০
৯৮৫ বার পঠিত
যারা সত্যিকার অর্থেই লেখক, তারা চরম দুঃখের সময়ও স্যাটায়ার করতে পারেন। অনেকে বলতে পারেন স্যাটায়ারতো রম্য। না, স্যাটায়র রম্য নয়, চরম কষ্টের আনন্দময় অভিব্যক্তি হলো স্যাটায়ার। আনন্দময় কথাটির উপর আপনাদের চিন্তা আটকে যাবার কথা। কষ্টের আনন্দময় অভিব্যক্তি হয় কী করে। বলি, কষ্টেওতো মানুষ হাসে, নাকি। স্যাটায়ার তেমনি কষ্টের হাসি।
কলেজে ভর্তি হয়েছি কেবল। সমাজ বদলের চিন্তা মাথায়। সারাক্ষণ একটা রাগী ইমেজ জেঁকে থাকে চেহারায়। সমাজ বদলের ভাবনায় একজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে দিন পার। সে সময় মোবাইল ফোন ছিলো না। কার্ডফোনের বিষয়টি কেবল চালু হয়েছে। ঢাকায় দু’তিনটি জায়গায় হাসিমুখে মন্ত্রী সাহেবরা ফোন-বাক্সের ফিতা কেটেছেন। অমন সময়ে বাসায় খবর পাঠানোটা ছিলো বড় ঝক্কির ব্যাপার। আর পাঠাবার কথাও মনে ছিলো না। সুতরাং বিকালে বাসায় ফিরতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বাবা সাধারণত চুপচাপ থাকেন, সেদিন সম্ভবত স্ট্রেসটা নিতে পারেননি। একমাত্র ছেলে বলে কথা। তিনিও ঝাড়লেন।
অভিমানে বেড়িয়ে পড়লাম। সারাদিন খাওয়া পড়েনি পেটে। যার উপকারে গিয়েছিলাম, কাজ শেষ হতেই সে শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে কেটে পড়েছে। স্বয়ং মার্ক্সের চ্যালা, মনে ছিলো দেশ উদ্ধারের জোশ, খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি। যার কাজ ছিলো সে কেটে পড়ার পর খালি পেট জানান দেয়া শুরু করেছিলো। বাসায় গিয়ে ভরপেট খাবো ভাবনাটা ছিলো এমন। পেট ভরেই খেয়েছি দুজনের ঝাড়ি। অতঃপর গৃহত্যাগ।
এমন গৃহত্যাগ যে পুরোটাই লোকসানের তা বুঝে ছিলাম পরে। কিভাবে বলি, গেলাম এক বন্ধুর বাসায়। ধারণা ছিলো অন্তত চা নাস্তাতো পাওয়া যাবে। সারাদিনে অন্যের কাজে মানিব্যাগে যা ছিলো তাও হাওয়া। তাই বাধ্য হয়েই এই রাস্তা। কপাল মন্দ। বন্ধুর খরুস মা আমাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন। বন্ধুকে বললেন, ‘ওই তরে না কইছি রাজনীতি করা পোলাপানগো লগে মিশবি না।’ বন্ধুর তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমার হাসি পেয়ে গেলো। দুঃখেও হাসি পায়। বুঝলেনতো।
উপায় ছিলো না। নিজেকেই রান্না করতে হয়েছে। ডাল আর চালের অদ্ভুত টাইপ খিচুড়ি সাথে আলু ভাজি, বেগুন ভর্তা। নিজের প্রথম রান্না, মনটা মোটামুটি ফুরফুরে, খেতে বসার আয়োজন করছি। উত্তেজনায় খেয়াল করিনি, পানি নিতে গিয়ে হাত লেগে পুরো প্লেটটাই মাটিতে। সারাদিন অভুক্ত, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা ভাতের দিকে চেয়ে দুঃখ হবার কথা, হেসে ফেললাম। কতই না অর্থহীন আয়োজন। মাটিতে পড়ে থাকা খিচুড়ি আর আলু, বেগুন যেন তাই বলে যাচ্ছিল।
রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানহোলে পড়ে গেলেন কেউ। কাদামাটিতে মুখ মাখামাখি। আশেপাশের মানুষ সবাই হেসে উঠলেন। যেন ম্যানহোলে পড়ে যাওয়াটা কত আনন্দময় ঘটনা। আসলেই কি আনন্দময়? না। তবুও মানুষ হাসে, আনন্দিত হয়। সামাজিকমাধ্যমে দেখলাম, এক নেতা ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করতে গিয়েছেন। গোলপোস্টের সামনে বল রাখা, নেতাজি শুধু লাথি দিয়ে বল পোস্টে ঢুকাবেন। বিধি বাম, লাথি দিতেই নেতা বেচারা চিৎপটাং। যারা দেখেন তারাই হাসেন। মনে হয় এরচেয়ে আনন্দের কিছু নেই। হায় আনন্দ। আনন্দতো রম্যই, নাকি?
