১
১৫৩৩ বার পঠিত
বাংলার মুক্তি সংগ্রামের প্রথম প্রকাশ ঘটে তার চিত্রকলাতেই। অবনঠাকুরের ‘নিউ বেঙ্গল স্কুল’ ছিল ব্রিটিশ শাসনের (শিক্ষা) বিপরীতে বাংলা তথা ভারতের স্বকিয়তার সন্ধান তথা স্বাধীনতার সন্ধান। স্বদেশী আন্দোলনকে এরপর গানে গানে ভরিয়ে তোলেন বাংলার নগরবাউলেরা। যামিনীরায় সে সংগ্রামেরই আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া যা পরবর্তীতে জয়নুলের ‘পাইনার মা’ বা অন্যান্য চিত্র। কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরী তাকে এগিয়ে নিয়েছেন আরো একধাপ।
১
‘বাংলাদেশের শিল্পকলায় মুক্তিযুদ্ধ’, এনিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আমরা যদি উপরের অংশটুকু মনে না রাখী তবে তা শিল্পকলা ও সভ্যতার সম্পর্ক নিয়ে আমাদের না জানার কারণে যে বিস্মৃতি, তাকেই মনে করিয়ে দেবে।
আপাতত আমরা আমাদের বিস্মৃতি প্রবন মন ও মেধা নিয়েই ‘বাংলাদেশের শিল্পকলায় মুক্তিযুদ্ধ’ প্রসঙ্গটি আলোচনা করবো।
২
বিষয় বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলাকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি
ক) ৫২ থেকে ৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম ও সংগ্রাম প্রানিত শিল্পকলা
১৯৪৮ এ ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাই ছিল ‘পাকিস্তানি ইসলামী’ ধারনার বিপরীতে একটি সংগ্রাম। ৪৮-এ যখন বাংলাভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি তৎপরতা শুরু হয় তখন থেকেই এ স্কুলের ছাত্ররা ছিল সে তৎপরতার বিরুদ্ধে। ১৯৫২ তে তাই এ স্কুলের ছাত্রদের প্রতক্ষ্য অংশগ্রহন ছিল অবশ্যম্ভাবী। সেই সব পোস্টার ফেস্টুন আজ কালের গর্ভে বিলীন। তবে মুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরীর রেখাচিত্র ও লিনোকাট ইতিহাসের দলীল।
৪৮ থেকে ৭১ এর মার্চ পযন্ত যত রাজনৈতিক পোস্টার, প্লাকার্ড, ফেসটুন, দেয়াল লিখন, মঞ্চসজ্জা তার সবই মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলার অংশ। সবই কালের গর্ভে বিলীন হলেও কিছু নমুনা রয়ে গ্যাছে সাদাকালো আলোকচিত্রে ও কিছু কিছু প্রকাশনায়।
হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদের ‘একুশের শহীদ মিনার’ এ সময়কালের কিংবা চিরকালের ‘মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলা’র অনন্য উদাহরন। আর পাকিস্তানি ‘ইসলামী আরবি লিপিকলা’ বিপরীতে ‘বিমূর্ত’ চিত্রকলার চর্চার পথ খুঁজে নেয়াকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি কি? যদি নেই তবে মুর্তজা বশীরের ‘দেয়াল’ চিত্রমালা আলোচনার দাবী রাখে। তবে জয়নুলের ‘পাইনার মা’ কিংবা ‘সংগ্রাম’, ইত্যাদী সমকালীন বাংলার মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সব চিত্রভাষ্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও মুর্তজা বশীরের দেয়াল চিত্রটি উপাদান, প্রকরন ও উপস্থাপনে এক অনন্য শিল্পকর্ম
খ) মুক্তিযুদ্ধকালীন শিল্পকলা
১) মুজিবনগর সরকার বা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রচার ও প্রচারনা বিভাগের পোস্টার লিফলেট ডাকটিকিট ইত্যাদী। যদিও এসব সংখ্যায় খুব বেশী নয় তবে মান প্রশ্নে এগুলোর তুলনা বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল।
২) মুক্তিযোদ্ধাদের অংকন, যা আজো সংগ্রহ করাই হয়নি
৩) অর্থ সংগ্রহ ও প্রচারনা মূলক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম সমূহ। এসব প্রদর্শনী আয়োজনে তৎকালীন তরুন চিত্রকর স্বপন চৌধুরীর নাম আলাদা করেই উল্লেখের দাবী করে। এসব প্রদর্শনীতেই আমরা আমাদের প্রধান চিত্রকরদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চিত্রকর্মটির সন্ধান পাই।
গ) যুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিংবা মুক্তিযুদ্ধ প্রানিত শিল্পকলা
মুক্তিযুদ্ধ বা সংগ্রাম এমন একটি ঘটনা যে এর মধ্যদিয়ে একটি দেশ বা অঞ্চলের সকল জীবন বোধেরই পরিবর্তন বা উত্তরন ঘটে আর যে কোন উত্তরনের মশাল বাহক সে দেশের শিল্প-সাহিত্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে একটি কূটতর্ক আছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী কতখানী প্রস্তুত স্বাধীন বা স্ব-এর অধিন হতে পারার জন্য’। আমরা সে তর্কে যাবনা, তবে এটুকু বলা যেতেপারে যে, এ কূটতর্কের গণ-আলোচনার সুযোগই ঘটে একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার পথটির প্রথম ধাপ অতিক্রান্ত হলেই।
সমকালের সকল শিল্পকর্মই আসলে সে অর্থে যুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিংবা মুক্তিযুদ্ধ প্রানিত শিল্পকলা।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিল্পকলা
যোদ্ধা ছিলেন না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বা যোদ্ধাদের নিয়ে চিত্র ভাস্কয করছেন যুদ্ধে অংশনিতে না পারার যন্ত্রণায় এমন বিবেচনায় মৃর্তজা বশীরের ‘এফিটাফ’ চিত্রমালা ও আব্দুল্লাহ খালীদের ভাস্কয ‘অপরাজেয় বাংলা’র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৯) কথা সর্বাগ্রেই আসে।
‘অপরাজেয় বাংলা’র সাফল্যে মুক্তিযুদ্ধ কে বিষয় করে ‘পাবলিক আর্ট’ বা ভাস্কয’র ব্যাপক প্রসার ঘটে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ২য় ও ৩য় দশকে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তম ভাস্কর হামিদুজ্জামান। তাঁর সংশপ্তক ভাস্কর্য (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯০) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কযের অন্যতম কাজ।
এছাড়াও আব্দুর রাজ্জাকের জাগ্রত চৌরঙ্গী (জয়দেবপুর চৌরাস্তা, ১৯৭৩), নিতুন কুন্ডুর শাবাশ বাংলাদেশ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯১), শ্যামল চৌধুরীর বিজয় ‘৭১ (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০০) নান্দনীক বিচারে উল্রেখযোগ্য কাজ।
এছাড়াও কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে বিধৃত হয়েছে ৩৬০ টি ভাস্কর্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস।
সাভারের জাতীয় স্মৃতি সৌধ এক অনন্য স্থাপনা। জেলায় জেলায় বিভিন্ন স্মৃতি সৌধ ও ভাস্কযের নন্দন বোধ (চেতনা ও শৈল্পিক সৌকয) আলাদা নন্দনতাত্বিক আলোচনায় অন্তর্ভূক্তি জরুরী হয়ে উঠেছে।
একক চিত্রকর্ম হিসেবে আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, মোহাম্মদ কিবরীয়া, কাজী আব্দুল বাসেত এর বেশকিছু চিত্রকে আমরা রচনা কৌশলের সৌকযের কারনেই আলোচনায় নিতে পারি।
তাঁরা চারজন
প্রথমক্ত তিনজন শিল্পী হিসেবে আগেই পরিচিত ছিলেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁদের চিত্রকর্মের অনন্যতার অনুপ্রেরনা।
১) কামরুল হাসান: গুরুসদয় দত্ত যে বাংলাকে খুঁজছিলেন কামরুল যেন সে বাংলাকেই খুঁজে পেলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। আর আমরা পেলাম একজন নগর পটুয়াকে, কালীঘাটের পট যেন পেল নতুন তুলির ছোয়া। তবে এ তুলি লোককলার শিল্প (Industry) যান্ত্রিকতা মুক্ত, ঝরঝরে…
২) এস এম সুলতান: কাঠমিস্ত্রী বা কৃষকের পুত্র লাল মিয়া বিশ্ব (ইউরোপ) ঘুরে নিজেকেই ফিরে পেলেন যুদ্ধপোড়া নিজগ্রামে।
৪) কাইয়ুম চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধারা কোথা থেকে এলো? সেনানিবাস থেকে না ছাত্রাবাস থেকে? না, তাঁরা ছিল ফসলের ক্ষেতে কৃষক হয়ে, তাঁরা ছিল নদীতে-নৌকায় মাঝি হয়ে। যারা মুক্তিযোদ্ধা হতে গিয়েছিল সেনানিবাস থেকে, যারা গিয়েছিল ছাত্রাবাস থেকে তারা মিশে গিয়েছিল এই কৃষকের সাথে মাঝির সাথে। এই শ্রেণীচুত্যির নাম, এই গণ সঞ্চালনের নাম মুক্তিযুদ্ধ। সাহাবুদ্দিনের ইউরোপীয় যোদ্ধার উত্থানের আগে তাই আমাদের নিজস্ব নগর দেয়ালে কিংবা প্রকাশনায় কাইয়ুম রচনা করেন মুক্তিযোদ্ধার কিংবা কৃষকের প্রতিকৃতি। ইউরোপীয় নগর ছাড়িয়ে যখন আমরা পুনরায় নিজস্ব নগর রচনা করবো তখন জয়নুল কামরুলের মত কাইয়ুম হবেন আমাদের চিত্রকর।
৩) সাহাবুদ্দিন আহমেদ: সাহাবুদ্দিন যদি প্যারিসে মাটি কামড়ে পড়ে না থাকতেন তবে কি আমরা তাকে নিয়ে আজ এতো আলোচনা করতাম? না! সাহাবুদ্দিন প্যারিসে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন, লড়েযান বিশ্ব শিল্পের ও দেশের রাজনীতির উত্থান পতনের বিপরীতে। এটা তিনি পারেন কারণ যৌবনের সবচেয়ে বিলাসী সময়টি তার কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই পরিচয় আমাদের কাছে যত সত্য তারচেয়েও বেশী বাস্তব তার নিজের কাছেই। তিনিই সফল বা স্বার্থক শিল্পী যে তার বাস্তবতাকেই নিজে দেখে ও অপরের করে দিতে পারে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭; ৬:০৫ পূর্বাহ্ন
মুক্তিসংগ্রামের সময় যেসব শিল্পীরা এতোকিছু অবদান রেখে গেছেন, আজ যদি তাঁঁরা বেঁচে থাকতেন তাহলে দেশের অবস্থা দেখে তাঁরা নির্ঘাৎ অক্কা পেতেন। ভাগ্যিস তাঁরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন।