“আমার দোষ হচ্ছে শেখবার পথে কিছুতেই আমাকে বেশীদিন চালাতে পারে নি। মন দিয়ে শেখা যদি আমার ধাতে থাকত তাহলে এখনকার দিনের ওস্তাদেরা আমাকে তাচ্ছিল্য করতে পারত না।“
রবীন্দ্রনাথ এ কথার কথা বললেও তাঁর যে গানের হাতেখড়ি হয়নি সেটা বলা যাবে না।
বিষ্ণু নামের এক পারিবারিক ওস্তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শেখা শুরু শিশুকালে। এক ব্যতিক্রমি পদ্ধতিতে গান শেখাতেন বিষ্ণু। মায়ের মুখের ছড়া দিয়ে যেমন প্রথম সাহিত্য পাঠ, ঠাকুরবাড়িতে তেমনি নিতান্ত মন-ভোলানো পাড়াগাঁয়ের ছড়া দিয়ে শিশুদের গানের হাতখড়ি হতো। রবীন্দ্রনাথের কথায়,
“সেগুলো পাড়াগেঁয়ে ছড়ার অত্যন্ত নীচের তলায়। যেমন,
এক-যে ছিল কুকুর-চাটা শেয়াল-কাঁটার বন
কেটে করলো সিংহাসন।
তখন হারমোনিয়াম আসেনি এ দেশের গানের জাত মারতে। কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করিনি।“
হারমোনিয়ামের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিরূপ ধারণা চিরকালই ছিল। অথচ তারপরে সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে তিনি হারমোনিয়ামেই ব্রহ্মসংগীত আউড়েছেন। এর পরে সেতার নিয়ে ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক বন্ধু শ্রীকন্ঠবাবুর কাছেই রবীন্দ্রনাথের আক্ষরিক অর্থে প্রথম গান শেখা ও গানের প্রতি ভালোলাগার শুরু।
রবীন্দ্রনাথের বড় হওয়ার সাথে সাথে আরও বড় ওস্তাদ এলেন ঠাকুরবাড়িতে, যদুভট্ট। মস্তবড় গানের ওস্তাদ। ঠাকুরবাড়ির সকলকে গান শেখাবেনই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ওস্তাদের শেখানো পথে চলতে রাজি হ’বার পাত্র নন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
“(যদুভট্ট) একটা মস্ত ভুল করলেন, জেদ ধরলেন আমাকে গান শেখাবেনই-সেইজন্যে গান শেখাই হল না”।
কিন্তু সেজোদাদা, জ্যোতিদাদাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের, সাহিত্য শিক্ষা ও ভাবের প্রধান সহায়। পরবর্তীতের বৌঠান কাদম্বরী দেবী।
এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথ একটি গানের কথা উল্লেখ করেছেন, ১৮৭৭ সালে লেখা গান ‘গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে‘। এক মেঘলাদিনের মধ্যাহ্নে খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে স্লেট লিখেছিলেন গানটি। শুনিয়েছিলেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীকেই প্রথমে।
তারপর রবীন্দ্রনাথ বিলেত গেলেন পরপর দু’বার। পাশ্চাত্য বিশেষকরে আইরিশ মেলডীজ শোনা ও শিক্ষা তাঁর সংগীত জীবনে বিশেষ প্রভাব রেখেছে। অনেক বিখ্যাত গান তিনি আইরিশ মেলডিজ অনুকরণে সুর দিয়েছেন শুধু নয়, বাংলা সংগীতে পাশ্চাত্য সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়,
“দেশে ফিরিয়া আসিয়া এই-সকল এবং অন্যান্য বিলাতি গান স্বজনসমাজে গাহিয়া শুনাইলাম। সকলেই বলিলেন, “ রবির গলা এমন বদল হইল কেন! কেমন যেন বিদেশী রকমের-মজার রকমের-হইয়াছে”।
বাল্মিকীপ্রতিভা গীতিনাট্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের দেশী ও বিলেতি সুরের সংমিশ্রিত চর্চার প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাল্মিকীপ্রতিভা সম্বন্ধে উচ্চধারণাই পোষণ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন,
“যাঁহারা এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়াছেন তাঁহারা আশা করি এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, সংগীতকে এইরূপ নাট্যকার্যে নিযুক্ত করাটা অসংগত বা নিস্ফল হয় নাই।”
রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ক্ষেত্রে এই বাল্মিকীপ্রতিভা গীতিনাট্যের স্বার্থক উপস্থাপনা এবং তখনকার বিদ্বজ্জনের ভূয়সী প্রশংসা এক অপরিসীম উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা এনে দিয়েছিল। তাই তো বাল্মিকীপ্রতিভার পরপরই তিনি এ রকম আরেকটি গীতিনাট্য লিখলেন, নাম কালমৃগয়া। ২৩ ডিসেম্বর,১৮৮২ সালে তেতলার ছাদে স্টেজ বানিয়ে কালমৃগয়া প্রথম অভিনীত হয়েছিল।
এক অন্য ও অনন্যধারার সংগীতসৃষ্টি যা রবীন্দ্রনাথ নিজেই একসময় বলেছেন,’দস্তুরভাঙা গীতবিপ্লবের প্রলয়ানন্দ’- তার পেছনে বাল্মিকীপ্রতিভা ও কালমৃগয়ার ভূমিকা অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“সংগীত সম্বন্ধে উক্ত দুই গীতিনাট্যে যে দুঃসাহসিকতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহাতে কেহই কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই এবং সকলেই খুশী হইয়া ঘরে ফিরিয়াছেন।”
তাই রবীন্দ্রনাথের যে অমর সৃষ্টি গান, সে গানের পেছনে তাঁর প্রথম জীবনের রচনা দু’টোর অনুপ্রেরণা অসীম। সেইসাথে তাঁর পারিবারিক পরিবেশ বিশেষত সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানও অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের কথায়,
“কখনো –বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম; জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন, আমি গান গাহিতাম-পূরবী রাগিণী হইতে আরম্ভ করিয়া যখন বেহাগে গিয়া পৌঁছিতাম তখন পশ্চিমতটের আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হইয়া গিয়া পূর্ববনান্ত হইতে চাঁদ উঠিয়া আসিত।”
১৮৮৭ সালে রবীন্দ্রনাথে মাঘোৎসব উপলক্ষে অনেকগুলো গান রচনা করে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ তখন চুঁচূড়ায় অবস্থান করছিলেন। সেজদাদা জ্যোতিদাদার হারমোনিয়ামের সাথে রবীন্দ্রনাথের গান। দেবেন্দ্রনাথ মোহিত হয়ে একইগান দু’দুবার করেও গাইতে বলছিলেন। গানের পরে বাবা রবীন্দ্রনাথকে একটি পাঁচ-শো টাকার চেক দিয়ে বলেছিলেন,
“দেশের রাজা যদি দেশের ভাষা জানিত ও সাহিত্যের আদর বুঝিত, তবে কবিকে তো তাহারা পুরষ্কার দিত। রাজার দিক হইতে যখন তাহার কোনো সম্ভাবনা নাই, তখন আমাকেই সে কাজ করিতে হইবে।”
পিতাকে শোনানো সে গানগুলোর একটা গান, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’।
দুই.
রবীন্দ্র গবেষক সমীর সেনগুপ্ত তাঁর ‘গানের পেছনে রবীন্দ্রনাথ‘ বইয়ে লিখেছেন,
“১৮৭৫ সালে পিতার সাথে বেড়াতে গিয়ে গীতগোবিন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দু’বছর লেগেছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের জয়দেবের গীতগোবিন্দ আত্মস্থ করতে”।
তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ষোল। সেসময় থেকে আর ক’বছরের মধ্যেই তিনি ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ লিখলেন ব্রজবুলি ভাষায়। অনেকেই ব’লে থাকেন বালক রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর প্রতিভার এ প্রথম উন্মেষ।
যদিও শান্তিদেব ঘোষ ভানুসিংহের পদাবলীর গানগুলো সম্পর্কে বলেছেন,
“এ গানগুলির সুরে একটি সহজ মাধুর্য আছে,এবং তা কথার সংগেও মানিয়েছে, কিন্ত অল্পবয়সের রচনা বলে শিল্পীর সহজাত নৈপুণ্য সুরযোজনার দিক থেকে তেমন প্রকাশ পায়নি”।
কারণ হিসেবেও শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, এ গানগুলো প্রথমে কবিতা হিসেবে রচিত হয়েছিল, পরে সেখানে সুর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ নিজেও পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে সুরযোজনা না করে প্রচলিত দেশী রাগ-রাগিনীতে ও পদ্ধতিতে ভানুসিংহের পদাবলীর গানগুলিতে সুর দেন।
শান্তিদেব ঘোষ আরও বলেছেন,
“এক-একটি গানের অন্যান্য সবক’টি তুকে প্রায় একই সুরের পুনরাবৃত্তি। সুরের দিক থেকে কোনোরূপ কল্পনার কোনো চেষ্টা এগুলিতে দেখা যায় না”।
ভানুসিংহের পদাবলী থেকে মোট সাতটি গান এখন পর্যন্ত গাওয়া হয়ে থাকে –
১) গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে
২) মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান
৩) সজনি সজনি রাধিকা লো
৪) শুন লো শুন লো বালিকা
৫) আজু সখি মুহু মুহু
৬) শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটা
৭) বাজাও রে মোহন বাঁশি
শান্তিদেব ঘোষ ভানুসিংহের পদাবলীর গানগুলোতে সুরের যে দূর্বলতার কথা বলেছেন, সে প্রসংগে সমসাময়িক সময়ে রচিত আরো কিছু গানের উল্লেখ করা যাক। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সালে রচিত হয় ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। গানটি ছায়ানট রাগে সুরসংযোজিত। আর ছায়ানট উত্তরভারতীয় একটি রাগ, যা আলাহিয়া বিলাবলের সাদৃশ্য একটি রাগ।
এর একবছর পরে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ দেশীয় পদ্ধতিতে অনেকগুলো গানের সুরসংযোজন করেন। গানগুলো ও সংযোজিত রাগ-রাগিনীগুলো এ রকম –
১) নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায় – (রাগ রাগিনী: মিশ্র বেহাগ-পূরবী-কাফি)
২) বলি ও আমার গোলাপবালা – ( রাগিনী-বেহাগ)
৩) শুন নলিনী খোলো গো আঁখি – ( রাগ –খট)
৪) আঁধার শাখা উজল করি – (রাগ: গৌড়সারং)
এ ক’টি গানের সুরসংযোজনার ব্যবহার দেখেই বোঝা যায় এ বয়স পর্যন্ত সমস্ত গানের সুরে হিন্দি-রাগরাগিনীই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র অবলম্বন ছিল। যার দেখা মেলে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ ও পরবর্তীতে ২১ বছর বয়সে লেখা ‘বাল্মিকী প্রতিভা’র সকল গানেও।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বাইশ তেইশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কোন গানে বাংলা কীর্ত্তন ও বাউল সুরের দেখা মেলে না। ব্যতিক্রম শুধু “ভানুসিংহের পদাবলী”- যেখানে বাংলার কীর্তনের ঢং পাওয়া যায়।
তিন.
রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ শিষ্য গুণী সংগীতশিল্পী শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রনাথের গানে কীর্তনের প্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন,
“জীবনের শেষার্ধে রচিত বহু গান গুরুদেবের হাতে প’ড়ে যে সম্পূর্ণরূপে রাবীন্দ্রিক কীর্তনে পরিণত হয়েছে, একথা বাংলার গায়কমহল সকলেই জানেন। কিন্তু কথা হচ্ছে যে তাকে কীর্তন গান বলা যায় কীনা? কীর্তনের আখর দেওয়া পদ্ধতিও তাঁর এই পর্বের গানে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন। কেবল ‘আমি শ্রাবণ আকাশে ঐ’ গানটিতে ব্যতিক্রম দেখি”।
রবীন্দ্রনাথের আখরযুক্ত কিংবা আখরমুক্ত যে কীর্তনাংগের গান তা নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে কীর্তন গানের উদ্ভব ও এর ধারাবাহিক পরম্পরা নিয়ে খানিক আলোচনা করা আবশ্যিক।
অনেকেই ‘প্রবন্ধ সংগীত’কে কীর্তন গানের পূর্বতন রূপ বলে মনে করেন। তাঁদের (যেমন, সংগীতবিশেষজ্ঞ খগেন্দ্রনাথ মিত্র,উৎপলা গোস্বামী প্রমুখ) মতে,
“প্রবন্ধ সংগীতের চারটি ধাতু ও ছ’টি অংগ থাকে। অধিকাংশ বৈষ্ণব পদাবলীতেও উদগাহ,মেলাপক, ধ্রুব এবং আভোগ-এই চারটি ধাতু বা অবয়ব গঠনের রীতি অনুসরণকরা হয়েছে”।
এ যুক্তি মেনে নিলে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ প্রথম ‘প্রবন্ধ সংগীত’। তার প্রায় দুশ’ বছর পরে পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রাচীন ধারার চর্যাপদ ও প্রবন্ধ সংগীতের গায়ন রীতি থেকে এক নতুনধারা সূচনা করেছে।
এই পঞ্চদশ শতাব্দীতে আরও দুজন বাংলাকে মাতিয়ে তুলেন এক নতুন ধারার পদ রচনা করে, এর নাম ‘কীর্তন গান’। প্রথমে কীর্তন পদ রচনা করেন বিদ্যাপতি। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দ-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ) এই কীর্তন গানকে আধ্যাত্মিক মার্গে উন্নীত ও জনপ্রিয়ই শুধু করেননি, এই কীর্তনগানের মাধ্যমে সমাজপরিবর্তনে সচেষ্ট হোন। প্রথিতযশা সংগীতবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘গভীর নির্জন পথে’ গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবকে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“শ্রীচৈতন্য আমাদের দেশে এসেছিলেন এক সময়োচিত ভূমিকায় পরিত্রাতার রূপে। তখন ষোড়শ শতকে শাসক মুসলমানের ব্যাপক হিন্দু ধর্মান্তকরণ রুখতে এবং শূদ্রবর্ণের উপর শুদ্ধ ব্রাহ্মনদের অত্যাচার ঠেকাতে তিনি এক উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্মের পরিকল্পনা নেন। তাঁর ধর্মসাধনের সরলতম পন্থা ছিল ‘হরেনামৈব কেবলম্’”।
শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যুর পরে স্বরূপ দামোদর,রায় রামানন্দ, স্বামী কৃষ্ণদাস-যাঁরা একাধারে ছিলেন উচ্চাংগ সংগীতজ্ঞ, তাঁরা কীর্তন গান ও পদের মাধ্যমে বৈষ্ণব ধর্মাচরণ করতেন। কিন্তু বাংলায় কীর্তন গানের নতুন ধারার প্রবর্তন করেন নরোত্তম দাস। তিনি বিলম্বিত ধ্রুপদকে ভিত্তি করে যে কীর্তন গান সৃষ্টি করলেন তার নামরসকীর্তন কিংবা লীলাকীর্তন। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় খেতরী গ্রামের এক জমিদার বংশে নরোত্তম দাস জন্মগ্রহন করেন। তিনি খেতরী গ্রামে দশদিন ব্যাপি এক কীর্তন গানের উৎসব করেন ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে, যা খেতরী-মহোৎসব নামে খ্যাত।
জানা যায়, কীর্তন গানের তিনটি ধারা –
এক) নরোত্তম দাসের প্রবর্তিত পদ্ধতির নাম ‘গরাণহাটী’,যা গড়েরহাট কিংবা গরাণহাট পরগরণার নামানুসারে।
দুই) ‘মনোহরশাহী’ ধারা, যা বীরভূম জেলার মনোহরশাহী পরগনার নামানুসারে।
তিন) ‘রেণেটী’ ধারা,যার প্রবর্তক ওড়িশার শ্যামানন্দ,যাঁকে গৌড়-উৎকলা বলে অভিহিত করা হয়।
শ্রীচৈতন্যদেবের সময়েই প্রথম কীর্তন গানে দেখা যায় গীত ও নৃত্যের সমাহার। এককথায় কীর্তন গান সে সময় থেকেই পরিণত হয় এক উৎকৃষ্ট ও অভিজাত সংগীতে। এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
“বাঙালির কীর্তনগানে সাহিত্যে সংগীতে মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল–তাকে প্রিমিটিভ এবং ফোক্ ম্যুজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবেনা। উচ্চ অঙ্গের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব জটিল ও বিচিত্র, তার তাল ব্যাপক ও দুরূহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহুশাখায়িত নাট্যরস আছে তা হিন্দুস্থানী গানে নেই”।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথমদিকে প্রচলিত ধারার সাথে মিল রেখে যে কীর্তন গান লিখেন সেগুলো আখর যুক্ত। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি গানের উল্লেখ করা যায় –
– নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে ( রাগ- যোগিয়া কীর্তন, তাল-একতাল, রচনাকাল- ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ)।
– ওহে জীবনবল্লভ (রাগ- কীর্তন, তাল-একতাল, রচনাকাল- ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ)
– আমি সংসারে মন দিয়েছিনু (রাগ- কীর্তন, তাল-একতাল, রচনাকাল- ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ)
– মাঝে মাঝে তব দেখা পাই (রাগ- কীর্তন, তাল-দাদরা, রচনাকাল- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ)
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীতে আখরকে বাদ দিয়েই কীর্তন রচনা করেন। এ প্রসংগে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন,
“আখর সমেত গাইবার সময় দেখা গেল যে… আখর যেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার জন্য ব্যস্ত”।
আখর বর্জিত ও বাউল গানের প্রভাবযুক্ত যে স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ নতুন ঢংয়ের কীর্তন, যেখানে হিন্দি উচ্চাংগসংগীতের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, সেগুলোকেই রবীন্দ্রবোদ্ধারা বলেন, ‘রাবীন্দ্রিক কীর্তন’। এ প্রসংগে উদাহরণ হিসেবে ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’ ( চিত্রাংগদা নৃত্যনাট্যে সংযোজিত) কথা উল্লেখ করা যায়। গানটি বেহাগ মিশ্র কীর্তনরাগে ও কাহারবা তালে রচিত, রচনাকাল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ। এ পর্যায়ে আরেকটি বিখ্যাত গানের কথা বলা যায়, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’; গানটির রাগ – কীর্তন, তাল- অর্ধঝাঁপ ও রচনাকাল-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ।
বাংলা গানের এক মহোত্তম সৃষ্টি কীর্তন গান রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তিনি তা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন,
“বাংলাদেশে কীর্তন গানের উৎপত্তির আদিতে আছে একটি অত্যন্ত সত্যমূলক গভীর এবং দূরব্যাপী হৃদয়াবেগ। এই সত্যকার উদ্দাম বেদনা হিন্দুস্থানী গানের পিঞ্জরের মধ্যে বন্ধন স্বীকার করতে পারলে না–সে বন্ধন হোক-না সোনার, বাদশাহীহাটে তার দাম যত উঁচুই হোক। অথচ হিন্দুস্থানী সংগীতের রাগরাগিণীর উপাদান যে বর্জন করে নি। সে-সমস্ত নিয়েই সে আপন নূতন সংগীতলোক সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টি করতে হলে চিত্তের বেগ এমনিই প্রবলরূপে সত্য হওয়া চাই”।
শুধু সংগীত কেন, সমস্ত শুদ্ধ সৃষ্টিতেই চিত্তের বেগ প্রবলতররূপে সত্য হয়ে প্রকাশিত হতেই হয়।