২১৭১ বার পঠিত
আপনি ঈশ্বরের সমালোচনা করতে পারবেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের না। রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকীতে এই আমার উপলব্ধি। বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে কথা বলতে যাবেন, সীমানা রবীন্দ্রনাথ, এই সীমার বাইরে যাওয়া মানা। ভয়াবহ একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে এভাবেই।
একটা ইন্টরভিউয়ে কথা বলছিলাম, এক কবি’র সাথে। একটু বিতর্কই হলো। তার ধারণা রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং তার সমালোচনাও উচিত নয়। শুধু উচিত নয় হলেও কথা ছিলো, রীতিমত অন্যায়। রবীন্দ্র সমালোচনা পাপ। তাকে বলেছিলাম, তবে কি আর কোনো রবীন্দ্রনাথ বা তারচেয়ে বড় কারো তৈরি হবার সম্ভাবনা নেই। তিনি এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন সে সম্ভাবনাকে। কী ভয়াবহ আর ধ্বংসাত্মক চিন্তা। মানুষের এগিয়ে যাওয়াকে রুখে দেয়ার ভাবনা।
না, রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে আলাপ করছি না। আলাপ-আলোচনার কথা উঠলেই সমালোচনা চলে আসবে। যে সাহিত্যের সমালোচনা করা যাবে না, সে সাহিত্যের আলোচনাও দরকার নেই। তাই সাহিত্য আলোচনা বাদ।
আলাপ করি কাল্ট নিয়ে। যেমন ভারতে ভগবান রজনীশকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো কিছু বিভ্রান্ত মানুষের কাল্ট। ‘ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান’ নামে এক কাল্টে বিশ্বাসীরা ভাবতো তাদের কাল্ট গুরু ডেভিড কোরেশ ঈশ্বরের সন্তান। আর পৃথিবীর সব নারী তার আত্মিক পত্মী। ডেভিডের চেলাচামুণ্ডারা তার সমালোচনা সহ্য করতো না। সমালোচকদের তারা ধ্বংস করে দিতো, অর্থাৎ হত্যা করতো।
কাল্টে’র সেক্যুলার ধরণ নিয়েও বলি। দ্য পিপলস টেম্পল। একটি সাম্যবাদী কাল্ট। যার গুরু জিম জোন্স। এই গুরু হলেন সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার এবং বর্ণবাদ বিরোধী। জোন্স খ্রিস্ট ধর্ম, সমাজতন্ত্র এবং বর্ণবাদ বিরোধীতা এই তিনকে ব্লেন্ড করে কাল্ট গড়ে তুলেছিলেন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে গড়ে উঠা কাল্টের ধাঁচে।
দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গুইয়ানাতে কাল্ট প্রধান জিম জোন্স তার অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন জোন্সটাউন। বিশ্বভারতীর প্রোটোটাইপ আর কী। জোন্স সেখানে শান্তির কথা শোনাতেন। সাম্যবাদের কথা, সাদা-কালো’র বৈষম্য বিলোপের কথা বলতেন। কিন্তু নিজের সমালোচনা সইতে পারতেন না। তার অনুসারীরা আরো একধাপ এগিয়ে ছিলেন। তারা তাদের গুরুর সমালোচনাকে রীতিমত পাপ হিসেবে ভাবতেন।
এক সময় অবস্থা দাঁড়ায় জোন্সটাউন থেকে যারা বেড়িয়ে আসতে চান, ত্যাগ করতে চান পিপলস টেম্পল, তাদের গুলি করে হত্যা করেন জোন্সের অনুসারীরা। সাম্যবাদের অনুসারী, রেসিজম বিরোধীদের হাতে নিহত হন তাদেরই এক সময়ের সদস্যরা। কী ভীষণ সাম্যবাদ! কী ভয়াবহ বর্ণবাদ বিরোধীতা। একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে বর্তমান সময়ে রবীন্দ্র অনুসারী আর সমালোচনাকারীদের মধ্যে। পার্থক্য হলো জোন্স অনুসারীরা শারীরিক ভাবে অন্যদের হত্যা করতো। আর রবীন্দ্র অনুসারীরা মানসিক ভাবে অন্যদের হত্যা করেন। রবীন্দ্র সমালোচনাকারীরা হয়ে যান অসাংস্কৃতিক, মূর্খ এবং উগ্রপন্থী। জোন্স অনুসারীরা যেভাবে চিহ্নিত করতেন তাদের বিরোধীদের, সমালোচকদের। বাংলাদেশে যা বুঝেছিলেন ব্রাত্য রাইসু, রবীন্দ্রনাথকে ছোট কবি বলতে গিয়ে।
বাংলাভাষীদের মাঝে রবীন্দ্র অনুসারী দু’রকমের। এক হলো বাংলাদেশের মুসলিম নামের সেক্যুরারগণ। আর পশ্চিমবঙ্গে ঠাকুরঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবি রাখা ধর্মপ্রাণরা। বাংলাদেশের যারা আছেন, তারা সেক্যুলার হিসেবে নিজেদের প্রমান করতে রবীন্দ্রনাথের অদৃশ্য ছবি বক্ষে ধারণ করেন। আর পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র অনুসারীরা ঠাকুরঘরে পূজা’র সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতে নিজেদের ধর্মপ্রাণ প্রমান করেন। দু’দলের মধ্যে পার্থক্য হলো বাংলাদেশের সেক্যুলারগণ নিজ ধর্মের বিরোধীতায় রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেন। বলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবাদতের সামিল। আর পশ্চিমবঙ্গের ধর্মপ্রাণরা নিজেদের ধর্ম ধারণে রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেন।
আবারো বলছি, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ে আলোচনার জন্য এই লেখা নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নয়। তাকে ঘিরে গড়ে উঠা কাল্ট’কে নিয়ে এই আলোচনা। জীবিতকালে এবং ততোধিক প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন যে কাল্টে’র প্রধান তথা গুরু। জীবিতকালেও তাকে ঘিরে এমন নতমাথা ভক্তি রবীন্দ্রনাথ উপভোগ করেছেন। আর না করলেও অন্তত বিরোধীতা করেননি। আর মৃত্যুর পর ভক্তি প্রণত ভক্তদের কথা বলাই বাহুল্য। তাদের জন্যই রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী হয়ে উঠেছে জন্মোৎসব। দেবতাদের জন্মবার্ষিকী যেমন হয়ে ওঠে। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষে অষ্টম তিথিতে পালন করা হয় ভগবান কৃষ্ণের জন্মোৎসব।
সাহিত্যের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা বলতে গেলে একটি কথাই বলতে হয়, তিনি ধর্মহীন ছিলেন না। ধর্ম নিরপেক্ষও নয়। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য লেখা তার প্রমান। এক সময় তিনি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। ব্রাহ্ম মানে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। বলতে গেলে, এক মে বা দ্বিতীয়ম। এক ব্যতিত দ্বিতীয় নেই, এই মতবাদ বিশ্বাসী হলেন ব্রাহ্মরা। অনেকেই খানিক ‘এক্সকিউজে’র সুরে রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম হওয়ার কথা বলেন। বলেন, রবীন্দ্রনাথ একেশ্বরবাদী ছিলেন। বাংলাদেশের সেক্যুলার রবীন্দ্র ভক্তদের মুখে এমন কথা বেশি শোনা যায়। অথচ মজার ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ‘মা’ এর বন্দনা অনেকবার এসেছে। আর সেই ‘মা’ কোন মনুষ্য জাতীয় প্রাণির সাধারণ মা নন, তিনি শক্তি রূপে বন্দিত ‘মা’। রবীন্দ্র সাহিত্য আলোচনা করতে গেলে, মুহূর্তেই একেশ্বরবাদ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর তখনই আলোচনা পরিণত হয় সমালোচনায়। যা রবীন্দ্র কাল্টের অনুসারীরা সহ্য করতে পারেন না। খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসু, কলকতার রোদ্দুর রায়’রা যে খড়গের নিচে কাটা পড়া মানুষ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন