সৌন্দর্য একটি ধারণা। অ্যাফ্রিকান দেশগুলোতে ঠোঁটে, নাকে বিচিত্র সব অলঙ্কার পরে মানুষ। যার ফলে ঠোঁট ঝুলে যায়, নাক থ্যাবড়া হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ গলা লম্বা করার জন্য গলায় চুড়ির মতন লোহার গয়না পরে। এক সময় গলা হয়ে যায় রাজহাঁসের মতন। যত গলা লম্বা, তত সুন্দর। হ্যাঁ, সুন্দর আর সৌন্দর্য একটি ধারণা মাত্র।
এক সময় আমরা নিচের দিকে ঢোলা প্যান্ট পরতাম। সিক্স বা সেভেনে পড়ি, এমন প্যান্ট বানালাম, এখনকার মেয়েদের প্লাজো না কী যেন নাম তার মতন। এখন পরি চিপা, মাঝখানে ছিলো স্কিন টাইট। মানুষকে কথিত সুন্দর করে যে ফ্যাশন, সেটাও একটা ধারণা।
ধারণা জীবন-ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। দর্শন অত্যাবশ্যকীয়। ধারণা আর দর্শন যারা গুলিয়ে ফেলেন, তাদের নিয়েই সমস্যা। তারাই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কুতর্কের দোকান খুলে বসেন। যেখানে প্রয়োজন জীবন বাঁচানো, তখন তারা চিন্তা করেন শরীর সাজানো নিয়ে। বেঁচে থাকার চেয়ে তাদের কাছে শারীরিক সৌন্দর্য মুখ্য হয়ে ওঠে। শরীর থাকলেই না কালো-সাদা রং। ঢোলা-চিপা প্যান্ট। লিপস্টিক আর আলতা।
মুশতাক মরে গেছেন। তার ফ্যাশনের প্রয়োজন হয়নি, এক টুকরো সাদা কাপড়ই ছিলো যথেষ্ট। তিনি কালো বা ফর্সা ছিলেন কবরের মাটি সে হিসেবে তাকে ঠাঁই দেবে না। দেবে একটা শরীর হিসেবে। সুতরাং শরীরটা মুখ্য। আর শরীর মানেই বেঁচে থাকা। ফ্যাশন ধারণা আর বেঁচে থাকাটা দর্শন।
বোকা কুমিরের গল্পটা বারবার করতে হয়। ওই যে, শেয়াল তার বাচ্চাগুলোকে খেয়ে নিলো, নদী পারাপারের সময় সে শেয়ালের পা কামড়ে ধরলো কুমির। চতুর শেয়াল বললো, ‘পা ছেড়ে লাঠি ধরেছো বাপু’। শেয়ালের চতুর কথায় সত্যিকার অর্থেই পা ছেড়ে লাঠি কামড়ে ধরলো বোকা কুমির। আর শেয়াল পগারপার।
আমাদের চতুর শেয়ালেরা বারবার আমাদের লাঠির টোপে ফেলছে, আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। লড়াইয়ের কথায় বলতেই হয়, পদাতিক সৈন্যদের বাদ দিয়ে কখনো যুদ্ধে জেতা যায় না। যুদ্ধের মূল শক্তিই পদাতিক বাহিনি। অন্যসব অক্সিলারি ফোর্স, সহায়ক শক্তি।
পদাতিক সৈন্য বাদ দিয়ে লড়াইয়ের চিন্তা নেহাতই ফিকশন, কল্পগল্প। কোনো যুদ্ধই সহায়ক শক্তির উপর ভর করে জেতা যায়নি। যায় না। পা হলো সেই পদাতিক বাহিনি, লাঠি হলো সহায়ক শক্তি। আমাদেরও বোকা কুমিরে পেয়েছে। আর আমরাও শেয়ালের চতুরতায় বারবার পা ছেড়ে লাঠি ধরছি। আর শেয়াল হচ্ছে পগারপার।
এখানেও একই কথা। লাঠি হলো ধারণা, পা হলো দর্শন। আপনি কালো, সাদা না বাদামি তাতে কিছুই যায় আসে না, আপনি মানুষ কিনা সেটাই প্রশ্ন। কুকুর পালতে গেলে আপনি রং দেখতে পারেন। কালো নিবেন না সাদা, নাকি ধুসর। মানুষে সে প্রশ্ন নেই।
ও, কুকুরের কথা যখন উঠলোই তখন প্রভুভক্তির আলাপে যাই। অনেকেই মিশাল দেন কুকুরের প্রভুভক্তির। কুকুর কখনো বেইমানি করে না, এমন কথাও বলেন। কথাটা মিথ্যা নয়। তবে কুকুরের ভক্তি বা আনুগত্য যুক্তিহীন। মানুষ আর পশুতে পার্থক্য করেছে এই যুক্তি, লজিক। কীভাবে করেছে শুনুন। কুকুরের আনুগত্য খাবার ও আশ্রয় সম্পর্কিত। যে খাবার দেয়, আশ্রয় দেয় তারই অনুগত হয় কুকুর। তার কথাতেই ওঠে-বসে। সে তাকে প্রভু মানে এবং বিনা প্রশ্নে। আর এই বিনা প্রশ্নটাই মানুষ আর কুকুরে ভেদরেখা টেনে দেয়।
প্রভু খুনি না সাধু তা দেখার বা বোঝার ক্ষমতা কুকুরের নেই। তার কাছে খুনি বা সাধু সবই সমান। অথচ মানুষের প্রশ্ন আছে বলেই সে খুনি ও সাধুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তার আনুগত্য হয় যুক্তি নির্ভর। একজন মানুষ কখনো একজন চোর, ডাকাত ও খুনির অনুগত থাকতে পারে না, কুকুরেরা পারে। সুতরাং ভক্তি মানেই যুক্তিহীন নয়। আজকে যে ভালো, কালকে সে খারাপ হতে পারে। এই যে পরিবর্তন তার সাথে আনুগত্যেরও পরিবর্তন হয়। যার হয় না, সে খুনি ও সাধুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সে মানুষের চিন্তা ধারণ করে না। মানুষের চিন্তার সাথে তার সাদৃশ্যতা নেই।
সুতরাং ধারণা ও দর্শনের যে বিভেদ তা বুঝতে হবে। ধারণা পোশাক, দর্শন শরীর। প্রভু হলো ধারণা, আর প্রভুকে পরখ করা হলো দর্শন। ধারণা কুকুর, দর্শন মানুষ। যুক্তিহীনতা কুকুর, যুক্তি মানুষের। কথা স্পষ্ট। এরপর না বুঝলেও করার কিছু নেই। যুক্তিহীন ও কুতর্কের দোকান থেকে দূরে থাকাই সমীচীন এবং কুকুর থেকেও।