০
৫৯৪ বার পঠিত
গুনীজনদের কারো কারো ধারণা, গণতন্ত্র গড়ে উঠার পূর্বশর্ত অর্থনৈতিক কাঠামো। অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে গণতন্ত্রের ধরণ। এমন ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে রাষ্ট্রের সংজ্ঞাটাই বদলে যায়। একটা মানবগোষ্ঠীর নিজস্ব ভূমি, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা এসবের উপর নির্ভর করেই রাষ্ট্র বিষয়ক চিন্তার জন্ম। মানুষের একটি স্বাধীন ভূমি, নিজেদের স্বকীয় আচার-আচরণের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচার ব্যবস্থা এমনসব উপাদানগুলোকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে যে চিন্তা, সেই চিন্তাই জন্ম দেয় একটি রাষ্ট্রের।
অর্থাৎ মানুষেরা যখন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়, তখনই রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়ার বিষয়টি তাদের মাথায় থাকে। মাথায় থাকা এমন বিষয় থেকেই কালের বিবর্তনে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতকে প্রাধান্য দেয়ার ধারণাটি টিকে গেছে। আর এই ধারণাটিই গণতন্ত্র। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র চালানোর দায়িত্ব আসা মানুষেরা ঠিক করে রাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতি। এরমধ্যে অন্যতমটি হচ্ছে অর্থনৈতিক কাঠামো। সুতরাং গণতন্ত্র ঠিক করে অর্থনৈতিক পরিচালন পদ্ধতি। এর উল্টোটা হবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতন। ফলে গাড়িও চলবে না, ঘোড়াও আগাবে না।
কেউ যদি বলেন, অর্থনীতি ভালো থাকলে, রাজনীতির প্রয়োজন নেই। এটা স্রেফ একটা প্রলাপ। রাজনীতি হলো রাষ্ট্রের সেই পরিচালন পদ্ধতি, যা সার্বিকভাব মানুষের জীবনযাপন প্রণালীকে নির্বিঘ্ন করে। রাজনীতির একটি অংশ মাত্র অর্থনীতি। তা না হলে চীনের অর্থনীতি শক্তিশালী, অথচ আমরা আফসোস করি সেখানের বাকস্বাধীনতা নিয়ে। আমরা চিন্তিত হই উইঘুর মুসলিমদের ধর্ম পালনে বাধা-নিষেধ নিয়ে। সুতরাং শুধুমাত্র অর্থনীতিই মানুষের মানুষ হিসাবে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়, কখনো ছিলো না। যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা ভাবে এসব কথা প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তারা হয় রয়েছেন ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’র বিভ্রান্তিতে, নয় বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে।
ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। কিন্তু সেখানের অর্থনীতি কি বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী? না। ফিনল্যান্ডের সুখী হবার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণের সম্মিলন। তারমধ্যে প্রধানতমটি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। যা দেশ পরিচালনের অধিকার দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠদের। সেই পরিচালকরা গণতান্ত্রিকভাবেই দেশ পরিচালনায় নির্ধারণ করেছেন অর্থনীতির নীতি। এটাই মূল কথা, এর বাইরে শুধু অর্থনীতিকে নীতি নির্ধারণের জায়গা দিলে স্রেফ দুই হাজারের পর্দা বিকাবে সাইত্রিশ লাখে, এক পাতা টিন হয়ে উঠবে রূপার চেয়েও দামী।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির যে দেশ, সে দেশের অর্থনীতির বিকাশও ঘটেছে রাজনৈতিক পন্থায়। রাজনীতির সে সব পন্থার মধ্যে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সুবিধাজনক ধরে নেয়া হচ্ছে গনতন্ত্রকে। সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কাছে হার মেনেছে। গণতান্ত্রিক অর্থনীতিকে পুঁজিবাদ বলে গালি দেয়া হলেও, বিকল্পে এর থেকে ভালো কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। গণতন্ত্র নির্ধারিত পুঁজিবাদই এখনো অর্থনৈতিক পন্থা হিসাবে আপাত শ্রেষ্ঠ।
কোনো কোনো গুনীজন অর্থনীতির বিভ্রান্ত ধারণা থেকে রাজনীতিকে পণ্য হিসাবে দেখেন। কী অদ্ভুত চিন্তা, ভয়ংকর ভাবনা। এক্ষেত্রে পণ্যের পরিষ্কার ধারণা গড়ে উঠা জরুরি। বাকস্বাধীনতা কোনো পণ্য নয়। বাকস্বাধীনতা হলো চিন্তার প্রতিফলন। আর চিন্তাই নির্ধারিত করে নীতি। যে নীতি চালায় সমাজ, অর্থনীতি, সর্বোপরি রাজনীতি। এই রাজনীতিকে যদি পণ্য হিসাবে চিন্তা করা হয় এবং বলা হয় এই পণ্য মানুষের সামনে তুলে ধরলে তারা পছন্দ করে নিবে, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ! এমনটা সত্যিই বিস্মিত হবার মত। ভবিষ্যতকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া ঠেকাতে এমন চিন্তা বর্জন করাই উচিত।
সবকিছুকে পণ্য হিসাবে গণ্য করলে মানুষ হিসাবে টিকে থাকার মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়। পণ্যের এমন ধারণায় মানুষ স্রেফ রোবট হয়ে উঠে, ডিভাইস হয়ে উঠে। যেমন আমরা সেলফোন পছন্দ করতে গিয়ে অ্যাপল না স্যামসাং নেব এমনটা ভাবি। অথচ যাই কিনি না কেনো, সেই পণ্য চালায় কিন্তু মানুষই। প্রোগ্রামটা মানুষেরই করা। সেই মানুষের চিন্তাকে ‘পণ্য’ ভাবা নিতান্তই অনিয়ন্ত্রিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন