ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছেন যে, তার সরকার অযোধ্যায় সরযূ নদীর তীরে ১০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি রামমূর্তি স্থাপন করবেন। ১০০ মিটার মানে প্রায় ৩৩০ ফুট (৩২৮.০৮৩৯৯ ফুট)। কল্পনা করলেই অনুমান করা যায় কী বিশাল উচ্চতা এবং আয়তন নিয়ে এই মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকবে। একটা দালানের ঘরের উচ্চতা যদি ১০ ফুট ধরা যায় তবে এটি অন্তত ৩৩ তলার একটা দালানের সমান উঁচু হবে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৩০ কোটি রুপী। বুঝা যায়, অভ্রংভেদী এই রামমূর্তি নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় জনমানসে রামের যে ভাবমূর্তি আছে তাকে আরও মহিমান্বিত এবং মূর্তরূপে দৃশ্যমান করা।
যোগী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি-এর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সেই দলের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ভারতের প্রধান মন্ত্রী মোদীরও এতে সায় আছে। অর্থাৎ এটা আমরা ধরে নিতে পারি মোদী এবং বিজেপি-এর সম্মতি নিয়েই যোগী রামমূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। কাজেই এটাও ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, প্রাক-নির্বাচনকালীন মোদীর প্রতিশ্রুত ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ বা আলোকোজ্জ্বল ভারত প্রতিষ্টার লক্ষ্যের সঙ্গে রামমূর্তি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা সম্পর্কিত। এখন একটু বিচার করে দেখা যাক রামমুর্তি প্রতিষ্ঠা ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ বা আলোকোজ্জ্বল ভারত নাকি ‘ডার্কলিং ইন্ডিয়া’ বা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারত কোনটি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
রাম শুধু একটি মহাকাব্যের নায়ক নন। তিনি শুধু একটি পৌরাণিক চরিত্রও নন। রাম প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জনমানসে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত এমন এক মানুষ যিনি শুধু একজন আদর্শ স্বামী নন, অধিকন্তু যিনি একজন আদর্শ রাষ্ট্রশাসকও। রামের শাসনকে আদর্শ শাসনের রূপ হিসাবে ধরে নেওয়ায় আদর্শ রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা সাধারণ হিন্দুদের নিকট রামরাজ্য রূপে অভিহিত। মানুষ হলেও হিন্দু সমাজে যেসব দেব সমতুল্য অথবা দৈব মর্যাদার অধিকারী চরিত্র সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী তাদের মধ্যে রামের অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এখন এই দৈব মর্যাদার অধিকারী মানুষের প্রকৃত ভূমিকা আমরা যদি নি্র্মোহভাবে বিচার করি তবে কোন সত্য বেরিয়ে আসে? লাঙ্গল চাষ প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লবের সূচনায় রামের যে যুগান্তকারী ভূমিকা আমি দেখতে পাই সেটা নিয়ে এখানে আমি কিছু বলব না। কারণ সেটা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন কোনও চরিত্রের নয় বরং সমাজ বিকাশের গতিধারায় খুবই লৌকিক একটা মানুষের যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ভূমিকা সংক্রান্ত আলোচনা। এ নিয়ে ‘বঙ্গরাষ্ট্রে’ শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র ‘রামায়ণ ও কৃষি বিপ্লব’ অধ্যায়ে আলোচনা আছে। আগ্রহী পাঠক সেটা পাঠ করতে পারেন। এখানে বরং আমি দেবতার মহিমা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এক চরিত্রকে বিচার করে দেখতে চাই। আর সেখানে প্রশ্ন আসে, রামকে আদর্শ স্বামী বা আদর্শ শাসক কোনটা বলা যাবে।
রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী পিতৃসত্য রক্ষার জন্য রাম স্বেচ্ছায় চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনবাসে যান। প্রথম প্রশ্ন আসে, কোনও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ কি নিজের স্ত্রীর রক্ষার ব্যবস্থা না করে শুধু এক ভাই লক্ষ্মণের ভরসায় তাকে বনে বা জঙ্গলে চৌদ্দ বৎসরের জন্য নিয়ে যেতে পারে? বনে শুধু হিংস্র পশু নয়, হিংস্র মানুষও তো থাকতে পারে! সীতার বিপদটা সেদিক থেকেই কিন্তু এসেছিল। সীতাকে হরণ করলেন রাবণ।
রাবণ খলনায়ক তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু খলনায়ক আর একজনও কি নন? তিনি হলেন রামের সৎ ছোট ভাই লক্ষ্মণ। অরণ্যে রামকে দেখে রাবণের বোন শূর্পণখা রামের প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু রাম তাকে পাত্তা দেন নাই। কারণ তিনি ছিলেন তার স্ত্রী সীতার প্রতি একনিষ্ঠভাবে অনুরক্ত। শেষে শূর্পণখা ক্ষিপ্ত হয়ে সীতাকে আক্রমণ করেন। বাস এইটুকু। এই অপরাধে লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক এবং কান কেটে দেন। এটা কি লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল না? শুধু তা-ই নয়, এটা কি কোনও প্রকৃত পুরুষের কাজ হল?
এই হল সীতা হরণের পটভূমি নির্মাণ। এরপর নাক-কান হারানো শূর্পণখা লঙ্কায় ফিরে তার বড় ভাই রাবণের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন। নিজের বোনের দুর্দশায় রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে সীতা হরণের সিদ্ধান্ত নেন। এটাও আর এক হাস্যকর এবং কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত। এক নির্দোষ, দুর্বল ও নিরীহ নারীকে শাস্তি দিয়ে এক পাশবিক পুরুষের বীরত্ব প্রদর্শনের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ছাড়া এটা আর কিছু নয়। সুতরাং পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণের কাহিনী যেভাবে রচিত হচ্ছে তার ভিত্তি নির্মাণে দেখা যাচ্ছে বিকৃত মানসিকতার দুই পুরুষের নির্ধারক ভূমিকা — প্রথম জন লক্ষ্মণ, দ্বিতীয় জন রাবণ। কিন্তু বিকৃত মানসিকতার বলব না তবে অবিবেচক বলব রামকে। কারণ নিজে যা খুশী তা করুন, যত খুশী ঝুঁকি নিন, কিন্তু একজন নারীর নিরাপত্তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না করে তিনি তাকে বনবাসে নিয়ে যেতে পারেন না। এটা আর যা-ই হোক রামকে কোনও মহিমা দেয় না। তবু যাইহোক, রাবণের কব্জা থেকে সীতাকে উদ্ধার করে রাম যথার্থ রূপে একজন বীরের কাজ করেছিলেন।
কিন্তু সীতাকে ফিরিয়ে আনবার পর থেকে তিনি যে কাজগুলি করেছিলেন সেগুলির অন্তত কিছু তাকে কোন্ মহিমা দেয় সেই প্রশ্ন আমার আছে। প্রথমত তিনি সীতার অগ্নি পরীক্ষা নিয়েছিলেন সতীত্ব প্রমাণের শর্ত হিসাবে। প্রথম বার তিনি সীতাকে উদ্ধার করার পর তার সতীত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য তার অগ্নি পরীক্ষা নেন। অর্থাৎ পরপুরুষের হাতে বন্দী অবস্থায় ধর্ষিত হলেও তার দায় বর্তাবে নির্দোষ, নিরীহ নারীর উপর! যাইহোক, এই পরীক্ষা লোক সমক্ষে না হওয়ায় প্রজা সাধারণের দিক থেকে এবং রামের নিজেরও দিক থেকে সংশয় ছিল। যদিও যে কোনও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে যে কোনও অগ্নি পরীক্ষায় কোনও মানুষ উত্তীর্ণ হয় কীভাবে? ঠিক আছে মেনে নিলাম সীতা উত্তীর্ণ হলেন। যদিও আমার বক্তব্য হবে দোষী-নির্দোষ যাচাইয়ের জন্য অগ্নি পরীক্ষা যে সঠিক পদ্ধতি সেটা প্রমাণের জন্য সবার আগে রামকে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে হত। সেটা তিনি করেন নাই। তবু ধরে নেওয়া গেল সীতা প্রথম অগ্নি পরীক্ষায় কোনও রকমে উতরে গেলেন। কল্পকাহিনীতে তো কতকিছুই সম্ভব? চাইলে হাতীকেও আকাশে উড়ানো যায়!
যাইহোক, প্রথম বারের অগ্নিপরীক্ষায় রামের মন ভরে নাই। প্রজারাও সেই অগ্নিপরীক্ষার গল্পে সন্তুষ্ট নয়। সুতরাং তিনি সীতাকে বনবাসে পাঠালেন। বনবাসে ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে সীতার আশ্রয় হল। সেখানে সীতার গর্ভ থেকে দুই যমজ পুত্র লব ও কুশের জন্ম হয়। অনেক কাল পর বালক লব-কুশের মুখে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ গাথা শুনবার পর এবং তাদের দেখবার পর রাম সীতাকে সপুত্র ফিরিয়ে নিতে চাইলেন। তবে শর্ত হিসাবে রাম দ্বিতীয়বার সীতার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে চাইলেন প্রকাশ্য রাজসভায় সর্বসাধারণের সম্মুখে। এবার রাজসভায় অগ্নিচিতার সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখে-অপমানে সীতা দ্বিধাবিভক্ত ধরিত্রীর নিকট আত্মবিসর্জন দিলেন।
রামের প্রসঙ্গে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধবাজ শাসকদের একজন চেঙ্গিস খানের কথা মনে এল। সেকালে কয়েক কোটি মানুষ হত্যাকারী বিশ্বত্রাস মোঙ্গল সমর নায়ক ছিলেন চেঙ্গিস খান (১১৬২-১২২৭), যিনি সেকালের শুধু চীনেরই দশ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি মানুষকে হত্যা করেছিলেন। প্রথম জীবনে তার অনেক দুর্গতি গিয়েছিল। একবার শত্রুপক্ষ তাকে আক্রমণ করলে তিনি প্রাণ রক্ষা করতে পলায়ন করেন। সেই সময় তার স্ত্রী বোর্তেকে তার শত্রুরা বন্দী করে নিয়ে যায়। তার স্ত্রীকে পরবর্তী সময়ে তিনি উদ্ধার করতে সমর্থ হন। বোর্তে যখন বন্দী হন তার নয় মাস পর তার প্রথম পুত্র জোচি জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং জোচির পিতৃত্ব নিয়ে সর্বদাই সন্দেহ থেকেছে। কিন্তু চেঙ্গিসের মত একজন নিষ্ঠুর খুনী ব্যক্তিও তার প্রথম স্ত্রী বোর্তেকে যেমন পরিত্যাগ করেন নাই তেমন তার প্রথম পুত্রসন্তান জোচিকেও পিতৃত্বের স্নেহে লালন করতে দ্বিধা করেন নেই। চেঙ্গিসের ছিল বহু সংখ্যক পত্নী-উপপত্নী। প্রকৃত বিচারেই তিনি ছিলেন বিপুল সংখ্যক নারীর ধর্ষক। কিন্তু সেই লোকটিও তার প্রথম স্ত্রীকে যেমন ভালবাসতেন এবং প্রধান স্ত্রী বা প্রধান রাণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন তেমন তার প্রথম সন্তানকেও ভালবাসতেন। এই রকম এক নৃশংস এবং বর্বরও তার স্ত্রীর সতীত্বের পরীক্ষা নিবার মত কোনও কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ ছিলেন না। অন্যদিকে, রাম সীতার গর্ভে জন্ম নেওয়া দুই পুত্র লব এবং কুশকে অনেক দিন পর্যন্ত গ্রহণ করতে চান নাই। বুঝাই যায় কেন। তার সন্দেহ ছিল তাদের পিতৃত্ব সম্পর্কে।
সুতরাং এই রকম একটি ক্ষেত্রে চেঙ্গিসের পাশে যদি রামকে রাখা হয় তবে কাকে উন্নততর কিংবা শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যাবে? আরও কথা আছে। দোষী কি নির্দোষ এটা প্রমাণের জন্য অগ্নিপরীক্ষা কি আদৌ কোনও পদ্ধতি হতে পারে? কাণ্ডজ্ঞান কী বলে?
রামকে আদর্শ রাষ্ট্র শাসক বলা হয়। এখন তার শাসন মানে তার দ্বারা অনুসৃত বা পালিত আইন, প্রথা এবং কাজ। রাম যদি কোনও আদর্শ শাসক হন তবে অগ্নিপরীক্ষার পদ্ধতিও কি গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, অধিকন্তু বাধ্যতামূলক হয় না? সে ক্ষেত্রে ভারতে রামের আদর্শে গঠিত রাষ্ট্র তথা প্রকৃত ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে হলে কি সকল বিচারে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের প্রধান পদ্ধতি হওয়া উচিত নয় অগ্নিপরীক্ষা? সুতরাং প্রতিটি বিচারালয়ের সামনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে অগ্নিচিতার ব্যবস্থা। পুলিশ অপরাধী বা আসামীদের ধরে নিয়ে এসে বিচারকের কাছে হাজির করা মা্ত্র বেশী ঝামেলা না করে বিচারপতি জিজ্ঞাসা করবে সে নির্দোষ নাকি দোষী। কেউ দোষ স্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা অনুযায়ী বিচারক শাস্তি ঘোষণা করবে। সেটা কারাদণ্ড, জরিমানা বা মৃত্যুদণ্ড যা-ই হোক না কেন। আর যেসব অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার করবে না তারা নির্দোষ কিনা সেটা সাব্যস্ত করার জন্য বিচারালয়ের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। যে নির্দোষ রামায়ণের নায়ক রামের বিচারের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী তার কিছুই হবে না! কারণ আগুন তাকে স্পর্শও করতে পারবে না। কত সহজ এবং নির্দোষ একটা বিচার ব্যবস্থা, তাই না? মামলার জট থাকবে না, আইনী লড়াইয়ের জটিলতা থাকবে না, বিচারক বা উকিলের জেরার ঝামেলা থাকবে না, পুলিশেরও তদন্ত ইত্যাদি ঝামেলাও অনেকাংশে থাকবে না!
রামরাজ্য মানে তো এমনই এক আদর্শ রাষ্ট্র যেটা শুধু আদিম নয়, একেবারে অমানবিক। তার প্রজা বা নাগরিকরা যেমন আদিম, অমানবিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পশ্চাৎপদ এবং বিচার-বুদ্ধিহীন তেমন তাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বকারী রাজা বা শাসকও জনতুষ্টিবাদী হতে গিয়ে রামের মতই হবে আদিমতা, অমানবিকতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা এবং বিচার-বুদ্ধিহীনতার তোষণ এবং পোষণ কারী।
রামমূর্তি প্রতিষ্ঠা দ্বারা নূতন করে রামের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে যোগী আদিত্যনাথ তথা হিন্দুত্ববাদীরা কি অন্ধত্ব এবং বিচার-বুদ্ধিহীনতার পূজারী এমন এক রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান? রামের কালপ্রেক্ষিতের ছুতা তুলে অনেকে এমন চাওয়ার সপক্ষে সাফাই গাইতে পারেন। যেমন সেকালে অগ্নিপরীক্ষা সিদ্ধ হলেও একালে সিদ্ধ নয়, ইত্যাদি। কিন্তু এটা শুধু কালপ্রেক্ষিতের ব্যাপার নয়, এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। এটা একটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গী যা স্বাভাবিক ও সুস্থ চিন্তাকেও গলা টিপে মারতে সাহায্য করে। এই দৃষ্টিভঙ্গী ভারতকে কোথায় নিবে? প্রতিযোগিতার এই পৃথিবীতে আধুনিক যুগে কি এই অন্ধত্ব এবং বিচার-বুদ্ধিহীনতা নিয়ে ভারত মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে পারবে? অতীতেও কি পেরেছে? হিন্দু ধর্মের বিকাশ এবং প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ কাল ধরে বিভিন্ন বৈদেশিক হানাদার শক্তির হাতে ভারতবর্ষের বিপর্যয়, লাঞ্ছনা এবং দীর্ঘ পরশাসনের অভিজ্ঞতা থেকে কি আমাদের কিছুই শিখবার নাই? শুধু বহিরাক্রমণকারীদেরকে দোষ দিলে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে? নিজেদের দুর্বলতার কারণ অনুসন্ধান করাও কি অপরিহার্য নয়?
ক্ষমতায় আসবার পূর্বে মোদী ভারতবাসীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ উপহার দিবার। শুধু মধ্যযুগীয় নয়, উপরন্তু আরও পশ্চাৎপদ আদিম এবং প্রায়-বন্য জীবনের আদর্শের নায়কদেরকে দৃষ্টান্ত হিসাবে জনসমাজের সামনে আরও জোরালোভাবে উপস্থিত করে মোদী এবং তার তার সাথীরা কোন্ ভারতের ভিত্তি নির্মাণ করতে চান? এটা কি হবে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ বা আলোকোজ্জ্বল ভারত নাকি ‘ডার্কলিং ইন্ডিয়া’ বা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারত? সংবাদপত্র থেকে ভারতের এবং আরও বিশেষ করে যোগীর রাজ্য উত্তর প্রদেশের যে ভয়াবহ চিত্র আমরা পাই তা থেকে এটা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে অন্ধত্বজীবী এবং অলোকবাদী ধর্ম মানুষের চেতনা এবং তার সমাজ ও রাষ্ট্রকে কোন্ জায়গায় নিতে পারে। ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের চেয়ে খুব ভালো কোনও চিত্র কি ভারত উপস্থিত করতে পারছে? ধর্মকে আশ্রয় করে ভারত আধুনিক কালের ধর্মমুক্ত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার স্বপ্ন দেখে! এটা যে কত হাস্যকর একটা স্বপ্ন সেটা দিন দিন আরও স্পষ্ট হবে। চীনের পাশে ভারতকে দাঁড় করালেও কি সেটা স্পষ্ট হয় না?
আমি জানি এ কথা ভারতের শাসকদের কানে যাবার কারণ নাই। তবে আমি মনে করি একশত মিটার উচ্চতার মূর্তি যদি কারও প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে সেটা রামের নয় বরং সেটা করা উচিত আধুনিক ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ স্বপ্নদ্রষ্টা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনাপতি-নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর। ভারতের রাষ্ট্র-শাসকদের সেই বুকের পাটা এবং দূরদৃষ্টি থাকলে তারা অযোধ্যায় রামমূর্তি নয়, বরং ভারতের রাজধানী দিল্লীতে সুভাষচন্দ্র বসুর অভ্রংভেদী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবে। আর নদীর তীরেই যদি সেই মূর্তি স্থাপন করতে হয় তবে সেটা করা যেতে পারে নয়া দিল্লীর কিছুটা নিকট দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর তীরে। ভারত সফরে এলে সেই মূর্তির সামনে এসে সমগ্র পৃথিবীর রাষ্ট্র-নেতাদের তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতে হবে। একবার কল্পনা করা যাক তো ভারত সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর আকাশ ছোঁয়া মূর্তির পদতলে পুষ্পার্ঘ অর্পণে বাধ্য হচ্ছেন। অবশ্য গান্ধী-নেহরুর ঐতিহ্যে লালিত ভারতের কাছ থেকে তেমন কিছুর প্রত্যাশা করাটাও হাস্যকর।