০
১৫৫১ বার পঠিত
আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাব মতে রসায়নের পর্যায় সারণীতে বর্তমানে ১১৮ টি মৌলিক পদার্থ আছে। এরমধ্যে ৯৮টি মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, বাকিগুলো সিনথেটিক, অস্থায়ী মৌল, তৈরির পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়।
আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের আগে দার্শনিকেরা দুনিয়ার বস্তুগুলোকে মোট পাঁচটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে গঠিত বলে মনে করতেন। কোথাও মনে করা হতো চারটি মৌল দিয়ে গঠিত। প্রায় সব কালচারে এই বিভাজনের একটা রূপ দেখা যায়। এগুলো হলো, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। অনেক জায়গায় শূন্য, আকাশ বা স্পেইসকে গণনায় ধরা হতো না। কারণ স্পেইসে বাকি চারটি মৌলের অবস্থান। স্পেইস ‘আ প্রায়োরি’, স্পেইস না থাকলে বাকি মৌলগুলো থাকার জায়গা পেত না। সেজন্য স্পেইস বা শুন্য আছে ধরে নিয়েই তারা মৌলগুলোকে চারভাগে ভাগ করত, মাটি, পানি, বাতাস আর আগুন। ইওরোপ, গ্রিক দর্শনে স্পেইসকে আলাদাভাবে আলোচনায় না রাখার কারণেই হয়ত তারা শুন্য আবিষ্কার করতে পারেনি, তাদের চিন্তা সেদিকে যায়নি। কিন্তু ভারতবর্ষে আকাশের ধারণা সেই আদিকাল থেকে ছিল, আকাশ পঞ্চভূতের অন্যতম উপাদান।
এখনকার বিজ্ঞানের হিসেবে আমরা এই সবগুলো (১১৮) মৌল সম্পর্কে জানতে পারি। মানুষের আগেকার প্রযুক্তি এবং বোধবুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা চারটি বা পাঁচটি মৌলতে ছিলাম। তবে সেটা কোনভাবে ভুল নয়, ১১৮ টির বদলে ৫ টি মৌল দিয়েও দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আলোচনার সুবিধার জন্য ১১৮টির বদলে ৫টি মৌল আছে ধরে নিলে অনেক সুবিধা।
প্যারাডাইম শিফটঃ
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞান একটা নির্দিষ্ট ‘প্যারাডাইম’, বা ‘মডেল’ অনুসরণ করে। সমকালীন প্যারাডাইমের সাথে যায় না এমন গবেষণা বিজ্ঞানের গেইটকিপার- জার্ণাল এডিটর, অধ্যাপক, প্রকাশক- এরা প্রকাশ হতে দেয় না। সেরকম কিছু প্রকাশ হলেও সেটাকে বর্তমানের প্যারাডাইমের আলোকে সমালোচনা করে বাতিল করে দেয়া হয়। একটা বড় সংখ্যক বিজ্ঞানী যদি নতুন কোন প্যারাডাইম নিয়ে কাজ করে, এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সমর্থন পায় তাহলে নতুন মডেল আস্তে আস্তে সেটার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। যেমন, বিজ্ঞানে অণুজীবের তত্ত্ব প্রসারের ফলে আগেকার ‘ম্যান মেশিন’ তত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়। আগে মানুষ ভাবত শরীর একটা মেশিন। শরীর খারাপ মানে মেশিনের কোন একটা পার্ট খারাপ হয়েছে সেটাকে ঠিক করলে শরীর ঠিক হয়ে যাবে। চোখে দেখা যায় না এমন অনুজীব শরীর খারাপের কারণ হতে পারে এটা মানুষের চিন্তায় ছিল না। বর্তমানে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে কোন বিভেদ না থাকলেও সাধারণ মানুষ এখনো সেটা চিন্তা করতে পারে না, কোভিড-১৯ এর সময় সেটা বেশ ভালভাবে বুঝা গেছে। ভাইরাস আক্রমণের শুরুর দিকে অনেকেই অদৃশ্য ভাইরাস এসে মানুষকে অসুস্থ করতে পারে বা এমনকী মেরেও ফেলতে পারে এটা ভাবতে পারেননি।
প্রাচীন মৌলঃ
আকাশঃ
প্রাকৃতিক প্রাচীন মৌলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হলো স্পেইস, আকাশ, akasha, খ । স্পেইসের সীমা-পরিসীমা আমাদের জানা নেই, কিন্তু স্পেইসের সামান্য কিছু জায়গা জুড়ে গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র, বা বস্তুর অবস্থান। বিশাল মহাশুন্য ফাঁকা, অনন্ত, অসীম। তার বিশালত্বের কারণে বস্তুবিশ্ব তাকে কলুষিত করতে পারেনি।
বাতাসঃ
বিশুদ্ধতার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাতাস, নির্মল বাতাস। বাতাসের নিজের কোন গন্ধ নেই, সে অন্যের গন্ধ বহন করে। ফলে দূষণের পরিমাণ কম হলে বাতাস সহজে নির্মল হতে পারে। বাতাসের মৌলের যে অনুপাত সেটা ইউনিক, একটু এদিক-সেদিক হলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আধুনিক মৌলের হিসেবে বাতাসে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন, আর্গন, নিয়ন, হিলিয়াম, ও ক্রিপটন মৌলকে পাওয়া যায়। বাতাসে তাই বড়জোর ৮-১০ টি মৌল আছে। প্রকৃতিতে মোট ৯৮ টি মৌল পাওয়া যায়, এরমধ্যে ১০ টির মত মৌল খুবই অল্প পরিমাণে পাওয়া গেছে। ৯৮ টি মৌলের মধ্য মাত্র দশটি বাতাসে আচে, বাতাস তো হালকা হবেই, সাথে ঘনত্ব অনেক কম। স্পেইসের কারণে বাতাসের জন্য অনেক ব্রিদিং স্পেইস আছে, মৌলগুলো অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস অনায়াসে প্রবাহিত হয়, যদি বাতাস পেতে আয়াস করা লাগে তাহলে জীবন হয়ে পড়ে কষ্টকর।
আগুনঃ
বাতাসের পরে আগুন কিন্তু টোটালি ডিফারেন্ট বল গেইম। আগুন হলো শক্তি, দৃশ্যমান জারণ বিক্রিয়া। আগুনকে তার দাহিকা শক্তিকে আলাদা করা যায় না। শক্তি দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। পারফেক্ট জ্বালানীর আগুন হবে কালারলেস। আগুনের শিখার হলুদাভ রঙ। জ্বালানী পরিপূর্ণভাবে দগ্ধ হয়ে ১০০% জারণ না হলে আগুনের এই রঙ দেখা যায়। মৌলের মধ্যে আগুন খুবই শক্তিশালী মৌল। সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। পানি এবং বাতাসের আগুনের সহযোগী। আগুন আর পানির সামঞ্জস্য না থাকলে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। এক বেশি পানির কারণে আগুন নিভে যেতে পারে অথবা পানি শুন্যতার কারণে শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাবে। দুটোই জীবনের জন্য প্রতিকূল।
পানিঃ
আগুনের পরে পানি। পানি জীবনদায়িনী, সঞ্জীবনী সুধা। বিশুদ্ধ পানিতে মাত্র দুটি মৌল আছে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। হাইড্রোজেন প্রকৃতির জ্বালানী, কার্বন এই জ্বালানীর বাহক। আর অক্সিজেন বস্তুকে জ্বালাতে সাহায্য করে। কিন্তু হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন যখন বিক্রিয়া করে, হাইড্রোজনকে যখন অক্সিজেন দ্বারা জারিত করা হয় তখন তৈরি হয় পানি। ঝরণার জলে, প্রস্রবনের পানিতে কিছু মিনারেলসও পাওয়া যায়, সেজন্য মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ঝরণার পানি পান করে আসছে। দূষিত না হলে বহতা নদী, খাল, ঝর্ণার পানি পান করা যায়। পানি নিজেকে সেডিমেন্টেশানের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করে নেয়। পানি দুনিয়ার যত ক্লেদ নিজের কাছে নিয়ে বাকি সবাইকে পরিষ্কার করে। মাটি থেকে ক্ষয় হয়ে ক্ষতিকর ধাতু পানিতে দ্রবীভূত না হলে সাধারণত পানিতে অল্পকিছু ধাতব আয়ন ছাড়া অন্যকিছু পাওয়া যেত না। গঠনের দিক দিয়ে পানি নিজে বিশুদ্ধ। ইউনিভার্সাল দ্রাবক পানি সবকিছুকে কিছু পরিমাণে দ্রবীভূত করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে দূষিত পানিতে, সমুদ্রের পানিতে দুনিয়ার প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। তারপরে বস্তুর তিনটি অবস্থা কঠিন, তরল, বায়বীয় এই তিনটি অবস্থায় অনায়াসে পরিবর্তিত হতে পারায় পানি অনেক ভার্সেটাইল। পানি বিশ্বজগতে জীবনের বাহক, প্রাণ রসায়নে পানি না থাকলে সেখানে জীবন থাকতে পারে না।
মাটিঃ
“মাটি হয়ে তবু কেন মাটিতে মিশাও।”
সবার শেষে মাটি। সবচেয়ে জটিল মৌল, ভারী, নিশ্চল, অবিশুদ্ধ মৌল। মাটি গার্বেজ, গু, গোবর, ম্যানিউর, জৈব পদার্থ, বালি, কাদা, ময়লা, পায়ের নীচে মাটির অবস্থান। এই মাটিই আবার খাঁটি। সকল ফর্মের শুরু এবং শেষ আশ্রয়স্থল, মাটি stability। মাটি থেকে সব সম্পদের সৃষ্টি। মাটি থেকেই পাওয়া যায় যতসব, মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত, সোনা-দানা, চুনি-পান্না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পায়ের নীচে মাটি থাকা লাগে। মনে নানা এন্টেনা লাগিয়ে চিদাকাশে ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে, পা কিন্তু মাটিতে আছে এইটা কোনভাবে ভুলা যায় না। পা পানিতেও স্থির হতে পারে না। পায়ের জন্য সলিড গ্রাউন্ড লাগবে। মাটি মানুষকে চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিতে বেঁধে রাখে। মানুষের জীবনে কোন মাটিতে তার জন্ম হলো, সেখানকার মাটি দিয়ে তৈরি মানুষগুলো কেমন, এসব কিছু একজন মানুষকে সারাজীবনের মত তাড়া করে বেড়াতে পারে।
কাজ করতে গেলে গায়ে কাদার দাগ লাগে। মাটি থেকে সহজে কারো মুক্তি, অন্যসব মৌলের ভূতাশুদ্ধি হয় কিন্তু মাটি সহজে শুদ্ধ হয় না, শুদ্ধতা মাটির বৈশিষ্ট্য নয়। মাটির মানুষের জীবনে কাদার দাগ থেকেই যায়।
আদিম মাটি মৌলকে ভেঙে আধুনিক রসায়ন ৯০ টির মত মৌল তৈরি করেছে। তারপরেও মানুষের কোয়েস্ট থামছে না। অণুকে ভেঙ্গে পরমাণু পাওয়া গেছে, পরমাণুকে ভেঙ্গে আরো অনেক ছোট কণিকা পাওয়া গেছে, সেগুলোকে ভেঙ্গে আরো ছোট ছোট কণিকা পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে ফান্ডামেটাল, ইন্ডিভিজিবল, অবিভাজ্য কিছু পাওয়ার জন্যে ভাঙ্গন চলতে থাকবে। তবে এই অভিযাত্রা আমাদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার সীমার দ্বারা নিয়ন্রিত। শেষ পর্যন্ত বস্তুর গঠনের জন্য একক কোন ইউনিট না পেলেও আমরা যতবেশি গভীরে যেতে পারব, ততো বেশি নতুন বিষয় জানতে পারব।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন