০
৫৯০ বার পঠিত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জার্মান সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জাগার কারণ হলো তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যবসায়িক কারণে প্রিন্স দ্বারকানাথ ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে সফর করেন ও বেশ লম্বা সময় জার্মানিতে কাটান ও জার্মান লেখকদের বই পুস্তক (মূল জার্মান ভাষায়) ঠাকুর পরিবারের লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় রাখেন।
কথিত আছে রবীন্দ্রনাথ যখন ১৭ বছর বয়স তখন তিনি জার্মান ভাষা শেখা শুরু করেন, এবং ১৮৭৮ সনে ভারতী পত্রিকায় তিনি গোয়েথের ‘ফাউস্ট’ এর লিটারেচার ক্রিটিক লেখেন যা তিনি ফাউস্ট এর জার্মান ভার্সন পড়েই আর্টিকেলটি লেখেন। এখনো রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সেই ফাউস্ট বইটি সংরক্ষিত আছে যেখানে তিনি নিজ হাতে বিশেষ বিশেষ লাইনগুলি মার্ক করেছিলেন। পরবর্তীতে জার্মান রোমান্টিক কবি হাইনরিশ হাইনের কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়ে।
যেমন হাইনের ‘মিট ডাইনেন ব্লাউয়েন আউগেন’ নামের একটি প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন ঠিক এভাবে:-
“নীল ভায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল
রাঙা গোলাপ গাল দুখানি, সুধায় মাখা সুকোমল
শুভ্র বিমল করকমল ফুটে আছে চিরদিন!
হৃদয়টুকু শুষ্ক শুধু পাষাণসম সুকঠিন!”
বাংলার কবি ও কবিতা প্রেমিকদের কাছে জার্মান সাহিত্য ও কবিতা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ জার্মান দর্শন, সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। জার্মান সাহিত্য ও কবিতা যেমন গ্যাটে, শীলার, ক্লাইস্ট, আইসেনডর্ফ ছাড়াও রোমান্টিক কবি হাইনরিশ হাইনে’র কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ।
বাংলার রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম ইংরেজি থেকে বাংলায় হাইনের কবিতা অনুবাদ করেন। ইংরেজি অনুবাদের আঠারো–উনিশ বছরের মধ্যে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজি, ইংরেজি থেকে বাংলায় হাইনের কবিতার আবেদন পৌঁছে যাওয়া সত্যিই চমকপ্রদ। অনেক পরে ১৯২৪–এ চিন ভ্রমণের সময় এক নৈশভোজের বক্তৃতায় এ–বিষয়ের উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–
“I also wanted to know German Literature and by reading Heine in translation, ‘I thought I had caught a glimpse of the beauty there.”
তিনি উল্লেখ না করলেও ধরা যায় সে–বইটি ছিল বাউরিংকৃত হাইনের কবিতার অনুবাদ।
রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন তিনি হাইনের কবিতার সৌন্দর্য সামান্যই ধরতে পেরেছিলেন, তা হয়তো নয়। অনুবাদগুলি পড়লে তাঁর অন্তরে যে হাইনের ডাক পৌঁছেছিল তা বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়। তিনি হাইনের Book of Songs ও Pictures of Travel কাব্য থেকে মোট নয়টি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। Book of Songs থেকে পাঁচটি, Pictures of Travel থেকে চারটি কবিতার বাংলা অনুবাদ ১৮৮৫ সালের এপ্রিল সংখ্যা সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, হাইনে তাঁর Youthful Sorrows-এর কবিতাগুলি Book of Songs-এ অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৮১৭ থেকে ১৮২১–এ লেখা বেশিরভাগ কবিতারই কোনো শিরোনাম ছিল না। সংখ্যা ছিল এগুলির পরিচয়ের সূচক। অনেকগুলি ছিল মাত্র চার লাইনে লেখা। ওইরকম একটি কবিতা Book of Songs-এর Youthful Sorrows অংশ থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন। যেমন–
First methought in my affliction, I can never stand the blow – Yet I did – strange contradiction! How I did, ne’er seek to know.
রবীন্দ্রনাথ কবিতার প্রথম লাইনটি শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেন। ‘প্রথমে আশাহত হয়েছিনু’ এ-শিরোনামে তাঁর অনুবাদ:
প্রথমে আশাহত হয়েছিনু
ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা
তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু
কী করে যে সে কথা শুধায়ো না।
এছাড়া Book of Songs-এর চারসংখ্যক কবিতা ‘আঁখিপানে সবে আঁখি তুলি’, চব্বিশসংখ্যক কবিতা ‘স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নি জ্বালায়’, বত্রিশসংখ্যক কবিতা ‘নীল বায়লেট নয়ন। দু’টি করিতেছে ঢল ঢল’ নামেও কবি অনুবাদ করেন।
হাইনের হৃদয়ের অন্তহীন দুঃখের কঠিন দহনই যেমন এ কবিতাগুলি, তেমনি কাব্যটিরও মূলভাব। রবীন্দ্রনাথ হাইনের শিরোনামসহ কোনো কবিতা অনুবাদ করেন নি। আবার দীর্ঘ কবিতাও বাদ দিয়েছেন। কিন্তু হাইনের কবিপ্রতিভার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের কাছে এমনভাবে ধরা পড়েছিল যে, মাত্র কয়েক লাইনের কবিতায় তিনি কবির বেদনাবিধুর হৃদয়টি সকলের কাছে সহজে তুলে ধরতে পেরেছেন। তিনি বোঝাতে পেরেছেন, Book of Songs-এর ‘গভীর রাগিণী’ উঠে বাজি বেদনাতে’। Pictures of Travel কাব্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সাতচল্লিশসংখ্যক কবিতা ‘বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!’, ঊনপঞ্চাশসংখ্যক কবিতা ‘তুমি একটি ফুলের মতো মণি’, পঞ্চাশসংখ্যক কবিতা ‘রাণী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি’, দুশো উনিশসংখ্যক কবিতা ‘বারেক ভালোবেসে যে জন।
তথ্যসহায়তা: কালি ও কলম এবং আজকের জার্মানি
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন