আপনারও কি তাই অভিমত? সীতা নামক নারী’টি’ আইসিং শোভিতা জেলি ক্যান্ডির মতো কিটকিটে মিষ্টি, তুলতুলে নরম আর চ্যাটচ্যাটে কাঁদুনে?
ভুল।
আসুন, ভাবা প্র্যাকটিস করি। সীতার ঘাড় থেকে নিতম্ব অবধি ইড়া ও পিঙ্গলাকে দুই পাশে রেখে একটা লৌহকঠোর মেরুদন্ড এঁকে দিই।
হ্যাঁ, বাবু বিবিগণ, মহাশয়, মহাশয়া, সীতা একজন মেরুদন্ডী প্রাণী।সেই প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে সীতা সেপিয়েন্সের বাল্মীকীভোরে। বাল্মীকীর সীতাকে না জানলে আমরা কেমন করে এগোব মাইকেলী সীতার কাছে?
অযোধ্যার রাজ অন্তঃপুরে তখন একজন ভগ্নহৃদয় পিতা, একজন উচ্চাকাঙ্খী বিমাতা আর একজন বিড়ম্বিত নায়ক। কৈকেয়ী যা বলার বলে দিয়েছেন। তার চেয়ে অনেক বেশী বলেছেন পিতা দশরথ তাঁর নীরব অশ্রুপাতে। বিড়ম্বিত নায়ক বর্তমান পরিস্থিতি
মর্মে মর্মে অনুধাবন করে তাঁর শ্রীমুখ খুললেন।
বিমাতা কৈকেয়ীকে তিনি বললেন, দেবি! ”রাজাজ্ঞার অপেক্ষা কি, আপনার অনুমতি পাইলে ভ্রাতা ভরতকে নিজেই রাজ্যধনপ্রাণ ও প্রফুল্লমনে সীতা পর্যন্ত প্রদান করিয়া প্রতিজ্ঞা পালন ও আপনার হিতসাধন করিব।’
হায়, এই কথা লেখার পর আদিকবির পালক লেখনী কেন উড়িয়ে নিয়ে গেল না ঝোড়োবাতাস? এই কথা যদি সীতার কান অবধি পৌঁছোত সেদিন, তাহলে নিশ্চিত সীতা সেদিনই নিজের অমাবস্যা-আচ্ছাদিত ভবিষ্যতের নিষ্ঠুর চিবুকটুকু দেখতে পেতেন।
কিন্তু তখনও অব্দি রামের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার স্বপ্নে মশগুল তিনি -কিছুই জানেন না।
অতঃপর রাম নিজ ভবনে এসে সীতাকে সব কথা বলে জানালেন যে তিনি চললেন বনবাসে। সীতা যেন তাঁর শ্বশুর – শাশুড়িদের যত্ন আত্তি করেন। এরপর সাবধান করলেন ভরতের কাছে আমার প্রশংসা কোর না, ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি অন্যের স্তুতি সহ্য করতে পারে না। ভরত- শত্রুঘ্নকে ভ্রাতা- পুত্রের ন্যায় দেখো।
এ- ও বললেন, ‘ তুমি যদি সর্বাংশে অনুকূল হইয়া থাকিতে পার তবেই ভরতের নিকট তিষ্ঠিতে পারিবে। মহারাজ তাঁহাকে রাজ্য প্রদান করিলেন, এক্ষণে তিনিই রাজা।সুতরাং তাঁহাকে প্রসন্ন রাখা তোমার কর্তব্য।’
এখন এই ‘সর্বাংশে অনুকূল’ কথাটার সামনে আমাদের দুদন্ড দাঁড়াতে হবে। দু একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে কপালের রগদুটোকে ধনুকের ছিলার মতো টানটান করে ভাবতে হবে সর্বাংশে অনুকূল মানে ঠিক কতটা অনুকূল? যদিও রাম ভরতকে ভ্রাতার মতো দেখতে বলেছেন, তবু… যে ব্যক্তি বিমাতা ও পিতার সামনে ভাইয়ের হাতে প্রফুল্লচিত্তে স্ত্রীকে তুলে দেওয়ার কথা অকপটে ব্যক্ত করতে পারেন, তিনি যখন স্ত্রীকে বলেন, ভ্রাতার সর্বাংশে অনুকূল থাকতে তখন সেই আনুকূল্য কতটা নিপাট নিখাদ.. সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায় বৈকি। এরকম কথার কারুকার্যময় কুরুশ – সূক্ষ্ম যবনিকার অন্তরালে মেয়েমানুষদের চাপাকান্নার পোড়ামাটির শিল্প তৈরি হয়।
যেমন আরেক অন্তঃপুরিকার গুমরে গুমরে মরা কান্না বাতাস আমাদের মনকে লবণাক্ত করে দেয়।
রাজা কুন্তীভোজের কাছে অনেক মুনি ঋষিরা আসতেন। এবং রাজা তাঁর দত্তক নেওয়া কন্যা রূপবতী গুণবতী কুন্তীকে তাদের সেবায় নিয়োগ করতেন। সুতরাং দুর্বাসাই তাঁর জীবনে প্রথম ব্যক্তি না…
একদিন কোপন স্বভাব দুর্বাসা তাঁর প্রাসাদে এসে বললেন,’ হে মহারাজ কুন্তিভোজ, আমি ভিক্ষা গ্রহণ করে তোমার গৃহে কিছুদিন থাকতে ইচ্ছা করি। কিন্তু আমি যখন তোমার গৃহে বাস করব, তখন তুমি বা তোমার অন্য কোন লোক, আমার অভিপ্রায়ের বিপরীত আচরণ যেন না করে। ‘
কোপন স্বভাব দুর্বাসা’র ( যদিও তিনি সুপুরুষ প্রজ্জ্বলিত বহ্নিসম,) ভয়ে সকলেই তটস্থ।পানটি থেকে চুনটি খসলে এই যদি ফোঁস করে অভিশাপ দিয়ে দেন! ভয়ে তটস্থ রাজা কুন্তিভোজ কুন্তীকেই এই অগ্নিতুল্য ঋষিকে সেবা করার ভার দিলেন।
উত্তরে কুন্তী কী বললেন,? আমি যখন ব্রাহ্মণের সেবায় রত হব, তখন উনি যদি নিয়ম রক্ষা না করে, ভোরবেলা সন্ধ্যাবেলা, গভীর রাত্রে, যখন খুশি আগমণ করলেও আমি একটুও রাগ করব না। উনি কোন নিয়ম না মানলেও, আমি কখনও ওঁর সেবা ছেড়ে যাব না। আমি যা করলে উনি সন্তুষ্ট হবেন, আমি তাই করব। আপনি ব্রাহ্মণকে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমি তা পালন করব।’
এবার কথা হচ্ছে অপরূপা কুন্তী দুর্বাসাকে কিরকম সেবা করতেন? দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করতে ভোরবেলা সন্ধ্যাবেলা বা গভীর রাত্রে তাঁকে কতটা দাঁতের নীচে দাঁত চাপতে হোত?
কুন্তিভোজ প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যায় কুন্তীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘পুত্রি, ব্রাহ্মণ কি তোমার সেবায় পরিতুষ্ট হচ্ছেন?
কুন্তী উত্তরে হেসে বলতেন, ‘ব্রাহ্মণ যারপরনাই আনন্দিত হচ্ছেন।’
কী সেই যারপরনাই আনন্দিত হওয়ার যোগ্য সেবা?
কুন্তীর মুখে আমরা একথাও শুনি, অনপরাধী হয়ে, শুচিতার দ্বারা শুচিসিদ্ধ চিত্তে আমি মহর্ষি দুর্বাসাকে পরিতুষ্ট করেছিলাম। বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ হবার ব্যাপারেও আমি কখনও ক্রুদ্ধ হই নি।
এই ‘বিশেষভাবে ক্রুদ্ধভাবে হওয়ার ‘ব্যাপারটা ঠিক কী ছিল?
দুর্বাসাকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিসম বলা হয়েছে। তাঁর তেজ বা রুদ্ররোষটিও সূর্যের মতই গনগনে। তবে কী তিনিই সূর্য?..
কথার কারুকার্যময় কুরুশ- সূক্ষ্ম যবনিকা নারীদের দীর্ঘশ্বাসে পলকা পালকের মতো দোলে। আর সেই পর্দার শরণ নিয়ে আমরা আজও বিচার করতে বসি, কোন বর্বর দুর্বাসা কিশোরী বা সদ্যযুবতী কুন্তীকে যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করলে বা তার কাঁচুলির ওপরে হাত রাখলে তা আদৌ যৌন হেনস্থা কি না…
কিন্তু সীতা এই সূক্ষ পর্দার ভিতর দিয়ে নিশ্চিত অকল্যাণের গন্ধ পেয়েছিলেন।
সর্বাংশে অনুকূল থাকার উত্তরে সীতা রামকে বলেছেন, ‘তুমি কি জঘন্য ভাবিয়া আমাকে ঐরূপ কহিতেছ?…বহুদিন হইল আমি তোমার আলয়ে অবস্থান করিতেছি, এক্ষণে জায়াজীবীর ন্যায় আমাকে কি অন্য পুরুষের হস্তে সমর্পণ করা তোমার শ্রেয় মনে হইতেছে?যদি তুমি এই দীন দুঃখিনীকে না লইয়া যাও, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বিষ পান অগ্নি বা সলিলে প্রবেশ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব। তুমি যদি আমায় না লইয়া যাও, আমি বিষ পান করিব, কোন মতেই বিপক্ষ ভরতের বশবর্তিনী হইয়া এইস্থানে থাকিব না।”
সীতার কথায় বাবা, মা, ভাই,ছেলে, বৌমা, সবাই নিজের পুণ্যফল ও ভাগ্য ভোগ করে কেবল পত্নী পতির ভাগ্য পায়, অতএব তিনিও রামের সঙ্গে বনে যেতে আদিষ্ট হয়েছেন। সীতার ত্রিলোকের ঐশ্বর্যে দরকার নেই; পতির সহবাসটাই বড় তাঁর কাছে।
রাম তাঁকে শ্বাপদ সরীসৃপ আর বনবাসের কায়ক্লেশের ভয় দেখালে সীতা সেসব পাত্তা দিলেন না। তবুও রাম সম্মত হলেন না দেখে সীতা ফুঁসে উঠে বললেন, ‘ নাথ! আমার পিতা যদি তোমাকে আকারে পুরুষ ও স্বভাবে স্ত্রীলোক বলিয়া জানিতেন, তাহা হইলে তোমার হস্তে কখনই আমায় সম্প্রদান করিতেন না।’
পতির প্রতি কী অগাধ প্রেম, নিজের সংকল্পে অটুট থাকার কী লৌহকঠোর প্রয়াস! যে নারী পুরুষোত্তমকে ‘জায়াজীবী’ অর্থাৎ যে পুরুষ স্ত্রীলোকের উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে বা কাপুরুষ ( আকারে পুরুষ, স্বভাবে স্ত্রী, যদিও অনেকে বলবেন, এই কথাটি স্ত্রীলোকের প্রতি চরম অপমান, তবু এটা মাথায় রাখতে হবে সীতা ঋকবৈদিক যুগের মেয়ে নন। তিনি পিতৃতন্ত্রের হাতে আজন্ম কাস্টমাইজড হওয়া একটি মেয়ে, তবু এরই মধ্যে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তাটা দেখবার মতো নয়! এই জেদ না থাকলে পরবর্তী ক্ষেত্রে তিনি রাবণের মতো দুর্বৃত্তের শত জোরাজুরিতেও তাঁর কন্ঠে মালা না দিয়ে রামের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন?) বলে মুখনাড়া দিতে এতটুকু কুন্ঠা বোধ করেন না, তাঁর সঙ্গে কি আমাদের মনে যে লবঙ্গলতিকা ক্রন্দনপরায়ণা সীতার চিত্রটি আঁকা আছে, তার কোন মিল আছে?
কিন্তু আমাদের বাল্মীকীর হাতে গড়া সীতা ঠিক এইরকমই। তারপর যেমন যেমন সময় এগিয়েছে, সীতা তেমন তেমন পিছিয়েছেন নিজের মানবসত্ত্বার নিরীখে। সেই সীতাকে খুঁড়ে বার করা এখন হরপ্পা বা মেহেরগড় সভ্যতার খনন কার্যের তুলনায় কিছু কম শ্রমসাধ্য নয়।
প্রমাণ চান?
রামচরিতমানসের তুলসীদাসী সীতা এবং রাম কিন্তু একফোঁটা ঐকান্তিক সাক্ষাৎকারের সুযোগটুকুও পান নি। রামের বনবাসের কথা শুনে কৌশল্যা কান্নাকাটি করতে লাগলেন। রামচন্দ্র মাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। সেইসময় সীতা দুঃসংবাদ পেয়ে সেখানে এসে পড়লেন, শাশুড়ির পায়ে এসে ঢিপ করে প্রণাম করে কাঁদতে বসলেন। ভাবতে লাগলেন,
‘চলন চহত বন জীবননাথূ।
কেহি সুকৃতী সন হোইছি সাথূ।।
কী শুনু প্রাণ কি কেবল প্রাণা।
বিধি করতবু কছু জাই ন জানা।।’
প্রাণনাথ বনে যাচ্ছেন। কোন পুণ্যে সীতা রামের সঙ্গে যেতে পারবেন ???তিনি বনে যাবেন আর আমি দেহ নিয়ে এখানে পড়ে থাকব? না আমার দেহ প্রাণ দুইই তাঁর সঙ্গে যাবে?বিধাতা কি লিখেছেন কপালে কিছুই জানি না।
সীতার অব্যবস্থিতচিত্ততা লক্ষ্য করুন। বাল্মীকীকন্যার যে অটলচিত্ততা প্রথম থেকে পরিলক্ষিত হয়, তার লেশমাত্র এ সীতায় নেই।
সবচেয়ে মজার কথা হল, সীতা সঙ্গে যাবে কি যাবে না, সেই নিয়ে প্রথম রায় দিলেন সীতাও নয়, রামও নয়, মাতা কৌশল্যা। তিনিই সীতার চোখে জল দেখে বলতে লাগলেন,
সীতা অতি কোমল প্রকৃতি, সকলের প্রিয়। তাকে আমি চোখের পুতুলের মতো ভালবেসেছি, এই কোমলাঙ্গী কি করে বনে যাবে? বিষয় ভোগে বঞ্চিত কোল ভীল রমণীরা, যাদের পাথরের কীটের মতো কঠিন স্বভাব , তারা বনের দুঃখ সইতে পারে,বা সেই তপস্বী স্ত্রীগণ, যারা তপস্যার জন্য সকল ভোগ ত্যাগ করেন, আরণ্যক দুঃখে স্থিরমতি থাকতে পারেন, কিন্তু যে সীতা ছবিতে আঁকা বানর দেখে ডরায়, সে কি করে বনে বাস করবে?
বুঝুন কান্ড একবার। আমাদের স্বামীকে মুখঝামটা দেওয়া সেই সীতার কি অবনমন, আসলে তো এ সীতার অবনমন নয়, যত যুগ এগিয়েছে ( বা পিছিয়েছে) তত সমাজে নারীর অবস্থান কীভাবে পতিত হয়েছে, এ যেন তারই এক ভাস্বর দলিল। শুধু নারীর অবস্থান নয়, সমাজটাও এমন সঙ্কীর্ণ পঙ্কিল যে স্বামী স্ত্রী’র এক কণা ‘প্রাইভেসি’ দেখিয়ে ফেললেও যেন রচয়িতার গর্দান যাবে।
যদিও সীতা শাশুড়ির পা ধরে ‘অবিনয়’ দেখিয়ে শেষপর্যন্ত রামকে অনেক কাকুতিমিনতি করে স্বামীর সঙ্গে বনের পথে পা দিয়ে বাল্মীকী প্রদর্শিত কাহিনীর গতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেছেন। কিন্তু সে যেন শুধু সাযুজ্যটুকু রাখার জন্যই রাখা। নইলে শাশুড়ির মুখে আমরা সীতা চরিত্রের যে বর্ণনা পাই, সেই দ্বিধান্বিত, ভীত, শান্ত, পুতুলের মতো, কোমল, কথায় কথায় পায়ে ধরা কেঁদেকেটে আঁচল ভাসানো সেই সীতা… কে সে?
অথচ চন্দ্রাবতী একজন নারী হয়েও কি অপ্রতিভ! তাঁর রামায়ণে ‘সুখের রজনীতে’ সখীরা লাজবন্তী সীতাকে রামের কোলে বসিয়ে দিচ্ছেন, রাম চকাস করে চুম্বনও করছেন নির্দ্বিধায়!
কৃত্তিবাস অবশ্য স্বামী স্ত্রীকে দুদণ্ড একান্তে কথাবার্তা বলতে দিয়েছেন। সীতা পতি ‘পরমগুরু’কে ছাড়া থাকতে পারবেন না এবং বাল্মীকীনিষ্ঠ কৃত্তিবাস এখানে সীতাকে ‘কুপিত সন্তাপে’ বলিয়েছেন,
‘পণ্ডিত হইয়া বল নির্বোধের প্রায়।
কেন হেন জনে পিতা দিলেন আমায়।।নিজ নারী রাখিতে যে ভয় করে মনে।
তারে বীর বলে নাকো কোন ধীর জনে।।
অর্থাৎ এখানে সীতা ‘জায়াজীবী’র মতো প্রখর ভর্ৎসনা করলেন না, কিন্তু ঠারেঠোরে কোমলাভাসে কুপিত সন্তাপটুকু জানিয়ে দিলেন। কম্ব রামায়ণের সীতাও অনেকটা এইরকমই। প্রথমে রাম তাঁকে সঙ্গে না নিয়েই বনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একথা ভেবে তিনি একটু রেগেই গেলেন। তবে বাল্মীকী – সীতার কড়া ভর্ৎসনা বা কৃত্তিবাসী সীতার মৃদু কটাক্ষ সেসব কম্বকন্যা সীতা কিছুই করেননি। বাকি কথা মোটের উপর বাল্মিকী অনুসারী। রাগ দিয়ে তাঁর কথা শুরু হলেও তারপর অভিমানে তিনি কেঁদে ফেলেছেন।
আরেকটা কথা, কৃত্তিবাস পুরুষোত্তম রামের মুখ দিয়ে একথা উচ্চারণ করাতে পারেন নি, যে তিনি ভরতকে রাজ্য, ধনের সঙ্গে সীতা অব্দি দিয়ে দিতে পারেন। তিনি যে তদ্দিনে ভগবত্তায় অধিষ্ঠিত; বাল্মীকীর নায়ক রামের রক্তমাংসল আচরণ কৃত্তিবাসী রামের কেন থাকবে? কম্ব রামায়ণের অবস্থাও তথৈবচ। তিনি বলছেন, মুখ ফুটে না চাইলেও ভরতকে আমি আনন্দিত মনে আমার সব দিতে পারি। এইরকম একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের মন্তব্যে দায় সেরেছেন। কারণ ‘সব’ এর মধ্যে সীতাকে রাখলে আছেন, না রাখলে নেই। পাঠকের উপর দায়টা ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। তুলসীদাসী রাম তো কৈকেয়ীর আশয় শুনে রীতিমতো পুলকিত হয়ে গেলেন। সামান্য একটা ব্যাপার, তার জন্য এত? পিতা মাতার আজ্ঞা পালন করা অবশ্য কর্তব্য এটুকু জানিয়েই তিনি পাত্তারি গুটিয়ে ফেললেন।
এইভাবে আমরা দেখছি, যত রাম মনুষ্যত্ব থেকে ভগবত্তায় সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, তত তাঁর দোষের পরিমাণ এক আনা দু আনা করে কমতে কমতে অধ্যাত্ম রামায়ণে দেখি… বালি বধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, শম্বুক বধ, সীতাকে বনবাসে পাঠানো এ সমস্ত ঘটনা – যা যা ভক্তের মনে ‘সচ্চিদানন্দ’, ‘পরমব্রহ্মের ‘ সম্পর্কে অস্বস্তির বোধ জাগ্রত করে, তা ভক্তিরসসিক্ত কাঁচি দিয়ে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এই রামায়ণে সীতাও ‘লোকবিমোহিনী’, অর্থাৎ যিনি সমস্ত লোককে বিমোহিত করে রেখেছেন, যে মোহিনীশক্তিকে বেদান্তে মায়ারূপে দেখানো হয়েছে।
তাই হে পাঠককুল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, সীতায় বহুদূর.. মেঘনাদ বধের সীতার কাছে যেতে হলে আমাদের এখন সীতার সঙ্গে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতে হবে।
আপনারা সহায় হোন, সঙ্গে থাকুন।
চলবে…