যা করে। ফলে একটা বিরল প্রতিভাবান, প্রবল সম্ভাবনাময় এবং স্বমহিমায় ভাস্বর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন-স্পন্দন অকালে চিরতরে থেমে গিয়েছে সেদিন আল্লাহর পিয়ারা সন্তানদের চাপাতির আঘাতে। তাই আজকে বড়োই অসময়ে বেদনাহত মন ও হৃদয় নিয়ে অভিজিতকে আমাদের স্মরণ করতে হচ্ছে তাঁর জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে। আলোচনা করতে হচ্ছে তাঁর জীবন, কর্ম, লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে। পর্যালোচনা করতে হচ্ছে কেনো তাঁকে হত্যা করা হলো, কী তাঁর অপরাধ ছিলো, কেনো হত্যাকারীরা আজো শাস্তি পেলো না?
শুধু অভিজিৎই তো মুহাম্মদের পিয়ারা উম্মতদের ঈমানি-চাপাতির কোপে নিহত হয় নি। নিহত হয়েছেন আহমেদ রাজীব হায়দার, নীলয় নীল, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নিজামুদ্দিন, ফয়সাল আরেফিন দীপন, জুলহাস মান্নানসহ প্রমুখ উজ্জ্বল প্রাণবন্ত তরুণ যুবকরাও। এঁদের সকলকেই প্রায় একইসময়ে – অভিজিতের আগে বা পরে – হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে। অভিজিৎ ছাড়া এঁদের কাউকেই আগে চিনতামনা, জানতাম না। এঁদের পরিচয় জানতে পারি নিহত হওয়ার পরই। জানতে পারি যে, এই তরুণরা ছিলেন চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, মনমানসিকতা, মননশীলতা ও নৈতিকতার দিক থেকে অভিজিৎ রায়ের শ্রেণিভূক্ত মানুষ। সবাই বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদে। বিশ্বাস করতেন মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তভাবনার দর্শনে। বিশ্বাস করতেন যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতায়। ঈশ্বর ও ঈশ্বরতত্ত্বে, ভাববাদ ও ভক্তিবাদে, গুরুবাদ ও দূতবাদে (প্রফেটতত্ত্বে) এবং বিশ্বাসের দর্শনে বিশ্বাস করতেন না কেউই।
গণতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ কী দোষের? মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তভাবনা কী দোষের? আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল তত্ত্বে অবিশ্বাস করা কী দোষের? হ্যাঁ, বাংলাদেশে এসবই দোষের। কারণ তাঁদের হত্যা করা হয়েছে সেই দোষের শাস্তি দিতেই। হত্যাকারীরা সে কথা জানিয়েছে গর্বভরেই। হত্যাকাণ্ড লুকিয়ে চুরিয়ে করলেও নাস্তিক ব্লগারদের যে ওরা হত্যা করবে সে কথা লুকিয়ে রাখে নি। কাকে কাকে হত্যা করবে তার একটা খতম তালিকা -সে তালিকা মাঝে মাঝে হাল-নাগাদ করেছে – তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সরকার সব জেনেও লিস্টে যাঁদের নাম আছে তাঁদের নিরাপত্তা প্রদান করা কিংবা খতম তালিকা তৈরি করে যারা হত্যার হুমকি দিয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেবার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে নাস্তিকতার চর্চা করা একটা অপরাধ এবং তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা সরকারের কর্তব্য নয়।
মূল কথা হলো, বাংলাদেশের সংবিধান যাই বলুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নাস্তিকতার চর্চা করা ও ধর্মের সমালোচনা করা একটি গুরুতর অপরাধ। না, এটা শুধু অভিযোগ নয়, এটা চরম বাস্তব। কারণ, আমরা গভীর বেদনার সাথে লক্ষ করেছি যে, নাস্তিক ব্লগারদের হত্যা করা যখন একসময় প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে কোনো আগ্রহই দেখান নি, এমনকী তিনি একবারও ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডগুলোর নিন্দা করেন নি। আমেরিকা প্রবাসী এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লেখক অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা চেপে ধরেছিলেন এই বলে যে, তিনি অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছেন কী না? সে প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়ে ছিলেন, তিনি নাস্তিকদের হত্যার নিন্দা করবেন না।
প্রধানমন্ত্রী মুখ ফস্কে এ কথা বলে ফেলেছেন বলে বিষয়টাকে লঘু করে দেখলে ভুল হবে। আসল কথা হলো, তাঁর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। ফলে তিনি প্রথমে নিজেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারেন না। ভাবেন, তিনি আগে একজন ঈমানদার মুসলিম নারী, তারপর দেশের প্রধানমন্ত্রী। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অগভীরতা ও অপ্রসারতার কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আসনকে তাঁর ধর্ম পরিচয়ের ওপর স্থাপন করতে সক্ষম হন নি। ফলে নাস্তিকদের হত্যাকাণ্ডকে প্রধানমন্ত্রীর চোখে না দেখে, দেখেন একজন মুসলিম নারীর চোখে। তাই পর পর নাস্তিক ব্লগারদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবরেও তিনি বিচলিত হন না, বিচলিত বোধ করেন না; তাদের হত্যাকাণ্ডে তিনি মুসলিম দুষ্কৃতিদের দোষ বিশেষ দেখতে পান না। বরং তিনি মনে করেন যে, মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্যেই তারা খুন হচ্ছে। তাই তিনি হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যে বিশেষ ভাবিত নন, বরং তারচেয়ে অনেক বেশি ভাবিত কীভাবে নাস্তিক ব্লগারদের বিচারের আওতায় নিয়ে তাদের কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দেওয়া যায়। তিনি যে সত্যিই এটা ভাবছেন তা ক্রমশঃ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের আধিকারিকের কথায়। ২০১৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করেছিলো জিহাদিরা। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের একজন সাংবাদিকের প্রশ্নে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান রাখ-ঢাক না করেই বলেন যে,
একইরকম হুঁশিয়ারি দেন পুলিশের আইজিপি এ,কে,এম শহিদুল হকও। নীলয় নীলের হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয় ২০১৫ সালে। সেই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রেস বিবৃতি দিতে গিয়ে নাস্তিক ব্লগারদের উদ্দেশে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন,
“আপনারা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না। লিখতে গিয়ে সীমা লংঘন করবেন না।”
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম তো খোলাখুলিই ঘোষণা দিয়েছেন যে, নাস্তিক ব্লগারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি প্রায় ওই একইসময়ে ঘোষণা দেন যে,
সরকারের এই ভূমিকার জন্যেই মুসলিম উগ্রবাদীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে নাস্তিক লেখক ও ব্লগারদের অবাধে হত্যা করতে পারে এবং হত্যাকারীদের কোনো শাস্তি হয় না।
বাংলাদেশ শুধু নাস্তিকদেরই বধ্যভূমি কিন্তু নয়। কারণ, মঠ-মন্দির-গির্জায় হামলা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের লুট, ধর্ষণ ও হত্যা করার ঘটনা তো প্রায় নিয়মিতই ঘটে। এ বিষয়ে প্রশাসন সূত্রে সম্প্রতি জানা গেছে মুসলিম মৌলবাদীদের খতম তালিকায় মন্দির, মঠ ও গির্জার প্রধান, বিদেশি নাগরিক, প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরও নাম রয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নির্দেশনায় এবং বিএনপি-জামাতের অর্থায়নে শিবিরের কর্মীরা সারাদেশে একের পর এক টার্গেট কিলিং ঘটাচ্ছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন,
“ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সারা দেশে একের পর এক টার্গেট কিলিং হচ্ছে। তারা প্রাথমিকভাবে পুরোহিত, ধর্মগুরু, যাজক, ভান্তেসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতাধিক ব্যক্তিকে টার্গেট করেছে। … এসব হত্যাকাণ্ডের অর্থদাতা হিসেবে কাজ করছে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর পরিবার ও জামায়াত-বিএনপিপন্থী অর্ধশত ব্যবসায়ী।”
টার্গেট কিলিং-এর ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু টার্গেট কিলিং হচ্ছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনায় এমন দাবী শিশুসুলভ ও হাস্যকর। কারণ, মুহাম্মদ বলেছেন, মুসলিম ভূখণ্ডকে পবিত্র করার জন্যে অবিশ্বাসীদের (মুশরিকদের), প্রগতিশীল মুসলমানদের (মুনাফেকদের) এবং নাস্তিকদের (মোরতাদদের) বিরুদ্ধে জিহাদ (যুদ্ধ) করা মুসলমানদের ঈমানি কর্তব্য। আর জিহাদ মানে তো – হয় আত্মসমর্পণ করো, না হয় দেশ ছাড়ো, না হয় মৃত্যু বরণ করো। স্বয়ং মুহাম্মদ নিজেই মদিনা থেকে ইহুদিদের বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। আর বনু কুরাইজা গোত্রের ৮০০/৯০০ পুরুষ ইহুদির গলা কেটে হত্যা করেছিলেন এবং সমস্ত নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস করে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। এভাবেই মুহাম্মদ ইহুদিদের নির্মূল করে মদিনাকে পবিত্র করেছিলেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ২য় খলিফা ওমর ফারুক মুহাম্মদের পথেই সৌদি আরবকে মুশরিকশূন্য করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের মাটিতে পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকেই ঈমানদার মুসলমানরা মুহাম্মদের সেই নির্দেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। যার ফলশ্রুতি হলো হিন্দু জনসংখ্যা ২২% থেকে ৮.৫% শতাংশে নেমে যাওয়া। সুতরাং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চলছে ইসরায়েলের নির্দেশনায়, এমন দাবী অবান্তর। বরং এই অবান্তর দাবীর আড়ালে হাসিনার সরকার একটি তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে। সেটা হলো – সংখ্যালঘুদের হত্যাযজ্ঞে বিএনপি-জামায়াতের যেমন যোগ রয়েছে, তেমনই যোগ রয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগেরও।
বাংলাদেশের মাটিতে একটা বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (সমস্ত অবিশ্বাসীগণ) ও প্রগতিশীল মুসলমানরা মুসলিম জঙ্গী সংগঠনগুলোর কাছে বধযোগ্য শত্রু হলেও তারা কিন্তু প্রকাশ্যে সে কথা ঘোষণা করে না, ওটা ওদের গোপন এজেন্ডা। কিন্তু নাস্তিকরা যে তাদের প্রধানশত্রু এবং তাদের সমূলে উৎখাত করতে চায় সেটা তাদের ওপেন এজেণ্ডা। এ ব্যাপারে সমস্ত মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনই – কী কম উগ্র কী বেশী উগ্র -নাস্তিকদের প্রধান শত্রু বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে যখন লং মার্চের ডাক দিয়েছিলো তখনও তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো এই নাস্তিক ব্লগাররাই। সরকারের কাছে তারা দাবী করেছিলো, এমন একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে নাস্তিকদের একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। হাসিনা সরকার কঠোর হাতে লং মার্চের অভিযানকে ব্যর্থ করেছিলেন। কিন্তু পরে হেফাজতে ইসলামের সাথে সন্ধি করে এবং তাদের অনেক দাবীই মেনেও নিয়েছে। তাদের দাবীর ভিত্তিতেই বেশ কয়েকজন নাস্তিক ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়েছিল এবং এখনও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকার যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিত্যাগ করেনি।
কিন্তু নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আইন প্রণয়নের যে দাবী হেফাজতে ইসলাম জানিয়েছে তা এখনও পূরণ না হওয়ায় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হবে বলে তারা ইতোমধ্যে সরকারকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। হেফাজতের প্রধান আল্লামা শফি আহমেদ প্রকাশ্য ধর্মীয়সভায় পূনরায় ঘোষণা দেন, নাস্তিকরা ইসলামের প্রধান শত্রু এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্যে প্রস্তুত থাকতে তাঁর অনুগামীদের তিনি নির্দেশও দেন। তিনি ঠিক কী বলেছেন তা শোনা যাক –
“Those who oppose any of the five pillars of Islam are atheists. Get ready (fellows). You will have to participate when we wage a war against the atheists.”
এমনকী হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফি আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন,
“নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
নাস্তিকরা তো তাদের প্রধান শত্রুই হবে। কারণ, সকল ধর্ম (Religion) ও ধর্মীয় মৌলবাদের বীভৎস অমানবিক ও কুৎসিত রূপ তো উন্মোচন কেবল নাস্তিকরাই করে। আইএস, বোকো হারাম, মুসলিম ব্রাদারহুড, আল হামাস, আল কায়দা, তালিবান, লস্কর-ই-তৈবা, জেএমবি প্রভৃতি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর হিংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার লোকের বা প্রতিষ্ঠানের অভাব দেখিনা। কিন্তু প্রতিবাদকারীরা আবার একইসঙ্গে ইসলামের প্রশংসা করতেও ভুল করেন না। তাদের বক্তব্য হলো, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে হিংসার জায়গা নেই। তারা আরও বলেন যে, এক ধরনের উগ্র আলেম সমাজ জিহাদের যে তত্ত্ব দিচ্ছে তা তাদের মনগড়া এবং তারা যা করছে তাতে ইসলামের বদনাম হচ্ছে। যারা বিশ্বজুড়ে ইসলামি সন্ত্রাসের এরূপ বাখ্যা দিচ্ছেন তারা মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি করছেন যা নাস্তিক লেখক ও ব্লগাররা কখনও করেন না। যারা ইসলাম ও ইসলামি মৌলবাদ নিয়ে মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি করেন তারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা, বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা – এসব নিয়েও মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি করেন।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, যে দেশে রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর ধর্মের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বিদ্যমান থাকবে সে দেশে বহুমতের স্থান থাকা সম্ভব নয়। বহুমতের সহাবস্থানের পরিবেশ ও পরিসরের জন্যে প্রয়োজন সর্ব্রাগ্রে ভিন্নমত ও বিরুদ্ধমতকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর উদারতা ও শিক্ষা। প্রয়োজন যুক্তি দিয়ে ভিন্ন ও বিরুদ্ধমতকে খণ্ডন করার বা মতৈক্য গড়ে তোলার ধৈর্য ও সহনশীলতা। কোনো ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্ম থেকেই সে উদারতা, ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা আশা করা যায় না। হিন্দু ধর্মে যেমন ব্রাহ্মণ ও শুদ্রের মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও বন্ধুত্ব আশা করা যায় না, তেমনি ইসলাম ধর্মেও মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে কিংবা মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব আশা করা যায় না। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা ও ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা হলো ধর্ম। এ কথা অকপটে বলে শুধু নাস্তিকরাই। তাই তারাই ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রধান শত্রু।
নাস্তিকরা রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-নেত্রীদের কাছেও শত্রু। কারণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দাবীতে তারা সর্বদা সোচ্চার। সোচ্চার রাষ্ট্রের দমননীতি ও দমনপীড়নের বিরুদ্ধে এবং বাক-স্বাধীনতা ও অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। নারীর স্বাধীনতা ও মুক্তি এবং নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নেও নাস্তিকরা সরব। নাস্তিকরা কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এবং যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার নিরন্তর প্রচার করে যা সব শাসক দলেরই ঘোরতর অপছন্দ। সারা বিশ্বজুড়ে নাস্তিকরা এই ভূমিকা পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাস্তিকদের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে একদিকে যেমন ধর্মান্ধ উগ্রবাদী সন্ত্রাসী মুসলিমদের আধিক্য ও আধিপত্য বিদ্যমান, তেমনি তার বিপরীতে নাস্তিকদের সরব ও সক্রিয় উপস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় (এই সময়ে অবশ্য রাষ্ট্র ও মুসলিম মৌলবাদীদের যৌথ আক্রমণে তারা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন)।
বাংলাদেশের মাটিতে নাস্তিক লেখক ও ব্লগারগণ ইসলাম ধর্মের অসহিষ্ণুতা, হিংসা ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশের প্রকৃত স্বরূপ যেভাবে উন্মোচন করে থাকেন তার তুলনা হয় না। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাদের ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন এবং মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তভাবনার পক্ষে যেরূপ চর্চা তাদের করতে দেখি তা আমাকে মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের বুকে নাস্তিক ব্লগারদের অসংখ্য ব্লগ, ওয়েবসাইট, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্যাদি রয়েছে যার সাহায্যে তারা একদিকে নিরন্তর সকল ধর্মের, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের আসল গণতন্ত্রবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, শান্তিবিরোধী এবং বিজ্ঞানবিরোধী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুৎসিত ও বীভৎস চেহারাটাকে উন্মোচন করে চলেছেন, আর একদিকে জনগণের মধ্যে প্রচার করে চলেছেন মুক্তচিন্তা, মুক্তভাবনা ও মুক্তবুদ্ধির দর্শন। নাস্তিকরা এই কাজ করে চলেছেন ধর্মাশ্রিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসহিষ্ণু অনুদার সমাজটা আমূল বদলে একটি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং বহুত্ত্ববাদী একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নির্মাণ করার লক্ষ্যে। এই কাজ সব রাষ্ট্রপ্রধানকেই ক্ষুব্ধ করে, হাসিনাকেও ক্ষুব্ধ করেছে, আগে যেমন ক্ষুব্ধ করেছিলো খালেদাকে।
বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগার ও লেখকদের প্রসঙ্গে আলোচনা করলে যাকে বাদ দিয়ে আলোচনা করা যায় না তিনি হলেন অভিজিৎ রায়। অভিজিত ছিলেন এ যুগের অন্যতম মুক্তচিন্তক। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা, প্রতিভা ও তীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে ধর্ম, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের চলমান ধারার বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমস্কতা ও বহুত্ববাদের একটা বিকল্প ধারা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি এটা বুঝেছিলেন যে, একক প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব নয়, এটা করতে হবে যৌথ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। সেজন্যই তিনি ২০০১ সালে গড়ে তুলেছিলেন সমমনস্ক ও সমমনোভাবাপন্ন যুক্তিবাদী মানুষদের নিয়ে একটা আন্তর্জালিক ব্লগিং প্লাটফর্ম যার নাম ‘মুক্তমনা’। অভিজিতের পাণ্ডিত্য, কঠোর পরিশ্রম ও সাংগঠনিক নিপুণতায় ‘মুক্তমনা’ খুব অল্প সময়েই বাঙালি বিজ্ঞান লেখক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীদের একটি বিশ্বস্ত প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছিল। একটি মানবকল্যাণকামী সুষ্ঠু ও সভ্য মানবসমাজ নির্মাণে মানবমনের বৌদ্ধিক বিকাশে ‘মুক্তমনা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনৈতিক মৌলবাদসহ সমস্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে হত্যা করবে বলে সংকল্প ও পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসারে তারা আড়াই বছর আগে তাঁকে হত্যা করে। ‘মুক্তমনা’ ব্লগে ও ওয়েবসাইটে স্বভাবতই তৈরি হয়েছে বিরাট শূন্যতা, সে শূন্যতা পূরণ করা বেশ কঠিন। এতদ্বসত্বেও সমমনা অন্যান্য কমিউনিটি ব্লগগুলোর মধ্যে অনেকেই অভিজিতের অসমাপ্ত লড়াইসমূহ অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন। আশা করবো অভিজিতের শূন্যস্থান পূরণ করতে তাঁর উত্তরসুরীরা কঠোর পরিশ্রম করবেন এবং মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অভিজিৎ রায় মুক্তমনার যে মশাল জ্বালিয়ে গিয়েছেন তাকে সমুন্নত ও সমুজ্জ্বল রাখাই হবে তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন। আমরা যদি স্ব স্ব ক্ষেত্রে কাজ করেই মুক্তমনা ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণের জন্যে, আমাদের কাজে আরো বেশী আত্মনিবেদন করতে পারি, তবে আমাদের কাজের মধ্যেই অভিজিৎ বেঁচে থাকবেন এবং আজকে আমাদের সেই সংকল্পই নিতে হবে।
– গিয়াসুদ্দিন
কলকাতা, ভারত, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