৮৫৭ বার পঠিত
প্রগতিশীলতা শুধু ঘরের চৌকাঠের বাইরের জিনিস নয়, নিজের ঘরের ভিতরেও এর চর্চা করতে হয়। এরকম একটি তার্কিক আলোচনা থেকেই ২০০৮ সালের প্রথম দিকে অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ থেকে আমি অনিয়মিত হয়ে যাই। যদিও ২০০৫ থেকেই অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’য় প্রায় নিয়মিতভাবেই লিখে এসেছি। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাসভূমি’ই তখন একমাত্র পাক্ষিক অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা। সেখানে প্রকাশিত একটি লেখা দেখে অভিজিতই আমাকে বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন মুক্তমনায় লিখতে। অভিজিতের অনুরোধ ফেলা সম্ভব হয়নি।
মুক্তমনা’য় অনিয়মিত হ’বার বিষয়টির সূত্রপাত ‘মুক্তমনা’র তখনকার এক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যকে নিয়ে। আমি সে ভদ্রলোকের অনেকগুলো লেখা অভিজিতকে পাঠিয়ে বলেছিলাম,এ ভদ্রলোক কীভাবে ‘মুক্তমনা’র উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হোন? কেননা, লেখায় ভিন্নমতের স্বাধীনতা যে কারুরই আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু ‘মুক্তমনা’ যখন একটি বিশেষ আদর্শকে ধারণ করে, তাই সে আদর্শের যে প্লাটফর্ম তার সংগঠকদের মধ্যে এ ধরনের ধোঁয়াশে চরিত্রের মানুষের নাম থাকা যথোচিত নয়। আমার যুক্তিটি তখন অভিজিতের পছন্দ হয়নি, আর কোনরূপ কথা না বাড়িয়ে আমিও মুক্তমনা থেকে সরে এসেছিলাম। আমার আগে ও পরে অনেকেই ‘মুক্তমনা’য় নিষ্ক্রিয় হয়েছিলেন এরকম অনেক ভিন্নমত ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে। কিন্তু মুক্তমনার সাথে আত্মিক সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি এক মুহুর্তের জন্যও; পারস্পরিক ভাললাগার ব্যত্যয় ঘটেনি আমাদের কখনোই।
বেশ কিছু পরে অভিজিৎ সে ভদ্রলোককে ‘মুক্তমনা’ থেকে শুধু সরিয়েই দেননি, তাঁকে নিজের ফেইসবুকেও ব্লক করেছিলেন বলে জেনেছি। যদিও ফেইসবুকের বন্ধু তালিকায় কে কা’কে রাখবেন সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়; কিন্তু এখনো বিশ্বাস করি ‘মুক্তমনা’র মতো সাইটে ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে অস্বচ্ছ (ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত) ধারণার মানুষদের সম্পাদনা পরিষদে না রাখাই যথার্থ হয়েছে।
এরপরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অভিজিতের আরেকটি লেখায় কিছু শব্দ প্রয়োগ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতান্তর ঘটেছিল। সেসময়ে স্বীকার না করলেও পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্যান্য লেখায় অভিজিৎ একটু সাবধানী হয়েছিলেন বলেও আমার মনে হয়েছে। কেননা, আমি বিশ্বাস করি দু’একটি প্রবন্ধ কিংবা বই পড়ে রবীন্দ্রনাথের মতো এত বিশাল প্রতিভাকে নিয়ে বিপরীত স্রোতে কলম ধরা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আমরা অনেকেই সেসময় এ কথাই বলতে চেষ্টা করেছিলাম যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের লেখার জন্য তাঁকে অনুতাপ কিংবা অনুশোচনা করতে হ’তে পারে। অভিজিৎ আমাদের অনেকের ধারণাকেই ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ওপর গবেষণামূলক একটি বিশাল বই লিখে ফেলেছেন সেবারের বইমেলায়। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে লেখায় যিনি সিদ্ধহস্ত তাঁর কাছে সাহিত্য, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো বহুগবেষিত লেখকের বিষয় নিয়ে লেখা বইটি না পড়লেও, বইটির সমালোচনা পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি।
সাহিত্য নিয়ে উৎকর্ষ লেখা লিখলেও অভিজিতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিজ্ঞান-দর্শন-ধর্মসহ সাধারণের বোধের বাইরের জটিলতম বিষয়গুলোকে সহজ ও সাবলিল ভাষায় যুক্তিগ্রাহ্য করে উপস্থাপনের চেষ্টা। সেইসাথে বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা বিষয়কে আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরে এর ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে পাঠকের মনঃসংযোগ ঘটানো। অভিজিতের লেখার প্রধান শক্তি এই যে, এতে একদিকে যেমন মনে এক দ্বন্দ্বমূলক ভাবের অবতারণা হয়, অন্যদিকে ভাবনার মূলে সংশয় ও জিজ্ঞাসা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে অন্ধবিশ্বাসের।
কিন্তু অভিজিতের লেখার পাঠককেও পাঠপূর্ব অনুশীলনের দরকার পড়ে, প্রয়োজন হয় একধরনের পাঠ্যাভাসেরও। অভিজিৎ রায়ের লেখা না পড়ে যতটা বিপক্ষে মন্তব্য করা যায় কিন্তু পড়লে সেটা হয়তো সম্ভব নয়। তাই যে মৌলবাদী ধর্মান্ধরা অভিজিতকে হত্যা করেছে তারা কেউই অভিজিতের লেখা পড়েছে ব’লে আমি মনে করি না। বরং এক ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক জোশ থেকেই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তার প্রধান কারণ হয়ত ‘মুক্তমনা’ এবং ‘মুক্তমনা’য় লেখা অসংখ্য মুক্তচিন্তার রচনা, যা অনেক মানুষকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, আলোকিত করতে সহায়ক হয়েছে। ঘাতকেরা জানতো এসবের পেছনের মানুষটি অভিজিৎ রায়। তাই সুযোগ বুঝেই অভিজিতকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে।
অভিজিতের লেখাগুলো ব্লগ কিংবা অনলাইন মাধ্যমের বাইরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে বলে মনে হয়নি। এমনকী বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে অভিজিৎ রায়ের কোন বিশেষ লেখা ব্যাপক আলোড়ন কিংবা আলোচনা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি; যা হয়েছিল অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বেলায়। হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ‘ প্রকাশের সাথে সাথেই দেশব্যাপী ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রতিবাদ লক্ষিত হয়েছিল, যা অভিজিতের কোন বিশেষ লেখার ব্যাপারে শোনা যায়নি। এখন প্রশ্ন, তবে কী কারণে অভিজিৎ ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের টার্গেট হলেন?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অভিজিতকে হত্যার টার্গেট করতে তাঁকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে প্রচার করাই বাংলাদেশের মতো হুজুগেচলা পাবলিকের দেশে যথেষ্ঠ। বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এমন আকার ধারণ করেছে যে, এখন যে কাউকে ইসলামবিরোধী ব’লে মোটামুটি প্রচার করে দিলেই হলো। সেইসাথে যদি দেখানো যায় যে তথাকথিত ধর্মবিদ্বেষী ব্যক্তির নাম জন্মসূত্রে অন্যধর্ম সাদৃশ্য এবং তিনি নাস্তিক, তবে তো সোনায় সোহাগা। নাস্তিকতা কী এবং কেন, খায় না পিন্দে এসবের ণত্ব-ষত্ব জানার দরকার নেই, সবকিছু না-জেনে না-পড়ে শুধু ‘নাস্তিক‘ এ’কথার ভিত্তিতেই তাঁকে মারার জন্য সাচ্চা ঈমানদার মানুষের অভাব হবে ব’লে মনে হয় না। শুধু হত্যা নয়, হত্যা পরবর্তী কোনো জনমত কিংবা আইনীসহায়তা পাওয়াও হবে প্রচণ্ড দুরূহ, যা ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে অভিজিতের ব্যাপারেও।
স্মৃতি প্রতারিত না করলে মনে পড়ছে, ১/১১- এর পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বন্দী, তখন তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে এক ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন। রাজনীতিবিদ তো দুরের কথা অনেক সুশীলকেও তখন দেখা যায়নি অসুস্থ ড. ওয়াজেদ মিয়াকে দেখতে যেতে। তখন যিনি অনেকবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে নিজের ছাত্র বলে পরিচয় দিয়ে গর্বিত হয়েছিলেন তিনি প্রথিতযশা শিক্ষক শুধু নন, মুক্তবুদ্ধিসম্মন্ন এক নিপাট ভদ্রলো্ক, মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়,অভিজিতের গর্বিত পিতা।
অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী একটিবারের জন্য পুত্রশোকাহত অধ্যাপক অজয় রায়কে সমবেদনা জানাতে গিয়েছেন কিংবা তাগিদ অনুভব করেছেন? হয়ত ক’রে থাকতে পারেন কিন্তু যেতে পারেননি কিংবা যাননি একমাত্র কারণে; আমার মনে হয় সেটা আর কিছু নয়, তাঁর ভোট হারানোর ভয়ে। কেননা, আমাদের মিডিয়াগুলো ইতোমধ্যেই মৃত অভিজিতের গায়ে ইসলামবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিয়ে আমজনতার তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে সুড়সুড়ি তুলে দিয়েছে।
তাই জীবিত অভিজিত রায় ধর্মান্ধ মৌ্লবাদীদের কাছে যেমন ভয়াবহ ছিলেন, মৃত অভিজিৎ রায়ও তেমনি প্রগতিশীলতার ভেকধারী মানুষ এবং আমজনতার ভোটপ্রত্যাশী নষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে তেমনি অচ্ছুৎ ও সহানুভূতিহীন। তা না হ’লে অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর সুশীল সমাজ ও প্রগতিশীল মানুষদের গা-ছাড়া ভাব কেন? কিন্তু এ সবে কী শেষরক্ষা হবে? আমি তা মনে করি না।
এক হুমায়ুন আজাদ নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, দেশ নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। এক দশক পর অভিজিৎ রায়ও প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, সে নষ্টদের অধিকারের আগ্রাসন আরও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ আপস দিয়ে হবে না। ধর্মান্ধতার উগ্রতাকে উৎপাটন করতে হবে সমূলে, অন্যথায় কারও নিস্কৃতি নেই। মুক্তবুদ্ধি দূরে থাক,স্বাভাবিক সভ্যভব্য-বিশ্বাসী-নিরীহ-নিপাট জীবনযাত্রাও কী সম্ভব হবে এই ধর্মান্ধদের স্বপ্নদেখা দেশে? মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রোএশিয়ার অনেক দেশের মতোই কী হবে না বাংলাদেশের অবস্থা?
তাই অভিজিতের রেখে যাওয়া পরিবার-পরিবার পরিজনের জন্যই শুধু নয়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে টিকিয়ে রাখতেও হুমায়ুন আজাদ, রাজিব-জগৎজ্যোতি, অভিজিৎ রায়সহ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ জংগীগোষ্ঠী দ্বারা নিহত সবার বিচার শুরু করতে হবে এখনই, কালবিলম্ব না ক’রে এখনই।
অভিজিতের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
– ভজন সরকার
হ্যামিল্টন, কানাডা
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন