০
১৪৫২ বার পঠিত
এমন হয় কেনো! বাস থেকে একটা পলিথিন পড়লো পায়ের উপর। পলিথিন ভরা বমি। ঘেন্না হওয়ার কথা অথচ হলাম আশ্চর্য। আমার সাথেই কেনো! রাস্তায়তো আরো লোক ছিলো, তাদের উপরতো পড়লো না! এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে, যে ব্যাখ্যায় দোষটা শেষমেশ আমারই হওয়ার কথা। অন্যমনস্ক ছিলাম, অন্যরা ছিলো মনস্ক। ওই যে বিজ্ঞানমনস্কের মতন মনস্ক আর কী। না হয়, হাইওয়ে দিয়ে হাঁটার কি দরকার, এমন কুপিত প্রশ্ন। দোষটা আমারই। ব্যাখ্যা এবং দায় এমনটাই।
ফাগুনেরও এমন অবস্থা ছিলো। ও বলতো, ‘দাওয়াতে খেতে বসলে আমার সামনে এসেই রোস্টের বাসনটা খালি হয়ে যেতো। খেতে গিয়ে হঠাৎ গ্লাস উল্টে পড়তো টেবিলে।’ আমি বলতাম, তুই অতি ভদ্র, সবাইকে ভালো জায়গা ছেড়ে দিয়ে তুই বসিস সবসময় শেষের দিকে, তাই দাওয়াতে রোস্ট থেকে বঞ্চিত হোস। আর খেতে বসে এক হাতে মোবাইল এবং সেই মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলে তো গ্লাস উল্টে পড়বেই। অর্থাৎ দোষটা ওরই।
এসবই ট্রেন্ডি ব্যাখ্যা এবং মূলত অর্থহীন। কখন কী হবে, তা বলার সাধ্য কারো নেই। কেনো হলো তা হওয়ার পর ব্যাখ্যা করা যায়, হওয়ার আগে আভাস দেয়াও সম্ভব হয় না। ঘুর্ণিঝড়, সুনামি এসবের পূর্বাভাস দেয়া যায়, জানি এমনটা বলবেন কেউ কেউ। কিন্তু কে মারা যাবেন তার ধারণা কি দেয়া যাবে? যাবে না। যায় না। তবে মৃত্যুর পর দোষটা হয় মৃতেরই। বলা হয়, আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। গেলেও একেবারে কিনারায় ছিলো, যার ফলেই মরেছে। ফলে ঘটে যাওয়ার দায়টা তার, মৃতের!
আমাদের বর্তমান অবস্থাটাও তেমনি। কেউ মারা গেলে আগে তার দোষ খোঁজা হয়। অন্ধকার রাস্তায় একা গেলো কেনো, বাসে গেলো কেনো, বর্ষায় লঞ্চে কেউ যায়- এমন সব কথা বা দোষ! আমার ফাগুনকে নিয়েও অনেকে বলেন, ও ট্রেনে আসতে গেলো কেনো। আরে, স্বাধীন একটা দেশে স্বাধীন একটা তরুণ কিসে আসবে না আসবে সেটা তার ইচ্ছা। তাকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাকে বাঁচিয়ে রাখার শর্ত দিয়েই রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। না হলে মানুষের রাষ্ট্রের দরকার ছিলো না। রাষ্ট্র হয়েছে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের শর্তেই। সেই শর্ত ভঙ্গ হলে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা। উদীয়মান গণমাধ্যমকর্মী। গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগে সাব-এডিটর। প্রতিভা, সততা আর প্রতিশ্রুতির অপূর্ব সমন্বয়। এমন একজনকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের ফরজ। সেই ফরজ কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি রাষ্ট্র। সাত মাস আগে, মে মাসের একুশ তারিখে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সে। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় জামালপুরের কাছে রেললাইনের ধারে। তার অগ্রজ এবং সহকর্মীরা বলেন সাংবাদিকতার আগুন ছিলো ফাগুনের মাঝে। সেই ফাগুন আমার বড় ছেলে। আমি পিতা হিসাবে ওর মৃতদেহ কাঁধে নিয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বোঝা বইতে হয়েছে আমায়। সাংবাদিক হিসাবে নিজ সাংবাদিক পুত্রের হত্যাকান্ড নিয়ে লিখেছি। একজন সাংবাদিকের জন্য এরচেয়ে যাতনার কিছু হতে পারে না। সেই যাতনা সয়েছি আমি, সয়ে যাচ্ছি এবং যাবো। সাথে লিখে যাবো।
ফাগুন ট্রেনে ফিরছিলো। অনেকেই বলেছেন, ট্রেনে আসলো কেনো? এমনকি দায়িত্বশীলও অনেকে বলেছেন, ‘ট্রেনের অবস্থা খারাপ, নানা গ্রুপ রয়েছে, রয়েছে অজ্ঞান পার্টি, এরমধ্যে ট্রেনে আসতে গেলো কেনো’! কী অদ্ভুত কথা! তারা জানেন ট্রেনের অবস্থা খারাপ, অথচ এর প্রতিকার হয় না। দীর্ঘ এক বছরে রেললাইনের পাশে পাওয়া গেছে অনেকের লাশ। গণমাধ্যম বলছে এগুলোর বেশিরভাগই হত্যাকান্ড। অথচ মৃতদের নাম জমা হচ্ছে অপমৃত্যুর খাতায়। ট্রেনে অজ্ঞান পার্টি রয়েছে, রয়েছে ছিনতাইকারী। তারা সামান্য জিনিসের জন্য মানুষ মেরে ফেলছে। করছে টার্গেট কিলিং। বিপরীতে তারা ধরা পড়ছে কয়জন। এতো ফাঁসি’র আওয়াজ শুনি, এদের কারো কি ফাঁসি হয়েছে? গত এক দশকে রেললাইনের ধারে এসব হত্যাকান্ডের শিকার কেউ ন্যায় বিচার পেয়েছে কি? পায়নি। কেনো পায়নি এর জবাবও দেয়ার কথা রাষ্ট্রের। অথচ কোথাও কোনো শোর নেই, এ ব্যাপারে ‘স্পিকটি নট’! এমন নিঃশব্দতায় নাগরিকরা যাবেন কই!
আমাদের দেশে মৃত্যু এতো সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন মারা গেলে প্রতিকারের বিপরীতে খোঁজা হয় মৃতের দোষ। যেনো মৃতকেই সবাই শূলে চড়াতে চায়। এ এক উল্টো নিয়মের দেশ। লঞ্চ, বাস, ট্রেনে অতিরিক্ত মানুষ। ছাদে মানুষ, ভেতরে দাঁড়ানো মানুষ, কেউ দেখার নেই। স্টেশনগুলোতে সিসি ক্যামেরা নেই। কারা চড়লো, কারা মারলো আর কে মরলো বোঝার উপায় নেই। দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, খুন হচ্ছে, আগুনে পুড়ে মরছে, নিখোঁজ হচ্ছে, কোথাও কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার ছেলে যখন নিখোঁজ। ওর মা আর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি পাগলের মতন, তখন অনেকে বলেছেন, ‘এই বয়সের ছেলে, দেখেন কোথায় কী করছে’। তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি, বয়সে তরুণ হলেও, মানুষ হিসাবে ফাগুন দায়িত্বশীল এবং চিন্তার মার্গটাও উঁচুতে। পরে যখন গণমাধ্যমে ওকে নিয়ে খবর বেরুলো, তখন তাদের মুখে ছিলো আফসোসের বাণী।
বলিহারি এমন আফসোসের। ঘটনা ঘটার পরের এ আফসোস হলো নিজ সামর্থ্যের অক্ষমতা প্রসূত। এমন আফসোসের ধারণা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা থেকে উৎসারিত। বয়সে তরুণ হলেও ফাগুনের চিন্তার মার্গ ছিলো এনাদের চেয়ে অনেক উপরে। চিন্তার উচ্চতা না থাকলে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির কথা ভাবতো না ফাগুন। ও বলতো, ‘আব্বুজি, বাইরে আঠেরোর পরেই মানুষ জব শুরু করে, আমারতো বিশ, আমি কেনো করবো না।’ এমন অগ্রসর চিন্তার কজন রয়েছে এদেশে।
যারা হত্যার পর খুনিদের না খুঁজে মৃতের দোষ খুঁজতে যান তারা মূলত উজবুক। কিংবা শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘উদ্ভট উটের পিঠে’র সওয়ারি। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, সব যোগ্যতা থাকা সত্বেও দেশের বাইরে না গিয়ে এই দেশে থেকেই দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলো। ‘উদ্ভট উটের পিঠ’ থেকে স্বদেশকে নামাতে হাতেগোনা যে কয়জন কাজ করছেন, তাদের একজন হতে চেয়েছিলো ফাগুন। ডেডিকেশন ছিলো তার, কমিটেড ছিলো সে। অথচ দেশ তাকে বাঁচাতে পারেনি। রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পরও এখনো তার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারেনি রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত ফাগুনের খুনিরা ধরা পড়েনি। কেনো পড়েনি সে লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। যদি সময় এবং সুযোগ হয়ে উঠে লিখবো অবশ্যই।
আজ সাত মাস ফাগুন চলে যাওয়ার। বাবা হিসাবে প্রতিদিন আর ক্ষণ যায় গুনে-গুনে। প্রতিদিন চাই, ওকে যেনো মনে না হয়, যেনো ভুলে যেতে পারি। তাহলে হয়তো ভেতরের যাতনা ও ক্ষোভ কিছুটা কমবে। নানা কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করি। ব্যর্থ সে চেষ্টা। হয় না, ভুলে থাকা যায় না। ভোলার চেষ্টায় আরো বেশি মনে পড়ে যায়। ফাগুনকে মনে পড়ার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় তার প্রতি ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার কথা, তাকে রক্ষার ব্যর্থতার কথা। বুকের হাপরে ক্রমশ ক্রোধ জমে, ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়। মাঝেমধ্যেই মাথার ভেতর রাগী গলায় নবারুণ ভট্টাচার্য বলে উঠেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না’। পরক্ষণেই নিজেকে শান্তনা দিই। বলি, ‘আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব’, যেমন নিতে চেয়েছিলো ফাগুন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন