সাহিত্যিক
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে সুনীলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আগামীতে তাঁকে কেউ মনে রাখবে কী? সুনীল বলেছিলেন, তিনি গান লিখে যাননি, তাই তাঁকে মনে রাখার তেমন কোন সম্ভাবনাও নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল মাপের লেখক-কবিকে তেমন করে কেউ কী মনে রাখছেন, শুধু তাঁর গান ছাড়া?
কথাটি সুনীল পরিহাসচ্ছলে বললেও একথা তো ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথের বিশাল কর্মের অনেক কিছুই যেন আজ অপঠিত হয়ে পড়ছে, শুধু গান ছাড়া। নতুন প্রজন্মের অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে ভুল করে ভেবে বসতে পারেন যে, তিনি শুধুই সংগীতের কথা ও সুর রচনা করে গেছেন। অথচ রবীন্দ্রব্যাপ্তির বিশালতায় সংগীত এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এ প্রসংগে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথ সেনকে লিখেছিলেন,
“গানের কবিত্ব সম্বন্ধে যা লিখেছ সবই মানি। কেবল একটা কথা ঠিক নয়। মাথায় কবিতা সম্বন্ধে কোনো থিওরিই নেই। গান লিখি, তাতে সুর বসিয়ে গান গাই– ওইটুকুই আমার আশু দরকার– আমার আর কবিত্বের দিন নেই”।
অথচ কবির কথায় সে কবিত্বহীন সৃষ্টিকর্মই যেন কবির পরিচিতিকে সামনে তুলে ধরছে আজ; অন্য সব কিছুকে পেছনে ফেলে!
কথাচ্ছলে বিনয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংগীতে কাব্যহীনতার কথা বললেও, রবীন্দ্রনাথের সংগীতে কাব্যভাবের যে প্রকাশ,সেরকমটি বাংলা কেন, অন্য কোন ভাষার সংগীতেও আছে কীনা সেটা বিবেচ্য। আর সেকারণেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানগুলোকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা, স্বদেশ, বিচিত্রসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ফেলেছেন। এ বিভক্তির পেছনে সুরের চেয়ে কথাকাব্যের প্রাধান্যই সবিশেষ। তাই রবীন্দ্রনাথের গান শুধু সুরের প্রক্ষেপণ নয়, বাণীর সুসংবদ্ধ উচ্চারণও। তাই যাঁরা রবীন্দ্রসংগীতচর্চা করেন, তাঁদেরকেও এ কথাগুলো শিরোধার্য মেনেই গান পরিবেশন করা উচিত।
একজন সামান্য শ্রোতা হিসেবে অনেকের মতো আমাদেরও কামনা, শুধু রবীন্দ্রনাথের গান কেন, যে কোন গান যখন কোন শিল্পী অনুষ্ঠানে পরিবেশন করবেন, তখন সে গানটির পেছনের কথা অর্থাৎ গানটির রচিয়তা ও সুরকারের নাম, কথা ও ভাবের কোন পর্যায়ে গানটি পড়ে এবং গানটি কোন সুর ও তালের অন্তর্ভুক্ত ইত্যাদি উল্লেখ করেই গানটি পরিবেশন করবেন। কারণ, গানের পেছনের মানুষগুলোর অপরিসীম সৃষ্টিশীলতাই কোন গানকে শিল্পীর কণ্ঠের মাধুর্যে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেয়। তাই গান উপস্থাপনের সাথে সাথে গানের পেছনের সে মানুষগুলোকে উপস্থাপন করাও শিল্পীর দায়িত্ব।
গানের একজন শিল্পীকে মনে রাখা উচিত, একটা গান কণ্ঠস্থ করতে যে পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও সাধনা তাঁকে করতে হয়, গানের কথা ও সুরের স্রষ্টা কিংবা প্রথম যিনি গানটা কণ্ঠধারণ করেছিলেন, তাঁকে তারচেয়ে শতগুণ পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও সাধনা করতে হয়েছে। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী – এ তিন জনকে নিয়েই রচিত হয় একটি গানের পূর্ণতার বৃত্ত।
দুই)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছ থেকে যত গঞ্ছনা সয়েছেন,তার অধিকাংশই ছিল রবীন্দ্রকাব্য ও সংগীতে অশ্লীলতার অভিযোগ। মোহিতলাল মজুমদার ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়দের নেতৃত্বে রবীন্দ্রবিরোধী গোষ্ঠীর প্রধান অভিযোগই ছিল, ‘রবীন্দ্রনাথের লেখা অশ্লীল, রবীন্দ্রনাথের লেখা বাঙালি যুবসমাজের মাথা খাচ্ছে‘। বিশেষ করে যে দু’টি গানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ‘নির্লজ্জ লাম্পট্যের‘ অভিযোগ প্রবলতর ছিল, সে গান দু’টো হলো- ‘তুমি যেও না এখনই, এখনো আছে রজনী‘1 এবং ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হলো মরি লাজে‘2।
রবীন্দ্রনাথের সৌভাগ্য যে, দিন যত বহে গেছে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অশ্লীলতা‘র অভিযোগও তত কমে এসেছে। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য তাঁর সংগীতসাহিত্যে (?) ‘অশ্লীলতা‘কে এমন সুক্ষ্ণ ও সুরুচিসম্মত মনোময় ভাষায় প্রয়োগ করেছেন যে, সাধারণ বাঙালির বোধের ‘ইথারে’ তা ধরা পড়েনি।
যদিও ‘অশ্লীল‘ শব্দটির প্রাসঙ্গিক ইতিহাস সন্ধান করলে দেখা যায় ‘শিল্পে যা সৌন্দর্যের পরিপন্থী তা-ই অশ্লীল‘। এবিষয়ে সংস্কৃতভাষা ও প্রাচীন ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ডঃ সুকুমারী ভট্রাচার্য বলেছেন,
“আর্যরা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যখন মগধের কাছাকাছি আসে তার পরে কথ্য মাগধী ভাষার প্রভাব পড়ে বৈদিক সংস্কৃতে। সংস্কৃতে যেটা ‘র’, মাগধী প্রাকৃত সেটা ‘ল’; কাজেই বৈদিক ‘শ্রীর’ শব্দ মাগধী-প্রভাবিত ‘শ্লীল’ শব্দে পরিণত হল। ‘শ্রীর’ মানে শ্রীযুক্ত;কাজেই শ্লীলতা বিচারে মূল নিরিখ ছিল সৌন্দর্য”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অসাধারণ প্রতিভা আর মেধার মাধ্যমে পরিশীলিত পাঠকের মনে রসবোধে ব্যাঘাত জন্মায় সে ব্যাপারে ছিলেন চূড়ান্তভাবেই সতর্ক। সে কারণে রবীন্দ্রনাথের রচনায় ‘অশ্লীলতা’র অভিযোগটিও আর ধোপে টেকেনি পরবর্তীতে।
অথচ রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবকে রাবীন্দ্রিক ভাষার বাইরে গিয়ে সাধারণমানের অর্থে বিশ্লেষণ করলে সেখানে দেহজকামের পরিপূর্ণ সাক্ষাৎ মেলে। উপরে উল্লেখিত দু’টি গান, ‘তুমি যেও না এখনই, এখনো আছে রজনী’ এবং ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হলো মরি লাজে’ বাদ দিলেও তাঁর প্রেমপর্যায়ের অনেক গানে মানবঅঙ্গের বর্ণনা ও কামরসের বিরহে বিরহীমনের ও দেহের আকুলতা দেখা যায়।
একেবারেই বহুশ্রুত কয়েকটি গানের কথাই ধরা যাক।
“খোল খোল দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমারে দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে”।3
একাকী মনে প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সংবেদনার চরম আকাঙ্ক্ষা; মিলনের এবং সংস্পর্শের। তেমনি আরেকটি গান প্রেম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত একটি গান ‘তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো,ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া’। একেবারেই মিলন-মত্ত যুগলের প্রেম-আকাঙ্ক্ষার কথায় রচিত গানখানি। মিলন অভিসারের চূড়ান্ত রূপ পায় গানটির শেষ লাইন দু’টিতে,
“আমায় পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে
তুমি যাও যে সরে-
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক
ওগো দুখজাগানিয়া॥”4
কিংবা প্রেম পর্যায়ের (২৫) আরেকটি গানের কথাই ধরা যাক, ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি/কেউ কী তা জানে’। মিলনের পরে দূরে থাকার বিরহ থেকেই গানটি। গানটির শেষ পয়ারে ব্যক্ত হয়,
“ওদের নেশা তখন ধরে নাই,
রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই ॥
তখনো তো কতই আনাগোনা,
নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা–
ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা
দলে এসেছি কেউ কী তা জানে”।5
দূরত্ব আছে, অবিশ্বাসের আভাসও আছে, বিরহ আছে, সন্দেহ আছে; কিন্তু কোথাও সৌন্দর্যের পরিমিতিবোধের একটু ঘাটতি নেই। দেহের আংশিক উন্মোচন আছে, চর্চিত দূরত্বের সাথে আছে মোহময় অবগুণ্ঠন; কিন্তু শিল্পগত রুচির বিচারে কোথাও ‘অশ্লীলতা‘য় গানগুলো হীন হয়ে পড়েনি। বরং রবিঠাকুরের পূজাপর্বের প্রায় সকল গানেই প্রেমের বাণী জাগতিকতা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভিন্ন ভিন্ন বোধ ও বিশ্বাসের বহুমূখিতায়।
তিন)
গান মানুষের জীবনের গভীর দুঃখ ও হতাশার দিনগুলোতে ভরসা দেয়। সে গান যে শুধু রবীন্দ্রনাথ কিংবা বড় কোন কবির দার্শণিক জীবনবোধের কথা হবে এমনটি নয়। একেবারে আটপৌরে সহজ কথা ও সুরের গানগুলো লক্ষ-কোটি মানুষের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে হাটে-মাঠে-ঘাটে-কলে-কারখানা কিংবা ব্যস্ত কোন জনপদে। বাংলাদেশের এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানেসে অঞ্চলের লোকগাঁথাভিত্তিক গান রচিত হয়নি। বাংলাদেশে এমন কোন জনপদ নেই যেখানে সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর কিংবা রাতের কোন নিশুথিপ্রহরে গানের সুর ভেসে আসে না। খুব ছোটবেলায় হেমন্তের প্রারম্ভে আমাদেরও ঘুম ভেঙ্গে যেত বৈষ্টম-বৈষ্টমীর টহলের গান ‘রাই জাগে শ্যাম জাগে, ব্রজবাসী জাগোরে’ এমন সবগানে। একেবারেই প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষাহীননারী-পুরুষদেরকেও দেখেছি বিশেষ কোন গানের উদ্বৃতি দিয়ে বলতে যে, তাঁর জীবনটা অমুক গানের কথার সাথে একেবারে মিলে গেছে; এমন এক অতি দুঃখের জীবন তাঁর।
পরবর্তীতে প্রায় সমস্ত মনীষিদের জীবনেও এর ব্যতিক্রম দেখি নি। তেমনি এক নন্দিত-নিন্দিত সাহিত্যিক নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী, যিনি নিরোদ সি চৌধুরী হিসেবেই পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান‘ গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি পঞ্চাশের দশকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তারপর নামকরা আরো আট-নয়টি বই লিখেন ইংরেজিতে এবং প্রায় সবগুলো বই-ই বেস্টসেলার হয় প্রকাশের সাথে সাথেই। বাংলাতেও লিখেছেন, ‘আত্মঘাতী বাঙালি‘, ‘আত্মঘাতী বাঙালি ও রবীন্দ্রনাথ‘, ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি‘, ‘আমার দেশ আমার শতক‘ ইত্যাদি।
ব্যক্তিগতভাবে নিরোদ সি-র সব কথার সাথে আমি সহমত নই। কিন্তু ইতিহাস ও অকপটে সত্যকথনে তাঁর জুড়িমেলা ভার; আমার শ্রদ্ধা ও সমীহের ক্ষেত্রটা সেখানেই। তাই ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ – যা লেখকের আত্মজীবনী এবং ভারতবর্ষ ও ইউরোপের ইতিহাস ও সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি কীভাবে নিজের জীবন গড়ার চেষ্টা করেছেন, তা বিধৃত আছে। এ বইটি আমার অবশ্যপাঠ্য তালিকায় সেলফে হাতের নাগালে থাকে। আমিও উজ্জীবিত হই বইটি পড়ে।
গান নিয়ে কথার পেছনে এতসব ধানাই-পানাইয়ের মূল কারণ, নিরোদ সি চৌধুরী স্বীকার করেছেন যে, তিনিও গান বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানকে তাঁর চরম দুর্দিনে পাথেয় হিসেবে পেয়েছিলেন। এখানে নিরোদ সি চৌধুরীর লেখা থেকেই তুলে দেই,
“আমি যখন ১৯২৬ সনে সরকারী চাকুরী ছাড়িলাম, তখন এই আশা করিয়াই ছাড়িয়াছিলাম যে, লেখকবৃত্তিতে জীবিকানির্বাহও করিতে পারিব, জীবনে সার্থকতাও আনিতে পারিব। প্রথমে জীবিকার্জনও হয় নাই, পরে ‘প্রবাসী’র সহকারী সম্পাদক হিসেবে তাহা হইল। কিন্তু লেখক বলিয়া কিছু খ্যাতি লাভ করিলেও উহাকে চরম সার্থকতা দূরে থাকুক, উতসাহপাইবার মত সার্থকতাও মনে হইত না। তাই ১৯২৯-৩০ সনে যখন আপিসের কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিতাম তখন একটা গভীর বিষাদ আমার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিত।পথ চলিতে চলিতে একটা গানের কথা ও সুর কানে বাজিত ও নিজেও অনুচ্চস্বরে গাহিতাম। সেটা এই,
এখনও গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা
এখনো মরণব্রত জীবনে হল না সাধা।
কবে যে এ দুঃখজ্বালা হবে রে বিজয়মালা
ঝলিবে অরুণরাগে নিশীথ রাতের কাঁদা।
-চোখে জল আসিয়া পড়িত। এই দীর্ঘ নিশীথরাতের কাঁদা ঘুচিয়া আমার জীবনে একটু অরুণরাগ দেখা দিতেও বিশ বছর লাগিয়াছিল।”
( নিরোদ সি চৌধুরী, আমার দেবোত্তর সম্পত্তি)
তাই এখনো নিরোদ চন্দ্র চৌধুরীর মতো বিদ্য-বিজ্ঞ-সাধারণ অসংখ্য মানুষ গান নামের সুর ও কথার এক মোহময় আবেশ দিয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। গানের এমনি এক সঞ্জীবন ক্ষমতা!!
চার)
স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনার মুহুর্তকে এভাবে বলা যায়,
“থামলাম, না থেমেও যাওয়া যেতো
এত দূর চলে এসে
বৈরাগ্যের ঝুলির প্রতি পিছুটান
টহলের মুষ্ঠিভিক্ষা মোহ।
যদিও মন মজে আছে
জোছনা বোষ্টুমির দেহের মাধুরীতে।“
পংক্তিগুলো যতবার পড়ি মনে হয় থামলাম বলে যে একটি ‘কমা’ দেয়া হয়েছে, তা কেন? এটুকু পড়ে মনে হতে পারে যে, চলেছি অনন্তকাল। যেমন অনেকে ভীষণ গর্বভরে বলি, ‘আমাদের জীবনের চলার পথ’। কথাটি আমরা অবচেতন মনে রবিঠাকুরের কাছ থেকে ধার করে নিই। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, আমার এ পথ চলাতেই আনন্দ। আমরাও বলি সে সুরেই। আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ নই, অথচ সবার ভিতরেই এক মূর্তমান রবীন্দ্রনাথ। তাই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের আবেগের প্রকাশ পূর্ণতা পায় না; অজান্তেই রবিঠাকুর ভর করে দাঁড়ায়।
অথচ আমাদের অনেকেরই ‘জীবনে পথ চলা‘ কথাটাই ভুল। এ জীবনের পথ অনেকাংশেই চলার নয়, পলায়নের। আমরা প্রায় সবাই পালাচ্ছি। নিজের কাছ থেকে; বর্তমানের কাছ থেকে; বাস্তবতার কাছ থেকে; কঠিন সত্যের মুখোমুখি হবার ভয় থেকে আমরা পালাচ্ছি। নিজেদের সুবিধেমতো স্বার্থের অভিমুখে আমাদের এ পলায়নপরতা। তাই ওই যে, ‘না থেমেও যাওয়া যেতো এত দূর চলে এসে’। অথচ কেন থামলাম? কতদূর এসে? কোথায়ই বা যাচ্ছিলাম? এসবের বাস্তবসম্মত কোন উত্তরই হয়তো নেই; অথচ আমি বলছি, আমরা সবাই বলছি।
তবে একটি কথা হয়ত তখন মনের ভিতর আকুলি-বিকুলি করে বেড়াচ্ছিল; সেটা পিছুটান। সামনের চলার পথ নেই; আছে শুধু পালাবার রাস্তা। কিন্তু পেছনের ফেলে আসা সড়কগুলো কী উজ্জ্বল! আর সে উজ্জ্বল সড়কে আছে ভোর রাতে কুড়িয়ে পাওয়া ‘মুষ্ঠভিক্ষা‘। আছে প্রতীকি ‘জোছনা বোষ্টুমি‘দের প্রতি পিছুটান।
মানুষ কেন বাঁচে? কীসের আকর্ষণে বাঁচে? ‘পজিটিভ’ মানুষেরা বলেন ভবিষ্যতের আশায়। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে, মানুষের সে বেঁচে থাকার ইচ্ছার ভিতরে লুকিয়ে থাকে অতীতের প্রতি পিছুটান। অতীতকে বয়ে নিয়ে যাওয়া।
একেবারেই অতীতমন্থনহীন মানুষতো স্মৃতিভ্রষ্ট রোগব্যাধি জর্জরিত মানুষ; শূন্যসার এক শিশু। দীর্ঘ যাপিতজীবন শেষে কে-ই আর শিশুজীবনে যেতে যায় এবং কারো অভিপ্রেতও নয় হয়ত? তাই বলছিলাম আমাদের সবার মন মজে থাকে পিছুটানে।
এ প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের জীবনের পথ চলার শেষ সময়ের কথা মনে পড়ে। ১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট ছিল বাইশে শ্রাবণ; কবির প্রয়াণের দিন। ঠিক তার কয়েকসপ্তাহ আগে ১৭ জুলাই কবি লিখেছেন,
“এসেছিলে তুমি আস নাই, জানায়ে গেলে
সমুখের পথে পলাতকা তব ছায়াটি ফেলে”।6
কে সে পলাতকা, জীবনসায়াহ্নে কবির কাছে না এসেও মনে জানান দিয়ে গেলেন যে তিনি এসেছিলেন? রবীন্দ্রনাথকে খুব অসুস্থ অবস্থায় কালিম্পং থেকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই প্রায় স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে, কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করা হবে। কবিও সেটা জানতেন। এটাও জানতেন যে, তিনি বোধহয় কোনদিন আর শান্তিনিকেতনে ফিরবেন না। এটাই তাঁর শেষযাত্রা। শেষযাত্রার বিহাগ কবির মনে, তিনি লিখছেন,
“তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল
শ্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল”।
এতো প্রকৃতির প্রতি বিরহ। কিন্তু তার পরের লাইনে পড়েই চোখ ছলছল করে ওঠে ফেলে আসা প্রিয়জনের দূর্মর মায়ায়-
“তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে সিক্ত সমীরে
পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়ায় যায় খেলে
এসেছিলে তুমি আস নাই, জানায়ে গেলে
সমুখের পথে পলাতকা তব ছায়াটি ফেলে”।
পলাতকার ছায়াটি জীবনের শেষ দিনেও রবীন্দ্রনাথ ভুলতে পারেননি; আমরা কোন্ নগণ্য।
পাঁচ)
কয়েকদিন আগে এক সকালে রোজকার মতই আগুন-হলদে পথ পাড়ি দিয়ে অফিসে যাচ্ছিলাম। সে রাস্তাটুকু নাতিদীর্ঘ না হলেও দীর্ঘ তো বটেই। খাড়া পাহাড়ের খাদ বেয়ে দুই পাশের ঘন গাছের সারির মাঝখান দিয়ে তা নেমে গেছে দেড় দুই কিলোমিটার। হঠাৎ ডানে তাকিয়ে দেখি কোথাও এক চিলতে পাথর কিংবা মাটি নেই; শুধু হলুদ আর হলুদ। সামনে তাকাতেই গাছ থেকে গাছে অদ্ভুত আলোর এক ভয়ঙ্কররূপে চোখ আটকে গেলো। একটু বামে তাকাতেই দেখি নিচে পাহাড়ের একবারে খাড়ায় যে গাছটা ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখা সুন্দর টবের মতো রঙিন পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার ওপর সকালের নরম রোদ পড়ে যেনো এক অলৌকিক আলো ছড়াচ্ছে। আরও দূরে লেকের ওইপাড়ের পাহাড়ে যেনো আলো আর রঙের পরীরা খেলছে।
এই সময়ে অনেক কিছুই মনে হতে পারতো; প্রিয় কোন কবিতার লাইন, অনেক পেছনে ফেলে আসা বিমূর্ত কোনো ল্যান্ডস্কেপ, কিংবা অতি প্রিয় কারও কণ্ঠে রবিঠাকুরের গান কিংবা আরও অনেক কিছুই। কিন্তু আমার সেসব কিছুই মনে আসে নি, আর কেনো জানি না, আমার তখনি এটাও মনে হলো এই তো সময় – এখনি – এই মূহুর্তের জন্যই আমি অপেক্ষায় ছিলাম।
মনে হলো তবে কী আমি প্রতিক্ষায় ছিলাম এই মূহুর্তগুলোর জন্য অনেকদিন থেকেই? দূর থেকে দূরে যেতে যেতে কিংবা দূর থেকে কাছে আসতে আসতে কিন্তু আমার অপেক্ষার দীর্ঘপালে হেমন্তের কোন্ এক আলোর বাতাস লাগলো আজ-
“আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবনভরা
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা”॥7
এ যেন রবিঠাকুরের অচলায়তনের আলো। দাদা ঠাকুরের দল অচলায়তনের দ্বার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেছে। মহাপঞ্চক কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না; বিশ্বাস হচ্ছে না অচলায়তনিকদেরও। এসময় নৃত্যরত বালকদল প্রবেশ করতেই চারদিক থেকে পাখির কলকাকলি; আকাশটা যেন নেমে এসেছে ঘরের ভেতর। সবখানেই আজ আলো। আলোর নাচ, আলোর বাজনা, আলোর হাসি, আলোর স্রোত, আলোর ঢেউ, আলোর পুলক, আলোর সুর। বালকদলের গানটিতে মোট শব্দ সংখ্যা মাত্র ৪৪টি অথচ আলো শব্দটিই এসেছে মোট ১৩ বার।
প্রতিটি মানুষের জীবনেও কখনো একা আবার কখনো সমষ্টিতে এরকম আলোর বন্যা আসে; তখন বিশ্বভরা থাকে আলোয়। ওদিন পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে যেতে যেতে ‘রবীন্দ্রনাথে’ আর ‘আলোতে’ আলোকময় হয়ে আলোর জলে স্নান করে করে স্নিগ্ধ হলাম যেন আমি।
টীকা:
1)
https://www.youtube.com/watch?v=dZEkJr1bK1I
2)
3)
4)
https://www.youtube.com/watch?v=xsltw2_udOI
5.
6.
https://www.youtube.com/watch?v=3vSPD6rPnjY
7.
https://www.youtube.com/watch?v=PwtORwAttGk
https://www.youtube.com/watch?v=-Clcn6VctXs
[ চলবে ]