তরুণ বয়সেই কবিতা লেখা শুরু। স্থানীয় ম্যাগাজিন, কাগজে লেখা ছাপা হয়। প্রেম ও দ্রোহের কবিতা। দ্রোহেতে প্রেমের মিশেল, প্রেমেতে মার্ক্স। মেয়েরা কখনো-সখনো তাকিয়ে দেখে। নিজেকে চে গুভারা মনে হয়। একদিন একজন বললো, তোমাকে ভালো লাগে। কমন কথা, ভালোলাগার পর ভালোবাসা। অথচ হয়নি। কারণ মাথায় তখন সমাজ বদলের চিন্তা, প্রলেতারিয়েতের মুক্তির জোশ। বিপ্লবীরা প্রেম করে না। সেই তরুণীর চোখে জল, নিজের মুখে বিজয়ের আনন্দিত হাসি। এখন বুঝি সেই হাসি আনন্দের ছিলো না, ছিলো বোকামীর। এখন লিখতে গিয়ে হচ্ছে রম্য। পড়ে নিশ্চিত কেউ না কেউ হেসে উঠবে।
উল্টো দৃশ্যও আছে। এক বন্ধুর প্রেম সফল করতে তার প্রেমিকাকে অনেক কষ্টে বাড়ি থেকে বের করা হলো। নেয়া হলো কাজি অফিসও। কবুল বলতে গিয়েই বাধলো বিপত্তি। ওই প্রেমিকা কাঁদতে কাঁদতে চোখ উল্টে মুর্ছা গেলো। কাজির সহকারিগণ সাধারণত একটু রসিক টাইপ হয়, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তাহারা যথারীতি ফিক করে হেসে উঠলেন। এটাওতো রম্য নাকি। সেই রম্যের ঠেলায় বন্ধুকে তার শ্রদ্ধেয় পিতার জুতার আদর সইতে হয়েছিলো। আর আমি, প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের বাসাতেই আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছিলাম।
এসবই রম্য। আমাদের জীবনটাই মূলত রম্যের সমষ্টি। রাজনীতির রম্যের কথা বলি। এরশাদের সময়, আন্দোলন চলছে। সাথে এরশাদ সাহেবও সারাদেশে সভা করে বেড়াচ্ছেন। ময়মনসিংহ শহরে এরশাদ সাহেবের জনসভা। আশেপাশের সব জেলা থেকে তার দলের লোকজন এসেছেন। আমাদের এখান থেকেও গেছে। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ছেলেরা সভায় বাধ সাধলো। তাদের বাধার মুখে এরশাদ সাহেবের সভায় আসা লোকজন যে যেদিকে পারলেন ভেগে গেলেন। ব্যানার ফেস্টুন সব ছিড়ে-ছুড়ে একাকার। পরদিন এক নেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, শুনলাম আপনাদের ব্যানার নাকি ছিড়ে ফেলেছে পোলাপান। উনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘শুধু কি আমাদেরটাই ছিড়েছে, সবারটাই ছিড়েছে। সবাই খেয়েছে।’ কী খেয়েছে তা আর বল্লাম না। এটাওতো রম্য, কি বলেন? আগেই বলেছি, জীবনটাই মূলত রম্যের সমষ্টি।
ভালোমত তাকান, দেখুন চেয়ে, রম্য ছড়ানো ছিটানো চারিদিকে। মানুষ না খেয়ে আছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে নিয়ে বেড়িয়েছেন নগর পরিভ্রমনে। ক্ষুধার্ত মানুষের আকুতি দেখে রাজা গোপালকে বললেন, তাদের এত আকুতি কেনো? ওদের ভাত জোটে না হুজুর, তাই ওরা ভাতের জন্য আকুল। রাজা আশ্চর্য, ভাত নেই তো কি হয়েছে! আমিও তো মাঝে-মধ্যে ভাত না খেয়ে বিরিয়ানি খাই, ওরাও তাই খাক। ক্ষুধার্ত প্রজার দুর্দশার ধারণা না থাকা রাজার খাদ্য বিলাসও তো রম্য, নয় কি?
মানুষের পকেট খালি অথচ জিডিপির অংক বাড়ছে এটাওতো রম্য। আমার পকেটে দশ টাকা আপনার পকেটে দশ হাজার। মোট দশ হাজার দশ। গড়ে দুজনের পাঁচ হাজার পাঁচ করে। এটাইতো হিসাব। গড়ের অংক। অংকের ফল মিললেও পকেট কিন্তু গড়ের মাঠ। এমন হিসাব কি রম্য নয়? আপনার ব্যাংক একাউন্টে যখন পনেরো হাজার টাকা নেই, সুইস ব্যাংকে অন্যের পনেরো হাজার কোটি, তখনও তা রম্য। এমন হাজার কোটি টাকার রম্য আমরা পনেরো টাকার চা-সিঙাড়া খেতে খেতে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাহেবের ‘ছা-ছপ-ছমুচা’তেও হাসি পায়। আবার তিনি যখন ধর্ষণকে অভিজ্ঞতা হিসাবে বর্ণনা করেন তখনও মুখ কুচকে উঠে। ঘৃণা, ক্রোধ আর ব্যঙ্গ যুগপত খেলা করে চোখ, মুখ আর ঠোঁটে। শেষে-মেশে নির্বোধ জ্ঞানে হেসে উঠে। এই হেসে উঠাটাও ব্যঙ্গ নয় কি? মোদিজি চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার অনুসরণে যখন কোনো কোটিপতি চাওয়ালা সাজতে চায়, তখন কি হাসি আসে না, আসে তো। সেটাও তো রম্যের হাসি, কী বলেন?
হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ। রম্য। আসলে রম্য কি? না, রাজনীতির অন্ধকার দিক কখনো আনন্দময় হতে পারে না। রম্যও প্রকৃত অর্থে আনন্দের নয়। রম্যকে তারাই আনন্দ বলেন যারা ভাঁড়ামি আর স্যাটায়ারের পার্থক্য বুঝতে অপারগ। সাথে ভালো আর মন্দেরও।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন