০
২০৪০ বার পঠিত
ইতিহাসের পথে ইসলামের অনুসন্ধান
২০০৮ সালের নভেম্বর মাস, জার্মানীর মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ধর্মতত্বের অধ্যাপক মুহম্মদ স্বেন কালিচ তার দীর্ঘদিনের গবেষনার ফল ঘোষনা করলেন। তিনি একদম পরিস্কারভাবে দুটো বিষয় তুলে ধরেন, প্রথমত– ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদের সম্ভবত কোন অস্তিত্ত ছিল না। দ্বিতীয়ত, যদি ইসলামের ইতিহাসে কোন মুহম্মদ যদি থেকেও থাকে তার সাথে ইসলামিক বিবরণের মুহম্মদের কোনই সম্পর্ক নেই। বস্তুত ইসলমিক বিবরণের সবটাই প্রায় গল্পকথা মাত্র যা অনেক পরে রচিত হয়েছে। ইসলামিক বিবরণে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এমন ঐতিহাসিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এক্ষেত্রে কালিচ মোটেও একা নন আর তিনিই প্রথম এই দাবী করলেন বিষয়টা এরকমও নয়। তাহলে– আসলে কালিচের এই ঘোষনার তাৎপর্য হল প্রথমত তিনি ছিলেন মুসলিম (জার্মানীর প্রথম ইসলামিক ধর্মতত্বের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করেন) আর দ্বিতীয়ত তার আগে কেউই এত দৃঢ়ভাবে মুহম্মদের অস্তিত্ব নাকচ করতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হল এই ঘোষনার ভিত্তি কি? আল্লার রাসুলের কর্মকান্ডের কি কোন ঐতিহাসিক প্রমান আছে, কোন শিলালিপি পাওয়া গেছে যা তার অস্তিত্ব প্রমান করে? সমকালীন অমুসলীম উৎস কি নবীর কর্মকান্ডের নিশ্চিত প্রমান দেয়?উত্তর হচ্ছে না, কিস্যু নেই। ধর্মীয় সাহিত্যকে এত নিশ্চিতভাবে ইতিহাস হিসাবে গ্রহন করা চলতে পারে না যার মধ্যে আবার অসংখ্য পরস্পরবিরোধী ও অসংলগ্ন তথ্য রয়েছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের ১৬০ কোটি মানুষ এত দৃঢ়ভাবে ইসলামিক সূত্রে আস্থাশীল যে তাদের বিশ্বাসের জোর দেখে অনেক গবেষক পর্যন্ত্য প্রভাবিত হয়েছেন। ফলস্বরুপ কোরান ও অনান্য ইসলামিক সূত্র অনুসন্ধান কোন নির্মোহ সংশয়ী দৃষ্টি নিয়ে করা হয়নি। যারাই এ বিষয়ে নিয়ে গভীর চর্চা করেছেন তারাই এ বিষয়ে ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবের কথা লিখেছেন। গবেষক আর্থার জেফারি ১৯৩৭ সালে দেখেছিলেন–
“critical investigation of the text of Quran is a study which is still in its infancy”.
পঞ্চাশ বছরেরও বেশী বাদে আমরা সেই একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই–
I have often come encountered individuals who came to the study of Islam with a background in the historical study of Hebrew Bible or early Cristianity, who express surprise at the lack of critical thought that appears in introductory textbook on Islam. The notion that ‘Islam was born in the clear light of History’ is still seems to be assumed by a great many writers of such texts. (Andrew Rippin)
এতদসত্বেও বলতেই হবে যে বহু এতিহাসিক বিভিন্ন সময়ে ইসলামিক বিবরণের ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন ইসলামিক উৎসের মধ্যেকার বৈপরীত্য খুঁজে বার করেছেন এবং সর্বশেষে ইসলামিক বিবরণের সাথে অমুসলিম উৎসের পার্থক্য দেখিয়েছেন। এইভাবে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন যাকে অ্যাকাডেমিক পরিভাষায় বলা হয় Revisionist School of Islamic Studies। থিওডোর নলদেক, জন ওয়ার্নসবার্গ, মাইকেল কুক, পাট্রিসিয়া ক্রোন এই সমস্ত গবেষকদের যে বিশাল গবেষনা রয়েছে তার উপর আমরা অতি সহজেই হাদিস ও সিরাত কে ঐতিহাসিক প্রমান্য গ্রন্থ হিসাবে অস্বীকার করতে পারি। কারণ দেখা যায়–
১. মু্হম্মদের সমকালীন অর্থ্যাৎ সপ্তম শতাদ্বীর প্রথম চার দশকের কোন লেখায় মুহম্মদের কোন উল্লেখ নেই। শুধু তাই নয় ইসলাম বা মুসলিম উল্লেখ আছে এমন কোন লেখা পাওয়া যায়নি। ৬৩৪ খ্রস্টাব্দে রচিত একটি প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া ছোট চিরকুট আকারের বিবরণে মুহম্মদের নাম আছে বলে মনে করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি পরে আসছি। প্রকৃতপক্ষে ওই চিরকুট থেকে কিছুই প্রমান করা যায়না। প্রথম বারের মত নিশ্চিতভাবে মুহম্মদের উল্লেখ পাওয়া যায় আর্মেনীয় খৃষ্টান বিশপ সেবিওসের বিবরণে।এটি ৬৭০ সালের দিকে রচিত হয়েছিল, মহম্মদের কথিত কর্মকান্ডের অন্তত ৩০–৪০ বছর বাদে।
২. এমনকি এই বিবরণেও মুহম্মদের অনুগামীদের মুসলিম বলা হয়নি বলা হয়েছে ইসমেলাইট। এর আগের সব লেখাতেই আরবদের দ্বারা বিজিত মানুষরা তাদের সারাসেন, ইসমেলাইট, হাজারীয় ইত্যাদী হিসাবে চিহ্ণিত করেছে, মুসলিম হিসাবে নয়।
৩. কোরানে মুহম্মদের উল্লেখ আছে মাত্র চার বার। যেখানে মোসেস বা মুসা নবী ১৩৬ বার উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি ফেরাউনের উল্লেখ আছে ৭৬বার। যে সমস্ত সুরায় মুহম্মদের নাম আছে সেখানেও প্রসঙ্গ পরিস্কার নয়। এইসব জায়গায় অনায়াসে Mu-ammad শব্দের আভিধানিক অর্থ নিযুক্ত, বেছে নেওয়া, প্রসংশিত ব্যক্তি ইত্যাদী অর্থ লাগানো যেতে পারে।
৪. সিরা বা মুহম্মদের জীবনীগ্রন্থগুলি হল ইসলামিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রথম সিরাত গ্রন্থটি লেখেন ইবনে ইশাক (৭০৪–৭৬৭) মুহম্মদের মৃত্যুর ১০০–১২৫ বছর পরে। এই বইটিই পরবর্তী সব মুসলিম ঐতিহাসিকদের সোর্স হিসাবে ব্যাবহৃত হয়েছে। হাদিসগুলি লেখা শুরু মুহম্মদের কথিত মৃত্যুর অন্তত দুশ বছর পরে।
৫. ৬–৭ প্রজন্ম পরে লেখা হাদিসগুলিকে কোন আধুনিক ঐতিহাসিকই ঐতিহাসিক বিবরণ হিসাবে স্বীকার করেন নি। সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় এধরনের বিবরণ সম্পূর্ণভাবে প্রচলিত গাল–গল্পের নির্ভরশীল হতে বাধ্য। মুসলিম স্কলাররাও অনেকেই জাল হাদিসের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন। আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি মুনিন ভাইয়েরা কোন হাদিস নিয়ে অস্বস্তিতে পড়লেই সেটা তখুনি জাল হাদিস হয়ে যায়।
৬. দেখা যায় পরবর্তী ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদি (৭৪৫-৮২২) অনেক বিষয়েই ইবনে ইশাকের থেকে বেশী জানেন। যেমন যেসব অভিযানে যুদ্ধ হয়নি- কেন কি কারণে তার বিস্তারিত বর্ননা দিয়েছেন ওয়াকিদি- যেখানে ইবনে ইশাক শুধু উল্লেখ করেছেন। আল তাবারীর ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভাল করে লক্ষ্য করলে পুরোটাকেই বানানো গল্পের একটা ট্রাডিশন ছাড়া কিছুই মনে হয়না।
৭.একাধিক হাদিস পাওয়া যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরান সংকলিত করছেন যেটা তার অন্তত ৪০ বছর আগেই উসমানের আমলে হয়ে যাওয়ার কথা। অন্য হাদিস অনুসারে মসজিদে কোরান তিলাওয়াত প্রথাও তিনিই চালু করেন।
ইসলামিক ইতিহাসের এরকম অসংখ্য অসংলগ্ন, পরস্পরবিরোধীতার উল্লেখ করা যেতে পারে যার জন্য যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে ইসলামিক ইতিহাসে আস্থা রাখা শক্ত। আপাতত ইসলামের পঞ্চম খলিফা মুআবিয়ার আমলে ছাপা মুদ্রার ছবি দিলাম; যেখানে দেখা যাচ্ছে মুসলিম শাসক একটি ক্রুস বহন করছেন। অপর পিঠে সম্ভবত মহম্মদের নাম রয়েছে।
কি বলেন মুনিন ভাইয়েরা, পুরোপুরি কুফরি!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন