০
১৬২৭ বার পঠিত
‘মুসলমান’ বলতে আমরা বুঝব সেইসব মানুষকে, যারা মুসলিম পিতামাতার সন্তান অথবা ধর্ম হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করেছে এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুক বা না-চলুক, নিজেদের মুসলমান বলে গণ্য করে। অনেকেই এই ভুল ধারণাটা পোষণ করে, যেখানে ষত মুসলমান আছে সবাই বুঝি এককাট্টা। ধারণাটা সবৈব ভুল। মুসলমান হয়ে মুসলমানের জন্ম কিছুটা সমমর্মিতা হয়তো তার মধ্যে আছে। অনুরূপ সমমর্মিতা খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, জরাথুস্ট্রিয়ানদের মধ্যেও লভ্য।
এটুকু বাদ দিলে, একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই মুসলমানরা বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত। আছে সুন্নি, শিয়া, খারিজি। আছে আরবি, তুর্কি, ইরানি, আফগান, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়, মালয়েশিয়। সাঈদ, শেখ, পাঠান, মুঘল মুসলিমও আছে। ধনী মুসলমান আছে। আছে হতদরিদ্র মুসলমানও। জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত মুসলমান যেমন আছে, তেমনি আছে বিরাট সংখ্যক পিছিয়ে থাকা মুসলমান। আছে স্বার্থান্ধ কিছু মুসলমান শাসক। শাসিত মুসলমানের সংখ্যাও অজস্র। তারা কখনো যেমন পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করে, তেমনি লড়ে অন্যদের বিরুদ্ধেও।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব মুসলিমরা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো পচিম ইয়োরোপীয় খ্রিস্টান শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল এবং যুদ্ধের পর নিজেরা স্বাধীনতালাভ করবে, এই মিথ্যা আশায় অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। হুরাক ও ইরান দু’টোই মুসলিম দেশ। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে এই দুই দেশের মধ্যে, নৃশংস ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এখনও স্মৃতিতে অমলিন। ১৯৯০ সালে ইরাক কর্তৃক কুয়েত আক্রমণের ঘটনাও আমাদের চোখ খুলে দেয়, এর ফলেই পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট’র মতো বৃহৎ শক্তিবর্গের নাক-গলানোর সুযোগ অনেক বেড়ে যায়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা অবাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। বাঙালি মুসলমানদের দাবি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, কেননা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ওই ভাষায় কথা বলে।
মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য কায়েম করার জন্য লড়াই করেছিল পাঠান মুসলিম এবং মুঘল মুসলিম। এমনকি ‘ক্রুসেড’ বা ধর্মযুদ্ধের আমলে, পোপের আহ্বানে খ্রিস্টানরা যখন ‘পবিত্র ভূমি’ মুক্ত করার জন্য দেড়শো বছর ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তখনও সকল মুসলমান খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে একজোট হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে বড় বিজ্ঞানী অনেকেই হয়েছেন কিন্তু মুসলমানদের ‘দুর্ভাগ্য’, এঁরা কখনোই মনে করেন নি, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুসলিম জনগণকে মুক্ত করাটা এঁদের কর্তব্য। মালয়েশিয়ায় মহাথির মুহম্মদের মতো মুসলিম নেতার দেখা পাওয়া গেছে, যিনি জোর দিয়ে বলেছেন বহুত্ববাদী সমাজে সংস্কারসাধন ও সহনশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা। বলা যায় ইন্দোনেশিয়ার নেত্রী মেঘবতী সুকর্ণপুত্রীর কথা, যাঁর পিতা ক্ষমতাচ্যুত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যান্ত্র। আছেন জনারেল পারভেজ মুশাররফ-এর মতো মুসলমান, যিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছেন অথচ এই মুশাররফই ‘মহামান্য মার্কিন রাষ্ট্রপতি’ বুশ-এর নয়নমণি, যে-বুশ অন্যান্য দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ না করে রাতে ঘুমোতে পারেন না। ওসামা বিন লাদেন-এর পার্শ্বচর জওয়াহারি-র মতো মুসলিম নেতাও আছে, যে মুশাররফকে গদিচ্যুত করার জন্য পাকিস্তানিদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
পিএলও-র সদস্যদের মতো মুসলমানও আছে, যারা স্বহস্তে নিজেদের কবর খুঁড়ছে এবং মার্তৃভূমি মুক্ত করার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পণ করে লড়াই করছে। জর্ডন, সৌদি আরব ও কুয়েত-এর রাজাদের মতো আত্মপরায়ণ মুসলমানও আছে, যারা মুসলিম ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছে। জর্ডনের রাজা তাঁর সেনাবাহিনীকে আদেশ দেন, পিএলও সদস্যদের তার দেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে দিতে, কেননা তার দেশে ওরা থাকলে তার সিংহাসন বিপন্ন! কুয়েত-এর রাজা ইরাকের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার চাইতে আমেরিকার সঙ্গে সংঘাত বাধিয়ে সুখ পান। সৌদি আরবের রাজার দাবি, তিনি ‘দুটি পূণ্যভূমির জিম্মাদার’ এবং অন্যান্য মুসলমানদের উপদেশ দেন একমাত্র আল্লার কাছে নতজানু হতে। অথচ, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, নিজে নতজানু হন আল্লার পরিবর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে। তাকে রক্ষা করার জন্য তিনি মার্কিন সেনাদের আমন্ত্রণ জানান এবং ভরণপোষণ দিয়ে তাদের রেখে দেন। যে পরিমাণ তেল আমেরিকা চায় তিনি ততটা উৎপাদন করেন এবং দেশের মানুষের স্বার্থের তোয়াক্কা না করে সে তেল বেচেন আমেরিকার বেঁধে দেওয়া দামে।
কাজেই বিশ্বের মুসলমানরা সবাই ‘একজোট’ ‘একপ্রাণ’ এই ধারণাটা একেবারে ভুল। বিশ্বের মুসলমানরা কখনো এককাট্টা ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও এক হবার কোনরূপ সম্ভাবনা নেই। পণ্ডিতদের অনেকেই ‘আরব’ আর ‘মুসলিম’ সমার্থক মনে করেন। বাস্তবিক, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মোহম্মদ যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আজ সেখানেই সৌদি আরবের অবস্থান। খুবই স্বাভাবিক, আরববাই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অর্থাৎ মুসলমান হয়। কিন্তু আজ আরব ভূখণ্ডের বাইরে অনেক বেশি সংখ্যক মুসলমান বসবাস করেন।
দেশে দেশে মুসলিম জনসংখ্যার হিসেব নিলে দেখা যাবে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান বসবাস করত অবিভক্ত ভারতে। দেশভাগের পরে, এখনও দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা ভারতে। প্রথম স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। কাজেই, আরবও যা মুসলিমও তা-এই সমীকরণ ঠিক নয়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন