০
৬১২ বার পঠিত
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের এক কোভিড আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ৬২ দিন চিকিৎসা নেন। ভালো হয়ে বাড়ি ফেরার পর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার বিল পাঠানো হয় তার কাছে। সেই বিলের পরিমান শুনলে আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষেরই চোখ কপালে উঠবে। বিলের পরিমান ছিলো ১১ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে কত কোটি টাকা তা নির্ণয়ের দায়িত্ব আপনাদেরই উপর দিলাম। করতে থাকুন।
এই ফাঁকে বলে নিই, এই টাকার অঙ্ক শুনতেই আমাদের দেশের একটা শ্রেণি লাফ দিয়ে উঠবে। বলবে, দেখেছো বিদেশে চিকিৎসা করাতে কত টাকা লাগে, আর আমরা বিনা পয়সায় করাচ্ছি। আমাদের পাঁচতারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোও এত টাকা বিল করতে সাহস পাবে না। দেখো, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও এগিয়ে আছি। এগিয়ে আছিতো, যেমন কোভিডের জন্মস্থান চীনের থেকেও আক্রান্তের সংখ্যায় এগিয়ে গেছি।
এই ‘ইয়ে’দের লাফিয়ে উঠা পুরোটা না পড়েই। পুরোটা মানে শেষেরটুকু পড়লে তাদের সব উৎসাহ নিমিষেই ধুলো হয়ে যেতো। মুশকিল হলো আমাদের দেশের এই ‘ইয়ে’গণ কোন লেখারই শেষটা পড়তে চায় না, এমনকি ইতিহাসের লিখনও না। আর যদিও ভুলে পড়ে ফেলে, তাহলে পারে তো শেষের প্যারাটাকে ভ্যানিশ করে দিতে চায়।
যাক গে, শেষেরটুকু পড়লে তারা দেখতে পেতো, সেই ১১ লাখের এক ডলারও রোগীর পরিশোধ করতে হবে না। পরিশোধ হবে ইনস্যুরেন্স থেকে। বলতে পারেন পরোক্ষে সরকার থেকে। সুতরাং একজনের চিকিৎসার বিল যদি ১১ লাখ ডলারেরও বেশি হয়, হু কেয়ারস। তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, বিলের দায়িত্বও সেই রাষ্ট্রেরই।
আর আমাদের চিকিৎসার দায়িত্ব কার? ভেন্টিলেটর, আইসিইউ এমনকি অক্সিজেনর অভাবেও রোগীরা মারা যাচ্ছেন সে দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের? যদি তাই হয়, তবে কি রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করছে? প্রশ্নটার উত্তর জরুরি। এখনের জন্য না হলেও আগামির জন্য। আগামিতে যেনো আমরা রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাইতে পারি, আমাদের চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বেঁচে থাকার দায়িত্বটা কার।
আমরা নানান কথা শুনেছি। আমাদের অগ্রসরমানতার পরাকাষ্ঠা দেখেছি। এই শোনা ও দেখা যে পুরোপুরি ম্যাজিক রিয়েলিটি, জাদু বাস্তবতা তাও আমরা বুঝতে শুরু করেছি। জাদু বাস্তবতা মানে হলো- শুনি, দেখি কিন্তু স্পর্শ করতে পারি না। আমাদের এই স্পর্শহীনতার প্রয়োজন নেই। আমাদের জাদু’র দরকার নেই। দরকার স্বার্থক ব্যবস্থাপনার। যে ব্যবস্থাপনা ম্যাজিক দেখাবার চেষ্টা করবে না।
আমাদের দুয়ারে দাঁড়ানো মূর্তিমান মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়েছে ম্যাজিক রিয়েলিজম মিথ্যা। জাদু বাস্তবতার জগতটি মিথ্যা। মিথোলজি শুনতে, পড়তে ভালো লাগে। ভালো লাগে সিনেমাতেও। কিন্তু রিয়েলিটি প্রত্যাখান করে ম্যাজিককে, ম্যাজিকসৃষ্ট মিথকে। জানিয়ে দেয় এই বানানো জগত মূল্যহীন, নিরর্থক এবং অলীক।
বিনীত জানাচ্ছি যে, এই লিখাটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি গণমাধ্যমের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু অনেকের সম্ভবত মনপুত হয়নি লিখাটির নির্যাস। তাই তারা রিপোর্ট করেছেন অথবা অন্যভাবেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানানো হতে পারে যে লেখাটি তুলে নেয়া হোক। আমি জানি না এ লিখাটিতে কী এমন বিধ্বংসী কথাবার্তা রয়েছে যা কারো তুমুল বিপদ বা আপত্তির কারণ হতে পারে! এই লিখা করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামান্যতম চিত্র। মূল চিত্র এরচেয়ে ভয়াবহ। এখানে বেসরকারি হাসপাতালে আধ ঘন্টার অক্সিজেন নিলে বিল হয় প্রায় লক্ষ টাকা। এখানে সাত হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হয় সাইত্রিশ হাজারে। কোভিড চিকিৎসায় হাসাপাতালের কেবিন ভাড়া ডাবলের বেশি হয়ে যায়। যা শোধ করতে হয় রোগীদেরই। যাদের প্রচুর টাকা আছে, যারা মূল সমাজের হাজার ভাগের এক ভাগও নন তাদের হয়তো এই বিল পরিশোধ করা সম্ভব। কিন্তু আপামর মানুষের পক্ষে এই খরচ বহন করা একেবারেই অসম্ভব। এই অসম্ভবকে যেনো সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব করা যায় সেই চেষ্টাতেই ছিলো উপরের লিখাটি। আমরা যারা লিখি তারা মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেই লিখি। যা আমাদের কাছে ক্ষতিকর মনে হয় তাই আমরা চিহ্নিত করতে চাই লিখার মাধ্যমে।
এ লিখার প্রতিপাদ্য কারো কাছে এই মৃত্যুকালে আপত্তির কারণ হতে পারে এমন চিন্তা করতে নিজেকেই অসুস্থ মনে হয়। বিকৃত মনে হয়। সমস্যা না ধরিয়ে দিলে সমাধান সম্ভব নয়, এটা তাদের মাথায় আসে না। তাদের অনুভূতির রাডার মিস করে অসংখ্য মানুষের আহাজারি, কান্না। যে ফেসবুককে তাদের আপত্তি জানানো, সেই ফেসবুকেই ঘুরছে এসব আহাজারি আর কান্নার কথা। হাসপাতাল ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু। সরকারি চাকুরে, চিকিৎসক, কোটিপতি অনেকেরই চিকিৎসার জন্য, একটু অক্সিজেন না পাবার জন্য মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। প্রতিদিন দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। হাহাকার চারিদিকে। এসব আপত্তিকারদের হৃদয়ে এগুলো কোনই ছাপ ফেলে না! সত্যি বিস্মিত হতে হয় এসব পাথর হৃদয়ের অধিকারীদের কীর্তি-কাণ্ডে। বলিহারি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন