পৃথিবীর সব জায়গাতেই পারিবারিক পেশা বলে একটা ব্যাপার আছে। বেশীর ভাগ মানুষের পারিবারিক পদবী নামের শেষে জুড়ে দেয়া থাকে। ভালো মিষ্টান্ন বিক্রেতার ছেলে বাবার মৃত্যুর পর মিষ্টান্ন বিক্রি চালিয়ে যায়। ডাক্তারের ছেলে-মেয়ে ডাক্তার কিংবা শিক্ষকের ছেলে-মেয়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেবার একটা চল ছিলো। ভালো রাজনীতিকের ছেলে-মেয়ে ভালো রাজনীতিক হবেন; এমন গ্যারান্টি নেই; ভালো চিত্র নায়কের ছেলে-মেয়ে ভালো নায়ক নায়িকা হবেন; এমন নিশ্চয়তা নেই। তবে পিতার পেশা কিংবা নেশায় সন্তানদের একটি ঝোঁক থাকে।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ভেঙ্গে পারিবারিক পেশার ধারণা প্রায় ক্ষয়িষ্ণু হলেও; একটি পেশায় বংশানুক্রমিকভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করে; তা হচ্ছে সরকারের সহমত ভাই হওয়া। বৃটিশ সরকারের সহমত ভাই কিংবা পাকিস্তান সরকারের সহমত ভাইয়েরা আজ নেই। কিন্তু বেঁচে আছে তাদের বংশগতি।
একটা শহরে দেখবেন একদল লোক আছে, যারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে। বৃটিশ আমল থেকে এরকম একদল লোককে দেখা যায়; সাহেবদের আসর আলো করে বসে আছে। এটিকে রায়-বাহাদুর ঘরানা বলা যায়। পাকিস্তান আমলে খান বাহাদুর ঘরানাটি রায়বাহাদুর ঘরানাকে পিছে ফেলে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা আলো করে বসে থাকতে শুরু করে। ভারতে রায় বাহাদুরেরাই থেকে যায় সরকারি কথাকলির আসরে। এটিই দক্ষিণ এশিয়ার একরকম স্বপ্ন; সরকারি আমন্ত্রণপত্র ফেসবুকে আপলোড করে অনেকেই জানান দেন, সরকারি ভোজসভায় যাইতেছি।
এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই জন্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে; ফেসবুক প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে; সময় অসময়ে শেখ হাসিনা-সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি ঝুলিয়ে বন্দনা করে যারা; যাদের চোট পাট শুনলে মনে হবে; বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেশটাকে স্বাধীন করেছে; দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত যারা পোকিত আওয়ামী লীগ; ধরা পড়লে ঠিকুজি খুঁজে পাওয়া যায়; পোকিত আল-বদর, আল-শামস; কমপক্ষে শান্তি কমিটির দাদার নাতি।
বাংলাদেশে যারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন; তারা গুটিকতক সাহসী মানুষ। আমরা যারা নব্বুই দশকটিকে কাছ থেকে দেখেছি; ঐ সাহসী মানুষেরাই এক অর্থে আমাদের সাংস্কৃতিক আইকন ছিলেন। কারণ ন্যায়বিচার আদায় করা ছাড়া সভ্য সমাজ গড়ে ওঠে না। একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের বিচার না হওয়ায়; যা খুশী তা-ই করে পার পেয়ে যাবার একটা মনোভঙ্গি তৈরি হয়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় পর একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ট্রাইবুনাল গঠন করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেন। এটির নাম যেহেতু আন্তর্জাতিক আদালত; তাই আন্তর্জাতিক বিধি মেনেই বিচারাদি হবার কথা।
এসময় অনলাইনে কিছু ‘দেশের মালিক তৈরি হয়’; এরা গায়ে লালসবুজ পতাকা জড়িয়ে যত্রতত্র সাধারণ মানুষকে জামাত-শিবির-রাজাকার বলে ট্যাগিং করতে শুরু করে। এরা নিজেদের শিবির সম্পৃক্ততা থাকায়; অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স প্রক্রিয়ায় অন্যকে শিবির বলে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী হিন্দু জনগোষ্ঠী সতত নির্যাতিত। ফলে ‘ইসলাম’ ধর্মের ওপর তাদের ক্ষোভ থাকা যৌক্তিক। এরপরেও শান্তি প্রিয় হিন্দুরা ঝিনুক নীরবে সহো মানসিকতায় মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারতে আশু হিন্দুত্ববাদের উত্থান দেখে বাংলাদেশের শিবসেনা ভক্তরা ফেসবুকে ইতিহাস শান দিয়ে ঘৃণা কারখানা চালু করে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে ঘিরে দেশপ্রেমের শো’ডাউনে সামনের সারিতে যাদের দেখা যায় এরা ‘শিবির-শিবসেনা’-কট্টরচিন্তার মিশেল। একটা ছদ্ম প্রগতিশীলতার হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে এরা ‘ফাঁসি ফাঁসি’ বলে গান গাইতে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে মৃত্যুদণ্ডকে যখন নিরুতসাহিত করছে মানবাধিকার গ্রুপগুলো; চোখের বদলে চোখের পরিবর্তে সংশোধনমূলক শাস্তির আবেদন করে আসছে নিয়মিত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জেহাদি জোশে রূপান্তর করে শেখ হাসিনার ক্ষমতা কাঠামোতে জায়গা করে নিতে মরিয়া জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড দালাল গোষ্ঠী শিবির-শিবসেনা নরভোজী মানস সংগুপ্ত রেখে।
বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সরল প্রকৃতির বলে; যে কোন দোলা লাগলেই আবেগি হয়ে পড়ে; এতোকাল মুক্তিযুদ্ধের কথা কেউ বলেনি; তাই ফেসবুকের ইতিহাসান ভাই ও বলদা দাদার ফ্যানক্লাব প্রশস্ত হতে থাকে। পাকিস্তান কায়েমের পর; পাকিস্তানী শাসকের বৈষম্যের ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে যারা বুঝে গিয়েছিলো, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়; তারা কিন্তু আর পাকিস্তানী উপনিবেশের ক্ষমতা-কাঠামোর ভোজসভায় যায়নি। তারা নেমে পড়েছে স্বাধীনতার আন্দোলনে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিজের জমিতে ফসল ফলিয়ে খায়; সতত স্বাধীনচেতা স্বয়ংসম্পূর্ণ জনমানুষ ‘সরকার’-কে একটা ঝামেলাদায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই জানে। ফলে আওয়ামী লীগ, বামদলগুলো কিংবা নির্দলীয় মানুষ; এরা সরকারি ভোজসভা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া লোক। নবান্নে গ্রামে গ্রামে যে ভোজের ঐতিহ্য; তাতে সরকারের বাড়িতে জিয়াফত খাওয়ার লোকের সংখ্যা হাতে গোণা।
বৃটিশ সরকারের সহমত ভাইয়েরা পাকিস্তান সরকারের সহমত ভাই হয়ে তাই সহমত ভাইয়ের কোরাম পূর্ণ করে। ফলে কীকরে ক্ষমতা-কাঠামোতে ঢুকতে হবে; এই পিঁপড়া বিদ্যা বংশানুক্রমিকভাবে কেবল কিছু সুনির্দিষ্ট লোকেরই আছে।
এরা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও ঘুরে ফিরে চরে খায়। বৃষ্টির ধরণ বুঝে মাথার ওপর চান-তারা কিংবা চরকা ও অধুনা ত্রিশূল আঁকা ছাতা বিস্তার করতে পারে এরা সময় বুঝে।
আওয়ামী লীগের মাঝের এই শিবির-শিবসেনা চক্রটি আওয়ামী লীগকে বার বার দুর্নামের সম্মুখীন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন, অন্তরে রক্ষণশীল রিপাবলিকান সমর্থন পুষে, উদার ডেমোক্রাট সেজে অনেকে রিপাবলিকান শিবিরে গিয়ে কষে গালি দিয়ে আসে; তাদের উত্তপ্ত করে। বাংলাদেশের কথায় কথায় জামাত-শিবির বলে; এরা আসলে মৃতপ্রায় জামাত শিবিরকে জাগাতে চায়। আর ভারতের বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের অংশগ্রহণ দেখে বোঝা যায়; এদের সাংস্কৃতিক পর্যায়ের মিলের কারণে একই সামাজিক বলয়ের লোক এরা।
ক্ষমতা-কাঠামোতে এইভাবে জায়গা করে নিয়েছে শিবির ও শিবসেনারাই। যারা ক্ষমতা-কাঠামোতে জায়গা করে নিতে পারেনি; তারা দক্ষিণ এশীয়দের শ্রেষ্ঠতম স্বপ্ন পশ্চিমের কোন দেশের নাগরিক হবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে, “জঙ্গিদের হিটলিস্টে আছি ভাই’ এই গল্প বলে। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ; ফেসবুকে সারাদিন নির্ভুল আওয়ামী লীগের সহমত কাব্য রচনা করছে; আর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন পত্রে লিখেছে, আওয়ামী লীগ সরকার আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারকে বহির্বিশ্বে অক্ষম প্রমাণের এ কাজটি আওয়ামী লীগের কোন সমর্থকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারা এই প্রতারক উপমানব মানসকে আর যাই হোক দেশপ্রেমিক বলা যাবে না।
পাকিস্তানের মতো জঙ্গী অভয়ারণ্য গত দশবছরে প্রায় জঙ্গীমুক্তির পথে; সাধারণ নির্বাচনগুলোতে জামায়াত ও জামায়াতে উলামা ইসলামীকে ভোট না দিয়ে ফতুর করে দিয়েছে সাধারণ ভোটারেরা; আর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বহুব্যবহারে জীর্ণ কাক-তাড়ুয়াটিকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে শিবিরঘন প্রশাসন ও শিবসেনাঘন বুদ্ধিবৃত্তির জগত।
আজকের যে সম্ভাবনাময় যুগ; এসময় তরুণেরা ই-বানিজ্য উদ্যোক্তা হয়ে; ন্যুনতম কৃষিঘন ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে নতুন কর্ম-সংস্থানের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু জেনেটিক্যালি যারা সহমত ভাই; এদের জীবনের একমাত্র সাফল্যের সংজ্ঞা সরকারি পদায়ন। দেশের বাইরে শ্রম ঘন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ফেলে দেশ উদ্ধারে দৌড়ে এসে সরকারি পদ-পদবী বাগানোটাকে “ফইন্নির ঘরের ফইন্নি (ফঘফ)” মানসিকতা; এটা না বললেই নয়।
এরকম ফঘফরা দেশের মানুষের বানভাসি জীবন, করোনাকালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, জীবন-মৃত্যুর শোক ঘেরা পরিবেশে সমস্ত ট্র্যাজেডিকে উপেক্ষা করে সহমত-চর্বির আয়েশে ‘ইতিহাসের মুজরা’ চর্চা করে। আর করোনাকালে আক্ষরিক মুজরার ‘পাপিয়া আসর’ না থাকায়; এদের শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে। তাই আতকা লম্ফ দিয়ে ওঠে, আন্নেরা তাজুদ্দিনরে পোশংসা কইরা বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিরে ডাইলুট করতেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের ৫০ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠিত মানুষদের নিয়ে কলতলার সেমিনার বসানোর বাস্তবিক কোন প্রয়োজন নেই। এরজন্য যোগ্য মানুষের ফোরাম আছে; যারা ব্যক্তিক লাভালাভের বাইরে নিঃস্পৃহভাবে ইতিহাস চর্চা করে। বাংলাদেশের রাজনীতির সোনালি যুগের রাজনীতিকেরা আছেন আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে। তাদের সুকৃতি নিয়ে কলতলার বিচারকের গোল্ডেন জিপিএ পাবার অপেক্ষায় কেউ বসে নেই।
এসব একজনকে খাটো করে আরেকজনকে বড় করার আলাপ অন্ধকার যুগের ব্যাপার। ক্ষমতা-কাঠামোতে প্রতিদিন নিজের আনুগত্য নিশ্চিত করতে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড সহমত ভাইয়েরা প্রতিদিনই ইতিহাসের মজা পুকুরে ঢিল মারতে চেষ্টা করে। এর মধ্যে দুটো উদ্দেশ্য থাকে। নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তা থেকে এরা ধরে নেয়, অমুকরে নিয়া দুইডা বাজে কথা বললে তমুক লিডার খুশি হপেন। আর হাডুডু প্রিয় জনতাকে যেই কোন একটা কাইজ্জায় ব্যস্ত করে দিলে, সেকেন্ড হোমে টেকাটুকা পাচারের কাজটা নীরবে নিভৃতে চালিয়ে যাওয়া যায়।
শিবসেনারা আবার ওঁত পেতে থেকে; ইতিহাসের যে ন্যারেটিভ দিয়ে মোদির হিন্দুত্ববাদী মৃগয়ার জ্বালানী জোগানো যাবে; ঐটা নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি তাদের।
এ কারণে জন-অধিকারের অগ্রাধিকার যে বিষয়গুলো তা নিয়েই আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা হওয়া দরকার। এতে সমাজ-রাজনীতির প্রগতি নিশ্চিত হয়। অতীতের লেবু চিপে তেতো করে পেট চালানোর কাজে নিয়োজিত ফড়িয়াদের কাবাডির কোটে ভুল করে পা ফেলাটা তাই সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়।